একপাশে সবুজে ঘেরা পাহাড়, অপর পাশে সীমাহীন নীল সমুদ্র, মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে সরু রেলপথ। ঝকঝক রব তুলে ছুটে চলছে ট্রেন আর যাত্রীরা চেয়ে দেখছে প্রকৃতির এই লীলাখেলা। বলছিলাম চট্টগ্রাম অঞ্চলের রেলপথের কথা। একসময় এই রেলপথ দিয়ে বাষ্পচালিত রেলগাড়ি চললেও বর্তমানে চলছে ডিজেল ইঞ্জিন বিশিষ্ট রেলগাড়ি। ভবিষ্যতে একসময় হয়তো গতির ঝড় তুলে সমুদ্রের তীর ধরে ছুটে চলবে বুলেট ট্রেন।
ব্রিটিশদের কাছে চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্ব ছিল অনেক। ১৭৬০ সালে চট্টগ্রামে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এখানে বিভিন্ন সরকারি দফতর ও স্থাপনা প্রতিষ্ঠা করতে থাকে তারা। ১৮৭০ সালের আগেই শহরের কদমতলী থেকে টাইগারপাস হয়ে পাহাড়তলী পর্যন্ত ২০৯ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। বিস্তীর্ণ এই এলাকা জুড়ে তারা নির্মাণ করে কমিশনারের বাংলো টিলা, সার্কিট হাউস, চট্টগ্রাম ক্লাব, জামিয়াতুল ফালাহ, লালখান বাজার, নেভাল এভিনিউ, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালসহ অসংখ্য সরকারি স্থাপনা। ১৮৭২ সালে প্রশাসনিক ভবন হিসেবে সিআরবি (সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং) নির্মাণ করা হয়।
আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে প্রতিষ্ঠার পর ১৪ই নভেম্বর, ১৮৯৩ সালে সরকারি গেজেটের মাধ্যমে সিআরবি-সহ ১৬০ একর জমি রেলওয়ের কাছে হস্তান্তর করে ব্রিটিশ সরকার। সিআরবি’কে করা হয় আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের সদর দফতর। মূলত তখন থেকেই এই ভবনটির নামকরণ হয় ‘সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং’। সিআরবি বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরতন ও দৃষ্টিনন্দন ভবনগুলোর মধ্যে অন্যতম।
সরকারের লাট বাহাদুর, আমলা, কেরানী প্রভৃতির পদচারণায় কর্মমুখর এই ভবন এলাকাটি এখন অনেকটাই শান্ত। উঁচুনিচু পাহাড়ি সর্পিলাকার রাস্তা, সেই রেইন্ট্রি কড়ই গাছ এবং ছোট ছোট বাংলোগুলো আজও আছে। কালের বিবর্তনে কত কিছুরই তো পরিবর্তন ঘটেছে! চারপাশে সুরম্য অট্টালিকা, প্রশস্ত পিচঢালা রাস্তা, বাষ্পশকট ছেড়ে আধুনিকতা এসেছে রেলওয়েতেও। কিন্তু সেই সিআরবি দেড়শো বছর ধরে লাখো মানুষের হাসি কান্না বুকে ধারণ করে আজও ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। যেন কারো কাছে কোনো অভিযোগ নেই। জরাজীর্ণ এই ভবনটি বর্তমান বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের সদর দফতর।
চট্টগ্রামে মূলত রেলপথ এসেছে আসাম ও সিলেটের সমৃদ্ধ চা শিল্পকে কাজে লাগানোর জন্য। সে সময় আসাম থেকে দূরত্ব অনেক কম হওয়া সত্ত্বেও চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে চা রপ্তানি করা যেত না। চা বোঝাই নৌকা অথবা গরুর গাড়ি কলকাতা পৌঁছত ১৫ দিনে। সেখান থেকে বিশ্ব বাজারে এই চা রপ্তানি করা হতো। চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার না করার কারণ হলো, আসামের সাথে চট্টগ্রামের তেমন কোনো যোগাযোগ ব্যবস্থাই ছিল না।
তাই আসামের চা উৎপাদনকারীরা এবং ইংরেজ বাগান মালিকরা দাবি করে পূর্ব বাংলা থেকে আসাম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করতে হবে। ব্রিটিশ সরকার একাধিকবার উদ্যোগ নিলেও সফল হতে পারেনি। ব্রিটিশ সরকার যখন অনেক চেষ্টা তদবির করেও দুর্গম অঞ্চল হওয়ায় রেলপথ নির্মাণ করতে সক্ষম হল না, তখন বেরি হোয়াইট নামক এক ইংরেজ ভদ্রলোক সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে আসামে রেলপথ নির্মাণ করে ফেললেন। ‘আসাম রেলওয়েস অ্যান্ড ট্রেডিং’ নামক এই কোম্পানি ডিব্রুগড় থেকে শাদিয়া পর্যন্ত স্বল্প দৈর্ঘের একটি রেলপথ নির্মাণ করে।
রেলপথের সুবিধা পেয়ে অত্রাঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার হতে থাকে। দ্রুত এই যোগাযোগ ব্যবস্থার বদৌলতে সেখানকার বাগান মালিকরা অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বেশি সুযোগ পেতে থেকে। সর্বোপরি এই স্বল্প দৈর্ঘ্যের রেলপথ ঐ অঞ্চলের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠোমোর আমূল পরিবর্তন সাধন করে। এই রেলপথের সফলতা দেখে ব্রিটিশ সরকার এবার নড়েচড়ে বসে। পূর্ব বাংলা থেকে আসাম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করা অবাস্তব নয়, সম্ভব।
এ উপলক্ষ্যে তৎকালীন ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের চিফ ইঞ্জিনিয়ার আসামে ভ্রমণ করেন। ১৮৮১ সাল থেকে ১৮৮৭ সাল পর্যন্ত তার উদ্যোগে সরেজমিনে জরিপ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। পরিক্ষা নিরীক্ষা শেষে তিনি ব্রিটিশ সরকারের কাছে দুইটি লাইন নির্মাণের জন্য সুপারিশ করেন। প্রথমটা হলো আসাম থেকে গারো পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ময়মনসিংহ হয়ে ঢাকা পর্যন্ত। দ্বিতীয়টা হলো আসাম থেকে সিলেট হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত।
শেষমেশ সম্ভাব্য খরচ কম হওয়াতেও চট্টগ্রাম বন্দরকে যুক্ত করার কথা বিবেচনা করে সরকার চট্টগ্রাম-সিলেট-আসাম রুটকেই প্রাথমিক পছন্দ হিসেবে বেছে নিল। এই হলো চট্টগ্রামে রেলপথ নির্মাণের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। এরপর এই রেলপথ নির্মাণের জন্য ১৮৯২ সালে লন্ডনে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে’।
কুমিল্লা-লাকসাম-চট্টগ্রাম সেকশন
১৮৯২ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পুরোদমে কাজে লেগে গেল আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে। কোম্পানিটি প্রথমেই কাজ শুরু করল চট্টগ্রাম থেকে। উদ্দেশ্য ছিল যত দ্রুত সম্ভব যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে বন্দর সুবিধা কাজে লাগানো। কুমিল্লা থেকে লালমাই, লাকসাম, নাঙ্গলকোট, ফেনী, মুহুরীগঞ্জ, চিনকি আস্তানা, মীরসরাই, সীতাকুণ্ড, কুমিরা, ফৌজদারহাট, পাহাড়তলী হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত রেলপথের নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৮৯২ সালে।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি রেল স্টেশন রয়েছে চট্টগ্রাম শহরে। পুরো শহর জুড়ে জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে রেলপথ। আর এসব রেলস্টেশনের প্রায় সবগুলোই নির্মিত হয়েছে ব্রিটিশ আমলে। বন্দর নগরীর গুরুত্ব বিচেনায় ব্রিটিশ সরকার শহরের সবত্র ছড়িয়ে দিয়েছে রেল নেটওয়ার্ক। চট্টগ্রাম জেলায় মোট ৫৩টি বা তারও বেশি রেলস্টেশন রয়েছে, যা বাংলাদেশের আর কোনো জেলায় নেই। এছাড়া চট্টগ্রামে দেশের সর্বোচ্চ ১৭৮ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে।
১৮৯২ সালে কাজ শুরু হয়ে চট্টগ্রাম-কুমিল্লা সেকশনের কাজ সমাপ্ত হয় ১৮৯৫ সালে। ১৫৯.৮৯ কিলোমিটারের এই রেলপথটি ছিল মিটারগেজ। নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর ঐ বছরের ১ জুলাই সেকশনটি উদ্বোধন করা হয়। ফলে সে বছর থেকেই এই সেকশনে ট্রেন চলাচল শুরু করে।
এদিকে ফৌজদারহাট থেকে হালিশহর হয়ে চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত রেলপথ নিয়ে যাওয়া হয় ১৯১০ সালে। বন্দর থেকে সাগরিকা হয়ে পুনরায় এই লাইন চট্টগ্রামের মূল স্টেশনের সাথে যুক্ত হয়েছে। ১৮৯৯-১৯১০ সালের মধ্যে চট্টগ্রাম পোর্ট কমিশনার ও আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে যুক্তভাবে চারটি স্থায়ী জেটি নির্মাণ করে। ১৯১০ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে পরিপূর্ণ রেলওয়ে সংযোগ সাধিত হয়। আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের ওয়াগনে প্রথম চায়ের চালান যখন চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে, ধরা যেতে পারে তখন থেকেই শুরু হল আধুনিক চট্টগ্রাম বন্দরের বিকাশ।
‘বারো আউলিয়ার দেশ’ খ্যাত চট্টগ্রাম ঐতিহাসিকভাবেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বন্দর নগরী হওয়ার কারণে শিল্প ও বাণিজ্যের কেন্দ্রভূমি ছিল এই শহর। কিন্তু রেলপথ না থাকাই এই বাণিজ্য ও অর্থনীতির উন্নয়নের গতি ছিল মন্থর। ঝকঝক রব তুলে চট্টগ্রামের অলিগলি কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন করে যখন রেলগাড়ি আসতে শুরু করল তখন এই শহরের কর্মব্যস্ততা কয়েকগুণ বেড়ে গেল। ঝিমিয়ে পড়া বন্দর হয়ে উঠল কর্মচঞ্চল আর চট্টগ্রামবাসীরা বাষ্পশকটে চড়ে এক ভিন্ন চট্টগ্রামকে দেখার সুযোগ পেলো।
চট্টগ্রাম-ষোলশহর-নাজিরহাট সেকশন
এই রেলপথটি চট্টগ্রাম শহরে বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে দেওয়া রেল নেটওয়ার্কেই একটি অংশ। পাশাপাশি নাজিরহাট পর্যন্ত রেলপথ নির্মিত হলে ওই অঞ্চলের একটা বিশাল সংখ্যক মানুষ রেল পরিসেবার আওতায় আসবে, এমন চিন্তা থেকেই কার্যক্রম হাতে নেয় কোম্পানি।
চট্টগ্রাম কেবিন জংশন থেকে ঝাউতলা, ষোলশহর, ক্যান্টনমেন্ট, ফতেয়াবাদ, জোবরা, হাটহাজারী, সরকারহাট হয়ে হালদা নদীর পাড়ে নাজিরহাট পর্যন্ত রেলপথের নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৯২৬ সালে। এই সেকশনের চট্টগ্রাম থেকে হাটহাজারী পর্যন্ত নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৯২৯ সালে। সে বছর হাটহাজারী পর্যন্ত ট্রেন চলাচল শুরু হয়। এর পর ১৯৩০ সালে নাজিরহাট ঘাট পর্যন্ত নির্মাণ কাজ শেষে সম্পূর্ণ লাইন উদ্বোধন করা হয়।
ফতেয়াবাদকে জংশন করে ১৯৭৩ সালে একটা লাইন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সবুজ অরণ্যের মাঝে মাত্র একটি প্লাটফর্ম এবং একটি লাইন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্টেশনটি। মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চট্টগ্রাম শহরে যাতায়াতের সুবিধার্থে স্টেশনটি নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে প্রতিদিন দুইটি শাটল ট্রেন এই স্টেশন থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত চলাচল করে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশন থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব মাত্র ২২ কিলোমিটার। অথচ ধীর গতির এ ট্রেনে চড়ে চট্টগ্রাম পৌঁছে সময় লাগে প্রায় এক থেকে দেড় ঘণ্টা।
ষোলশহর-দোহাজারী সেকশন
চট্টগ্রাম থেকে যখন নাজিরহাট পর্যন্ত রেলপথের নির্মাণ কাজ চলছিল ঠিক তখন ঐ সেকশনের ষোলশহর থেকে দোহাজারী পর্যন্ত রেলপথের কার্যক্রমও চলমান ছিল। বৃহৎ পরিসরে সমগ্র চট্টগ্রামকে রেল পরিসেবা দিতেই আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের এই আয়োজন। তাছাড়া সে সময় কালুরঘাট, পটিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে রেলপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলাও জরুরি হয়ে পড়েছিল।
সাঙ্গু নদীর পাড়ে দোহাজারী পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল। তা হলো বান্দরবন, কক্সবাজারসহ বিস্তৃত পাহাড়ী অঞ্চলের সাথে চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করা। বর্তমানে দোহাজারী থেকে লোহাগড়া, চকরিয়া, ইসলামাবাদ, রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। ২০২২ সাল নাগাদ এই রেলপথের নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এই রেলপথ নির্মিত হলে ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নিরবিচ্ছিন্ন রেল যোগাযোগ স্থাপিত হবে।
ষোলশহর থেকে দোহাজারী পর্যন্ত রেলপথের নির্মাণ কাজ শেষে উদ্বোধন করা হয় ১৯৩১ সালে। এই রেলপথ নির্মাণ করতে গিয়ে আসাম বেঙ্গলকে বেশ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়। কালুরঘাটে কর্ণফুলীতে তৈরি করতে হয়েছে রেল ব্রিজ। ৬৩৮.৫ মিটার দৈর্ঘ্যের এই ব্রিজটি নির্মাণ করে ‘ব্রুনিক এন্ড কোম্পানী ব্রিজ বিল্ডার্স হাওড়া’ নামক একটি কোম্পানি। তদানীন্তন দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল এই ব্রিজ। স্থানীয়ভাবে ব্রিজটি ‘কালুরঘাটের পোল’ নামে পরিচিত। ১৯৫৮ সংস্কারের মাধ্যমে এই সেতুটি সড়ক ও রেল উভয়ের জন্যই উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়েছে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম ডাবল লাইন এবং মিটারগেজ বিড়ম্বনা
ঢাকা-চট্টগ্রাম নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রেল রুট। অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক কিংবা যাত্রী চাহিদা বিবেচনায় এই সেকশনটি বাংলাদেশ রেলওয়ের কাছে সবচেয়ে লাভজনক। কিন্তু আধুনিক ও বিলাসবহুল সব ট্রেন থাকা সত্ত্বেও এই সেকশনটি ছিল ধীর গতি সম্পন্ন। এর প্রধানতম কারণ একে তো মিটারগেজ, তার ওপর আবার সিঙ্গেল লাইন। তাই এই সমস্যা সমাধানকল্পে সরকার বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
২০০৭ সালে তিন বছর মেয়াদী (২০০৭-১০) ‘রোলিং ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম’ এর আওতায় ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ ডাবল লাইনে উত্তীর্ণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল পথের মোট দৈর্ঘ্য ৩২৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে পূর্ব থেকেই ১১৮ কিলোমিটার রেলপথ ডাবল লাইন ছিল। বাকি থাকল ২০৭ কিলোমিটার। চিনকি আস্তানা-লাকসাম ৭১ কি.মি. এবং ভৈরববাজার-টঙ্গী ৬৪ কি.মি. ডাবল লাইন নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১১ সালে। বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে এই ১৩৫ কি.মি. ডাবল লাইন রেলপথ নির্মাণ কার্যক্রম শেষ হয় ২০১৫-১৬ সালে।
এদিকে এই রুটের একমাত্র সিঙ্গেল লাইন হিসেবে বাকি থাকল লাকসাম-আখাউড়া ৭২ কি.মি. রেলপথ। এই অংশে ডাবল লাইন ডুয়েলগেজে উত্তীর্ণ করার কাজ শুরু হলো ২০১৫ সালে। ২০২২ সাল নাগাদ এই নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হওয়ার কথা রয়েছে। এই সেকশনটি ডাবল লাইন হলে সমগ্র ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটটি ডাবল লাইনে উন্নীত হবে।
উল্লেখ্য যে, টঙ্গী-ভৈরববাজার ও চিনকি আস্তানা-লাকসাম মোট ১৩৫ কি.মি রেলপথ হলো মিটার গেজ ডাবল লাইন। অর্থাৎ এই পথে কোনো ব্রডগেজ ট্রেন চলতে পারবে না। অপরদিকে লাকসাম-আখাউড়া সেকশনটি ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন। যার ফলে একটা জটিলতা এখনো রয়ে গেল।
আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের সর্বত্রই ব্রডগেজ নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। তাছাড়া ব্রডগেজ ছাড়া ভারত ও মিয়ানমারের সাথে রেলপথে ট্রানজিট সুবিধা নিশ্চিত করাও সম্ভব নয়।
তাই চিনকি আস্তানা-লাকসাম ও টঙ্গী-ভৈরববাজার নব নির্মিত ১৩৫ কিলোমিটার মিটারগেজ ট্র্যাক ভেঙে নতুন করে ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ করা হবে। আর এতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া ওই লাইন নির্মাণে খরচ হয়েছিল প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা এবং ভেঙে ফেলতে খরচ হবে আরো ১ হাজার কোটি টাকা। একটা অপরিকল্পিত সিদ্ধান্তের কারণে নানা সমস্যায় জর্জরিত বাংলাদেশ রেলওয়েকে বিশাল ক্ষতিপূরণ দিতে হলো।
গত অর্ধ শতাব্দী ধরে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের উন্নয়নকল্পে খরচ করা হয়েছে কয়েক বিলিয়ন ডলার। কিন্তু এত কিছুর পরও এই রুটের উন্নতির পরিবর্তে অবনতিই বেশি হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এই লাইনের যে অবস্থা ছিল বর্তমান অবস্থা তার চেয়েও খারাপ। ১৯৮৬ সালে মহানগর এক্সপ্রেসে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে পৌঁছতে সময় লাগত ৫ ঘণ্টা ৫ মিনিট, বর্তমানে যা ৭ ঘণ্টাতে দাঁড়িয়েছে। এইভাবে সময় বেড়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বিলাসবহুল ট্রেন খ্যাত সুবর্ণ এক্সপ্রেসেরও।
এই সিরিজের পূর্ববর্তী অন্যান্য পর্বগুলো পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে:
১. ভারতবর্ষে রেলওয়ের আগমণ-১ম পর্ব
২. প্রথম যেদিন রেল এলো বাংলায়-২য় পর্ব
৩. বিহার দুর্ভিক্ষ ও সাঁড়া-পার্বতীপুর-শিলিগুড়ি রেল সেকশন-৩য় পর্ব
৪. যশোর-খুলনায় রেল যুগের সূচনা এবং রূপসা-বাগেরহাট সেকশন-৪র্থ পর্ব
৫. উত্তরবঙ্গে যেভাবে ছড়িয়ে পড়ল রেলপথ-৫ম পর্ব
৬. রেলগাড়ি যখন নদীপথে-৬ষ্ঠ পর্ব
৮. কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের সেকাল-একাল-৮ম পর্ব
৯. চা শিল্প যেভাবে সিলেট ও আসামের ইতিহাস বদলে দিয়েছিল-৯ম পর্ব