গ্রিস ছেড়ে ভূমধ্যসাগরের আকাশে প্রবেশ করার কিছুক্ষণের মধ্যেই ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর দুটি এফ-১৫ যুদ্ধ বিমানের রাডারে ধরা পড়ল ফিলিস্তিনি যাত্রীবাহী ডিএইচএফ-৫ বাফেলো প্লেনটি। রাডারের বিপ বিপ শব্দ কানে আসা মাত্রই ফাইটার দুটো দিক ঘুরিয়ে রওনা দিল সোজা প্লেনটির উদ্দেশ্যে। কাছাকাছি যেতেই দৃষ্টিগোচর হলো প্লেনটির লেজের নীল ও বাদামী বর্ণের প্রতীক এবং সিরিয়াল নাম্বার। কোনো সন্দেহ রইল না এটিই সেই প্লেন, গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী যার মাঝে আছেন ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগ্রামের নেতা ইয়াসির আরাফাত। পাইলট দুজনের মধ্যে যিনি সিনিয়র, তিনি রেডিওতে যোগাযোগ করলেন বিমান বাহিনীর কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টারে। শেষবারের মতো জানতে চাইলেন, “আমরা কি প্লেনটি ধ্বংস করব?”
ঘটনাটি ১৯৮২ সালের ২৩ অক্টোবর বিকেল বেলার। ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর কমান্ডার ইন চীফ, মেজর জেনারেল ডেভিড ইভরি বসে আছেন রজধানী তেল আবিবের কেন্দ্রে, বিমান বাহিনীর ভূগর্ভস্থ প্রধান কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টারে, যার ছদ্মনাম ক্যানারি। এফ-১৫ ফাইটার প্লেনের পাইলট যখন আরাফাতকে বহন করা বিমান ধ্বংস করার অনুমতি চাইলেন, তখন তার কন্ঠস্বর গমগম করে উঠল ক্যানারির লাউড স্পীকারে। সবাই ঘুরে তাকাল ইভরির দিকে। সবাই নিশ্চিত ছিল, তিনি সাথে সাথেই অনুমতি দিবেন। কিন্তু মেজর জেনারেল ইভরি, যার এমনিতে যেকোনো জটিল বিষয়ে তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিতে পারার ব্যাপারে সুখ্যাতি আছে, সেদিন সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে গেলেন।
ইভরি জানতেন, হামলা করার জন্য যা যা দরকার, তার সবই তাদের কাছে আছে। তাদের গোয়েন্দারা সরাসরি দেখে নিশ্চিত হয়েছে যে, ইয়াসির আরাফাত ঐ প্লেনেই উঠেছেন। হামলা লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার কিংবা এতে অন্য কারো ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, কারণ বিশাল ভূমধ্যসাগরের জলরাশির উপর এই প্লেনটিই একমাত্র এবং পরিষ্কার টার্গেট। তাছাড়া সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, হামলার নির্দেশ এসেছে স্বয়ং ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী (পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী) এরিয়েল শ্যারনের কাছ থেকে।
বিমান বাহিনীর কাজ শুধু নির্দেশ অনুযায়ী বিমান আক্রমণ করা, তাতে ফলাফল কী হবে সেটা বিবেচনা করা তাদের দায়িত্ব না। কাজেই ইভরির পক্ষে স্বাভাবিক ছিল সম্মতিসূচক নির্দেশ দেওয়া। কিন্তু তার মনের মধ্যে কোথায় যেন একটু অস্বস্তি কাজ করছিল। তিনি রেডিও হাতে তুলে নিলেন। পাইলটদেরকে উদ্দেশ্যে করে বললেন,
নেগেটিভ! আই রিপিট, নেগেটিভ অন ওপেনিং ফায়ার।
ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগঠন, পিএলও’র চেয়ারম্যান ইয়াসির আরাফাতকে হত্যার এই পরিকল্পনাটি মাত্র আগের দিনই প্রস্তুত করেছিল ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। সে সময় পিএলও-তে মোসাদের দু’জন গুপ্তচর নিযুক্ত ছিল। তাদের কাছ থেকে মোসাদ সংবাদ পায়, ২৩ তারিখ বিকেলে ইয়াসির আরাফাত একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন বিমানে চড়ে গ্রিস থেকে মিসরের উদ্দেশ্যে রওনা দিবেন। দীর্ঘদিন ধরেই ইসরায়েল ইয়াসির আরাফাতকে হত্যা করার সুযোগ খুঁজছিল। এ তথ্য পাওয়া মাত্রই তারা কাজে লেগে গেল।
মোসাদের মধ্যে যে বিভাগটি নির্দিষ্ট ব্যক্তিদেরকে হত্যার দায়িত্বে নিযুক্ত, তার নাম সিজারিয়া। আরাফাতের অবস্থান জানার সাথে সাথেই সিজারিয়ার পক্ষ থেকে দুজন এজেন্টকে গ্রীসে পাঠিয়ে দেওয়া হলো আরও বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করার জন্য। সে সময় এথেন্স এয়ারপোর্টের নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুব একটা মজবুত ছিল না। এজেন্ট দুজন প্রায় বিনা বাধায় ব্যক্তি মালিকানাধীন প্লেনগুলো যেখানে পার্ক করা থাকে, সেখানে পৌঁছে যায়। আরাফাত ঠিক কোন প্লেনটিতে ওঠে, তা নিশ্চিত করার জন্য তারা সেখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।
ওদিকে তেল আবিবে এরিয়েল শ্যারন তার অধীনে থাকা ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্সের (আইডিএফ) চিফ অফ স্টাফ, লেফটেন্যান্ট জেনারেল রাফায়েল এইতানকে ক্রমাগত চাপ দিয়ে যাচ্ছিলেন আরফাতকে হত্যার মিশন যেন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়, তা নিশ্চিত করার জন্য। রাফায়েল এইতানের নির্দেশে ইসরায়েলি বিমান বাহিনী, তেল নোফ বিমান ঘাঁটিতে তাদের দুটি এফ-১৫ ফাইটার জেটকে প্রস্তুত করে রাখে, যেন সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথেই তারা যাত্রা শুরু করতে পারে।
বিমান বাহিনীর কমান্ডার ইন চীফ ডেভিড ইভরির সব সময়ই সাবধানী এবং সচেতন কর্মকর্তা হিসেবে খ্যাতি ছিল। তিনি জানতেন যদি ভুলক্রমে আরাফাত নেই, এরকম কোনো যাত্রীবাহী বিমান ধ্বংস করে দেওয়া হয়, তাহলে সেই ঘটনার রাজনৈতিক প্রভাব কতটা ভয়াবহ হতে পারে। কাজেই তিনি নিজে গিয়ে পাইলট দুজনের সাথে কথা বললেন। তিনি তাদেরকে স্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ দিলেন,
আমার সম্মতি ছাড়া তোমরা আক্রমণ করবে না। পরিষ্কার? এমনকি, যদি যোগাযোগ ব্যবস্থায় সমস্যা হয়, যদি তোমরা আমার নির্দেশ শুনতে না পাও, তাহলেও তোমরা আক্রমণ করবে না।
২৩ তারিখ দুপুর ২টা ৫ মিনিটে এথেন্স থেকে সিজারিয়া এজেন্টদের একজন মোসাদের হেডকোয়ার্টারে ফোন করল। সে জানাল, তারা ইয়াসির আরাফাতকে সনাক্ত করেছে। তার বর্ণনা অনুযায়ী আরাফাত তখন তার সঙ্গীসাথী সহ একটি ডিএইচসি-৫ বাফেলো বিমানে চড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ফাইটার জেটের পাইলটরা যেন সহজে প্লেনটিকে সনাক্ত করতে পারে, সেজন্য সে প্লেনটির লেজের নীল এবং বাদামী বর্ণের প্রতীকের বিবরণ এবং এতে লেখা রেজিস্ট্রেশন নাম্বারটিও জানিয়ে দিল। তার দেওয়া তথ্য মোসাদ সাথে সাথে বিমান বাহিনীর কন্ট্রোল সেন্টার, ক্যানারিতে পাঠিয়ে দিল।
অভিজ্ঞ বিমান বাহিনী প্রধান ডেভিড ইভরি কিন্তু এত সহজে নিশ্চিত হতে পারলেন না। তার মনের মধ্যে সন্দেহ উঁকি দিয়ে যেতে লাগল। তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না, ঐ সময়ে আরাফাত কেন মিসরে যাবেন? গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী সে সময়ে আরাফাতের গ্রীসে বা মিসরে যাওয়ার মতো কারণ ঘটেনি। তাছাড়া যদি গিয়েও থাকেন, তাহলেও তিনি কেন বাফেলো বিমানে চড়বেন? তার মতো পদমর্যাদার একজন ব্যক্তির জন্য বাফেলো বিমানগুলো মোটেও সম্মানজনক ছিল না।
সন্তুষ্ট হতে না পেরে ইভরি আবারও তথ্য নিশ্চিত করতে নির্দেশ দিলেন। সিজারিয়ার এজেন্ট দুজন আবারও জানাল, তারা সম্পূর্ণ নিশ্চিত, প্লেনে চড়া ব্যক্তি ইয়াসির আরাফাতই। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, গোয়েন্দাদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য আরাফাত লম্বা দাড়ি রেখেছেন, কিন্তু তারপরেও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল, তিনি আরাফাত ছাড়া অন্য কেউ নন।
বিকেল ৪টা ৩০ মিনিটে সিজারিয়া এজেন্টরা মোসাদ হেডকোয়ার্টারে ফোন করে জানাল, আরাফাতকে বহনকারী প্লেনটি আকাশে উড়েছে। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই ইভরি প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধান রাফায়েল এইতানের কাছ থেকে সরাসরি নির্দেশ পেলেন, “ধ্বংস করে দাও প্লেনটি।” ইভরি তার পাইলটদেরকে উড়তে নির্দেশ দিলেন। কিন্তু তার সন্দেহ তখনও দূরীভূত হয়নি। তিনি আবারও ফোন করলেন মোসাদের কাছে। তাদেরকে বললেন, ভিন্ন কোনো উৎস থেকে নিশ্চিত করতে যে, ঐ ব্যক্তি আসলেই আরাফাত, তার মতো দেখতে অন্য কেউ না।
ইভরি পাইলটদের মানসিক অবস্থার কথা জানতেন। তিনি জানতেন, এরকম মুহূর্তে ফাইটার প্লেনের পাইলটরা যেকোনো অযুহাতে মিসাইল নিক্ষেপের জন্য উদগ্রীব থাকে। রেডিওতে সামান্য শব্দ হলেও তারা সেটাকেই সম্মতি হিসেবে ধরে নিতে চায়। তাই উড়তে নির্দেশ দেওয়ার পরেও তিনি আবার তাদের সাথে যোগাযোগ করে স্মরণ করিয়ে দিলেন, যেন তারা কোনো অবস্থাতেই তার পরিষ্কার নির্দেশের আগে আক্রমণ না করে।
এদিকে রাফায়েল এইতান, মোসাদ এবং সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী, ‘আমান’ বারবার ইভরির কাছে ফোন করে খোঁজ নিচ্ছিল, অপারেশনের অগ্রগতি কতটুকু? যদিও সিজারিয়ার এজেন্টরা তাদের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করেছিল, কিন্তু ইভরি তাদেরকে বলছিলেন যে, তখনও নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যায়নি আসলেই প্লেনে আরাফাত আছেন কিনা। ঠিক এরকম সময় স্পীকারে পাইলটের কন্ঠস্বর ভেসে আসে যে, তারা বাফেলো প্লেনটির দেখা পেয়েছেন। কিন্তু ইভরি তখনও দ্বিতীয় উৎস থেকে নিশ্চয়তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তাই তিনি আক্রমণ না করার জন্য নির্দেশ দিলেন।
ইভরির পক্ষে আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না। তার উপর আইডিএফ প্রধান রাফায়েল এইতান এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী এরিয়েল শ্যারনের সরাসরি নির্দেশ ছিল প্লেনটি ধ্বংস করার জন্য। তিনি যদি তা না করেন, তাহলে তাকে কঠিন জবাবদিহিতার মুখামুখি হতে হবে। ইভরি যখন কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না, ঠিক তখন বিকেল ৫টা বাজে ক্যানারির একটি ফোন বেজে উঠল। এটি ছিল সরাসরি মোসাদের হেডকোয়ার্টারের সাথে সংযুক্ত একটি সুরক্ষিত লাইন।
ইভরি ফোন রিসিভ করলেন। অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এল গম্ভীর কিন্তু বিব্রত একটি কন্ঠস্বর। জানানো হলো, মোসাদ ভিন্ন একটি উৎস থেকে নিশ্চিত করেছে যে, ইয়াসির আরাফাত আসলে গ্রিসেই যাননি। কাজেই যে ব্যক্তি প্লেনে উঠেছেন, তিনি আরাফাত হতে পারেন না। সম্ভবত তিনি একই চেহারার অন্য কেউ। ইভরি বাফেলো বিমানটিকে অনুসরণ করতে থাকা পাইলটদেরকে জানালেন, তারা যেন আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে।
৫টা ২৩ মিনিটে আরেকটি রিপোর্ট এল ক্যানারিতে। মোসাদের দ্বিতীয় আরেকটি উৎস এবং আমানের একটি উৎস পৃথক পৃথক ভাবে নিশ্চিত করল, প্লেনে চড়া ব্যক্তি আসলে ইয়াসির আরাফাতের ভাই ফাতহি আরাফাত। ফাতহি ছিলেন একজন ডাক্তার এবং ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা। সেদিন তিনি ৩০ জন শিশুকে সাথে করে গ্রিস থেকে মিসরে যাচ্ছিলেন তাদের চিকিৎসার জন্য, যারা মাত্র এক মাস আগে লেবাননের সাবরা-শাতিলা শরণার্থী শিবিরে খ্রিস্টানদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যা থেকে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল, কিন্তু আহত হয়েছিল গুরুতরভাবে।
চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা ছেড়ে দিলেন ইভরি। তার আশঙ্কাই শেষ পর্যন্ত সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। একাধিকবার সতর্কভাবে তথ্য যাচাই করার নির্দেশ না দিলে এটা হতে পারত ইসরায়েলের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ভুলগুলোর মধ্যে একটি। আহত শিশুতে পরিপূর্ণ প্লেনকে মিসাইল দিয়ে ধ্বংস করলে বিশ্বব্যাপী তার প্রবল বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারত। ইভরি শেষবারের মতো যোগাযোগ করলেন এফ-১৫ পাইলটের সাথে। তাদেরকে নির্দেশ দিলেন, “ফিরে এসো। ঘরে ফিরে এসো।”
Israel’s security forces tried for decades to kill the Palestinian leader Yasir Arafat. Now, former officials tell the story of how they failed — and how far they almost went to succeed. https://t.co/ohxhkxVsct
— The New York Times (@nytimes) January 24, 2018
ইয়াসির আরাফাতকে হত্যা করার এটাই একমাত্র বা প্রথম ইসরায়েলি প্রচেষ্টা ছিল না। এর আগে পরে অনেক বারই তাকে হত্যার চেষ্টা করেছে ইসরায়েল। আরাফাতকে হত্যাচেষ্টার এসব পরিকল্পনা এবং সেগুলো থেকে আরাফাত কীভাবে বারবার রক্ষা পেয়েছেন, তা বিস্তারিত উঠে এসেছে সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত সাংবাদিক রনেন বার্গম্যানের একটি সুদীর্ঘ প্রবন্ধে। এই প্রবন্ধটি তার প্রকাশিতব্য বই “Rise and Kill First: The Secret History of Israel’s Targeted Assassinations” এর একটি অধ্যায়।
ইসরায়েল ভিত্তিক সাংবাদিক রোনান বার্গম্যান এ পর্যন্ত ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা এবং প্রতিরক্ষা বিভাগের শত শত কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এবং হাজার হাজার গোপন নথিপত্র দেখেছেন। তার নিজের ভাষায়, এসব নথিপত্রে ইসরায়েলের ইতিহাসের এমন এক গোপন দিকের সন্ধান পাওয়া যায়, যা এমনিতেই ভয়ংকর হিসেবে খ্যাতি অর্জন করা ইসরায়েলের জন্যও আশ্চর্যজনক। ইসরায়েল রাষ্ট্রটিকে টিকিয়ে রাখতে গিয়ে এর কর্মকর্তারা যে পরিমাণ হত্যা এবং গুপ্তহত্যা করেছেন, তা ইউরোপের যেকোনো রাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে গেছে। অনেক সময়ই তারা এসব পরিকল্পনা এবং এগুলোর বাস্তবায়ন করেছেন বেসামরিক জনগণের ক্ষয়ক্ষতির তোয়াক্কা না করেই।
তবে বার্গম্যান এটাও উল্লেখ করেন, সবসময়ই যে তাদের কর্মকর্তারা একচেটিয়াভাবে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এমন না। তাদের মধ্যে অনেক সময়ই অভ্যন্তরীণ বিতর্ক ছিল যে, তারা ঠিক কতটুকু কঠোর হবেন? রাষ্ট্রীয়ভাবে কতটুকু সন্ত্রাসবাদী কর্মকান্ড চালাবেন? এই প্রক্রিয়ায় কতটুকু পর্যন্ত বেসামরিক জগনণের ক্ষতিকে অগ্রাহ্য করবেন? ঠিক কোথায় তারা তাদের সীমারেখা টানবেন?
The NYTimes Magazine @NYTmag published one chapter of my new book, “Rise And Kill First” to be published in the next few days in the US by @randomhouse (already in Germany and shortly, in Israel as well) https://t.co/9rgvXvTCa4 pic.twitter.com/p6szOF97wO
— Ronen Bergman (@ronenbergman) January 24, 2018
১৯৫৯ সালে তরুণ ইয়াসির আরাফাত যখন আল-ফাতাহ প্রতিষ্ঠা করেন, তখন প্রথমে ইসরায়েল তাকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু ১৯৬৫ সালে ফাতাহ যখন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে, তখন মোসাদের ইউরোপ শাখার প্রধান রাফি এইতান (আইডিএফ প্রধান রাফায়েল এইতান না, ভিন্ন ব্যক্তি) সর্বপ্রথম মোসাদের পরিচালক মায়ার আমিতকে পরামর্শ দেন সিজারিয়াকে নির্দেশ দেওয়ার জন্য, যেন তারা আরাফাতকে হত্যা করে।
ইয়াসির আরাফাত বামপন্থী ভাবধারা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। সে সময় পূর্ব জার্মানীর সাথে তার বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। এইতান তখন আমিতকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তারা খুব সহজেই আরাফাতের জার্মানীর ফ্রাঙ্কফুর্টের ঘাঁটিতে আক্রমণ চালিয়ে তাকে হত্যা করতে পারবেন। আমিত সে সময় এই প্রস্তাবে রাজি হননি। কিন্তু পরবর্তী কয়েক দশক ধরে মোসাদ সহ ইসরায়েলি বিভিন্ন বাহিনীর প্রধানরা অনেকেই আরাফাতকে হত্যা করতে চেষ্টা করেছেন। তাদের দৃষ্টিতে অত্যন্ত জনপ্রিয় এই নেতাকে দুনিয়ার বুক থেকে সরিয়ে দেওয়াটা ছিল ইসরায়েলের স্থিতিশীলতার জন্য খুবই জরুরী।
১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধের পর ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে যখন পূর্ব জেরুজালেম এবং পশ্চিম তীরে ইসরায়েলিদের উপর গেরিলা আক্রমণ চলছিল, তখন গোপন তথ্যের ভিত্তিতে ইসরায়েলি সেনারা আরাফাতের বাসায় হানা দিয়েছিল। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে মাত্র কয়েক মিনিট আগেই তাদের আগমন টের পেয়ে পালিয়ে যেতে পেরেছিলেন আরাফাত। ইসরায়েলি সৈন্যরা যখন তার বাসায় প্রবেশ করে, তখনও টেবিলের উপর থাকা তার খাবারগুলো থেকে গরম ধোঁয়া উড়ছিল।
আরাফাতকে হত্যাচেষ্টার সবগুলো অভিযান কিন্তু এত সহজ এবং সংক্ষিপ্ত ছিল না। ১৯৬৮ সালে ইসরায়েলের গোয়েন্দা বাহিনী তিন মাস ধরে এক ফিলিস্তিনি বন্দীকে ব্রেইন ওয়াশ করে তাকে দিয়ে ইয়াসির আরাফাতকে হত্যা করানোর প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। কিন্তু তাকে ছেড়ে দেওয়ার পাঁচ ঘন্টার মধ্যেই সে অস্ত্র সহ স্থানীয় পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং ইসরায়েলের গোয়েন্দা বাহিনীর এই প্রকল্পের কথা ফাঁস করে দেয়।
এসব ঘটনায় ইয়াসির আরাফাতের জনপ্রিয়তা উল্টো আরো বৃদ্ধি পেতে থাকে। শুধু ফিলিস্তিন না, বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রেও তার সমর্থন এবং গ্রহণযোগ্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। পূর্ব জার্মানীর নেতা এরিখ হনেকার তাকে ফিদেল ক্যাস্ট্রোর মতোই বিপ্লবী হিসেবে সম্মান করতেন। তার গোয়েন্দা বাহিনী আরাফাতকে নিয়মিত গোপন তথ্য এবং অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করত। এমনকি, সিআইএ-ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে গোপনে ভিন্ন পরিচয়ে আরাফাতকে সাহায্য করত। এসব কারণে ইয়াসির আরাফাত ধীরে ধীরে ইসরায়েলিদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যেতে থাকেন। তাকে প্রকাশ্যে হত্যা করা ইসরায়েলের জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠতে থাকে।
পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নতুন গতিপথ লাভ করে ১৯৮১ সালে, যখন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব নেন এরিয়েল শ্যারন। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই তিনি ইয়াসির আরাফাতকে ইসরায়েলের প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং নতুন করে তাকে হত্যার ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করেন। তার নির্দেশে ইসরায়েল আয়োজন করে ভয়ংকর এক অভিযান ‘অপারেশন অলিম্পিয়া’, যা সফল হলে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহস হতো সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম।
১৯৮২ সালের ১লা জানুয়ারি পিএলও লেবাননের বৈরুত স্টেডিয়ামে তাদের ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আক্রমণের বার্ষিকী উপলক্ষ্যে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করছিল। সে অনুষ্ঠানে ইয়াসির আরাফাত সহ পিএলও এবং ফাতাহ’র প্রধান প্রধান নেতারা উপস্থিত থাকার কথা ছিল। ইসরায়েল পরিকল্পনা করে, সেই অনুষ্ঠানের মঞ্চের নিচে শক্তিশালী বোমা স্থাপন করে ফিলিস্তিনের সব নেতাকে একসাথে নির্মূল করে ফেলা হবে।
পরিকল্পনা ঠিকভাবেই এগোচ্ছিল। এমনকি মঞ্চের নিচে বোমাও স্থাপন করা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ইসরায়েলের ডেপুটি প্রতিরক্ষামন্ত্রী সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ আমানের একদল কর্মকর্তা সহ প্রধানমন্ত্রী বেগিনের সাথে গিয়ে দেখা করেন এবং তাকে বোঝান যে, এরকম ভয়াবহ হত্যাকান্ড ঘটালে পুরো বিশ্ব একসাথে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিবে। ফলে শেষপর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে শ্যারনের এই পরিকল্পনা বাতিল করা হয়।
ভয়ংকর এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হলেও শ্যারন সেখানেই থেমে থাকেন নি। ইয়াসির আরাফাতকে হত্যা করার জন্য তিনি গঠন করেন নতুন একটি স্পেশাল টাস্ক ফোর্স, যার নাম ‘সল্ট ফিশ’। এর দায়িত্ব দেন তার অত্যন্ত বিশ্বস্ত এবং বিশেষ অভিযানে বিশেষজ্ঞ দুই কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্ণেল ইউজি দাগান এবং মোসাদের সাবেক ইউরোপীয় প্রধান রাফি এইতানকে। আমানের সাহায্যে তারা আরাফাতের অবস্থান জানার জন্য বৈরুতের টেলিফোন এক্সচেঞ্জগুলোতে আড়িপাতা যন্ত্র স্থাপন করেন। তাদের পরিকল্পনা ছিল, আরাফাতের অবস্থান নিশ্চিত করতে পারলে সেখানে বিমান হামলা চালিয়ে তাকে হত্যা করা হবে।
কিন্তু ইয়াসির আরাফাত ততদিনে বেশ সাবধান হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন, যেসব বাড়িতে তিনি কিছুক্ষণ আগেই ছিলেন, অথবা কিছুক্ষণ পরেই যেসব বাড়িতে তার যাওয়ার কথা ছিল, সেগুলোতে একের পর বিমান হামলা আর যা-ই হোক, কাকতালীয় হতে পারে না। কাজেই তিনি কোনো নিয়মিত সময়সূচী অনুসরণ করা বন্ধ করে দিলেন। তার থাকার কোনো নির্দিষ্ট স্থান রইল না, হঠাৎ করেই তিনি কোনো স্থানে হাজির হতেন, আবার হঠাৎ করেই সেখান থেকে চলে যেতেন।
১৯৮২ সালের জুলাই মাসে সল্ট ফিশ আরাফাতকে হত্যার নতুন একটি পরিকল্পনা করল। সে সময় ইসরায়েলের একটি বামপন্থী পত্রিকার সম্পাদক ইউরি আভনারি বৈরুতে গিয়ে ইয়াসির আরাফাতের সাক্ষাৎকার নেওয়ার আয়োজন করছিলেন। ইসরায়েলের বামপন্থীদের অনেকে শুরু থেকেই ফিলিস্তিনের উপর ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল, কাজেই আরাফাত এই সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হলেন। ইসরায়েল জুড়ে এ সাক্ষাৎকারের উদ্যোগটি প্রচন্ড সমালোচনার শিকার হচ্ছিল, কিন্তু সল্ট ফিশ সিদ্ধান্ত নিল, তারা সাক্ষাৎকারে বাধা না দিয়ে বরং এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে আরাফাতকে হত্যার চেষ্টা করবে।
জুলাই মাসের তিন তারিখে ইউরি আভনারি তার এক রিপোর্টার এবং এক ফটোগ্রাফার সহ ইসরায়েলের সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বৈরুতে প্রবেশ করেন। কিন্তু তাদের অজান্তেই তাদেরকে অনুসরণ করে বৈরুতে ঢুকে যায় সল্ট ফিশের একদল গুপ্ত ঘাতক। ইয়াসির আরাফাত অবশ্য অনুমান করতে পেরেছিলেন যে, মোসাদ তাকে হত্যা করার এই সুযোগ হাতছাড়া করবে না। কাজেই তার সহকারীরা সাংবাদিকদেরকে নিয়ে বৈরুতের অলিগলিতে ঘুরতে ঘুরতে শেষপর্যন্ত যখন নিশ্চিত হন যে, তারা অনুসরণকারীদেরকে খসিয়ে দিতে পেরেছেন, তখনই কেবল তারা আরাফাতের আস্তানায় যান। ফলে কোনো রকম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ছাড়াই সেবার সাংবাদিকরা আরাফাতের সাক্ষাৎকার নিয়ে ফিরে যেতে সক্ষম হয়েছিল।
যত দিন যেতে থাকে, এরিয়েল শ্যারন এবং আইডিএফ প্রধান রাফায়েল এইতান আরাফাতকে হত্যা করার জন্য সল্ট ফিশ এবং ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর উপর তত বেশি চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন। বারবার ব্যর্থ হওয়ায় শ্যারনের জন্য আরাফাতকে হত্যা করাটা অনেকটা ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। তিনি একের পর এক ভয়ংকর পরিকল্পনা করতে থাকেন, যেগুলোতে বেসামরিক জনগণেরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু প্রতিটি পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করে আরাফাত রক্ষা পেয়ে যান প্রধানত দুটি কারণে। প্রথমত, তার অবিশ্বাস্য রকমের সৌভাগ্য। আর দ্বিতীয়ত, ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর প্রধান ডেভিড ইভরি এবং সল্ট ফিশের প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্ণেল ইউজি দাগানের সতর্ক এবং সুবিবেচক সিদ্ধান্ত।
আইডিএফ প্রধান রাফায়েল এইতান বুঝতে পারছিলেন, ইয়াসির আরাফাতের অবস্থান জানা সত্ত্বেও এবং তার ও শ্যারনের পরিষ্কার নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও যেসব স্থানে ব্যাপক প্রাণহানির সম্ভাবনা ছিল, সেসব স্থানে ইভরি এবং দায়ান ইচ্ছে করেই আক্রমণ করছিলেন না। বরং তারা অযুহাত দেখাচ্ছিলেন যে, ইন্টালিজেন্স রিপোর্ট যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য না। কাজেই আগস্টের ৪ তারিখে যখন এইতানের কাছে বৈরুতের কেন্দ্রে অবস্থিত একটি বাড়িতে আরাফাতের সম্ভাব্য একটা মিটিংয়ের তথ্য এল, তিনি দায়ান এবং ইভরিকে না জানিয়ে সরাসরি বিমান বাহিনীর অপারেশন্স বিভাগের প্রধান এভিয়েম সেলার কাছে গেলেন।
এভিয়েম সেলাকে নিয়ে এইতান একটি এফ-৪ ফাইটার জেটে চড়ে বসলেন। সেলা যখন জানতে চাইলেন তারা কোথায় যাচ্ছেন, এইতান সোজাসুজি উত্তর দিলেন, “আমরা বৈরুতে বিমান হামলা করতে যাচ্ছি।” সেলা চমকে উঠলেন, কিন্তু তার কিছু করার ছিল না। তারা উড়ে চললেন পশ্চিম বৈরুতের একটি অফিস ব্লকের উদ্দেশ্যে, যেখানে সল্ট ফিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ইয়াসির আরাফাতের একটি মিটিংয়ে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। নির্দিষ্ট বিল্ডিংটির উপরে পৌঁছে এইতান পরপর দুটি বোমা নিক্ষেপ করেন। কিছুক্ষণ পর ঘুরে এসে তিনি আরো একটি বোমা নিক্ষেপ করেন বিল্ডিংটির ধ্বংস নিশ্চিত করার জন্য, এরপর খুশি মনে ফিরে চলে গেলেন। কিন্তু তাদের দুর্ভাগ্য, সেদিনও ইয়াসির আরাফাত নির্ধারিত সময়ে মিটিংয়ে হাজির না হওয়ায় প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন।
ততদিনে শ্যারন বুঝতে পেরেছিলেন, আরাফাতকে প্রকাশ্যে হত্যা করা খুব একটা সহজ হবে না, তাছাড়া প্রকাশ্যে হত্যা করলে আরাফাত ফিলিস্তিন এবং বিশ্ববাসীর কাছে শহীদের মর্যাদা পেয়ে যাবেন। তাই শ্যারন সিদ্ধান্ত নিলেন, আরাফাতকে এমনভাবে হত্যা করতে হবে, যেন সেটাকে দুর্ঘটনা বলে মনে হয়। অপারেশন সল্ট ফিশের কর্মপদ্ধতিতে পরিবর্তন আনলেন তিনি। এর নামও পরিবর্তন করে নতুন নাম দিলেন অপারেশন গোল্ডফিশ। কিন্তু তাদের প্রধান লক্ষ্য একটাই রয়ে গেল- ইয়াসির আরাফাত।
এরকম সময়ই তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, আরাফাতকে হত্যা করার সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হবে গভীর সমুদ্রের উপর তার প্লেন মিসাইল দিয়ে ধ্বংস করে দেওয়া। তারা ভূমধ্যসাগরের উপর একটি নির্দিষ্ট এলাকাও বাছাই করে ফেললেন, যা কোনো রাডারের আওতাভুক্ত না, কিন্তু যার উপর দিয়ে বাণিজ্যিক বিমান নিয়মিত যাতায়াত করে। ফলে সেখানে যদি মিসাইলের মাধ্যমে হামলা করা হয়, তার কোনো প্রমাণ থাকবে না। তাছাড়া ঐ স্থানের সমুদ্রের গভীরতাও এত বেশি ছিল যে, ধ্বংসস্তুপ খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব হবে, ফলে বিমান বিধ্বস্ত হলেও সেটা সন্ত্রাসী হামলা ছিল, নাকি নিছকই দুর্ঘটনা, সেটা কেউ কখনও জানতে পারবে না।
গভীর সমুদ্রের বুকে অপারেশনের পরিকল্পনা হওয়ায় ইসরায়েলি বিমান বাহিনীকে সে সময় একটি বোয়িং ৭০৭ বিমানের মধ্যে রাডার স্থাপন করে সমুদ্রের উপর অস্থায়ী উড়ন্ত কমান্ড পোস্ট সৃষ্টি করতে হয়েছিল, দায়িত্ব ছিল সেই কমান্ড সেন্টারের মধ্য থেকে অপারেশন পরিচালনা করা। আর শ্যারনের নির্দেশে চারটি এফ-১৬ এবং এফ-১৫ ফাইটার জেটকে সদা প্রস্তুত রাখা হয়েছিল, যেন নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথেই তারা উড়ে গিয়ে আক্রমণ করতে পারে। ১৯৮২ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৮৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত নয় সপ্তাহ সময়ের মধ্যে ইসরায়েলি বিমান বাহিনী এই অপারেশনের আওতায় অন্তত পাঁচটি প্লেন ধ্বংস করার প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে অপারেশনগুলো বাতিল করা হয়েছিল।
অপারেশনগুলো বাতিলের পেছনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী আমানের গবেষণা বিভাগের পরিচালক আমোস গিলবোয়া। কারণ তার দায়িত্ব ছিল যেকোনো অপারেশনের পর তার রাজনৈতিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিক ফলাফল কী হতে পারে, তা বিশ্লেষণ করা। তার বিশ্লেষণ অনুযায়ী বাণিজ্যিক যাত্রীবাহী প্লেন ধ্বংস করার মতো এ ধরনের অধিকাংশ পরিকল্পনাই যদি সফল হতো, তাহলে শেষ পর্যন্ত তা ইসরায়েলের জন্য ক্ষতিকর হতো।
এরিয়েল শ্যারন এবং রাফায়েল এইতান ছিলেন ইয়াসির আরাফাতকে হত্যার ব্যাপারে বদ্ধ পরিকর। কিন্তু অন্য সবাই তাদের সাথে সব বিষয়ে একমত ছিলেন না। কাজেই অনেক ক্ষেত্রেই পরিষ্কার নির্দেশ পাওয়া সত্ত্বেও তারা কখনো রেডিওর ফ্রিকোয়েন্সি ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্বল করে যোগাযোগে ব্যাঘাত ঘটিয়ে, কখনো ভুল তথ্য দিয়ে, কখনো প্লেন খুঁজে না পাওয়ার অযুহাত দেখিয়ে হামলাগুলো ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। বেশিদিন হয়তো তাদের পক্ষে এরকম করা সম্ভব হতো না, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে ততদিনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পাশাপাশি ইসরায়েলি জনগণও এরিয়েল শ্যারনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল।
আন্তর্জাতিক সমালোচনায় এবং জনগণের চাপে বৈরুত শরণার্থী শিবিরে সংঘটিত বর্বর হত্যাকান্ডে এরিয়েল শ্যারনের ভূমিকা তদন্ত করার জন্য বিশেষ কমিশন গঠন করতে বাধ্য হয়েছিলেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেগিন। যদিও কমিশন খ্রিস্টানদেরকেই হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী করে, কিন্তু তারা এটাও উল্লেখ করে যে, শ্যারনই তাদেরকে সেখানে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছিলেন। ফলে শেষপর্যন্ত শ্যারনকে পদত্যাগ করতে হয়। এবং ইসরায়েলিরাও ধীরে ধীরে এটা মেনে নেয় যে, ইয়াসির আরাফাত একজন আন্তর্জাতিক নেতা, যাকে হত্যা করার মাধ্যমে ফিলিস্তিন সংকটের কোনো স্থায়ী সমাধান অর্জিত হবে না।
শ্যারনের সাথে আরাফাতের দ্বন্দ্ব অবশ্য সেখানেই শেষ হয়নি। ২০০১ সালে শ্যারন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। প্রথম দিকে যদিও বুশ প্রশাসের সাথে সমোঝতায় এসে শ্যারন অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ স্থগিত করেন এবং আরাফাতকে হত্যার লক্ষ্য থেকে সরে আসেন, কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি আবারও তার পুরনো নীতিতেই ফিরে যান। ২০০৪ সালের ২২শে মার্চ অবরুদ্ধ গাজাতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী হেলিকপ্টারের গানশিপ থেকে গুলি করে হত্যা করে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগঠন হামাসের প্রধান শেখ আহমেদ ইয়াসিনকে।
এর পরপরই এপ্রিলের ২৩ তারিখে সাংবাদিকদের সাথে এক সাক্ষাৎকারে এরিয়েল শ্যারন জানান, বুশ প্রশাসনের সাথে তার পুরনো সমঝোতা অনুযায়ী চলতে তিনি বাধ্য নন। সেই অঙ্গীকার এখন আর কার্যকর না। সাংবাদিকরা যখন তাকে আবার জিজ্ঞেস করে, এর অর্থ কি তিনি প্রয়োজনে ইয়াসির আরাফাতের উপরেও আক্রমণ করবেন? উত্তরে শ্যারন বলেন, “আমি মনে করি না, ব্যাপারটি এর চেয়ে আর পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব।”
শ্যারনের নীতির এই পরিবর্তনের কিছুদিনের মধ্যেই সুস্থ-সবল ইয়াসির আরাফাতের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। এককালের দুর্ধর্ষ গেরিলা নেতা ইয়াসির আরাফাত, যিনি অসংখ্যবার বিশ্বের অন্যতম দক্ষ গোয়েন্দাবাহিনীর হত্যাচেষ্টাকে ফাঁকি দিয়েছেন, হঠাৎ করেই রহস্যজনকভাবে অসুস্থ হয়ে স্ট্রোক করেন। ১১ই নভেম্বর, ২০০৪ সালে ফ্রান্সের একটি হাসপাতালে মৃত্যু ঘটে তার। তার শরীরে হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত তেজস্ক্রিয় বিষাক্ত পদার্থ পোলোনিয়ামের অস্তিত্ব ছিল কি না, তা নিয়ে বিতর্ক আজও শেষ হয়নি। শেষপর্যন্ত ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যুর মৃত্যুর পেছনে কি এরিয়েল শ্যারনই দায়ী ছিলেন, সে রহস্যের হয়তো কোনোদিনই সমাধান হবে না।