১৮৩৫ সালের শীতকাল।
বার্লিনের প্রাসাদে আয়োজিত হয়েছে জমকালো এক বল নাচের অনুষ্ঠান। উপস্থিত আছেন তৃতীয় ফ্রেডেরিক উইলিয়ামের ছেলে, পরবর্তী রাজা চতুর্থ ফ্রেডেরিক উইলিয়ামের ভাই প্রিন্স উইলিয়াম। অভ্যাগতদের সাথে কুশলাদি বিনিময় শেষে তার দৃষ্টি পড়ল তরুণ দুই জার্মানের দিকে। তাদের একজন বেশ নামকরা এক আইনজ্ঞ। তিনি এগিয়ে এলেন রাজপুত্রের দিকে, তাকে অনুসরণ করলেন সাথে থাকা তরুণ ব্যক্তিটি। আইনজ্ঞ রাজপুত্রকে যথাযথ সম্মান জানিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন, তিনি অটো ভন বিসমার্ক।
উনবিংশ শতাব্দীর প্রধান রাজনীতিবিদদের তালিকা করলে জার্মানির প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ অটো ভন বিসমার্কের নাম উপরের সারিতেই থাকবে। ক্ষণজন্মা এই ব্যক্তি ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় স্বল্প সময়ের মধ্যে জার্মানিকে একীভূত করতে সক্ষম হন, যা তার পূর্বসূরিরা কয়েক দশক চেষ্টা করেও পারেননি। তার রাজনৈতিক আদর্শ আর মতবাদ নিয়ে বিতর্ক আছে, থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রুশিয়া আর জার্মান রাষ্ট্রে বিসমার্কের অবদান অনস্বীকার্য। কয়েক দশক ইউরোপের রাজনীতিতে বিসমার্কের দাপট এতটাই ছিল যে প্রুশিয়ার সমার্থক হিসেবে তার নামই হয়ে যায় দ্য আয়রন চ্যান্সেলর।
পরিবার
অটো এডওয়ার্ড লিওপোল্ড ভন বিসমার্কের জন্ম প্রুশিয়ার অন্তর্গত ব্র্যান্ডেনবার্গের শ্যেনহাউজেন অঞ্চলে। দিনটি ছিল পয়লা এপ্রিল, ১৮১৫। তিনি ছিলেন ছয় ভাইবোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। তখন ইউরোপ জুড়ে চলছে নেপোলিয়নের ১০০ দিনের যুদ্ধ।
বিসমার্কের বাবা ফার্দিন্যান্ড নিরীহ গোছের মানুষ। শ্যেনহাউজেনে ভূসম্পত্তি দেখাশোনা করাতেই তার আগ্রহ। ৩৫ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেছিলেন পটসড্যামের মেঙ্কেন পরিবারের সতের বছর বয়সি উইলহেলমিনাকে। উইলহেলমিনা দৃঢ়চেতা এবং শিক্ষিত নারী ছিলেন। তার পরিবার ছিল ব্যবসায়ী ও শিক্ষানুরাগী। উইলহেলমিনার পিতা প্রুশিয়ার কূটনৈতিক মিশনে কর্মরত। এককালে রাজার মন্ত্রিসভাতেও তিনি সচিবের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
ফার্দিন্যান্ড ছিলেন জাঙ্কার। তবে সচ্ছলতা থাকলেও ধনাঢ্য ছিলেন না তিনি। বিসমার্কের পূর্বসূরিরা ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকেই ব্র্যান্ডেনবার্গের বনেদি বংশ বলে পরিচিত। তারা লড়াই করেছেন ইউরোপের ত্রিশ বছরের যুদ্ধে ফরাসি আর সুইডিশদের পক্ষ হয়ে। রাজার প্রতি অনুগত হলেও দ্বিমত প্রকাশে তারা বিন্দুমাত্র দ্বিধা করতেন না। প্রথম ফ্রেডেরিক উইলিয়াম একবার নাকি বলেছিলেন এই বিসমার্কেরা বড় বেশি স্বাধীনচেতা।
শিক্ষা
শ্যেনহাউজেনের আলো-বাতাসে বড় হচ্ছিলেন ভবিষ্যৎ জার্মানির অন্যতম প্রবাদপুরুষ। মফস্বলের নিস্তরঙ্গ জীবন তার কাছে ভালোই লাগছিল। কিন্তু বাদ সাধলেন উইলহেলমিনা। তিনি ছেলেকে উচ্চশিক্ষিত করতে চাইলেন। বিসমার্কের বয়স তখন সাত তাকে পাঠিয়ে দেয়া হলো বার্লিনের বোর্ডিং স্কুলে। বার্লিনে তার জন্য ফ্ল্যাট, পরিচারক আর গৃহশিক্ষকের ব্যবস্থা হয়। ১৮২৭ সালে বিসমার্ক জিমনেসিয়ামে (তখনকার উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের সমতুল্য) ঢুকলেন। এখান থেকে ১৮৩২ সালে পরীক্ষায় পাশ করলেন তিনি।
ছাত্র হিসেবে বিসমার্ক ছিলেন গড়পড়তা মানের। তার সামনে পথ খোলা ছিল দুটি, একটি হলো কূটনীতিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা, অথবা সামরিক বাহিনীতে যোগ দেয়া। সেনাবাহিনীর চিন্তা বিসমার্কের মাথায় আসেইনি। ফলে তিনি মায়ের পরামর্শে কূটনীতিক পেশার দিকে ঝুঁকলেন। এই কাজে সুবিধা হবে ভেবে হ্যানোভারের গোটিংনেন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিসমার্ক আইন পড়তে গেলেন ১৮৩২ সালে। কিন্তু পড়া অসমাপ্ত রেখেই পরের বছর তিনি ফিরে আসেন।
তবে হ্যানোভারের সামাজিক বলয়ে বিসমার্ক যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। নানা আমোদপ্রমোদে সময় সেখানে তার ভালই কেটেছিল। ১৮৩৪ সালে বিসমার্ক বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হোন, পরের বছরেই তিনি সেখান থেকে রোমান এবং ক্যাথলিক আইন নিয়ে পরীক্ষা পাশ করলেন।
কর্মজীবনের সূচনা
১৮৩৫ সালের জুনে বিসমার্ক বার্লিনের নগর আদালতে জুনিয়র অফিসিয়াল হিসেবে যোগ দেন। ১৮৩৬ সালে তিনি আকিয়ান অঞ্চলে বদলি হন। তিনি ইচ্ছে করেই আকিয়ানে বদলি নেন কারণ জেলা গভর্নর কাউন্ট আর্নিম তাদের পারিবারিক বন্ধু। এখান থেকেই তিনি প্রুশিয়ান কূটনৈতিক মিশনে দায়িত্বের জন্য চেষ্টা তদবির করতে থাকলেন। তৎকালীন প্রশিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যানসিলন তাকে বললেন আগে যে কাজ তিনি এখন করছেন তার মেয়াদ শেষ করতে, এরপর শুল্ক বিভাগের মধ্য দিয়ে ঢুকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরির চেষ্টা করতে। তার কথা মেনে ১৮৩৭ সালের ডিসেম্বরে বিসমার্ক নতুন দায়িত্ব নিয়ে পটসড্যামে এলেন।
প্রুশিয়ার নাগরিকদের জন্য সামরিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক ছিল। কাজেই বাধ্য হয়ে বিসমার্ক ১৮৩৮ সালের মার্চে সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন। এই সময় তিনি ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশ ছিলেন, তার মাথায় ঘুরছিল বাড়ির নির্বিবাদ জীবন। তিনি চাইছিলেন কোনো ছুতোয় শ্যেনহাউজেনে চলে যেতে।
১৮৩৮ সালের জানুয়ারিতে বিসমার্কের মা মারা যান। সেপ্টেম্বরে বাবার দেখাশোনা করার কথা বলে বিসমার্ক সেনাবাহিনী থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে আসেন। পরের বছর সরকারি চাকরি থেকেও ইস্তফা দেন।১৮৪০ সালে ফার্দিন্যান্ড সন্তানদের মধ্যে সম্পত্তি ভাগ করে দেন। বিসমার্ক নিজের অংশ খেটেখুটে লাভজনক করে তোলেন।
রাজনীতির হাতেখড়ি
শ্যেনহাউজেনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ক্রমেই জড়িয়ে পড়তে থাকেন বিসমার্ক। ১৮৪৫ সালে বাবা মারা যাবার পর থেকে তিনি রাজনীতিতে আরো বেশি মনোযোগ ঢেলে দিলেন। তার রাজনৈতিক আদর্শ ছিল রক্ষণশীল। বিসমার্ক দ্রুতই এলাকায় গণ্যমান্য ব্যক্তিতে পরিণত হন। ১৮৪৭ সালে রাজা যখন ইউনাইটেড ডায়েটের ঘোষণা দেন তখন সেখানে আঞ্চলিক প্রতিনিধি নির্বাচনে বিসমার্কের নামও উঠে এসেছিল। তবে শেষ অবধি ব্রশিতজ নাম আরেক ব্যক্তি প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। বিসমার্ককে বিকল্প হিসেবে রাখা হয়।
খ্রিষ্টধর্মের প্রতি বিসমার্কের খুব বেশি আকর্ষণ ছিল না। ষোল বছর বয়সে একবার তিনি নিজেকে নাস্তিক দাবি করেছিলেন। কিন্তু এই সময় তার মধ্যে পরিবর্তন আসে মারিয়া ভন থ্যাডেন আর মরিতজ ভন ব্ল্যাঙ্কেনবার্গ নামে দুই ব্যক্তির সংস্পর্শে এসে। তিনি অত্যন্ত ধার্মিক হয়ে ওঠেন। তাদের মাধ্যমে তার সাথে অভিজাত পরিবারের সদস্য জোয়ানা ভন প্যাটমেকারের পরিচয় হয়। ১৮৪৭ সালের ২৮ জুলাই জোয়ানাকে তিনি বিয়ে করেন। বিসমার্কের দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল এবং আমৃত্যু তিনি স্ত্রীর সাথে ছিলেন।
বিয়ের ঠিক আগে আগেই মে মাসে বিসমার্কের কাছে ইউনাইটেড ডায়েটে যাবার ডাক আসে, কারণ ব্রশিতজ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এখানে ১৭ মে, ১৮৪৭ সালে প্রুশিয়ান জাঁদরেল রাজনীতিবিদরা প্রথম বিসমার্কের দেখা পেলেন। তবে এই বিসমার্ক কট্টর ধর্মঘেঁষা ব্যক্তি। নিজের ভাষণে তিনি তীব্রভাবে লিবারেল মতাদর্শকে আক্রমণ করেন এবং রাজার প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য ঘোষণা করেন। লিবারেলদের বিরুদ্ধে চাঁছাছোলা কথা বলায় আইনসভাতে বিসমার্কের বিপক্ষে তুমুল শোরগোল সৃষ্টি হল, তবে রক্ষণশীল গোষ্ঠী তাকে বুকে টেনে নেয়।
ইউনাইটেড ডায়েটে প্রতিপদে বিসমার্ক লিবারেলদের সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়তে থাকেন। সরকারের প্রতি তার সমর্থন অবশ্য তাকে রাজপুত্র উইলিয়ামের কাছে প্রিয় করে তোলে। তবে ফ্রেডেরিক উইলিয়াম নিজে বিসমার্ককে উগ্রপন্থি রক্ষণশীল ঝামেলাবাজ মনে করতেন। তবে ভেনিসে বিসমার্কের মধুচন্দ্রিমাতে তার সাথে রাজার দেখা হলে তিনি বিসমার্কের কার্যক্রমের প্রতি নিজের সমর্থন জানান।
বিসমার্ক এবং ১৮৪৮ সালের বিপ্লব
মার্চ ১৯, ১৮৪৮।
বার্লিনে গোলযোগের খবর শ্যেনহাউজেনে এসে পৌঁছল। বিপ্লবীদের সাথে সরকারি বাহিনীর সংঘর্ষের খবর পেয়ে বিসমার্ক যুগপৎ উদ্বিগ্ন এবং রাগান্বিত বোধ করলেন। সেনারা কেন গোলা মেরে বিপ্লবীদের শায়েস্তা করছে না ভেবে বিসমার্ক কূলকিনারা করতে পারলেন না। তিনি যখন জানতে পারলেন রাজা সেনাদের বার্লিন থেকে চলে যেতে বলেছেন তিনি ধরেই নিলেন বিপ্লবীরা রাজাকে জিম্মি করে তাকে চাপ দিয়ে এ কাজ করেছে। অবিলম্বে বিসমার্ক ফয়সালা করলেন আশেপাশ থেকে লোকজন সংগ্রহ করে বার্লিনে গিয়ে নিজেই বিপ্লবীদের সাথে লড়াই করে রাজাকে উদ্ধার করবেন।
প্রাথমিক পদক্ষপে হিসেবে পরিস্থিতি সরেজমিনে পর্যালোচনা করতে বিসমার্ক বার্লিনের নিকটবর্তী পটসড্যামে উপস্থিত হন। এখানে বন্ধু আলবার্ট ভন রুনের সাথে তার কথা হয়। রাজনৈতিক মতাদর্শে তারা একই পথের পথিক ছিলেন। দুই বন্ধু একমত হলেন বিপ্লবীদের পিষে ফেলতে একজন যোগ্য ব্যক্তির নেতৃত্ব দরকার। তাদের মাথায় প্রথম যে নাম আসল তা রাজপুত্র উইলিয়ামের।
দুই বন্ধু উইলিয়ামকে খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু তিনি কোথাও নেই। গুঞ্জন ছিল তিনি দেশত্যাগ করেছেন। ফলে বিসমার্ক দেখা করলেন উইলিয়ামের স্ত্রী অগাস্টার সাথে। তার সাথে আলোচনা ফলপ্রসূ হলনা। অগাস্টা বিসমার্ককে তার স্বামীর নাম ব্যবহার করে হঠকারী কিছু করতে কঠোরভাবে নিষেধ করলেন। অনেকে মনে করেন অগাস্টা লিবারেল গোষ্ঠীর সাথে সমঝোতায় পৌঁছেছিলেন যে ফ্রেডেরিক উইলিয়াম সিংহাসন ত্যাগ করবেন এবং রাজপুত্র উইলিয়ামও ক্ষমতার দাবি ছেড়ে দেবেন। বিনিময়ে উইলিয়ামের শিশুপুত্র সিংহাসনে বসবে, তার রিজেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেবেন অগাস্টা। বিসমার্ক নাকি এই পরিকল্পনা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। তবে যা-ই হোক না কেন, তাদের মধ্যে এখান থেকে যে শীতল সম্পর্কের সূচনা হলো তা বজায় ছিল সারাজীবন।
মার্চের ২৫ তারিখ রাজা পটসড্যামে উপস্থিত হয়ে সেনাদের শান্ত থাকার আদেশ দিলে বিসমার্কের মোহভঙ্গ হয়। ফ্রেডেরিক তো জিম্মি নন, দিব্যি যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। হতাশ বিসমার্ক শ্যেনহাউজেন ফেরত এলেন।
সংসদে বিসমার্ক
প্রুশিয়ার দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ প্রবর্তন হলে বিসমার্ক ১৮৪৯ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে নিম্নকক্ষের একটি আসনে জিতে এলেন। এপ্রিলে যখন ফ্রেডেরিক ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি’র কাছ থেকে জার্মান সম্রাট হবার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন বিসমার্ক তখন রাজাকে সমর্থন করলেন। তিনি দাবি করলেন ফ্রাঙ্কফুর্টের লিবারেল ডায়েটের কাছ থেকে কিছু গ্রহণ করা মানে প্রুশিয়ার সিংহাসনের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা। বিসমার্কের মত ছিল প্রুশিয়ার একার পক্ষেই জার্মানিকে একত্রিত করা সম্ভব, এজন্য লিবারেলদের সিলছাপ্পড় লাগবে কেন। কিছুদিন পর রাদোভিতজ প্ল্যান প্রকাশিত হলে বিসমার্ক সেটারও বিরোধিতা করলেন। এর মূল কারণ ছিল এই পরিকল্পনায় অস্ট্রিয়ার প্রধান ভূমিকা। বিসমার্ক বিশ্বাস করতেন অস্ট্রিয়াকে ছাড়াই জার্মান রাষ্ট্রকে দাঁড়া করাতে হবে।
কনফেডারেট ডায়েট
অল্মুটজের চুক্তির পর জার্মান কনফেডারেশন পূর্ববৎ অবস্থায় ফেরত গেল। প্রুশিয়ার জন্য অপমানজনক এই ঘটনার পর ফ্রাঙ্কফুর্টের কনফেডারেট ডায়েটে প্রতিনিধি পাঠানোর বিষয় সামনে চলে আসে। অল্মুটজে অস্ট্রিয়ার সামনে প্রুশিয়ার অসহায় আত্মসমর্পণের পর কেউই এই দায়িত্ব নিতে রাজি হচ্ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে বিসমার্কের বন্ধু এবং রাজার ঘনিষ্ঠ সহকারী লুদ্ভিগ ভন গারলেখ তার নাম প্রস্তাব করলেন। বিসমার্কের মত অনভিজ্ঞ কাউকে কনফেডারেট ডায়েটের মত গোলমেলে জায়গাতে পাঠাতে ফ্রেডেরিক উইলিয়াম প্রথমে রাজি ছিলেন না। কিন্তু কোনো বিকল্প না থাকায় তাকে রাজি হতে হলো। সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে প্রুশিয়ান দূত ভন রশোকে সাময়িকভাবে বিসমার্কের সাথে ফ্রাঙ্কফুর্ট পাঠানো হয়, উদ্দেশ্য তার ছত্রছায়ায় বিসমার্ককে কূটনীতি শেখানো।
কনফেডারেট ডায়েটে বিসমার্ক কাজেকর্মে অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে প্রুশিয়ার হারানো মর্যাদা পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হন। তিনি শিষ্টাচার বজায় রেখে তাদের প্রস্তাবের সমালোচনা করতেন এবং প্রুশিয়ান অবস্থানকে গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরতেন। বার্লিনে সরকারকে তিনি প্রভাবিত করতে চেষ্টা করেন যাতে প্রুশিয়া রাশিয়া আর ফ্রান্সের সাথে মৈত্রীজোট গঠন করে। তিনি বুঝেছিলেন এর ফলে অস্ট্রিয়ার উপর আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি করা সম্ভব। তিনি জার্মান শুল্ক অঞ্চলের মাধ্যমে অস্ট্রিয়ার উপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টিরও পরামর্শ দেন।
১৮৫১ সালের ১৫ জুলাই বিসমার্ককে ফেডারেল/কনফেডারেট ডায়েটে প্রুশিয়ান মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হল। ভন রশো ফিরে গেলেন রাশিয়াতে। ২৭ আগস্ট থেকে ফ্রাঙ্কফুর্টে বিসমার্ক একাই কাজ চালাতে আরম্ভ করেন। প্রুশিয়ার আর অস্ট্রিয়া যে সমপর্যায়ে তা দেখাতে তিনি অদ্ভুত এক রাস্তা বেছে নেন। এক সভায় অস্ট্রিয়ান প্রতিনিধি থুন শার্ট পড়ে উপস্থিত হলে বিসমার্ক তার জ্যাকেট খুলে ফেলেন। থুন যখন সিগার জ্বালালেন, বিসমার্কও নিজের একটি সিগার বের করে তার কাছেই দেয়াশলাই চেয়ে বসেন। হাস্যকর মনে হলেও বিসমার্কের কাজ ছোট ছোট রাজ্যগুলোর প্রতিনিধিদের সামনে প্রুশিয়ার অবস্থান উচ্চ করে।
জার্মান শুল্ক অঞ্চল নিয়ে আলোচনা
প্রুশিয়ার সাথে জার্মান রাষ্ট্রগুলোর যে শুল্ক অঞ্চল তৈরি হয়েছিলে তা সব রাজ্যের অর্থনীতিকেই বেগবান করে। অস্ট্রিয়া এখানে প্রবেশের দাবি জানিয়ে বসে। তারা চাচ্ছিল তাদের দ্রব্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা। বিসমার্কের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না লাভজনক এই কাস্টমস ইউনিয়নে তাদের প্রবেশের সুযোগ দেবার। প্রথমে সরাসরি তাদের অনুরোধ বাতিল না করে তিনি টালবাহানা করতে থাকেন। অস্ট্রিয়ার ভেতরে ব্যবসায়ী আর সরকারের আলোচনা তাকে সময় পাইয়ে দেয়।
আলোচনা চলাকালিন সময়েই ১৮৫১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর হ্যানোভার, অল্ডেনবার্গ আর শমবার্গ-লিপ্পে অঞ্চলের সাথে চুক্তির মধ্য দিয়ে তারাও প্রুশিয়ার কাস্টমস ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত হলো। ১৮৫২ সালের শুরুতে ভিয়েনার এক সম্মেলনে অস্ট্রিয়া জার্মান কাস্টমস ইউনিয়নে তাদের প্রবেশাধিকারের পক্ষে ছোট ছোট জার্মান রাষ্ট্রগুলির সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চালায়। এটা ছিল তাদের মিটেলইউরোপা (Mitteleuropa /মধ্য ইউরোপ) পরিকল্পনার অংশ। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল জার্মান কাস্টমস ইউনিয়ন ব্যবহার করে মধ্য ইউরোপে একটি লাভজনক শুল্কমুক্ত বাণিজ্যিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, যার নাটাই থাকবে অস্ট্রিয়ার হাতে।
যদিও ছোট দেশগুলো প্রুশিয়ার ব্যাপারে খুব নিঃসন্দেহ ছিল না, তথাপি প্রুশিয়ার সাথে তাদের অর্থনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকায় তারা প্রকাশ্যে অস্ট্রিয়ার পক্ষাবলম্বনে বিরত থাকে। অবশেষে ফ্রাঙ্কফুর্টের ডায়েটে রাজার অনুমোদনে বিসমার্ক অস্ট্রিয়ার প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাখ্যান করেন।যদি অস্ট্রিয়ার প্রস্তাব অন্যান্য রাষ্ট্রগুলি মেনে নেয়, তিনি হুঁশিয়ার করেন, তাহলে প্রুশিয়া ডায়েট থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেবে। একইসাথে অস্ট্রিয়ার উত্থাপিত সংবাদপত্রের উপর কড়া সেন্সরশিপ আরোপের আইনেরও তিনি বিরোধিতা করলেন। যদিও ডায়েটের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য অস্ট্রিয়ার পক্ষে ছিলেন, কিন্তু তাদের প্রস্তাব পাশে দরকার ছিল নিরঙ্কুশ সমর্থন। বিসমার্কের বিরোধিতায় তারা সেটা অর্জন করতে ব্যর্থ হলো।
কাছাকাছি সময়ে থুনের জায়গাতে সাময়িকভাবে অস্ট্রিয়ার প্রতিনিধি হয়ে এলেন প্রকেশ। তিনি যতটা ভাল অ্যাকাডেমিক, ঠিক ততটাই বাজে কূটনীতিক। ফলে তাকে সহজেই বুঝিয়ে সুঝিয়ে বিসমার্ক এমন সব আইন পাশ করিয়ে নেন যাতে ডায়েটের প্রশাসনিক কাজে প্রুশিয়ার অংশগ্রহণের সুযোগসুবিধা বৃদ্ধি পায়।
ক্রিমিয়ান যুদ্ধ এবং প্রুশিয়ার অবস্থান
১৮৪৩ সালে জেরুজালেমে খ্রিষ্টান নাগরিকদের অধিকার নিয়ে রাশিয়ার সাথে অটোমান সাম্রাজ্য, সার্ডিনিয়া, ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডের লড়াই শুরু হয়। এই যুদ্ধ ক্রিমিয়ান ওয়ার নামে পরিচিত। রাশিয়ান সেনারা দানিয়ুব নদী ধরে অভিযান চালাতে থাকলে অস্ট্রিয়া সেখানে তাদের স্বার্থের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। রাশিয়ার দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিতে এসময় তারা জার্মানিতে প্রুশিয়ার সাথে কোনো বিবাদে জড়াতে চায়নি। তারা পরিকল্পনা করছিল প্রয়োজনে রাশিয়ার বিরুদ্ধ জোটে যোগ দেবার। তাদের ভয় ছিল প্রুশিয়া যদি তখন রাশিয়ার সাথে হাত মেলায় তাহলে অস্ট্রিয়া বেকায়দায় পড়ে যাবে। ফলে তারা চাইছিল প্রুশিয়াকে যেভাবেই হোক খুশি রাখতে।
বিসমার্ক সব বুঝতে পেরে পরিকল্পনা করলেন পুরো জার্মানিকে এই যুদ্ধের বাইরে রাখবার।প্রকাশ্যেই তিনি এই নীতি ঘোষণা করলেন। যেহেতু তারা অস্ট্রিয়ার সাথে যোগ দিচ্ছেন না তাই রাশিয়া তার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাল। বিসমার্ক তাদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠলেন যা পরে তার কাজে লেগেছিল। একইসাথে অস্ট্রিয়াকে চাপ দিয়ে ডায়েটে নানা সুবিধা আদায়ের চেষ্টাও তিনি অব্যাহত রাখলেন। ১৮৫৪ সালে ভন গারলেখকে লেখা চিঠিতে তিনি ক্রিমিয়ান যুদ্ধে নিরপেক্ষতার গুরুত্বের ব্যাপারে জোর দেন। কিন্তু তারপরেও ১৮৫৪ সালের এপ্রিলের ২০ তারিখ প্রুশিয়া অস্ট্রিয়ার সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল তাদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা।
অস্ট্রিয়া চাইছিল এই চুক্তির জোরে প্রুশিয়া এবং জার্মান রাষ্ট্রগুলোকে রাশিয়ার বিপক্ষে নামিয়ে দেবে। ১৮৫৫ সালের জানুয়ারিতে তারা সেই লক্ষ্যে অস্ট্রিয়ার স্বপক্ষে জার্মান কনফেডারেশন বাহিনী গঠনের অনুরোধ করে।তাদের ইচ্ছা ছিল এই বাহিনী রাশিয়ার সাথে তাদের হয়ে লড়াই করবে। ছোট ছোট জার্মান রাষ্ট্রগুলো সরাসরি অস্ট্রিয়াকে মানা করার সাহস রাখত না। ফলে বিসমার্ক তাদের দিয়ে একটি ঘোষণাপত্র প্রকাশ করলেন, যেখানে তারা নিরপেক্ষতা বজায় রেখে যেকোনো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার অঙ্গীকার করে। ফলে অস্ট্রিয়া যা চাইছিল, রাশিয়ার বিরুদ্ধে জার্মানির অস্ত্রধারণ, সেই পরিকল্পনা বিসমার্কের কথার মারপ্যাঁচে কেঁচে গেল। শেষ পর্যন্ত জার্মানি ক্রিমিয়ান যুদ্ধে নিরপেক্ষই থাকল।
বিসমার্ক এই বেলা অস্ট্রিয়াকে কূটনীতির মাঠে হারিয়ে দিলেও তিনি বুঝতে পারলেন জার্মানি প্রুশিয়ার নেতৃত্বে একত্রিত হবার জন্য প্রস্তুত নয়, এখনো অস্ট্রিয়াই এখানে বড় খেলোয়াড়। প্রুশিয়াকে সবাই বিশ্বাসও করে না। তিনি অনুধাবন করলেন অস্ট্রিয়াকে সরিয়ে রেখে জার্মানিকে একতাবদ্ধ করতে হলে ইউরোপিয়ান রাজনীতিকে ব্যবহার করতে হবে।