প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তির সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হতো – মুখ্য মিত্রশক্তি (ব্রিটেন, রাশিয়া, ফ্রান্স, জাপান, ইতালি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) এবং সহযোগী মিত্রশক্তি (মিত্রশক্তির অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্র)। মুখ্য মিত্রশক্তি এবং সার্বিয়া ও মন্টিনিগ্রোকে নিয়ে আগের পর্বগুলোতে আলোচনা করা হয়েছে। অন্যান্য সহযোগী মিত্র রাষ্ট্রগুলো এই পর্বের আলোচ্য বিষয়বস্তু।
বেলজিয়াম
‘বেলজিয়াম রাজ্য’ (ডাচ: Koninkrijk België; ফরাসি: Royaume de Belgique; জার্মান: Königreich Belgien) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সহযোগী মিত্রশক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিল। পশ্চিম ইউরোপের এই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটির ওপর জার্মানি কর্তৃক পরিচালিত আক্রমণ ছিল এই মহাযুদ্ধে ব্রিটেনের অংশগ্রহণের অন্যতম কারণ। সেসময় বেলজিয়াম ছিল একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র, কিন্তু আফ্রিকায় তাদের একটি বৃহৎ উপনিবেশ (‘বেলজীয় কঙ্গো’; বর্তমান কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র) ছিল। বেলজিয়ামের প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে বেলজীয় কঙ্গোও স্বয়ংক্রিয়ভাবে এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধের জন্য বেলজিয়াম তার আফ্রিকান উপনিবেশটির সম্পদ ব্যবহার করে এবং উপনিবেশটি থেকে আগত হাজার হাজার সৈন্য কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে বেলজিয়াম ছিল একটি পূর্ণ নিরপেক্ষ রাষ্ট্র এবং ১৮৩৯ সালে সম্পাদিত ‘লন্ডন চুক্তি’ অনুযায়ী বেলজিয়ামের নিরপেক্ষতা রক্ষার দায়িত্ব ব্রিটেনের ওপর ন্যস্ত ছিল। এদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে জার্মান সশস্ত্রবাহিনীর জেনারেল স্টাফ রুশ–ফরাসি জোটের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য যুদ্ধের জন্য যে পরিকল্পনা করেছিল, সেটি অনুযায়ী জার্মানি প্রথমে ক্ষিপ্রগতিতে ফ্রান্সকে পরাজিত করে এরপর রাশিয়ার বিরুদ্ধে সর্বশক্তি মোতায়েন করার চিন্তাভাবনা করছিল। দ্রুতগতিতে ফ্রান্সকে পরাজিত করার জন্য সেসময় জার্মানির ফ্রান্সের বিরুদ্ধে বিপুল সংখ্যক সৈন্য প্রেরণের প্রয়োজন ছিল এবং এক্ষেত্রে জার্মান সৈন্যদের বেলজিয়াম অতিক্রম করতে হতো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পরপরই জার্মানি এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা চালায়।
কিন্তু বেলজিয়াম তার নিরপেক্ষতার নীতি অনুসারে বেলজীয় ভূখণ্ড দিয়ে জার্মান সৈন্যদের যাতায়াতের সুযোগ দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এর ফলে ১৯১৪ সালের ৩ আগস্ট জার্মানি বেলজিয়ামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং বেলজিয়ামের ওপর আক্রমণ চালায়। ২৮ আগস্ট জার্মানির মিত্র অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরিও বেলজিয়ামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু কেন্দ্রীয় শক্তির অপর দুই সদস্য রাষ্ট্র (ওসমানীয় রাষ্ট্র ও বুলগেরিয়া) বেলজিয়ামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেনি। বেলজীয় সৈন্যরা প্রধানত ইউরোপের পশ্চিম রণাঙ্গন ও পূর্ব আফ্রিকায় কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। অবশ্য পূর্ব রণাঙ্গনসহ অন্যান্য অঞ্চলেও বেলজিয়াম কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করে।
১৯১৪ সালের শেষদিক নাগাদ জার্মান সৈন্যরা বেলজিয়ামের প্রায় সমস্ত অংশ দখল করে নেয়, কিন্তু বেলজীয় উপকূলের ক্ষুদ্র একটি অংশ তারা দখল করতে পারেনি। যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে বেলজীয় সৈন্যরা জার্মানদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং এজন্য বেলজিয়াম দখলের ক্ষেত্রে জার্মানদের বেশ সময় লেগে যায়, যার ফলে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আক্রমণ পরিচালনার ক্ষেত্রে তারা কিছুটা দেরি করে ফেলে। এর ফলে জার্মানদের কাঙ্ক্ষিত ক্ষিপ্রগতির বিজয়ের পরিবর্তে পশ্চিম রণাঙ্গনের যুদ্ধ এক রক্তাক্ত অচলাবস্থায় রূপ ধারণ করে। অবশেষে ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর নাগাদ কেন্দ্রীয় শক্তি মিত্রশক্তির নিকট আত্মসমর্পণ করে এবং বেলজিয়াম দখলমুক্ত হয়।
বেলজিয়াম ও বেলজীয় কঙ্গো থেকে আগত প্রায় ৩,৮০,০০০ সৈন্য এই মহাযুদ্ধে কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করে। এদের মধ্যে প্রায় ৮৮,০০০ জন নিহত এবং ৪৪,৬৮৬ জন আহত হয়। উল্লেখ্য, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের ফলে বেলজিয়াম জার্মানির মূল ভূখণ্ড থেকে মরেসনেট ও ইউপেন–ম্যালমেডি অঞ্চল এবং আফ্রিকায় অবস্থিত জার্মান উপনিবেশ ‘রুয়ান্ডা–উরুন্ডি’ (বর্তমান রুয়ান্ডা ও বুরুন্ডি) লাভ করে।
পর্তুগাল
‘পর্তুগিজ প্রজাতন্ত্র’ (পর্তুগিজ: República Portuguesa) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সহযোগী মিত্রশক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিল। আইবেরীয় উপদ্বীপের এই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার চেষ্টা করে, কিন্তু পরবর্তীতে মিত্রশক্তিতে যোগদান করে। সেসময় আফ্রিকা, পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় পর্তুগালের বেশ কয়েকটি উপনিবেশ ছিল এবং পর্তুগালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে এই উপনিবেশগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধ পরিচালনার জন্য পর্তুগাল এই উপনিবেশগুলোর সম্পদ ব্যবহার করে এবং পর্তুগিজ উপনিবেশগুলো থেকে আগত হাজার হাজার সৈন্য কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
পর্তুগাল কর্তৃক ব্রিটেনের সঙ্গে তাদের বিস্তৃত বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রাখার প্রচেষ্টা এবং জার্মানির সঙ্গে পর্তুগালের ঔপনিবেশিক দ্বন্দ্ব ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পর্তুগালের অংশগ্রহণের মূল কারণ। উল্লেখ্য, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ইউরোপে যে বিপরীতমুখী দুইটি জোট (‘ত্রিশক্তি জোট’ এবং ‘ত্রিশক্তি আঁতাত’) গড়ে উঠেছিল, পর্তুগাল এর কোনোটির সদস্য ছিল না। কিন্তু ১৩৮৬ সালে সম্পাদিত ‘ইঙ্গ–পর্তুগিজ মৈত্রী’র পর থেকে পর্তুগাল ব্রিটেনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিল এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালেও এই সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল।
অবশ্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পর পর্তুগাল নিরপেক্ষতা বজায় রাখার প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু অচিরেই আফ্রিকায় অবস্থিত জার্মান ও পর্তুগিজ উপনিবেশগুলোর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তা সত্ত্বেও ১৯১৬ সালের মার্চ পর্যন্ত পর্তুগাল ও জার্মানি একে অপরের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করা থেকে বিরত ছিল। কিন্তু এসময় পর্তুগাল ব্রিটেনের সঙ্গে তাদের সামুদ্রিক বাণিজ্য অব্যাহত রেখেছিল এবং জার্মান সাবমেরিনের আক্রমণে পর্তুগিজ বাণিজ্যিক নৌবহরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছিল। ব্রিটেনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রাখা ছিল পর্তুগালের অর্থনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, ফলে পর্তুগাল ও জার্মানির মধ্যকার দ্বন্দ্বের মাত্রা প্রকট হয়ে ওঠে। অবশেষে ১৯১৬ সালের ৯ মার্চ জার্মানি পর্তুগালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং জার্মানির মিত্র অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি জার্মানির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশের উদ্দেশ্যে ১৫ মার্চ পর্তুগালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। অবশ্য কেন্দ্রীয় শক্তির অপর দুই সদস্য রাষ্ট্র (ওসমানীয় রাষ্ট্র ও বুলগেরিয়া) পর্তুগালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেনি।
পর্তুগিজ সৈন্যরা প্রধানত আফ্রিকা, ইউরোপের পশ্চিম রণাঙ্গন ও বিশ্বের মহাসাগরগুলোতে কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এই মহাযুদ্ধে পর্তুগাল ও পর্তুগিজ উপনিবেশগুলো থেকে আগত প্রায় ১,০০,০০০ সৈন্য অংশগ্রহণ করে। এদের মধ্যে ১৯,৫৪০ জন নিহত/নিখোঁজ এবং ১৩,৭৫১ জন আহত হয়। উল্লেখ্য, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের ফলে পর্তুগাল আফ্রিকায় জার্মানির কাছ থেকে কিয়োঙ্গা অঞ্চল লাভ করে, যেটিকে ‘পর্তুগিজ মোজাম্বিকে’র অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
রুমানিয়া
‘রুমানিয়া রাজ্য’ (রুমানীয়: Regatul României) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সহযোগী মিত্রশক্তির একটি অন্যতম সদস্য ছিল। পূর্ব ইউরোপের এই রাষ্ট্রটি মহাযুদ্ধের প্রথম দুই বছর নিরপেক্ষতা বজায় রাখে, কিন্তু একই সঙ্গে মিত্রশক্তি ও কেন্দ্রীয় শক্তি উভয়েই রুমানিয়ার সঙ্গে গোপনে আলোচনা চালাতে থাকে এবং রুমানিয়াকে নিজেদের পক্ষে টেনে নেয়ার প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। শেষ পর্যন্ত রুমানিয়া মিত্রশক্তির পক্ষে যুদ্ধে যোগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
রুমানিয়ার নিজস্ব ভূখণ্ড বিস্তৃত করার আকাঙ্ক্ষা এবং অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি ও বুলগেরিয়ার সঙ্গে রুমানিয়ার ভূখণ্ড সংক্রান্ত বিরোধ ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রুমানিয়ার অংশগ্রহণের প্রধান কারণ। ১৯১৬ সালের মাঝামাঝি নাগাদ ইউরোপের পূর্ব রণাঙ্গনে রাশিয়া অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি ও জার্মানির বিরুদ্ধে একটি বিস্তৃত আক্রমণাভিযান পরিচালনা করে, যেটি ইতিহাসে ‘ব্রুসিলভ আক্রমণাভিযান’ (Brusilov Offensive) নামে পরিচিত। এই আক্রমণাভিযানের ফলে অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় সমরযন্ত্র প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। এমতাবস্থায় রুমানিয়া অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির দুর্বলতার সুযোগ নেয়ার উদ্দেশ্যে মিত্রশক্তিতে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেয় এবং ১৯১৬ সালের ২৮ আগস্ট অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশের উদ্দেশ্যে একই দিনে জার্মানি, ৩০ আগস্ট ওসমানীয় রাষ্ট্র এবং ১ সেপ্টেম্বর বুলগেরিয়া রুমানিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে রুমানিয়া অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে কিছু সাফল্য অর্জন করে, কিন্তু শীঘ্রই জার্মানি, অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি ও বুলগেরিয়ার সম্মিলিত পাল্টা আক্রমণের মুখে রুমানীয়রা পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হয়। ক্রমে কেন্দ্রীয় শক্তি রুমানিয়ার সিংহভাগ ভূখণ্ড দখল করে নেয় এবং রুমানিয়ার অবশিষ্টাংশ যাতে কেন্দ্রীয় শক্তির দখলে চলে না যায়, সেজন্য রাশিয়া রুমানিয়ায় সৈন্য প্রেরণ করে। কিন্তু ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের ফলে রাশিয়ায় তীব্র অরাজকতার সৃষ্টি হয় এবং রাশিয়া রুমানিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। এর ফলে রুমানিয়া বাধ্য হয়ে ১৯১৭ সালের ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় শক্তির সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এদিকে ১৯১৮ সালের প্রথমদিকে রুমানিয়া রাশিয়ায় আক্রমণ চালায় এবং বেসারাবিয়া দখল করে নেয়।
১৯১৮ সালের মে মাসে রুমানিয়া ও কেন্দ্রীয় শক্তির মধ্যে ‘বুখারেস্ট চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয় এবং এর মধ্য দিয়ে রুমানিয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয় ও কার্যত জার্মানির একটি আশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত হয়। কিন্তু ১৯১৮ সালের ১০ নভেম্বর রুমানিয়া আবার কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং ১১ নভেম্বর মিত্রশক্তির নিকট জার্মানির আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে। এভাবে মহাযুদ্ধের অন্তিম মুহূর্তে দ্বিতীয়বারের মতো যুদ্ধে প্রবেশের মাধ্যমে রুমানিয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী শক্তিগুলোর একটি হিসেবে আবির্ভূত হয়।
রুমানিয়ার প্রায় ৭,৫০,০০০ জন সৈন্য এই মহাযুদ্ধে কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এদের মধ্যে ৩,৩৫,৭০৬ জন নিহত এবং প্রায় ১,২০,০০০ জন আহত হয়। উল্লেখ্য, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের ফলে রুমানিয়া অস্ট্রিয়ার কাছ থেকে বুকোভিনা, হাঙ্গেরির কাছ থেকে ট্রান্সিলভানিয়া ও বানাতের অংশবিশেষ, বুলগেরিয়ার কাছ থেকে দব্রুজা এবং রাশিয়ার কাছ থেকে বেসারাবিয়া লাভ করে।
গ্রিস
‘গ্রিস রাজ্য’ (গ্রিক: Βασίλειον τῆς Ἑλλάδος) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সহযোগী মিত্রশক্তির একটি অন্যতম সদস্য ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পর প্রায় তিন বছর রাষ্ট্রটি আনুষ্ঠানিকভাবে নিরপেক্ষতা বজায় রাখে এবং এই যুদ্ধে গ্রিস কোন পক্ষে যোগদান করবে, সেটি নিয়ে গ্রিসের অভ্যন্তরে একটি গুরুতর রাজনৈতিক সঙ্কটের সৃষ্টি হয়। অবশেষে গ্রিস মিত্রশক্তির পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
গ্রিসের ভূখণ্ড সম্প্রসারিত করার আকাঙ্ক্ষা এবং ওসমানীয় রাষ্ট্র ও বুলগেরিয়ার সঙ্গে গ্রিসের রাজনৈতিক ও ভূখণ্ড সংক্রান্ত দ্বন্দ্ব ছিল গ্রিসের প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রধান কারণ। উল্লেখ্য, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে প্রথম ও দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধে অংশগ্রহণের ফলে গ্রিসের ভূখণ্ডের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। ১৯১৩ সালে সম্পাদিত ‘গ্রিক–সার্বীয় মৈত্রী’ অনুযায়ী গ্রিস আনুষ্ঠানিকভাবে সার্বিয়ার সঙ্গে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ ছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর গ্রিস প্রাথমিকভাবে নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে, কিন্তু শীঘ্রই বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ নিয়ে গ্রিসের অভ্যন্তরে দুটি বিপরীতমুখী পক্ষের সৃষ্টি হয়। গ্রিক রাজা কনস্ট্যান্টাইন কেন্দ্রীয় শক্তির প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং কেন্দ্রীয় শক্তির পক্ষে যুদ্ধে যোগ দিতে কিংবা নিরপেক্ষ থাকতে আগ্রহী ছিলেন। অন্যদিকে, গ্রিক প্রধানমন্ত্রী এলেফথেরিয়োস ভেনিজেলোস মিত্রশক্তির প্রতি সহানূভূতিশীল ছিলেন এবং মিত্রশক্তির পক্ষে যুদ্ধে যোগ দিতে ইচ্ছুক ছিলেন। এই নিয়ে উভয়ের মধ্যে ব্যাপক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। ১৯১৫ সালে বুলগেরিয়া কেন্দ্রীয় শক্তিতে যোগদান করে এবং সার্বিয়ার ওপর আক্রমণ চালায়, কিন্তু রাজা কনস্ট্যান্টাইন সার্বিয়াকে সহায়তা করতে অস্বীকৃতি জানান। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী ভেনিজেলোস সার্বিয়াকে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে গ্রিসের থেসালোনিকিতে মিত্রশক্তিকে সৈন্য অবতরণ করতে দেন। অন্যদিকে, কনস্ট্যান্টাইন গ্রিক–বুলগেরীয় সীমান্তবর্তী গ্রিক ভূখণ্ডে কেন্দ্রীয় শক্তিকে সৈন্য মোতায়েন করার অনুমতি প্রদান করেন।
ক্রমে গ্রিসে কার্যত দুটি সরকার স্থাপিত হয়– রাজা কনস্ট্যান্টাইনের অধীনস্থ কেন্দ্রীয় শক্তি–সমর্থিত সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী ভেনিজেলোসের নেতৃত্বাধীন মিত্রশক্তি–সমর্থিত সরকার। অবশেষে ১৯১৭ সালের জুনে রাজা কনস্ট্যান্টাইন পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং ২৭ জুন গ্রিস জার্মানি, অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া ও ওসমানীয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। গ্রিক সৈন্যরা প্রধানত মেসিডোনীয় রণাঙ্গন ও পশ্চিম এশিয়ায় কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। অবশেষে ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর নাগাদ কেন্দ্রীয় শক্তি মিত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং এর মধ্য দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে। এদিকে ১৯১৭ সালে রাশিয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিলে মিত্রশক্তি রাশিয়ায় আক্রমণ চালায় এবং গ্রিস এই আক্রমণে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ২,৫০,০০০ জন গ্রিক সৈন্য অংশগ্রহণ করে। এদের মধ্যে প্রায় ২৬,০০০ জন নিহত এবং প্রায় ২১,০০০ জন আহত হয়। উল্লেখ্য, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে গ্রিস বুলগেরিয়ার কাছ থেকে পশ্চিম থ্রেস এবং ওসমানীয় রাষ্ট্রের কাছ থেকে ঈজিয়ান সাগরের সিংহভাগ দ্বীপ লাভ করে। অবশ্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে গ্রিস পরাজিত ওসমানীয় রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে যে গ্রিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালিয়েছিল, বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী গ্রিক–তুর্কি যুদ্ধে (১৯১৯–২২) গ্রিসের পরাজয়ের ফলে সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
ব্রাজিল
‘ব্রাজিল যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র’ (পর্তুগিজ: República dos Estados Unidos do Brasil) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তির একমাত্র দক্ষিণ আমেরিকান সদস্য রাষ্ট্র ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রায় তিন বছর পর্যন্ত ব্রাজিল নিরপেক্ষ ছিল, কিন্তু এরপর তারা মিত্রশক্তির পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। অবশ্য বিশ্বযুদ্ধে ব্রাজিলের অংশগ্রহণ ছিল সীমিত এবং মূলত প্রতীকী ধাঁচের।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পরপরই ব্রাজিল এই যুদ্ধে নিজেকে নিরপেক্ষ হিসেবে ঘোষণা করে, কিন্তু যুদ্ধের কারণে ব্রাজিলের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে থাকে। তদুপরি, জার্মান সাবমেরিনগুলো মিত্রশক্তির সঙ্গে বাণিজ্যে লিপ্ত নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলোর জাহাজ ডুবিয়ে দিতে শুরু করলে ব্রাজিলের বেশ কয়েকটি জাহাজের সলিলসমাধি ঘটে। এর ফলে ব্রাজিলের সামুদ্রিক বাণিজ্যে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয় এবং ব্রাজিলের জনমত তীব্রভাবে জার্মানবিরোধী হয়ে ওঠে। এমতাবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পর ব্রাজিল জার্মানির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং ১৯১৭ সালের ২৬ অক্টোবর জার্মানি ও জার্মানির মিত্র রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
অবশ্য কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে ব্রাজিলের সামরিক কার্যক্রম ছিল প্রকৃতপক্ষে সীমিত। ব্রাজিল আটলান্টিক মহাসাগরে জার্মান নৌবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনায় অংশগ্রহণ করে এবং ইউরোপের পশ্চিম রণাঙ্গনে একটি ক্ষুদ্র সৈন্যদল ও ভূমধ্যসাগরে একটি ক্ষুদ্র নৌবহর প্রেরণ করে। মোট ১,৭১৩ জন ব্রাজিলীয় সৈন্য এই মহাযুদ্ধে কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং এদের মধ্যে প্রায় ১০০ জন নিহত হয়। উল্লেখ্য, বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মান সাবমেরিন বহর কর্তৃক ডুবিয়ে দেয়া ব্রাজিলীয় জাহাজগুলোর জন্য জার্মানি ব্রাজিলকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে বাধ্য হয়।