একসময় ইরান ছিল আমেরিকার ঘনিষ্ঠ মিত্র। রেজা শাহ পাহলভীর সময়ে ইরান-মার্কিন সম্পর্ক ছুঁয়েছিল অনন্য উচ্চতা। কিন্তু একপর্যায়ে ইরানে ইসলামিক বিপ্লব হয়, ধর্মীয় মতাদর্শভিত্তিক শাসনব্যবস্থার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়ে যায় সেই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। ইরানে আমেরিকার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি রেজা শাহ পাহলভী দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। মূলত ইসলামি বিপ্লবই আমেরিকা ও ইরানের তিক্ত সম্পর্কের পটভূমি রচনা করে। ইরাক যখন ইরানের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করে ইরানে হামলা চালিয়েছিল, তখন আমেরিকা ইরাকের সমালোচনা বা কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ তো দূরের কথা, উল্টো ইরাককে নানাভাবে সহায়তা করেছিল। এমনকি ইরানে রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগের পরও ইরাক তেমন কোনো আন্তর্জাতিক নিন্দা কিংবা শাস্তিমূলক ব্যবস্থার শিকার হয়নি। কারণ আমেরিকার শত্রুর বিরুদ্ধে ইরাক সামরিক পদক্ষেপ নিচ্ছিল, যেটি আমেরিকাকে খুশি করেছিল।
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি অত্যন্ত জটিল। বিগত অনেক দশক ধরেই মধ্যপ্রাচ্য খুবই সংঘাতপূর্ণ। এরকম একটা স্থানে ভিন্ন ইসলামিক মতাদর্শের ইরান চারদিক থেকেই বিভিন্ন শত্রুরাষ্ট্র দ্বারা ঘেরা৷ তাই ইরান শুরু থেকেই চেয়েছে পারমাণবিক অস্ত্রের মালিকানা হাতে পেতে। এতে আঞ্চলিক শত্রুদের বিপক্ষে তার বাড়তি সুবিধা থাকতো। ইরাকের হামলার পর থেকে ইরান আরও বেশি করে এই বিপুল ক্ষমতাশালী অস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে। এরই প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে পরমাণু কর্মসূচি গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ইরানের নীতিনির্ধারকরা। ১৯৯৭ সালে পরমাণু কর্মসূচি দেখভাল করার করার আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ইরান অনুমতি লাভ করে। কিন্তু অনুমতি পেলেও পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু করা এত সহজ নয়। অনেক দীর্ঘ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয়। ইরান তখন সন্ধান চালাচ্ছে কোনো পরমাণু বিজ্ঞানীর হাত ধরে পারমাণবিক প্ল্যান্টের নকশা পাওয়া যায় কিনা।
আমেরিকা তার শত্রুর বিরুদ্ধে এই সুযোগটি কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ বিভিন্ন উৎস থেকে আসা খবরের ভিত্তিতে বুঝতে পারছিল ইরান যেকোনো মূল্যে পারমাণবিক প্ল্যান্টের নকশা পেতে চায়। আমেরিকা ইরানের এই ‘দুর্বলতা’কে পুঁজি করে দেশটির পরমাণু কর্মসূচি যেন আরও কয়েক বছর পিছিয়ে যায়, সেটি নিশ্চিত করতে তৎপর হয়ে ওঠে। খুব সুপরিকল্পিতভাবে তারা ‘অপারেশন মার্লিন’ গ্রহণ করে। তাদের পরিকল্পনার মূল বিষয় ছিল যেকোনো নিরপেক্ষ বিজ্ঞানীর মাধ্যমে ইরানের কাছে পারমাণবিক প্ল্যান্টের একটি ত্রুটিপূর্ণ নকশা হস্তান্তর করা হবে। ইরান যখন সেই পারমাণবিক প্ল্যান্টের ভুল নকশা অনুযায়ী প্ল্যান্ট তৈরি করতে যাবে, তখনই ঘটবে বিপত্তি। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। ফলে বেশ কয়েক বছর পিছিয়ে যাবে দেশটি। আমেরিকার এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অভিযানের ছদ্মনাম দেয়া হয় ‘অপারেশন মার্লিন’। সিআইএ কোমরবেধে নেমে পড়ে এই অভিযান সফল করতে।
আমেরিকা একজন সাবেক সোভিয়েত পরমাণ বিজ্ঞানীর সন্ধান পায়, যাকে দিয়ে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের পারমাণবিক কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে বেশ চমৎকার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন। পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে তিনি আমেরিকায় চলে আসেন। সিআইএ তাকে মোটা অংকের অর্থ প্রদান করে এই পরিকল্পনা সফল করার জন্য। তিনি পারমাণবিক প্ল্যান্টের একটি খসড়া তৈরি করেন এবং পরিকল্পনামতো প্ল্যান্টের বেশ কিছু অংশ নকশা থেকে বাদ দিয়ে দেন। ইরানের হাতে পৌঁছে দেয়ার আগে তিনি তার তৈরিকৃত ত্রুটিপূর্ণ পরিকল্পনা সিআইএর দ্বারা অনুমোদন করিয়ে নেন। তবে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে, ইরান তার পরিকল্পনার ত্রুটিগুলো উদঘাটন করে ফেলবে। আর উদঘাটন করে ফেললেই হয়তো তারা তাকে মেরে ফেলার গোপন পরিকল্পনা হাতে নিবে। সিআইএ তার আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেয়, তাকে অভয় প্রদান করে।
পারমাণবিক প্ল্যান্টের নকশা চূড়ান্ত হয়ে গেলে সিআইএ সেই সাবেক সোভিয়েত পরমাণু বিজ্ঞানীকে হাঙ্গেরিতে পৌঁছে দেয়। হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্টে অবস্থিত ইরানি দূতাবাসে সেই পরমাণু বিজ্ঞানী পারমাণবিক প্ল্যান্টের ত্রুটিপূর্ণ নকশা হস্তান্তর করে। ইরানের কূটনৈতিক কর্মকর্তারা সানন্দে এই নকশা গ্রহণ করেন। তবে এখানে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার ঘটে যায়। সেই সাবেক সোভিয়েত বিজ্ঞানী ত্রুটিপূর্ণ নকশায় যে ত্রুটিগুলো ছিল, সেগুলো আলাদাভাবে চিহ্নিত করে সেই নকশার ফাইলে দিয়ে দেয়। অর্থাৎ, ইরান পারমাণবিক প্ল্যান্টের একটি ত্রুটিহীন নকশাই শেষপর্যন্ত হাতে পায়। সেই সোভিয়েত বিজ্ঞানী ত্রুটিগুলো বিশেষভাবে যুক্ত করে দেয়ার বিষয়টি এই অভিযানের মূল পরিকল্পনাকারী মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-কে জানাননি। ফলে সিআইএর অজান্তেই এই পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে যায়।
ইরান হাতে পাওয়া সেই নকশা নিজেদের বিজ্ঞানীদের দ্বারা ঠিকমতো পর্যবেক্ষণ করিয়ে নেয়। সেখানে তারা কোনো ত্রুটি খুঁজে পায়নি এবং সেই নকশা অনুযায়ী পরমাণু প্ল্যান্ট স্থাপনের কার্যক্রম শুরু করে দেয়। এর ফলে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি আরও গতি লাভ করে। সিআইএ যখন বুঝতে পারে তাদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে, তখন তারা অবাক হয়ে যায়। এই অভিযানের ব্যর্থতা অনুসন্ধান করতে শেষপর্যন্ত একটি সরকারি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এই ব্যর্থ অপারেশন আমেরিকার রাজনীতিতে আলোচনায় এসেছিল পরবর্তীতেও। ২০১৫ সালে আমেরিকার অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই জেফ্রি স্টার্লিং নামের একজন সাবেক সিআইএ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল যে তিনি এই ‘ক্লাসিফায়েড’ অপারেশনের তথ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের একজন সাংবাদিকের কাছে হস্তান্তর করেছেন। তার বিচারের সময় আমেরিকায় এক বড় ধরনের বিতর্ক শুরু হয়েছিল। কেউ কেউ তাকে আখ্যা দিয়েছেন ‘জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্যদানকারী’ হিসেবে, কেউ কেউ বলেছিলেন যে তার উদ্দেশ্য সৎ ছিল না।