ইজরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত বর্তমান সময়ের চলমান দীর্ঘতম সংঘাত। কিন্তু কেন কীভাবে এ সংঘাতের সূচনা তা আমরা অনেকেই জানি না। তবে যারা সকল মুসলিম দুর্ভাগ্যের আড়ালে ইহুদী বা খ্রিস্টান চক্রান্ত খুঁজে পেতে চান, হয়ত এ লেখাটা তাদেরকে ঐতিহাসিক অর্থেই ভিন্ন একটা আঙ্গিকে পথ দেখাবে। আর যারা সত্যি সত্যি এ সংঘাতের উৎস জানতে এ লেখাটি পড়ছেন, আশা করি খুব সহজ সরল ভাষায় পুরো সংঘাতের একটি সংক্ষিপ্ত ধারণা পেয়ে যাবেন।
সংঘাতের পুরনো ‘ইতিহাস’ জানতে হলে আমাদের নজর দিতে হবে ধর্মগ্রন্থে। কারণ প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে সমর্থিত হোক বা না হোক, ধর্মীয়ভাবে ইজরায়েল (ইহুদী) আর ফিলিস্তিন (বর্তমানে মুসলিম) জাতি নিজেরা কী বিশ্বাস করে তাদের ধর্মীয় ঐতিহ্য নিয়ে, সেটা তাদের এই পবিত্র ভূমি নিয়ে কাড়াকাড়িতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
খেয়াল করে দেখেছেন কি, আমি ফিলিস্তিনের পাশে লিখেছি, “বর্তমানে” মুসলিম। কেন বর্তমানে কথাটা ব্যবহার করলাম? কারণ যখন ইজরায়েলের ইহুদী জাতি তুঙ্গে ছিল সেই হাজার হাজার বছর আগে, তখন ফিলিস্তিন জাতি ছিল পৌত্তলিক। সুতরাং ইজরায়েলের চোখে তারা ছিল ‘ভিলেইন’।
প্রথমে আমাদের জানা দরকার ইজরায়েলের ধর্মীয় ইতিহাস কী। হিব্রু বাইবেল এবং ইসলামী ধর্মীয় ইতিহাস মোতাবেক, নবী হযরত ইব্রাহিম (আ) ঈশ্বর ইয়াহওয়েহ (হিব্রুতে ঈশ্বরকে এ নামেই ডাকা হয়, আর আরবিতে আল্লাহ্) তাকে প্রতিশ্রুতি দেন যে পবিত্র ভূমি কেনান তার সন্তানাদিকে দেয়া হবে (যেটা এখন ইজরায়েল ফিলিস্তিন অঞ্চল)। অর্থাৎ তার বংশধররা এ এলাকার মালিক হবে।
ইব্রাহিম (আ) এর প্রধান দুই পুত্র ইসমাইল (আ) আর ইসহাক (আ)। ভাগ্যক্রমে, ইসমাইল (আ) আর তার মা হাজেরা-কে আরবের মক্কায় নির্বাসনে পাঠানো হয়। আর ওদিকে কেনান দেশে রয়ে যান ইসহাক (আ) [আইজ্যাক]। তার পুত্র ছিলেন ইয়াকুব (আ) [জ্যাকব]। ইয়াকুব (আ) এর আরেক নাম ছিল ইসরাইল, হিব্রুতে যার আক্ষরিক অর্থ “ঈশ্বরের সাথে জয়ী”। তার বারো সন্তানের নামে ইজরায়েলের বারো গোত্রের নাম হয়।
ঘটনাক্রমে ১২ পুত্রের একজন ইউসুফ (আ) ভাইদের চক্রান্তে মিসরে উপনীত হয় দাস হিসেবে। জেলের ভাত খেয়ে সাত বছর পর ভাগ্যের চাকা ঘুরে নিজেকে মিসরকর্তার ডান হাত হিসেবে আবিষ্কার করেন এবং একই সাথে তিনি হন নবী। দুর্ভিক্ষপীড়িত অন্য ভাইরা তারই কাছে তখন সাহায্য চাইতে মিসরে আসে। কালের পরিক্রমায় শত শত বছর বাদে এই ইজরায়লিরা মিসরের ফারাও এর দাসে পরিণত হয়, যখন এক মিসরীয় যুবরাজ (পালিত পুত্র) নিজেকে রাজপরিবারের সমস্ত আয়েশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে বহু বছর বাদে ইজরায়েলের নির্যাতিতদের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন, তিনি আর কেউ নন, নবী হযরত মুসা (আ)। লোহিত সাগর পাড় করে তিনি ইজরায়েল জাতিকে নিয়ে যান ওপারে ফেরাউনের কবল থেকে মুক্ত করে। [বাংলাতে এখানে একটি ভুল তথ্য অনেকে জেনে থাকে যে, মুসা (আ) নাকি নীলনদ পার করেছিলেন, কিন্তু কুরআন আর বাইবেল এ ব্যাপারে একমত যে, এটা লোহিত সাগর ছিল।]
নবী মুসা (আ) পেলেন আসমানী কিতাব তাওরাত, কিন্তু তখন একেশ্বরবাদী ইহুদীরা পৌত্তলিকতায় মগ্ন হয়ে পড়ায়, ৪০ বছর শাস্তি দেন আল্লাহ্ তাদেরকে। মরুর বুকে ঘুরপাক খেতে থাকে তারা। অবশেষে নবী ইউশা (আ) এর নেতৃত্বে তারা কেনান দেশে উপনীত হয়। এবার তাদের কেনান জয়ের পালা।
এখানে এসেই আমরা বুঝতে পারি, কেনান দেশের আদি নাগরিক কারা ছিল। তারা আর কেউ নয়, এখন আমরা যাদের ফিলিস্তিনি বলি, বলা চলে তারাই। তবে ফিলিস্তিনিরাও এখানে আসে ইজ্রায়েলিরা আসার কিছু আগে, খ্রিস্টপূর্ব ১২ শতকে। ফিলিস্তিনিরা মূলত Aegean অরিজিনের। তারা এসেছিল কাফতর থেকে। তার আগে এখানে ছিল হিভাইট, জেবুসাইট, এমরাইট, হিট্টাইট, পেরিসাইট- এরা। তারা পৌত্তলিক ছিল এবং বা’ল, আশের ইত্যাদি দেবতার পূজা করত।
ইজরায়েলিরা যখন কেনান দেশে থাকত, তখন তারা স্থানীয়দের সাথে বিবাহ করে। ফলে পরবর্তী বংশধর এমনভাবে বাড়তে থাকে যে, ৮৭.৫%-ই হলো কেনানীয় রক্ত। আর ফিলিস্তিনিরা নিজেদের কেনানীদের বংশধর বলেই জানে। তাই জিনগতভাবে তারা আসলে প্রায় একই। কেবল ধর্মবিশ্বাসে ছিল আলাদা। ইজরায়েলিরা যেখানে উপাসনা করত এক ঈশ্বরের, সেখানে ফিলিস্তিনিরা ছিল পৌত্তলিক।
ইজরায়েল রাষ্ট্রের প্রথম রাজা হন তালুত, যাকে বাইবেলে বলে সল (Saul)। বেথেলহেমের জেসির ছোট ছেলে দাউদ [ডেভিড] তালুতের সেনাবাহিনী থেকে ফিলিস্তিনের জালুত/গোলায়াথ-কে পরাজিত করে একক যুদ্ধে এবং তখনই সকলের নজরে আসে। কালক্রমে তিনি ইজরায়েলের জনপ্রিয় রাজা কিং ডেভিড/দাউদ হন [এবং ইসলাম মতে, নবীও]। তার পুত্র সলোমন বা সুলাইমান (আ) তার রাজ্যকে আরো প্রসারিত করেন। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন টেম্পল অফ সলোমন বা বাইতুল মুকাদ্দাস।
সুলাইমান বা সলোমনের মারা যাবার পর পুত্র রেহোবামের রাজত্বকালে ইজরায়েলের পতন শুরু হয়, পৌত্তলিকতায় ডুবে যেতে থাকে। শক্তিমান ব্যাবিলন রাজ্যের আক্রমণে ইজরায়েলিরা বন্দি হয়ে পড়ে। তাদের নির্বাসন শুরু হয়, আর ওদিকে ইজরায়েল রাষ্ট্র ধুলায় মিশে যায়।
কিন্তু আল্লাহর চোখে শাস্তি শেষ হলে, পারস্যের রাজা সাইরাস তাদের ব্যাবিলন থেকে মুক্ত করেন। এ সময় নবী হযরত দানিয়েল (আ) এর কীর্তি উল্লেখযোগ্য। ফিরে এসে তারা পুনরায় বানায় ধ্বংসপ্রাপ্ত বাইতুল মুকাদ্দাস। আর নবী/পাকব্যক্তি হজরত উজাইর (আ) [এজ্রা] আর নেহেমিয়া (আ) এর নেতৃত্বে ইজরায়েল আবার ভালোর দিকে ফিরতে থাকে। তাছাড়া সাহায্য করেন হজরত হিজকিল (আ) [এজেকিয়েল]।
সুলাইমানপুত্র রেহোবামের সময় রাজ্য দুভাগ হবার কথা বলছিলাম। উত্তরের রাষ্ট্র ইজরায়েল, আর দক্ষিণের রাষ্ট্র জুদাহ। এটা মোটামুটি খ্রিস্টপূর্ব ৯ম-১০ম শতকের কথা। আর মাঝখানে এত কাহিনী গিয়ে রাজা সাইরাসের হাতে উদ্ধার পাবার সময়কাল ছিল খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৯ সাল।
যখন খ্রিস্টপূর্ব ৩২২ সালে অ্যালেক্সান্ডার দ্য গ্রেট মারা গেলেন, তখন তার জেনারেলরা কামড়াকামড়ি শুরু করে দেন রীতিমত। যেমন টলেমি নিয়ে নিলেন পুরো ইহুদী অঞ্চলের দখল। যদিও পরে সিরিয়ার সেলুচিদদের হাতে খ্রিস্টপূর্ব ১৯৮ সালে হারিয়ে ফেলেন এ অঞ্চল। ওদিকে গ্রিক সভ্যতার সংস্পর্শে এসে ইহুদী ধর্ম প্রভাবিত হয়ে নতুন এক সেক্ট গড়ে ওঠে, যারা পরিচিত হয় হেলেনিস্টিক জ্যু (ইহুদী) নামে। তাদের মাঝে ছিল গ্রিক সংস্কৃতির ছোঁয়া। মূল ধারার ইহুদীরা তাদের ধর্মচ্যুত মনে করত।
খ্রিস্টপূর্ব ৬৩ সালে রোমান জেনারেল পম্পেই জেরুজালেম দখন করে নেন। যীশুর জন্মের ৪৭ বছর আগে আলেক্সান্দ্রিয়ার যুদ্ধে ৩০০০ ইহুদী সেনা পাঠানো হয় যারা জুলিয়াস সিজার আর ক্লিওপেট্রাকে রক্ষা করে।
রোমান সংসদ হেরোদ নামের একজনকে ইহুদীদের রাজা হিসেবে নিয়োগ দেয়। এরকম সময়ে এই ইহুদী অঞ্চল যখন রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে, তখন জন্মগ্রহণ করেন যীশু খ্রিস্ট (ঈসা আঃ)। তিনি ছিলেন “মসীহ” (অভিষিক্ত ত্রাতা) যিনি কিনা এই হতভাগ্য ইহুদী রাষ্ট্রকে উদ্ধার করবেন, নতুন আলোর পথ দেখাবেন। কিন্তু যখন যীশু ইহুদী ইমামদের (র্যাবাইদের) দুর্নীতি নিয়ে কথা বলতে লাগলেন তখন ইহদিরা চক্রান্ত করল যেন রোমান শাসককে বুঝিয়ে সুজিয়ে যীশুকে ক্রুশে দিয়ে মেরে ফেলা যায়, এবং তাই তারা করে। ইহুদী মতে তারা যীশুকে ক্রুশে দিয়ে মেরে ফেলে। যদিও ইসলাম মতে, আল্লাহ্ হযরত ঈসা (আ)-কে অক্ষত রাখেন এবং তুলে নেন, যিনি শেষ সময়ে আবার ফেরত আসবেন।
৬৪ সালে ইহুদী রুল জারি করা হয় যে, সকল ইহুদিকে ৬ বছর বয়স থেকেই লেখাপড়া শিখতে হবে। তখন থেকেই ইহুদীরা লেখাপড়াকে খুবই গুরুত্ব সহকারে নিত।
৬৬ সালে রোমান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে স্বাধীন রাষ্ট্র ইজরায়েল ঘোষণা করে বসে ইহুদীরা। তখন তাদের শায়েস্তা করা হয়, প্রায় ১ মিলিয়ন ইহুদী মারা যায়।
১৩১ সালে সম্রাট হাদ্রিয়ান ইহুদী ধর্ম নিষিদ্ধ করেন। জেরুজালেমের নাম পরিবর্তন করে রাখেন ইলিয়া কাপিতোলিনা। বাইতুল মুকাদ্দাসের জায়গায় জুপিটার মন্দির বসান। আর ইহুদী প্রদেশের নাম চেঞ্জ করে রাখেন “প্যালেস্টাইন” বা আরবিতে “ফিলিস্তিন”। তখন আবারো বিদ্রোহ করে ইহুদীরা, কিন্তু লাভ হয়নি।
৪র্থ শতকে সম্রাট কন্সটান্টিনোপল জাতীয় ধর্ম হিসেবে খ্রিস্ট ধর্ম ঘোষণা করার পর মরণাঘাত পায় ইহুদী ধর্ম। মোটামুটি বড় নিষেধাজ্ঞা নেমে আসে ইহুদীদের উপর।
৬১১ সালের দিকে পারস্য সাম্রাজ্যের অধীনে পড়ে ইহুদীরা। ওদিকে বাইজান্টিন সম্রাট হেরাক্লিয়াস/হারকিউলিস কথা দেন তিনি ইহুদী অধিকার ফিরিয়ে দেবেন, কিন্তু দেননি।
ইসলামী বিশ্বাস মতে, ৬১১ সালের এক রাতে মুহাম্মাদ (স) মিরাজে জেরুজালেম গিয়েছিলেন, এবং সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত জেরুজালেমের বাইতুল মুকাদ্দাসের ওখানে নামাজ পড়েন। ৬৩৪-৩৬ সালে মুসলিম বাহিনী জেরুজালেম অধিকার করে নেয়। ক্রুসেডের আগ পর্যন্ত খুলাফায়ে রাশেদিন এর শাসন করেন মদিনা থেকে। ৬৯১ সালে আব্দুল মালিক আজকের সেই সোনালি গম্বুজ নির্মাণ করেন। আর ৭০৫ সালে বানানো হয় মসজিদুল আকসা।
১০৯৯ সালে প্রথম ক্রুসেডে খ্রিস্টানরা জেরুজালেম দখন করে নেয়। কিন্তু ১১৮৭ সালে সুলতান সালাহুদ্দিন (সালাদিন) আইয়ুবি আবার দখন করে নেন জেরুজালেম। এ সময় পর্যন্তও ইহুদীরা ওখানেই থাকত। কিন্তু ধীরে ধীরে ইউরোপে জায়গা করে নিতে থাকে তারা।
ইউরোপের ব্ল্যাক ডেথ মহামারির সময় ইহুদীদের অনেককেই খুন করা হয়, সন্দেহ ছিল- তারা বুঝি কুয়ার পানিতে বিষ মেশাচ্ছে। আর স্পেনে খ্রিস্টান রাজত্বে মুসলিম আর ইহুদী দু’ধর্মের মানুষকেই মারা শুরু হয়ে যায়, যেটার নাম কুখ্যাত স্প্যানিশ ইনকুইজিশন। ততদিনে ১৪৯৭ সাল চলে এলো। ইহুদীরা পালিয়ে রোম, পোল্যান্ড, কিংবা উসমানী সাম্রাজ্যে চলে গেলো।
১৫৩৮ সালে সুলতান সুলেমান জেরুজালেম ঘিরে বিখ্যাত দেয়াল তুলে দেন। যেটা এখন ওয়াল অফ জেরুজালেম নামে পরিচিত।
এরপর কালের বিবর্তনে ১৯ শতকে ইহুদীরা ইউরোপে অধিকার পেতে শুরু করল। তখন অর্ধেক ইহুদিই থাকতো রুশ রাজ্যে। এই রাশিয়ান ইহুদীরা ১৮৮২ সালে হোভেভেই জিওন (“জিওনের জন্য ভালোবাসা”) নামের আন্দোলন শুরু করে। জিওন বা জায়ন হলো জেরুজালেমের এক পাহাড়। মূলত জেরুজালেম ফিরে পাবার জন্য এক আন্দোলনের সূচনা সেটা, জায়োনিস্ট আন্দোলন। তারা মৃত হিব্রু ভাষা জীবিত করতে শুরু করল।
১৯০২ সালের মাঝে ৩৫,০০০ ইহুদী এখন চলে আসে ফিলিস্তিনে, যেটা এখন ইজরায়েল নামে পরিচিত। তখন সেটা অবশ্য মুসলিম অধিকারে। এটাকে বলা হয় প্রথম আলিয়া, আলিয়া হলো ইহুদী পুনর্বাসন, যখন অনেক ইহুদী একসাথে সরে আসে। তখন মুসলিম প্রধান ফিলিস্তিনে দেখা গেল, জেরুজালেমের সিংহভাগই হঠাৎ করে ফিরে আসা ইহুদী।
১৮৯৬ সালে Theodor Herzl দ্য জুইশ স্টেট নামে এক লিখনি প্রকাশ করেন যাতে তিনি বলেন, ক্রমবর্ধমান ইউরোপীয় ইহুদীবিদ্বেষের একমাত্র সমাধান আলাদা এক ইহুদী রাষ্ট্র। ১৮৯৭ সালে জায়োনিস্ট সংঘ গড়ে তোলা হয়। প্রথম জায়োনিস্ট কংগ্রেসে লক্ষ্য ধার্য করা হয়, প্যালেস্টাইনে ইহদি রাষ্ট্র করে তুলতে হবে।
১৯১৪ সালের মাঝে দ্বিতীয় আলিয়া হয়ে গেল, ৪০,০০০ ইহুদী এ এলাকায় চলে এলো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইহুদীরা সমর্থন দেয় জার্মানিকে, কারণ তারা শত্রু রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়ছিল। খুবই আইরনিক, না? কারণ পরের বিশ্বযুদ্ধেই এই জার্মানি ইহুদীদের একদম নিশ্চিহ্ন করতে নেমে পড়েছিল!
জায়োনিজম আন্দোলনকারীরা চাচ্ছিল আমেরিকা আর ব্রিটেনের সমর্থন পেতে। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ ইতোমধ্যে সহানুভূতি দেখিয়েছিলেন। ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্দ বেলফোর ইহুদী কমিউনিটির নেতা রথসচাইল্ডকে চিঠি দেন, যা বেলফোর ডিক্লেরেশন নামে পরিচিত। এতে বলা হয়, ব্রিটিশ সরকারের এই ইহুদী রাষ্ট্রের ব্যাপারে সমর্থন আছে। ব্রিটিশ আর ফ্রেঞ্চ ব্যুরোক্রেটরা মিলে মধ্যপ্রাচ্যের নতুন সীমা নির্ধারণ করে। বিনিময়ে জায়োনিস্ট স্পাই নেটওয়ার্ক ব্রিটিশ সরকারকে ওসমানি সৈন্য সামন্ত নিয়ে তথ্য পাচার করত।
বেলফোর ঘোষণার পরোক্ষ সমর্থন ১৯২২ সালে লীগ অফ ন্যাশন্স দিয়ে দেয়। ১৯২৩ সালের মাঝে ৩য় আলিয়া হয়, এবং আরো ৪০,০০০ ইহুদী আসে ফিলিস্তিনে। আর ১৯২৯ সালের মাঝে ৪র্থ আলিয়া হয়, যখন আরও ৮২,০০০ ইহুদী চলে আসে। খরচপাতিতে সাহায্য করত জ্যুইশ ন্যাশনাল ফান্ড, বিদেশি জায়োনিস্টরা এতে সাহায্য করত।
১৯২৮ সালে JNC (Jewish National Council) গঠিত হয় ফিলিস্তিনে। ১৯২৯ সালে প্রথম বড় ইহুদী-মুসলিম দাঙ্গা হলো জেরুজালেমের ওয়েইলিং ওয়াল (বুরাক দেয়াল) নিয়ে। ফলে ১৯৩১ সালে জায়োনিস্টরা ইর্গুন জাই লিউমি নামে এক মিলিশিয়া প্রতিষ্ঠা করে। এই ইহুদী সন্ত্রাসী সংগঠন ১৯৪৬ সালে জেরুজালেমের কিং ডেভিড হোটেলে বোমা বিস্ফোরণ করে এবং ১৯৪৮ সালে ইহুদী অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে দেইর ইয়াসিন গ্রামে গণহত্যা করে।
১৯৩৩ সালে নাৎসিদের সাথে চুক্তিতে আরো ৫০ হাজার ইহুদী ফিলিস্তিনে চলে আসে। ১৯৩৮ সালের মাঝে ৫ম আলিয়া হয়ে গেল, প্রায় আড়াই লাখ ইহুদী এলো ফিলিস্তিনে।
এরপর শুরু হয়ে গেল সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার, প্রায় ছয় মিলিয়ন ইহুদী হত্যা করে নাৎসিরা। মোটামুটি এই যুদ্ধের শেষ হবার মধ্য দিয়ে আমেরিকার ইহুদীরা জায়োনিস্ট মুভমেন্টের মাথা হয়ে দাঁড়ায়।
১৯৪৬ সালের জুলাইতে সন্ত্রাসী দল ইর্গুন কিং ডেভিড হোটেলে বিস্ফোরণ ঘটায়। সেখানে ফিলিস্তিনের British administrative headquarters ছিল। সে হামলায় মারা যায় ৯১ জন মানুষ, আর আহত হয় ৪৬ জন। ইর্গুন সন্ত্রাসীরা আরবদেশী ওয়ার্কার আর ওয়েইটার সেজে বোম পেতে আসে। বিস্ফোরণে পুরো দক্ষিণ পাশ ভেঙে পড়ে। তখন তেল-আবিব (যেটা বর্তমানে ইজরায়েলের রাজধানী) শহরে কারফিউ জারি করা হয়। ফিলিস্তিনের প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার ইহুদিকে জেরা করা হয়। ১৯৪৭ সালে ব্রিটেনের লেবার সরকার এই ঝামেলাটা সদ্য গঠিত জাতিসংঘকে হ্যান্ডেল করবার জন্য প্রস্তুত হয়।
১৯৪৭ সালের ১৫ মে গঠিত হয় United Nations Special Committee on Palestine (UNSCOP) যা পরে প্রস্তাব দেয় “স্বাধীন এক আরব রাষ্ট্র, স্বাধীন এক ইহুদী রাষ্ট্র এবং জেরুজালেম শহর”- এই তিন ভাগ। সামান্য কিছু এদিকওদিকের মাধ্যমে জাতিসংঘের জেনারেল অ্যাসেম্বলিতে এই প্রস্তাব বিষয়ে ভোট হয়। ফলাফল স্বরূপ, ইহুদী সমাজে উচ্ছ্বাস আর আরব সমাজে অসন্তুষ্টি ছড়িয়ে পড়ে।
ঐ অঞ্চলে দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। প্রায় ১ লাখ আরব ইহুদীপ্রধান এলাকা ছেড়ে চলে যায়। আমেরিকা তখন ফিলিস্তিন ভাগ করার প্রস্তাব থেকে সমর্থন গুটিয়ে নেয়, কিন্তু ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ তারিখে ব্রিটেন নতুনতর সাপোর্ট দেয়।
জায়নিস্ট নেতা ডেভিড বেনগুরিওন বাধ্যতামূলক করলেন সকল ইহুদী নারীপুরুষকে মিলিটারি ট্রেনিং নিতে হবে। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে, শেষ ব্রিটিশ সামন্ত এই এলাকা ছেড়ে চলে যায়। সেদিন তেলআবিব মিউজিয়ামে জ্যুইশ পিপলস কাউন্সিল জড়ো হয় এবং ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ঘোষণা করে। সাথে সাথে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান এবং সোভিয়েতের স্টালিন স্বীকৃতি দেয় ইজরায়েলকে। তবে আরব লিগের মিসর, জর্ডান, সিরিয়া, লেবানন, ইরাক প্রত্যাখ্যান করে।
আরব রাষ্ট্রগুলো তখন ফিলিস্তিনের দিকে এগিয়ে যায় এবং শুরু হয় প্রথম আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ। আরব রাষ্ট্রগুলো অ্যাটাক করে, কিন্তু সদ্যজাত ইজরায়েলের তখনও কোনো ভারি অস্ত্র ছিল না। তখন জাতিসংঘ অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা জারি করে এ অঞ্চলে ইজরায়েলকে রক্ষা করতে। কিন্তু চেকোস্লোভাকিয়া সেই ব্যান ভঙ্গ করে ইজরায়েলকে অস্ত্র সাপ্লাই দেয়। ১১ জুন এক মাসের শান্তিচুক্তিতে বাধ্য করে জাতিসংঘ।
তবে মারা যায় ইসরায়েলের ৬,০০০ মানুষ। যেখানে মোট জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ছ লাখ। ৭ লাখ ২৬ হাজার ফিলিস্তিনি দেশছাড়া হয়। ১৯৪৭ এর ১১ মে জাতিসংঘে সদস্যপদ পেয়ে যায় ইজরায়েল।
ইজরায়েলের সংসদ “নেসেত” [Knesset] প্রথম মিলিত হয় তেলআবিবে, এরপর ১৯৪৯ সালের সিজফায়ারের পর চলে যায় জেরুজালেমে। জানুয়ারিতে প্রথম নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে ইজরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন ডেভিড বেনগুরিওন। ১৯৫১ সালের মাঝেই ইমিগ্রেশনের কারণে ইজরায়েলের জনসংখ্যা হয়ে গেল দ্বিগুণ। ১৯৫৮ সালে সংখ্যাটা দাঁড়ায় বিশ লাখে।
১৯৫৬ সালে সুয়েজ খালজনিত জটিলতায় ইজরায়েল মিসর আক্রমণ করে বসে। ইজরায়েলের মিত্র ছিল ব্রিটেন আর ফ্রান্স। এতে প্রবল নিন্দার ঝড় ওঠে।
এ সময়টাতে ইজরায়েল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদী হত্যাকারী নাৎসিদের খুঁজে বের করে হত্যা করতে থাকে, বা মৃত্যুদণ্ড দিতে থাকে। দুর্ধর্ষ ইজরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের তৎপরতা ওঠে তুঙ্গে।
১৯৬৭ সালে ছয় দিনের আরব ইজরায়েল যুদ্ধ চলছিল। ৮ জুন তারিখে ইজরায়েল এয়ার ফোর্স আর নেভি মোটর টর্পেডো বোট মার্কিন জাহাজ ইউএসএস লিবার্টি আক্রমণ করে বসে। মারা যায় ৩৪ ক্রু, আহত হয় ১৭১ ক্রু। জাহাজটা ছিল মিসরীয় শহর আরিশ থেকে ২৫ নটিকাল মেইল দূরে। ইজরায়েল দুঃখ প্রকাশ করে বলে, মিসরীয় জাহাজ ভেবে আক্রমণ করে ফেলেছিল। এখনকার হিসাব মতে ইজরায়েল সরকার তিন দফায় ২২.৯, ২৩.৩ এবং ১৭.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ দেয় সে ঘটনায় নিহতদের জন্য। যদিও তদন্ত রিপোর্ট বলে এটা ভুল ছিল, তবুও বেঁচে যাওয়া আক্রান্তদের মতে, এটা নাকি ইচ্ছাকৃত ছিল!
১৯৬৮ সালের মার্চে ইজরায়েলি ফোর্স অ্যাটাক করে ফিলিস্তিনি বাহিনী ফাতাহকে। তবে ফাতাহ আর পিএলও (Palestine Liberation Organization) তখন আরব জুড়ে নাম করে ফেলে। ১৯৬৯-১৯৭০ সালে আবারো মিসরের সাথে ইজরায়েলের যুদ্ধ লেগে যায়। ১৯৬৯ এর ডিসেম্বরে ইজরায়েল এর নেভি ৫জন সোভিয়েত সেনাকে মেরে ফেলে যারা সাহায্য করছিল মিসরকে। তখন পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যায় ইজরায়েলের জন্য। পরিস্থিতি ঠাণ্ডা করতে আমেরিকা কাজ করতে থাকে, ১৯৭০ সালের অগাস্টে সিজফায়ারে রাজি হয় উভয় পক্ষ। তখন মিসরের প্রেসিডেন্ট নাসের।
১৯৭২ সালে মিউনিখ অলিম্পিকের সময় ইজরায়েলের টিমের ১১ জনকে ফিলিস্তিনি Black September Organization (BSO) জিম্মি করে। জার্মান তৎপরতায় আটজন কিডন্যাপারের পাঁচজনই মারা যায়, আর সাথে খেলোয়াড়রাও। তবে বাকি ফিলিস্তিনিদের জার্মান সরকার ছেড়ে দেয় এক হাইজ্যাক হওয়া বিমানের হোস্টেজ মুক্ত করতে। ইজরায়েল সরকার এর জবাব দেয় বোমা বিস্ফোরণ, গুপ্তহত্যা আর লেবাননে পিএলও হেডকোয়ার্টারে হামলার দ্বারা। হামলার নেতৃত্ব দেন এহুদ বারাক, যিনি পরে গিয়ে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।
১৯৭২ সালে মিসরের প্রেসিডেন্ট হয়ে এলেন আনোয়ার সাদাত। এরপর ইয়ম কিপুর যুদ্ধে মিসর আর সিরিয়া মিলে সারপ্রাইজ অ্যাটাক করে ইজরায়েলকে। তবে মিত্রের সহায়তায় ইজরায়েল ভালো মতই যুদ্ধে ব্যাক করে। এ যুদ্ধের ফলে সৌদি সরকার ১৯৭৩ এর তেল সংকট সূচনা করে। ১৯৭৪ এর মে-তে মা’লোত গ্রামের ১০২ শিশুকে স্কুলে জিম্মি করে ফিলিস্তিনিরা, মারা পড়ে ২২ শিশু। সে বছরই পিএলও জাতিসংঘে অব্জার্ভার স্ট্যাটাস পায়, আর ইয়াসির আরাফাত জেনারেল অ্যাসেম্বলিতে ভাষণ দেন।
১৯৭৪ এর শেষ দিকে ইছহাক রাবিন প্রধানমন্ত্রী হন। ৭৬ এর জুলাইতে ফ্রান্সের ২৬০ যাত্রীসহ বিমান ছিনতাই করে ফিলিস্তিনি আর জার্মান সন্ত্রাসীরা, সেটা উগান্ডায় উড়িয়ে নেয় তারা। জার্মানরা তখন অ-ইহুদী যাত্রীদের ছেড়ে দেয়, কিন্তু হত্যার হুমকি দেয় প্রায় ১০০ ইহুদী যাত্রীকে। প্রধানমন্ত্রী রাবিন তখন একটা রেস্কিউ অপারেশন অর্ডার করেন, এবং সত্যি সত্যি ইহুদী যাত্রীদের উদ্ধার করে ইজরায়েল ফোর্স। কিন্তু উগান্ডার মতো জাতিসংঘের এক রাষ্ট্রে এরকম উদ্ধার অভিযান সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি স্বরূপ বলে মন্তব্য করেন জাতিসঙ্ঘ সেক্রেটারি ওয়াল্ডহাইম, যিনি কিনা আবার আগে নিজে নাৎসি ছিলেন।
১৯৭৭ সালে রাবিন এক কেলেংকারিতে সরে দাঁড়ান আর শিমন পেরেজ প্রধানমন্ত্রী হন। তবে নির্বাচনে জিতে মেনাখেম বেগিন প্রধানমন্ত্রী হয়ে যান। ৩০ বছরের শত্রুতা ঝেড়ে মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত জেরুজালেম ভ্রমণে যান। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার সাদাত আর বেগিনের সাথে মিলিত হয়ে ক্যাম ডেভিডে এক শান্তিচুক্তির রূপরেখা অংকন শুরু করেন। পশ্চিম তীর আর গাজা এলাকা ফিলিস্তিনের অধিকারে থাকবে। ওদিকে ১৯৭৯ সালে ইরানি ইসলামি বিপ্লব থেকে পালিয়ে আসে ৪০ হাজার ইহুদী। ১৯৮৪ সালে ইথিওপিয়াতে দুর্ভিক্ষ চলাকালে ৮০০০ ইথিপিয়ান ইহুদীকে উড়িয়ে নিয়ে আসা হয় ইজরায়েলে। ১৯৮৫ সালে লেবানন থেকে সব ইজরায়েলি সামন্ত সরিয়ে নেয়া হয়। ১৯৯২ সালে আবারো জয়ী হন রাবিন।
১৯৯৩ সালের জুলাইতে, এক সপ্তাহ ধরে ইজরায়েল লেবাননে অ্যাটাক চালায়, লেবাননের শিয়া হিজবুল্লাহ পার্টিকে দুর্বল করে দিতে। ১৯৯৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইজরায়েলের মৌলবাদী ইহুদী কাখ পার্টির সমর্থক বারুখ গোল্ডস্টাইন হেব্রনের পবিত্র প্যাট্রিয়ার্ক গুহাতে ২৯ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে, আহত করে ১২৫ জনকে (সে গুহায় নবী হযরত ইব্রাহিম আঃ এর কবর আছে বলে কথিত)। ১৯৯৪ সালে ওয়াশিংটন ডিক্লারেশনে সাইন করে জর্ডান আর ইজরায়েল, সাক্ষী ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। ফলে, দীর্ঘদিনের এক যুদ্ধ পরিস্থিতি শেষ হয়, যেটা এ দুই দেশের মাঝে ছিল। ওদিকে রাবিন আর পিএলও চেয়ারম্যান ইয়াসির আরাফাতও শান্তিচুক্তি সাক্ষর করেন [অস্লো একর্ড]। কিন্তু ফিলিস্তিনি সুন্নি সংগঠন হামাস এর বিরোধিতা করে।
৯৬ সালের নির্বাচনে নেতানিয়াহু জিতেন, আর হামাস বোমা চালায় কিছু। সেপ্টেম্বরে ফিলিস্তিনি দাঙ্গায় ৮০ জন মারা যায়। ৯৯ এর জুলাই এর নির্বাচনে এহুদ বারাক জিতে যান। কিন্তু ২০০১ সালে নির্বাচনে জিতেন এরিয়েল শ্যারন। তিনি ২০০২ সালে পশ্চিম তীরে ব্যারিয়ার বানানো শুরু করলেন। এর প্রতিবাদে ফিলিস্তিনের গাজা থেকে সেখানে মরটার হামলা হতে লাগল। আর লেবানন থেকে হিজবুল্লার আক্রমণ অব্যাহত ছিল। ২০০৪ সাল থেকে একদম পুরোদমে গাজায় প্রতিশোধ নিতে নামে ইজরায়েল। চলতে থাকে অপারেশন।
২০০৬ সালে ফিলিস্তিনে জিতে আসে হামাস, এসেই তারা আগের সকল সাইন করা চুক্তি বাতিল বলে গণ্য করে। এমনকি ইজরাইল এর প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা থেকে তারা সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারের ইহুদী গণহত্যাকে জায়োনিস্টদের বানানো মিথ বলেও প্রচার করে বসে, এটা তাদের বড় একটা ভুল ছিল। ২০০৬ সালে শ্যারন স্ট্রোক করায় প্রধানমন্ত্রী হন এহুদ ওলমার্ট।
২০০৬ সালের ১৪ মার্চ এক ফিলিস্তিনি জেলে অপারেশন চালায় ইজরায়েল। জুন মাসে ফিলিস্তিনের হামাস গাজা বর্ডার ক্রস করে ট্যাঙ্ক অ্যাটাক করে ইজরায়েলি সেনাকে ধরে নিয়ে আসে। লেবাননের হিজবুল্লাও প্রায় একই কাজ করে, দুজন ইসরাইলী সেনা ধরে নিয়ে আসে। ফলে ইজরায়েল দ্বিতীয় লেবানন যুদ্ধ শুরু করে দেয়। ২০০৭ সালে গাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় হামাস।
২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে ইজরায়েলি এয়ারফোর্স সিরিয়ার নিউক্লিয়ার রিয়াক্টর ধ্বংস করে দেয়। ২০০৮ সালে হামাসকে শায়েস্তা করতে গাজায় অভিযান চালায় ইজরায়েল।
২০০৯ সালে নেতানিয়াহু ক্ষমতায় আসেন, এবং এখনো আছেন। ২০১১ সালে হামাস আর ইজরায়েলের চুক্তি হয়, যার ফলে সেই কিডন্যাপ করা ইজরায়েলি সেনার বিনিময়ে ইসরায়েল ১০২৭ ফিলিস্তিনি বন্দিকে ছেড়ে দেয়।
২০১২ সালের নভেম্বরে হামাস নেতা আহমেদ জাবারিকে হত্যা করতে ইজরায়েল গাজায় হামলা শুরু করে। যখন ২০১৪ সালে ফাতাহ আর হামাস একত্রে সরকার গঠন করতে রাজি হয়, তখন ইজরাইল শান্তিচুক্তি করতে বসতে অস্বীকৃতি জানায়।
২০১৪ সালের ৮ জুলাই হামাসের রকেট হামলার উত্তরে ইসরায়েল গাজা এলাকায় বড় আকারের আক্রমণ শুরু করে। এখন ২০১৭ সালে এসেও ইজরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বৈরথ চলছেই।
২০০৫ এর হিসাব মতে, জেরুজালেমে ৭,১৯,০০০ মানুষ বাস করত, যার ৪,৬৫,০০০ ইহুদী আর ২,৩২,০০০ মুসলিম। ইহুদীরা পশ্চিমে, আর মুসলিমরা পূর্ব দিকে বাস করে। ইজরায়েল ছাড়া বিশ্বের আর কোনো দেশই বলে না যে, জেরুজালেমকে রাজধানী করবার অধিকার রাখে ইসরায়েল। কারণ এ শহর ঘিরে আছে খ্রিস্টান, ইহুদী আর মুসলিম তিন ধর্মাবলম্বীদেরই তীর্থস্থান। এই পবিত্র ভূমি নিয়ে মারামারির পেছনে কারণ সেই একটাই- কারা এর আসল মালিক?
হিব্রু বাইবেল মাফিক ইহুদীদের দাবি সেই প্রাচীনকালেই তারা এখানে ছিল, মাঝে অন্যত্র নির্বাসিত হলেও এ জায়গার আসল অধিকার তাদেরই। কিন্তু তাদের সেই ধর্মগ্রন্থমতেই ফিলিস্তিনিরা ছিল ইহুদীরা আসবার আগে থেকেই এ অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দা। তাই ইহুদিদের এখানে উড়ে এসে জুড়ে বসা ব্যাপারটা এই অঞ্চলের মুসলিমরা মেনে নিতে রাজি নয় একদমই। এবং ধর্মগতভাবেই সারা বিশ্বের মুসলিমরা তাদের এ দাবিকে সমর্থন জানায়। তবে মার্কিন মিত্র হওয়ায় ইজরায়েলের ক্ষমতা যে সুবিশাল সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
ফিলিস্তিনিদের উপর অবিরাম চলতে থাকা হামলাগুলো বিশ্ববিবেককে নাড়া দিয়ে যায়- বিশেষ করে গাজার হামলাগুলো। মিশরের সিনাই আর সিরিয়ার গোলান মরুভূমির দখল রাখা ইজরায়েলের চরম হঠকারিতার পরিচয় দেয়। আর প্রতিনিয়ত সেখানে নিরীহ নারী-শিশু পর্যন্ত মারা যাচ্ছে। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে এ দ্বৈরথ মিটে যাবার কোনো ক্ষীণ আশা আদৌ দেখা যায় না। এ লেখাতে সহস্র বছরের ইতিহাস অতি সংক্ষেপে লিখতে গিয়ে অনেক ভুল করে থাকতে পারি, আশা করি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন পাঠক।