পেন্টাগন পেপার্স: যেভাবে ফাঁস হলো মার্কিন গোপন রিপোর্ট

ভিয়েতনাম যুদ্ধে যেসব মার্কিন সৈন্য মারা গিয়েছিল, তাদের গড় বয়স ছিল মাত্র ২২ বছর। এ বয়সে যেখানে একজন যুবকের বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানচর্চায় মত্ত থাকার, বন্ধুদের সাথে নিয়ে নির্বিবাদী সময় কাটানোর কিংবা অনাগত ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে একজন যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে প্রস্তুত করার কথা, সেখানে ‘গণতন্ত্র রক্ষার তাগিদে’ তাদেরকে নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে গিয়ে দিনের পর দিন যুদ্ধ করতে হচ্ছে। মার্কিন সরকারের খামখেয়ালিপনায় বেঘোরে প্রাণ হারাতে হচ্ছে ভিয়েত কংদের হাতে, নয়তো উত্তর ভিয়েতনামের বেসামরিক মানুষের উপর গণহত্যা চালানো সেনাবাহিনীর সহযোগী হতে হচ্ছে। সদ্য কৈশোর পেরোনো তরুণদের প্রতি জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের বুলি আওড়ানো মার্কিন যুদ্ধবাজ প্রশাসনের এমন অবহেলা আর নেওয়া যাচ্ছিল না কোনোভাবেই। ড্যানিয়েল এলসবার্গও নিতে পারেননি।

গশহশহডহ
ড্যানিয়েল এলসবার্গ, যিনি পেন্টাগন পেপার তৈরির পর ফাঁস করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন; Image source: undark.org

এলসবার্গ ভাবলেন, ভিয়েতনাম যুদ্ধ সম্পর্কে মার্কিন প্রশাসনের কুকীর্তিগুলো সামনে আনা দরকার। আর এটা করতে হলে পেন্টাগন পেপার্স জনগণের সামনে আনতে হবে। সে উদ্দেশ্যে তিনি মার্কিন সিনেট সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করা শুরু করলেন। কিন্তু সবাই তাকে ফিরিয়ে দিলেন। এত স্পর্শকাতর বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে কোনো সাহায্য করা সম্ভব নয়। সিনেট সদস্য হয়ে আমেরিকার এমন অতি গোপনীয় নথিপত্র জনসমক্ষে প্রকাশ করার মতন ঝুঁকি কে-ই বা আর নিতে চাইবে? কিন্তু, তারা নিজেরা সাহায্য করতে অপারগতা প্রকাশ করলেও পরামর্শ দিতে কার্পণ্য করেননি; ওয়াশিংটন পোস্ট কিংবা নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতো মার্কিন বড় বড় গণমাধ্যমে এটি প্রকাশ করার প্রস্তাব দিলেন তারা।

ড্যানিয়েল এলসবার্গও ভাবলেন, গণমাধ্যমের দ্বারা পেন্টাগন পেপার্স প্রকাশ করা উচিত। বিশ্ববিখ্যাত ও প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যমগুলো এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য হতে পারে। সেই হিসেবে তিনি যোগাযোগ করতে শুরু করলেন। বিখ্যাত পত্রিকা ‘দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর সাংবাদিক নিল শিহানের সাথে দেখা করলেন এলসবার্গ। গোপনে ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং ফাঁস হতে যাওয়া পেন্টাগন পেপার্স সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা করলেন দুজনে। সাংবাদিক নিল শিহানের সাথে আগে থেকেই পরিচয় ছিল এলসবার্গের। ১৯৬৮ সালে ভিয়েতনামে যখন কর্মরত ছিলেন, তখনই শিহানকে চিনতেন তিনি। এমনকি তাকে অনেক গোপন তথ্যও দিয়েছিলেন।

নিউ ইয়র্কের হিলটন হোটেলের একটি রুমে কয়েক সপ্তাহ ধরে চলল পেন্টাগন পেপার্স নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ-মতামত প্রদান। শিহানের সাথে হেড্রিক স্মিথ, ফক্স বাটারফিল্ডের মতো আরও কিছু জাঁদরেল সাংবাদিক যোগ দিলেন। সব মিলিয়ে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চললো পেন্টাগন পেপার্সের উপর আর্টিকেল তৈরির কাজ।

ময়ময়হজসম
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক নিল শিহান ও তার সহযোগী আরও কয়েকজন জাঁদরেল সাংবাদিকেরা মিলে পেন্টাগন পেপার্স প্রকাশের কাজে হাত দেন; image source: nytimes.com

অবশেষে সমস্ত প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ১৩ জুন, ১৯৭১ সালে প্রথম আর্টিকেল প্রকাশিত হয় পেন্টাগন পেপার্সের উপর। মার্কিন সমাজে রীতিমতো আলোড়ন শুরু হয়ে যায় আর্টিকেল প্রকাশিত হওয়ার পর। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাহসী সাংবাদিকতায় মুগ্ধ হয়ে মার্কিনীরা তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন বেকায়দায় পড়ে যান। মার্কিন প্রশাসন এতদিন ধরে জনগণের সাথে যেভাবে মিথ্যাচারিতা করে আসছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে, তা জনগণকে ক্ষিপ্ত করে তোলে।

কিন্তু যে ব্যক্তির কারণে দ্য টাইমস পেন্টাগন পেপার্সের কপি হাতে পেয়েছিল, জনগণের সামনে গোপনীয় নথিপত্রের উপর আর্টিকেল প্রকাশিত হবার পেছনে যিনি মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন, সেই ড্যানিয়েল এলসবার্গ সম্পর্কে একটু জানা যাক।

ড্যানিয়েল এলসবার্গ ছিলেন অসম্ভব মেধাবী একজন মানুষ। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে বি.এ. ডিগ্রি লাভের পর যোগ দিয়েছিলেন মার্কিন নৌবাহিনীতে। সেখান থেকে একজন বিশ্লেষক হিসেবে যোগ দেন র‍্যান্ড কর্পোরেশনে, যেটি সেসময় নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে অন্যতম থিংক ট্যাংক হিসেবে কাজ করছিল। র‍্যান্ড কর্পোরেশনে কর্মরত থাকা অবস্থায় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতির উপর পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর র‍্যান্ড কর্পোরেশন ছেড়ে মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন একজন সামরিক বিশ্লেষক হিসেবে। তাকে ভিয়েতনামে পাঠানো হয় মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে। মূলত ভিয়েতনামে অবস্থান করার সময়ই তিনি একেবারে কাছ থেকে ভিয়েতনাম যুদ্ধ পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পান, এবং তার মনে হয়েছিল, মার্কিন সেনাবাহিনীর পক্ষে এ যুদ্ধে জেতা সম্ভব নয়। পরবর্তী সময়ে তিনি আবার র‍্যান্ড কর্পোরেশনে ফিরে আসেন।

১৯৬৭ সালে মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব রবার্ট ম্যাকনামারার অনুরোধে একদল বিশ্লেষক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে একেবারে ১৯৬৮ সালের আগপর্যন্ত বিভিন্ন মার্কিন প্রশাসন যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ভিয়েতনাম সম্পর্কে– তার উপর একটি সমীক্ষা প্রস্তুত করতে শুরু করেন। প্রায় ৩৬ জন সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তির উপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, যাদের মধ্যে সামরিক বিশ্লেষক ড্যানিয়েল এলসবার্গও ছিলেন। সমীক্ষা তৈরির সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সিআইএ, মার্কিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের আর্কাইভ থেকে বিভিন্ন ডকুমেন্টের সহায়তা নেন। পুরো সমীক্ষাটির অফিসিয়াল নাম ছিল ‘রিপোর্ট অভ দ্য অফিস অভ দ্য সেক্রেটারি অভ দ্য ডিফেন্স ভিয়েতনাম টাস্ক ফোর্স’।

প্রায় ১৮ মাস সমীক্ষা তৈরির পেছনে ব্যয় করার পর দেখা যায়, সমীক্ষাটির আকার দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭,০০০ পৃষ্ঠা, যেখানে ৪,০০০ পৃষ্ঠা ছিল সরকারি নথিপত্র এবং ৩,০০০ পৃষ্ঠা ছিল ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। প্রায় ৪৭ ভলিউমের সমীক্ষাটির গায়ে ‘টপ সিক্রেট’ লেবেল লাগিয়ে পুরোপুরি গোপন রাখা হয়।

সমীক্ষা তৈরির কাজ করার সময় ড্যানিয়েল এলসবার্গ বুঝতে পারেন, মার্কিন প্রশাসন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ভিয়েতনাম ইস্যুতে প্রতিনিয়ত সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা করেছে। সমীক্ষায় দেখা যায়, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট চার্লস ডি গল তাদের ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতা থেকে আমেরিকাকে আগেই সতর্ক করেছিলেন, কিন্তু আমেরিকা তাদের কথায় কোনো ভ্রুক্ষেপ করেনি। ভিয়েতনাম যুদ্ধের পেছনে প্রত্যেক মার্কিন প্রেসিডেন্টের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির স্বার্থও জড়িত ছিল। কোনো প্রেসিডেন্টই চাচ্ছিলেন না, তাদের সময় দক্ষিণ ভিয়েতনামের পতন ঘটে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কমিউনিস্ট শাসনের গোড়াপত্তন ঘটুক।

১৯৭১ সালের ১৩ জুন, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রথম আর্টিকেল প্রকাশিত হওয়ার পরদিন পেন্টাগন পেপার্স নিয়ে দ্বিতীয় আর্টিকেলও প্রকাশিত হয়। সেই রাতেই দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের সম্পাদককে মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল জন মিচেল টেলিগ্রাম করেন। টেলিগ্রামে পত্রিকাটিকে পরবর্তী সময়ে পেন্টাগন পেপার্স নিয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ করতে নিষেধ করা হয়। এ-ও বলা হয়, সরকারি গোপন তথ্য জনসম্মুখে প্রকাশ না করার যে আইন রয়েছে, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস তা লঙ্ঘন করেছে। কিন্তু দ্য নিউইয়র্ক টাইমস পেন্টাগন পেপার্সের উপর আর্টিকেল প্রকাশনা বন্ধ করতে অস্বীকৃতি জানায়। এরপর এ পত্রিকার বিরুদ্ধে ফেডারেল আদালতে মামলা করা হয় এবং আদালত পরবর্তী সময়ে পেন্টাগন পেপার্সের উপর কোনোকিছু প্রকাশ করতে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।

মচজআজআ
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে বড় করে ছাপা হয় পেন্টাগন পেপার্সের খবর; Image source: therealnews.com

ওয়াশিংটন পোস্টের হাতে পানামা পেপার্সের কপি ছিল না, তাই তারা দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের বরাত দিয়ে আর্টিকেল প্রকাশ করত। খুব দ্রুত ড্যানিয়েল এলসবার্গ তাদেরকেও পেন্টাগন পেপার্সের এক কপি দিয়ে দেন। কিন্তু নিজেদের হাতে আসা কপির উপর আর্টিকেল প্রকাশ করার আগের রাতে তাদেরকে মার্কিন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম রেনকুইস্ট ফোন করেন এবং প্রকাশ না করতে আদেশ করেন। কিন্তু ওয়াশিংটন পোস্ট সাফ জানিয়ে দেয়, তারা প্রকাশনা চালিয়ে যাবেন এবং দরকার হলে আইনী লড়াইতেও তারা রাজি।

শেষ পর্যন্ত মামলা হয়। ১৯৭১ সালের মার্চের ২৫ তারিখে মামলার শুনানি উপস্থাপিত হয়। এরপর ৩০ জুন মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট নিক্সন প্রশাসনের বিপক্ষে গিয়ে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস ও ওয়াশিংটন পোস্টের পক্ষে একটি ঐতিহাসিক রায় দেয়, যেটি সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। এছাড়াও মার্কিন প্রশাসন এতদিন ধরে কোনো গোপন তথ্য প্রকাশনার পূর্বে নিষেধাজ্ঞা জারির যে সুবিধা পেয়ে এসেছিল, সেটিও রদ করা হয়। পুনরায় মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলো পেন্টাগন পেপার্সের উপর রিপোর্ট প্রকাশ করতে থাকে।

য়নানান
পেন্টাগন পেপার্স প্রকাশনা নিয়ে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস ও অন্যান্য সংবাদপত্রের সাথে নিক্সন প্রশাসনের যে মামলা হয়, তাতে বিচারক প্রকাশনা অব্যাহত রাখার পক্ষে রায় দেয়। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এটি ছিল একটি মাইলফলক;
Image source: lawliberty.org

প্রেসিডেন্ট নিক্সনের প্রশাসন ড্যানিয়েল এলসবার্গের বিপক্ষেও দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির মামলা চলার সময় তাকে নির্দোষ হিসেবে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।

পেন্টাগন পেপার্স প্রকাশ করার পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যেসব মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করতেন, তাদের অনেক ত্রুটি ও মিথ্যাচারিতা প্রকাশিত হয়ে পড়ে। প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন অতিমাত্রায় ভিয়েতনামের যুদ্ধে দক্ষিণ ভিয়েতনামের পক্ষে হস্তক্ষেপ করতে থাকেন, যেগুলো মূলধারার গণমাধ্যম থেকে গোপন রাখা হয়। কিন্তু পেন্টাগন পেপার্সের ফাঁস হওয়া কপির মাধ্যমে তা প্রকাশিত হয়ে পড়ে। এছাড়াও আমেরিকার নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যে ভুল সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হয়েছিল, সেগুলোও ফাঁস হয়ে যায়। মূলত পেন্টাগন পেপার্সের কারণেই পুরো আমেরিকান সমাজ ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিপরীতে অবস্থান নেয় এবং শেষ পর্যন্ত আমেরিকা ভিয়েতনাম থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।

Related Articles

Exit mobile version