তখন উমাইয়া শাসনামল (৬৬১-৭৩৭ খ্রি.)। হজরত আলী (রা)-এর ইন্তেকালের পর ইসলামে মূলধারার খিলাফত বিলুপ্ত হয়েছে। হুসাইন (রাঃ) ইয়াজিদ বাহিনীর নিকট পরাজিত ও নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পর উমাইয়া গোত্রের শাসকরাই হয়ে ওঠে তৎকালীন ইসলামী সাম্রাজ্যের শাসনকর্তা।
ইয়াজিদ খিলাফতের দায়িত্ব নেবার পর তাকে অনেকেই খলিফা হিসেবে মেনে নিতে পারেনি। কারণ, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আপন দৌহিত্র হুসাইন (রাঃ)-কে হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতায় পাকাপোক্ত হয়েছিল ইয়াজিদ। সেই থেকেই ইসলাম ধর্মে বেশ কয়েকটি বিভাজন দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। কেউ হয়তো চাইত উমাইয়া শাসনের অবসান হোক। আবার কারো আদর্শিক দিক ছিল- এমন একজন খিলাফতের দায়িত্বপ্রাপ্ত হোক যে কি না রাসূল (সাঃ)-এর নিজ গোত্রের একজন। উমাইয়া শাসনামলের শেষ পর্যায়ে এমন আরো একটি গোষ্ঠীর উত্থান হয়, যারা কোনো রাজনৈতিক প্রচেষ্টায় নয়, বরং আধ্যাত্মিকতার মাধ্যমে মূল ধারার ইসলামে ফিরে যেতে চাইত।
এই আধ্যাত্মিকতার চর্চাই পরবর্তীতে সুফিবাদ নামে পরিচিত হয়। সুফি সাধকরা জাগতিক বিলাসবহুল জীবন ত্যাগ করে অতি সাধারণ জীবনযাপন করতেন। রাসূল (সাঃ) এবং তাঁর সাহাবীগণ যেমন সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন, সুফিরাও সেভাবেই সকল বিলাসিতা বর্জন করতেন। অতি সাধারণ পশমের পোশাক, শুধুমাত্র রুটি আর পানি আহার হিসেবে গ্রহণ করে তাঁরা আধ্যাত্মিক সাধনায় মগ্ন থাকতেন। আরবিতে এমন জীবনযাপনকে বলা হতো ‘সুফ’। এই সুফ থেকেই পরবর্তীতে সুফিবাদের উত্থান হয়।
রাসূল (সাঃ)-এর সময়কালে তিনি রাষ্ট্র পরিচালনা তথা সকল প্রকার সমস্যার সমাধান করতেন ওহীর মাধ্যমে অথবা আল্লাহ তায়ালার বার্তাবাহক হিসেবে। কিন্তু উমাইয়া শাসনামলে শাসক এবং আলেমরা বেশ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যান। ফলে মূলধারার ইসলাম তার পুরোনো ঐতিহ্য হারায়। এমনই একটি সময়ে সুফিবাদের উত্থান হয়।
সেসময় কিছু মানুষ মনে করতেন, যেহেতু আর ওহি নাজিল হবে না, তাই আল্লাহ তায়ালার অলৌকিকত্ব উপভোগ করার একমাত্র উপায় হলো, নির্ধারিত ইবাদতের বাইরেও অধিক ইবাদত করা। তাই তাঁরা একটানা অনেক সময় ধরে কুরআন পাঠ এবং বিরতিহীনভাবে নফল নামাজ আদায় করতে শুরু করেন। এমনই একজন ছিলেন বাগদাদের আল-জুনায়েদ, যিনি প্রতিদিন অবসর সময়ে টানা চারশত রাকাত নফল নামাজ আদায় করতেন। তাঁরা রেফারেন্স হিসেবে রাসুল (সাঃ)-এর একটি হাদিস উল্লেখ করতেন।
“সর্বোত্তম জিহাদ হলো, আল্লাহর বিধানের ব্যাপারে অন্তরের সাথে জিহাদ করা (জামউল জাওয়ামি, কানযুল উম্মাল)।”
খুব অল্প সময়ের মাঝেই গোটা মুসলিম সাম্রাজ্যে সুফিবাদ দর্শন ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমে লোকমুখে ছড়ালেও পরবর্তীতে তা কার্যকরভাবে বিস্তার লাভ করে। কেননা তৎকালে অনেক বিখ্যাত সুফি সাধকের আবির্ভাব হয়, যাদের আধ্যাত্মিকতার চর্চা এবং সাধারণ জীবনযাপন মানুষকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করেছিল।
বিভিন্ন যুগে সুফিবাদ দর্শন যাদের অবদানে বিখ্যাত হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ৩ জন
রাবেয়া বসরি
শত শত বছর ধরে ইসলাম ধর্মের সুফিবাদ দর্শনে যার নামটি দ্যুতি ছড়িয়ে টিকে আছে, তিনি হলেন রাবেয়া বসরি। তাঁর জন্মস্থান বা পরিবার সম্পর্কে ইতিহাস থেকে তেমন কোনো তথ্য জানা যায়নি। ছোটবেলায় পরিবারের সাথে কোনো এক সফরে যাওয়ার সময় ডাকাত দলের কবলে পড়ে রাবেয়া দাসী হিসেবে বিক্রি হয়েছিলেন ইরাকের বসরা অঞ্চলের এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর কাছে। সেই থেকেই রাবেয়া বসরি বসরায় বসবাস করতে শুরু করেন।
রাবেয়াকে যে ব্যক্তি দাসী হিসেবে ক্রয় করেছিলেন, তিনি তাঁর ইবাদত-বন্দেগি দেখে ভীষণ মুগ্ধ হতেন। তিনি (দাস মালিক) একদিন আবিষ্কার করলেন, রাবেয়া নামাজ পড়ার সময় অদ্ভুত এক আলো ছড়ায় তাঁর চারপাশ থেকে। সেদিনের পর থেকে তিনি আরো গভীর পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করেন এবং বুঝতে পারেন, রাবেয়া সাধারণ কেউ নয়। সে হয়তো দরবেশ বা আধ্যাত্মিক কোনো একজন মানুষ।
এরপর রাবেয়ার মালিক তাঁকে মুক্ত করে দেন এবং ভালো পাত্রের সাথে বিয়ে দিতে চান। কিন্তু রাবেয়া জানান, তিনি বিয়ে করতে পারবেন না। কারণ, তিনি আল্লাহর প্রেমে এতটাই মশগুল যে অন্য কাউকে বিয়ে করা সম্ভব নয়। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই রাবেয়ার খবর বসরা ছেড়ে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় অনেকেই মনে করতেন, এই নারী আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের কৌশল জানে। অনেকেই তাঁকে দেখার জন্য বসরাতে আসতে শুরু করে, আবার অনেকেই তাঁর সাগরেদ হয়, যেন তারাও আল্লাহকে পাওয়ার কৌশল শিখতে পারে। এভাবেই রাবেয়া হয়ে ওঠেন বিখ্যাত রাবেয়া বসরি, যার নাম এখনও ভীষণ পরিচিত।
আবু হামিদ মুহাম্মাদ আল-গাজালি
আবু হামিদ মুহাম্মাদ আল-গাজালি, ভারতীয় উপমহাদেশে যিনি ইমাম গাজালি হিসেবে পরিচিত। এগারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে তৎকালীন পারস্যের খোরাসান প্রদেশে জন্ম তাঁর। ছোট থেকেই অসম্ভব মেধাবী ছিলেন। মাত্র ২০ বছর বয়সে ধর্মের উপর বিশেষ জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি খ্যাতিমান আলেম হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। অল্প বয়সেই তাঁর এমন খ্যাতির পেছনে কারণ হিসেবে ছিল তৎকালীন ‘মুতাজিলা’ নামক দার্শনিকদের সাথে যুক্তিতর্ক। মুতাজিলারা ছিল এমন একটি দার্শনিক শ্রেণী যাদেরকে মূলধারার আলেমরা বিচ্ছিন্নতাবাদী সম্প্রদায় মনে করতেন।
মুতাজিলারা মনে করত, কুরআন আল্লাহর অন্যান্য সৃষ্টির মতোই সাধারণ একটি বই মাত্র, তাই কুরআনকে ব্যাখ্যা বা সংশোধন করা যাবে। পাশাপাশি তারা গ্রীক দর্শন সম্পর্কে ছিল বেশ দক্ষ। ইমাম গাজালিও গ্রীক দর্শন চর্চার মাধ্যমে তাঁর অসামান্য বিচক্ষণতা দিয়ে মুতাজিলা দার্শনিকদের ধরাশায়ী করেন। ফলে তিনি হয়ে ওঠেন তুমুল জনপ্রিয়। ১০৯১ খ্রিস্টাব্দে সেলজুক শাসকরা ইমাম গাজালিকে তখনকার সময়ে বাগদাদের বিখ্যাত নিজামিয়াহ কলেজের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেন।
জীবনের খুব অল্প সময়ে অনেক খ্যাতি এবং সফলতা অর্জন করলেও গাজালি মনে করতেন, তিনি আল্লাহকে সঠিকভাবে অনুভব করতে পারছেন না, কীসের যেন একটা মানসিক অপূর্ণতা ছিল তাঁর জীবনে। এরপর হঠাৎ করেই তিনি তাঁর দায়িত্ব থেকে ইস্তফা দিয়ে একেবারে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। যখন ফিরে আসেন তখন তিনি নতুন একজন মানুষ। তবে পূর্বের মতোই মূলধারার আলেমদের তিনি সঠিক মনে করতেন, তবে অধিকতর সঠিক মনে করতেন সুফিবাদকে। নতুন রূপে ফিরে আসা ইমাম গাজালি বলেন, আল্লাহকে পেতে হলে অন্তরের দৃষ্টি দিয়ে খুঁজতে হবে। এজন্য প্রয়োজন কঠোর সাধনা, যে সাধনা মানুষের অন্তর্দৃষ্টি খুলে দেয়। আর এর উপায় জানে কেবল সুফিরাই। এরপর তিনি “Alchemy of Happiness” ও “Revival of The Religious Science” বই দুটি লেখেন। এই বইগুলোর মাধ্যমে তিনি মূলধারার ইসলাম ও সুফিবাদের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেন এবং সুফিবাদ ইসলামের মৌলিকতার অবিচ্ছেদ্য অংশ সেটা বোঝাতে চেষ্টা করেন। এছাড়াও তিনি এই বই দুটিতে সামাজিক, ধর্মীয়, জৈবিক জীবন সম্পর্কে সুফিবাদ দর্শনের আলোকে বিস্তারিত আলোচনা করেন, যা অল্প দিনের মাঝেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে, সেই সাথে বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সুফিবাদ একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপে আবির্ভূত হয়।
জালালুদ্দিন রুমী
“কেবল হৃদয় দিয়েই আপনি আকাশ ছুঁতে পারেন”- রুমি
জালালুদ্দিন রুমী নামটির সাথেই যেন জড়িয়ে আছে হাজারও আধ্যাত্মিক কবিতার লাইন। বাল্যকালে বাবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাজীবন শেষ করে, সেই প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। বেশ কিছু ধর্মীয় বিষয় ব্যাখ্যা করে শিক্ষকতায় বেশ সুনাম অর্জন করেন। কিন্তু এক দরবেশের (সুফি সাধক) সাথে পরিচয় তাঁর পুরো জীবনকে বদলে দেয়। তিনিও হঠাৎ করেই নিরুদ্দেশ হয়ে যান শামস-ই-তাবরিজ নামের সেই পাগলাটে দরবেশের সাথে। তাঁদের মধ্যে এতটাই গভীর সম্পর্ক তৈরি হয় যে, রুমি তার লেখা কবিতাগুলা স্বাক্ষর করতেন শামস-ই-তাবরিজের নামে। একজন আফগান লেখক এ সম্পর্কে বলেছিলেন, রুমির লেখাগুলো হয়তো অনায়াসেই তার মৃত্যুর পরেও ১০০ বছর টিকে থাকতো; কিন্তু শামস-ই-তাবরিজের সান্নিধ্য রুমিকে আজও টিকিয়ে রেখেছে।
বেশ কয়েক বছর পর শামস-ই-তাবরিজ গায়েব হয়ে যান। এরপরেই রুমি, মাসনাভি-ই-মানাতি নামের ১ হাজার পৃষ্ঠার একটি কবিতা রচনা করেন। ইংরেজিতে যাকে ‘The Spiritual Manuscript’ এবং বাংলায় ‘আধ্যাত্মিকতার পাণ্ডুলিপি’ বলা হয়। এছাড়াও জালালুদ্দিন রুমি ৩০ হাজার ছন্দময় গদ্য রচনা করেন। তাঁর এসকল অমর সৃষ্টির পরতে পরতে রয়েছে আধ্যাত্মিকতার অমৃত সুধা, যা পরবর্তীতে রুমির অসংখ্য ভক্ত তৈরি করেছে। এভাবেই রুমি তাঁর কবিতাগুলোর মাধ্যমে সুফিবাদকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।
বর্ণিত তিনজন ছাড়াও আরো অনেক বিখ্যাত সুফি সাধকগণ তাঁদের আধ্যাত্মিক সাধনায় সুফিবাদকে সমৃদ্ধ করেছেন।
সুফিবাদ দর্শনে এমন কিছু অদ্ভুত ক্ষমতা আছে যার মাধ্যমে যেকোনো মানুষ এর প্রতি আকৃষ্ট হয়। তবে বর্তমান সময়ে মূলধারার সুফিবাদ তাঁর পুরনো জৌলুশ হারিয়েছে। তাই হয়তো এই দর্শনের জনপ্রিয়তা বা গ্রহণযোগ্যতা আগের মতো নেই। তবে সে ছিল একটা সময়, যখন সুফিবাদের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহকে পেতে চাইত, প্রকৃত ইসলাম আঁকড়ে ধরতে চাইত।