ফ্রান্সের বিরুদ্ধে অস্ট্রো-প্রুশিয়ান যৌথ পিনিৎজ ঘোষণাপত্রের পরের বছরেই দ্বিতীয় লিওপোল্ড মৃত্যুবরণ করেন। ফলে ফ্রান্স যখন অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে তখন সিংহাসনে নতুন রাজা হলি রোমান এম্পেরর দ্বিতীয় ফ্রান্সিস। তিনি ছিলেন লিওপোল্ডেরই সন্তান, মাঁরি আন্তোয়াঁনেতের ভাগ্নে। তিনি এবং প্রুশিয়ার রাজা ফ্রেডেরিক উইলিয়াম কেউই কিন্তু ফ্রান্সের সাথে যুদ্ধ করতে চাননি। তাদের উদ্দেশ্য ছিল কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে বিপ্লবীদের প্রতিহত করা। তাছাড়া ফ্রান্স নিজেকে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র ঘোষণা করে লুইকে স্বপদে বহাল রেখেছিল, রাজপরিবারও প্রকাশ্যভাবে হুমকির মধ্যে ছিল না।
কিন্তু ফ্রান্স থেকে পালিয়ে আসা বহু অভিজাত, যাদের অনেকে ছিলেন সামরিক কর্মকর্তা, তাদের লক্ষ্যই ছিল ইউরোপিয়ান রাজাদের সাহায্যে লড়াইয়ের মাধ্যমে বিপ্লবকে সমূলে উৎপাটন করা, সেজন্য তারা নানা পরিকল্পনা করছিলেন। এদিকে বিপ্লবীদের মধ্যেও বিভক্তি ছিল। তাদের উগ্র বামপন্থি ধারা জ্যাকোবিন’রা চিরতরে রাজতন্ত্রকে উৎখাত করে প্রজাতান্ত্রিক শাসনের স্বপ্ন দেখত। এই কারণে কিছুটা উদারপন্থী চিন্তাধারার বিপ্লবী উপদলের, বিশেষ করে গিরোন্ডিন’দের সাথে তাদের বিবাদ ছিল। জ্যাকোবিনরা ছিল যুদ্ধের মাধ্যমে ফ্রান্সের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী, তাদের নেতাদের অন্যতম ম্যাক্সিমিলিয়ান রবোস্পিয়ার নামে এক কট্টর বিপ্লবী।
প্রথম কোয়ালিশন
প্রথমদিকে ফ্রান্সের পরিবর্তন পার্শ্ববর্তী কোনো রাজ্যই আমলে না নিলেও বিপ্লবীদের দ্রুত উত্থানে সারা ইউরোপে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। অস্ট্রিয়ার আর প্রুশিয়ার জোটে পরে আস্তে আস্তে যোগ দিয়েছিল ইংল্যান্ড, স্পেন, ইটালি এবং জার্মানির অনেক রাষ্ট্র। তৈরি হয় প্রথম কোয়ালিশন। এরকম সাতটি কোয়ালিশন লেগেছিল শেষ পর্যন্ত বিপ্লবী ফ্রান্সকে পরাস্ত করতে। তবে অন্যান্য সদস্য যোগ দেবার আগেই অস্ট্রিয়া এবং প্রুশিয়া ফ্রান্সে হামলা চালাতে মনস্থির করে।
প্রায় ৮০,০০০ প্রুশিয়ান এবং ৬৮,০০০ অস্ট্রিয়ান সেনার সমন্বয়ে বিশাল বাহিনী প্রস্তুত হলো ফ্রান্সে আগ্রাসনের জন্য। তাদের সাথে ৬,০০০ নির্বাসিত ফরাসি নিয়ে মিলিত হলেন ষোড়শ লুইয়ের ভাই কাউন্ট অফ আর্তোঁয়া। বাহিনীর সর্বাধিনায়ক আমাদের পরিচিত সেই ডিউক অফ ব্রান্সউইক, ফার্দিন্যান্দ। ২৫ জুলাই ১৭৯২ সালে তিন ভাগে ভাগ হয়ে তারা অগ্রসর হলেন। ফার্দিন্যান্দ চললেন মোজেল নদীর দক্ষিণ তীর ধরে, উদ্দেশ্য ভেঁর্দা আর শ্যালোন শহরের পথ ধরে সোজা প্যারিসে প্রবেশ করা। তার সাথে প্রুশিয়ার রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডেরিক উইলিয়াম ছিলেন পর্যবেক্ষক হিসেবে। জার্মান এক প্রিন্স হনলোয়া (Prince Hohenlohe) তার বিশ মাইল দক্ষিণে থিঁওভিল আর মেটজ বরাবর রওনা হলেন। তৃতীয় ভাগ কাউন্ট ক্লারাফেতের নেতৃত্বে সেঁদা আর মেজিদ শহরের দিকে এগিয়ে গেল।
ব্রান্সউইক ম্যানিফেস্টো
রওনা হবার আগে ফার্দিন্যান্দ নিজেদের লক্ষ্য ব্যাখ্যা করে একটি লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন, যা ইতিহাসে বিখ্যাত ব্রান্সউইক ম্যানিফেস্টো নামে। এই ম্যানিফেস্টো লিখেছিল নির্বাসিত ফরাসি অভিজাতেরা, যারা নিজেরাও যৌথ বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। অনুমিতভাবেই তাদের লেখা বিপ্লবের বিরুদ্ধে বিদ্বেষে পরিপূর্ণ। ব্রান্সউইক ম্যানিফেস্টোর মূল কথা ছিল এই সমরাভিযান ফরাসী ভূখণ্ড ছিনিয়ে নেয়ার জন্য নয়, বরঞ্চ লুইকে সহায়তা করার মাধ্যমে ফ্রান্সকে তার পূর্ণ রাজতন্ত্রভিত্তিক চরিত্র ফিরিয়ে দেয়া, বিপ্লবীরা যা ভূলুণ্ঠিত করেছে। ফার্দিন্যান্দ জানিয়ে দিলেন যারা সম্রাটের আনুগত্য স্বীকার করবে, তাদের জানমালের সুরক্ষা দেয়া হবে। আর শত্রুদের দেয়া হবে কঠোর শাস্তি।
প্রজাতন্ত্রের উত্থান
ফ্রান্সে চলছে চরম নৈরাজ্য। দীর্ঘদিনের নিষ্পেষিত জনতার প্রতিহিংসার কোপানলে পড়েছেন সমাজের উঁচুশ্রেণীর অনেকেই। বিপ্লবের দুটি প্রধান দল জ্যাকোবিন আর গিরোন্ডিন’দের মধ্যে চলছে ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতা। গিরোন্ডিনরা বর্তমান প্রধান সরকারী পদগুলি দখল করে রেখেছিল, তাদের অনেকেই সাংবিধানিকভাবে রাজতন্ত্র বজায় রাখার পক্ষপাতী। রবোস্পিয়ার আর তার দল রাজার ঘোর বিরোধী। এর মাঝেই লুইয়ের সাথে বহিঃশক্তিগুলির চিঠি চালাচালি হচ্ছিল। তার স্বপক্ষের অনেকেই জড়িত ছিল রাজনৈতিকভাবে লুইকে আবার পূর্বের স্থানে অধিষ্ঠিত করতে।
কিন্তু সাধারণ জনগণের মাঝে রাজার প্রতি ঘৃণা দিন দিন বাড়ছিল, তাদের সমস্ত সমস্যার জন্য তারা দায়ী করছিল লুই এবং তার স্ত্রী রানী মাঁরি আন্তোয়াঁনেতকে। রবোস্পিয়ার যখন দেখলেন জ্যাকোবিনদের নিষ্ক্রিয় করবার সমস্ত ব্যবস্থা করে ফেলেছে গিরোন্ডিনরা তখন তিনি জনগণের ক্ষোভকে উস্কে দিতে থাকলেন। এর মধ্যে ব্রান্সউইক ম্যানিফেস্টো তার হাতে নতুন অস্ত্র তুলে দিল। এই ঘোষণাপত্র ছিল একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য রাষ্ট্রের প্রকাশ্য হস্তক্ষেপের চেষ্টা, যা কূটনৈতিক শিষ্টাচারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কাজেই আগুনে ঘি পড়ল, ফরাসি জনতা ধরে নিল এসবের পেছনে লুইয়ের হাত আছে।
রাজপরিবার বাস করছিল প্যারিসের উপকণ্ঠে সেইন নদীর তীরের টিলরেরি (Tuileries) প্রাসাদে। ১০ অগাস্ট ১৭৯২ সালে উত্তেজিত একদল জনতা প্রাসাদের দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ে। তাদের জড়ো হতে দেখে লুই আগেই পরিবার নিয়ে সরে গিয়েছিলেন। তিনি বিপ্লবী নেতৃত্বের আশ্রয় প্রার্থনা করেন। জ্যাকোবিনরা সাধারন মানুষকে সাথে নিয়ে রাজতন্ত্রের পতন দাবি করতে থাকে। গিরোন্ডিনদের পিঠ দেয়ালে থেকে গেল। লুইয়ের পক্ষ নিলে ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। সুতরাং তারা দাবি মেনে নেয়। ফরাসি রাজপরিবারকে অন্তরিন রাখা হলো প্যারিসের টেম্পল টাওয়ারে। ২১ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত করে ফ্রান্সকে একটি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়। ২১ বছরের ঊর্ধ্বে সকল নাগরিকের জন্য ভোটাধিকার প্রচলন হল। সংক্ষিপ্ত এবং আগে থেকেই রায় নির্ধারিত বিচার শেষে রাজা রানীর মৃত্যুদন্ডের ফরমান দিল বিপ্লবী কাউন্সিল। গিলোটিনের মাধ্যমে ১৭৯৩ সালের ২১ জানুয়ারি লুই এবং ১৬ অক্টোবর মাঁরি আন্তোয়াঁনেতের দন্ড কার্যকর করা হয়।
পর্যুদস্ত ফরাসি সেনাবাহিনী
রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সমস্যা ফরাসী সেনাদলকেও স্পর্শ করেছিল। তাদের বহু অফিসার ছিল উঁচুশ্রেণীর এবং রাজতন্ত্রপন্থি। ফলে অনেকেই পালিয়ে গিয়েছিল। কেবল আর্টিলারির অফিসার কোরই তুলনামুলভাবে অক্ষত ছিল। তা সত্ত্বেও অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণার পর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১৭৯২ এর মে মাসে তাদের অস্ট্রিয়ান নেদারল্যান্ডসে পাঠানো হয়। কিন্তু পরিণতি হল শোচনীয়। যুদ্ধ করার কোনো ইচ্ছাই সেনাদের মধ্যে দেখা গেল না। অস্ট্রিয়ানদের দেখলেই অনেকে পালিয়ে যেত, অনেক সেনা আবার শত্রুপক্ষে গিয়ে যোগ দেয়। ফলে জুনের মধ্যেই তাড়া খেয়ে ফরাসিরা অস্ট্রিয়ান নেদারল্যান্ডস ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
ফার্দিন্যান্দের অভিযান
২৫ জুলাই চলা শুরু করে তিন ভাগে বিভক্ত অস্ট্রো-প্রুশিয়ান সেনাদল ফ্রান্সের এলাকায় ঢুকে পড়ে। এরই মধ্যে রাজপরিবারের বন্দিত্বের খবর আসল। ২৩ আগস্ট ফার্দিন্যান্দ লংউই (Longwy)দুর্গ দখল করে নেন, সেপ্টেম্বরের দুই তারিখ পতন হল ভেঁর্দা’র (Verdun)। প্যারিসের রাস্তা তখন তার সামনে উন্মুক্ত। যদি ফার্দিন্যান্দ সোজা প্যারিসের দিকে এগিয়ে যেতেন খুব সম্ভবত তাহলে তিনি শহর দখল করে নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে আশেপাশের ফরাসি প্রতিরক্ষা অবস্থানগুলো নিষ্ক্রিয় করতে মনোযোগ দিলেন। ফলে বিপ্লবীরা নিজেদের গুছিয়ে নেবার মূল্যবান সময় পেয়ে যায়। ১৮ আগস্ট ফরাসি জেনারেল দ্যুমুরিয়ে (Charles Dumouriez) আগ্রাসি বাহিনীর বিরুদ্ধে উত্তরের সেনাদের দায়িত্ব পান, ২৭ তারিখ মধ্য ফ্রান্সের নেতৃত্ব দেয়া হলো কেলারম্যানকে (François Kellermann)।
দ্যুমুরিয়ে ইতোমধ্যে গিরোন্ডিন পার্টিতে নাম লিখিয়েছেন, এবং মার্চ মাস থেকে তাকে ফরাসি পররাষ্ট্র বিষয়ক দপ্তরের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। তার উপর ভার পড়ল ফার্দিন্যান্দকে ঠেকানোর। বহু স্বেচ্ছাসেবী এসময় দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সেনাবাহিনীতে নাম লিখিয়েছিল, ফলে ফরাসি সেনাদলের আকারও বেড়ে যায়।
যদিও ফার্দিন্যান্দ পার্শ্ববর্তী ফরাসি সমস্ত হুমকি ধ্বংস করে দিয়েছেন, তবুও তার যাত্রা নিষ্কণ্টক নয়। তার সামনে রুক্ষ পার্বত্য আহগন (Argonne) অঞ্চল, প্যারিসে যেতে যা অতিক্রম করতে হবে। দ্যুমুরিয়ে তা জানতেন, তাই তিনি ফয়সালা করলেন এখানেই প্রুশিয়ানদের ঠেকাতে হবে। আহগনের মধ্য দিয়ে যাওয়ার পথ পাঁচটি। দক্ষিণে লাশালাদ আর লেস ইলেট বন্ধ করতে প্রেরণ করা হলো জেনারেল ডিলনকে। দ্যুমুরিয়ে নিজে গ্রানপ্রিঁ আর ক্রয়-অ-বুঁয়ো’র দিকে চললেন। ছোট একদল ঘাঁটি করল উত্তরের পথ ল্যু শ্যেনে।
সেপ্টেম্বরের ৫ তারিখ লেস ইলেটে এসে ফরাসি সৈন্যদের দেখতে পেয়ে ফার্দিন্যান্দ হকচকিয়ে গেলেন। সরাসরি হামলা করে রক্তক্ষয়ের ইচ্ছা তার ছিল না, ফলে সহকারী হনলোয়াকে সেখানে থাকতে বলে তিনি চলে যান গ্রানপ্রিঁর দিকে। অন্যদিকে অস্ট্রিয়ান কম্যান্ডার ক্লারাফেট পৌঁছে গিয়েছিলেন ক্রয়-অ-বুঁয়োতে। তার অধীনস্থ অস্ট্রিয়ান বাহিনী ফরাসিদের হটিয়ে দেয় এবং ১৪ সেপ্টেম্বর প্রতি আক্রমণের মুখেও নিজেদের অবস্থান ধরে রাখে। দ্যুমুরিয়ে পরাস্ত হয়ে দক্ষিণে সরে আসেন, এখানেই ফার্দিন্যান্দকে বাধা দিতে মনস্থ করলেন। এই কৌশলের ফলে অস্ট্রো-প্রুশিয়ান বাহিনী একত্রিত হতে পারল না, কারণ দখল করা পথগুলো নিজেদের পিছু হটার জন্য পরিস্কার রাখতে তাদের সেখানে সেনা মোতায়েন করতে হয়, এবং ফরাসি বাহিনী ছড়িয়ে থাকায় তাদের মোকাবেলার জন্যও শত্রুরা বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। ফার্দিন্যান্দ সরাসরি প্যারিসের দিকে যাত্রাও করতে পারছিলেন না, কারণ পেছন থেকে তখন দ্যুমুরিয়ে হামলা করতে পারবেন।
ভাল্মির যুদ্ধ
দ্যুমুরিয়ে সেন্ট-মেনোল্ড এলাকাতে ঘাঁটি বানালেন। এখানে সেপ্টেম্বরের ১৯ তারিখে কেলারম্যান এসে তার সাথে মিলিত হলেন। কেলারম্যান পূর্বদিকে শিবির ফেললেন। সেদিকে ছিল ল্যা লুন নামে একটি রাস্তা, যার কাছেই ভাল্মি গ্রামের নিকটবর্তী এক পাহাড়ি টিলা। টিলার উপরে একটি উইন্ডমিল, যেখানে সেনা কম্যান্ড স্থাপন করা হল। এর পাশেই আরেকটি পাহাড়, ইভর্ন। ভাল্মিতে ফরাসি সেনাদের মধ্যে ছিলেন এক সাহসী যুবক, তার নাম নেই (Michel Ney)। সাহসিকতার সাথে তিনি ফরাসী সেনাদলের নানা যুদ্ধে এরপরেও অংশ নিয়েছিলেন। যাকে ইতিহাস চেনে নেপোলিয়নের সঙ্গি মার্শাল নেই নামে।
২০ তারিখ প্রুশিয়ান সেনারা ফরাসি অবস্থানের সামনে এসে উপস্থিত হল। ল্যা লুনে কামান বসিয়ে ফ্রেঞ্চরা কিছুক্ষন তাদের বাধা দিতে চেষ্টা করে। এর মাঝেই কেলারম্যান তার অবশিষ্ট সেনাদের উইন্ডমিল ঘিরে বসিয়ে দিলেন। ওদিকে ল্যা লুন থেকে ফরাসিরাও মার খেয়ে পিছিয়ে এলো। দ্যুমুরিয়ে একদল সেনা পাঠিয়ে দিলেন ইভর্ন পাহাড় দখলে রাখতে। তিনি সরাসরি কেলারম্যানের সাহায্যে আগাতে পারছিলেন না তার সমরবিন্যাসের কারণে, এবং দুই বাহিনীর মধ্যভাগে জলাভূমি থাকায়। তবে তিনি ছোট ছোট দল পাঠান কেলারম্যানের পার্শ্বভাগ মজবুত করতে।
দুপুরের দিকে আবহাওয়া লড়াইয়ের উপযুক্ত হয়ে উঠল। ফার্দিন্যান্দ ধারণা করছিলেন অস্ট্রিয়ান নেদারল্যান্ডসে যেরকম হয়েছে, সেরকম এখানেও বোধহয় একটু চেপে ধরলেই ফরাসিরা বাপ বাপ করে পালাবে। তিনি কামান দাগার নির্দেশ দিলেন, ফরাসিরাও যথোচিত জবাব দিল। কিছু সময় পর ফার্দিন্যান্দ বুঝলেন ফরাসিরা আসলে নড়বে না। সরাসরি তাদের আক্রমণের চিন্তাও বাতুলতা, কারণ কেলারম্যানের অবস্থানের সামনে দীর্ঘ উন্মুক্ত প্রান্তর, কোনো আড়াল নেই। ফলে ইনফ্যান্ট্রি চার্জ করলে ফ্রেঞ্চ লাইন পর্যন্ত যাবার আগেই বহু সেনা মারা পড়বে। তারপরেও ফরাসি সেনাদের পরীক্ষা করতে তিনি কয়েকবার সেনাদের সামনে বাড়তে নির্দেশ দিলেন। কিন্তু অল্প কিছুদূর যাবার পড়েও যখন ফরাসিরা পালালো না তিনি তখন তাদের ডেকে ফিরিয়ে আনেন। এভাবে বিকাল চারটা অবধি শুধু গোলা বিনিময় হলো। এরপর ফার্দিন্যান্দ নিজের কম্যান্ডারদের নিয়ে বসলেন। তার সিদ্ধান্ত ছিল তিনি এখানে লড়াই করবেন না।
সত্যিকার অর্থে বিদেশি এক রাজাকে সিংহাসন ফিরিয়ে দিতে নিজেদের লোকবল জলাঞ্জলি দিতে প্রুশিয়া কতটুকু নিবেদিত ছিল তা প্রশ্নসাপেক্ষ। সরাসরি হামলা চালালে হয়তো ফার্দিন্যান্দ জয়ী হতেন, অথবা ফরাসিরা তাকে হটিয়ে দিত। ফলাফল যেটাই হতো না কেন, ফরাসি অবস্থানের কারণে অগণিত প্রুশিয়ান সেনা এই সংঘর্ষে মারা যেত, ফলে পুরো অভিযানের ভবিষ্যৎ হয়ে পড়ত অনিশ্চিত। কাজেই ফার্দিন্যান্দের লড়াই না করার সিদ্ধান্ত কৌশলগত ছিল।
এই সংঘর্ষে দেড়শর কিছু বেশি প্রুশিয়ান সেনা আর প্রায় ৩০০ ফরাসি মারা গিয়েছিল। এরপর ফার্দিন্যান্দ শত্রুপক্ষের সাথে আলোচনা আরম্ভ করেন। ততদিনে ফ্রান্স পরিণত হয়েছে প্রজাতন্ত্রে। আলোচনা কোনো ফল বয়ে আনছিল না, এদিকে ফরাসি সেনারা প্রুশিয়ানদের দুই পাশে ধীর ধীরে শক্তিবৃদ্ধি করছিল। অবশেষে সেপ্টেম্বরের ৩০ তারিখ ফার্দিন্যান্দ পিছিয়ে যান, প্যারিসের দিকে যাওয়া হবে না বুঝে তিনি ফিরতি পথ ধরলেন। গন্তব্য রাইনের ধারে প্রুশিয়ান দুর্গ। এর সাথে সাথে ফরাসী রাজপরিবারের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। তবে অস্ট্রো-প্রুশিয়ান বাহিনী ফিরে গেলেও তারা খুব শিগগিরি আবার ফিরে আসবে।