ছোটখাট গড়নের দেহ, টেনেটুনে সাড়ে পাঁচ ফুটও হবে না। দেহের গঠন অনেকটা নাচিয়েদের মতো, আর হাতে কোদাল থাকলে তার সাথে কেউ পেরে উঠবে না, হোক সেটা মাটি খোঁড়া কিংবা মারামারি। তার চোখের দিকে তাকালেই অবশ হয়ে যায় শিকারের দেহ, চোখের তারায় যেন শয়তান হাসছে। আর তার বন্ধুর চেহারাটাও বিশেষ সুবিধার নয়, সরীসৃপের মতো লম্বাটে মুখ, ঠাণ্ডা নিষ্প্রভ কালো চোখ, কিন্তু তার নিচেই লুকিয়ে রয়েছে আরেকজন খুনীর মস্তিষ্ক।
এডিনবার্গের সাংবাদিকরা তাদের পাঠকদের কাছে এভাবেই তুলে ধরলো উইলিয়াম বার্ক আর তার বন্ধু উইলিয়াম হেয়ারের চেহারার বর্ণনা। এই দুইজনের কুকীর্তির খবর শুনে আতঙ্কে থমকে গিয়েছিলো উনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ সমাজ, লাশ চোর হয়ে উঠেছিল বার্ক-হেয়ারের সমার্থক শব্দ।
লাশ চোর, যারা ‘রিসারেকশনিস্ট’ হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছিল, নিয়মিত হানা দিতে থাকলো ইংল্যান্ডের গোরস্থানগুলোতে। কোদাল আর হারিকেন নিয়ে রাতের অন্ধকারে কবর থেকে চুরি করতে থাকলো সদ্যমৃত লাশগুলো। তারপর সেগুলোকে বিক্রি করে দিতো কাঁটাছেড়ার অপেক্ষায় বসে থাকা মেডিকেল ছাত্রদের কাছে। কিন্তু বার্ক-হেয়ার লাশ চুরি করার ধার ধারেনি, বরং তারা নিজেরাই খুন করে লাশ বানিয়ে বিক্রি করতে শুরু করলো!
আয়ারল্যান্ডের দরিদ্র পরিবারে জন্ম উইলিয়াম বার্কের। দিনমজুর বাবার মতো তারও পেট চালাতে নামতে হয়েছিল দর্জি, মুচিসহ অন্যান্য কাজে। পেটের তাগিদে স্কটল্যান্ডে পাড়ি জমানোর পর ভুলে গেলো আয়ারল্যান্ডে থাকা পরিবারের কথা। স্কটল্যান্ডে আধাসামরিক বাহিনীতে কাজ করার সময় পরিচয় হলো হেলেন ম্যাকডৌগালের সাথে, তাকেই স্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করলো বার্ক।
এদিকে ঐ বাহিনীতেই আয়ারল্যান্ড থেকে আসা আরেকজনের সাথে পরিচয় হলো বার্কের। কড়া মেজাজের জন্য পরিচিত এই লোকের নাম উইলিয়াম হেয়ার। হেয়ার আর তার স্ত্রী মার্গারেট এডিনবার্গে থাকতো, পেট চলতো নিজেদের বোর্ডিং হাউজ ভাড়া দিয়েই। সস্তা থাকা-খাওয়ার জায়গা পেয়ে সেখানেই হাজির হলো সস্ত্রীক বার্ক। একই বাড়িতে থাকা আর একইজায়গায় কাজ করার ফলে দুইজনের মধ্যে খাতির জমে উঠতে বেশি সময় লাগেনি।
হেয়ারের বোর্ডিং হাউজের ভাড়াটে শুধুমাত্র হেলেন আর বার্কই ছিল না। ডোনাল্ড বার্ক নামের এক বৃদ্ধও আস্তানা গেড়েছিলো ওখানে। তারপর হঠাৎ একদিন রাতে সম্পূর্ণ ভাড়া পরিশোধ করার আগেই পরলোকে পাড়ি জমালো সে। হেয়ারের এখন টাকার প্রয়োজন, এদিকে মৃতদেহ গোর দেওয়ার খরচও কম নয়।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলো উইলিয়াম বার্ক। এডিনবার্গের মেডিকেল শিক্ষার্থীদের জন্য লাশ খুবই আকর্ষণীয় বস্তু, জানা ছিল তার। শহরের বিখ্যাত শল্যচিকিৎসাবিদ ডক্টর নক্সের বাড়িতে হাজির হলো দু’জন, ছালায় ভর্তি ভাড়া না মেটানো ভাড়াটের মৃতদেহ। ডাক্তার নক্সের সেক্রেটারি মৃতদেহটির বিনিময়ে আট পাউন্ড হস্তান্তর করলো। হেয়ার নিলো সাড়ে চার পাউন্ড, বাকিটুকু গেল বার্কের পকেটে। হঠাৎ করে হাতে কাচা টাকা আসার পর দু’জনেরই মনে ‘ভালো একটা ব্যবসা’ শুরু করার বুদ্ধি এলো। কিন্তু তারা নিয়মিতভাবে মৃতদেহ পাবে কোথায়?
সমাধান নিজেই হেঁটে এলো। শহরের বাইরেই অ্যাবিগেইল সিম্পসন নামের এক বিধবা মহিলা বাস করে। প্রতি সপ্তাহে পেনশনের টাকা নিতে শহরে আসতে হয়, যার বেশিরভাগই উড়িয়ে দেয় মদ খেয়ে। বৃদ্ধ, দুর্বল আর একাকী এই মহিলাকে বোর্ডিং হাউজে হুইস্কি খাওয়ার আমন্ত্রণ জানালো হেয়ার, বৃদ্ধাও সাদরে গ্রহণ করলো তা। মাতাল হয়ে পড়তেই তার হাত-পা চেপে ধরলো হেয়ার, আর হাত দিয়ে নাক-মুখ বন্ধ করে শ্বাসরোধ করে প্রথম নিজ হাতে কাউকে হত্যা করলো বার্ক। তারপর বস্তাবন্দী করে গন্তব্য আবারো ডাক্তার নক্সের বাসা, হাতে এলো কড়কড়ে কিছু টাকা।
বার্ক আর হেয়ারের পরবর্তী শিকার আরেক বৃদ্ধ। অসুস্থ জোসেফের মৃত্যু হলো বালিশের নিচে চাপা পড়ে। বালিশ দিয়ে নাক চেপে ধরার ফলে মৃতদেহে খুব একটা ছাপ না পড়ায় বার্ক আর হেয়ারের কাছে খুনের এই পদ্ধতিই প্রিয় হয়ে উঠলো। ময়নাতদন্তকারীকেও বুঝতে কষ্ট হবে এই মৃত্যু স্বাভাবিক না অস্বাভাবিক। ৪০ বছর বয়সী এক ফেরিওয়ালা হেয়ারের বোর্ডিং হাউজে উঠেছিলো। ঠিক সেই সময়েই তার শরীরে বাসা বাঁধলো জন্ডিসের জীবাণু। অসুস্থ এই মধ্যবয়সীকেও পরপারে পাঠিয়ে দিলো বার্ক-হেয়ার, নক্সের সেক্রেটারির কাছ থেকে বাগিয়ে নিলো ১০ পাউন্ড।
এই বৃদ্ধদেরকে কার পর কাকে খুন করা হয়েছিল তা নিয়ে বেশ সন্দেহ রয়েছে। কারণ এ অপরাধগুলোর স্বীকারোক্তি বার্কের মুখ থেকে নেওয়া হয়েছিল। বার্ক আর হেয়ার দু’জনে মিলে এতগুলো খুন করেছিলো যে, কার পরে কাকে এবং কবে খুন করা হয়েছিলো তাও মনে ছিল না তাদের! একের পর এক লাশ জমা হতে থাকলো। একটি লাশ হস্তান্তর করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মেরি পিটারসেন নামক এক মহিলাকে খুন করে আবার নিয়ে আসায় সন্দেহ করতে শুরু করে ডাক্তার নক্সের সহকারী, যদিও তাদেরকে ঠিকঠাকভাবেই টাকা পরিশোধ করে দেয় সে।
এদিকে মেরির আকর্ষণীয় চুল কেটে পরচুলার দোকানে বিক্রি করে দিয়ে আসে বার্ক। বার্ককে নক্সের সহকারী মেরির দেহ কোথা থেকে পেয়েছে তা জিজ্ঞাসা করে। বার্কের উত্তর শুনে নক্সের সহকারীর মন্তব্য করেছিলেন, “কোনো ব্যক্তি যে তার আত্মীয়ের মৃতদেহ বিক্রি করতে পারে এই প্রথম শুনলাম!”
বার্ক আর হেয়ারের শিকাররা ছিল মূলত এডিনবার্গের সাধারণ গরীব জনগণ, যাদেরকে দেখার মতো কেউ নেই, যারা হারিয়ে গেলেও জনসাধারণের মনে খটকা লাগবে না। যা-ই হোক, বার্ক আর হেয়ার বেশ বড় একটা ভুল করে বসলো। তাদের পরবর্তী শিকার হলো এক স্থানীয় ভিক্ষুক, শারীরিক আর মানসিক- উভয়দিক থেকেই বিকলাঙ্গ এই ব্যক্তি পরিচিত ‘ড্যাফট জেমি’ নামে।
রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করে বেড়ানো ড্যাফট জেমির মুখটা সবার কাছেই পরিচিত। বার্ক আর হেয়ার আন্দাজও করতে পারেনি ড্যাফট জেমির অনুপস্থিতি কতটা জনসাধারণের মনে আলোড়ন ফেলবে। ১৮ বছর বয়সী জেমি বিকলাঙ্গ হলেও তার শরীরে যথেষ্ট শক্তিসামর্থ্য ছিল, তাই যখন বার্ক আর হেয়ার তাকে মাতাল করে খুন করার চেষ্টা করলো, সে তার সর্বশক্তি দিয়েই বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলো। তবে দু’জন বলশালী ব্যক্তির সাথে একা সে কি আর পারে?
বার্ক আর হেয়ার জেমির লাশ বিক্রি করে দিয়ে টাকা গুণতে গুণতে বাড়ি ফেরার পরদিন যখন ডাক্তার নক্স তার সহকারীদের নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা শুরু করলেন, তখনই তার এক সহকারী লাশটিকে ‘ড্যাফট জেমি’ হিসেবে শনাক্ত করলেন। এদিকে জেমির মতো একজন তরুণ কীভাবে হঠাৎ করে মারা গেলো আর কীভাবেই বা দুইজন অপরিচিত ব্যক্তি তার লাশ নিয়ে বিক্রি করলো তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা শুরু হলো।
বার্ক আর হেয়ারের ১৬তম এবং শেষ শিকার হলো মার্গারেট ডকার্টি, হেয়ারের বোর্ডিং হাউজের আরেকজন ভাড়াটে। কিন্তু এই মধ্যবয়সী মহিলাই শেষ চেষ্টা করে ধরিয়ে দেয় দুই খুনীকে। তার মুখে বালিশ চেপে ধরতেই মার্গারেট ‘খুন’ বলে চিৎকার করে উঠেছিলেন, যা শুনতে পেয়েছিলো বোর্ডিং হাউজের ভাড়াটিয়া দম্পতি জেমস-অ্যান গ্রে। পরদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর হেয়ারের স্ত্রী তাদের সাথে একটু অদ্ভুত ব্যবহার করা শুরু করে, তাদেরকে পাশের রুমে যেতে নিষেধ করে। এই নিষেধ করাই কাল হয়ে দাঁড়ালো বার্ক-হেয়ারের জন্য। কৌতূহলবশত তারা ঘরে ঢুকে আবিষ্কার করে মার্গারেটের লাশ। সাথে সাথে তারা পুলিশকে জানায়। যদিও এর মধ্যেই লাশ ডাক্তার নক্সের মর্গে পৌঁছিয়ে গিয়েছে।
বার্ক আর হেয়ারকে গ্রেফতার করা হয়। ডাক্তার নক্সকে ঝামেলা পোহাতে হয়নি, যদিও তার মতো একজন অভিজ্ঞ ডাক্তার কীভাবে এত তাজা লাশ নিয়মিতভাবে তার বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে তা বুঝেও না বোঝার ভান করেছিলেন। বিচারের মুখোমুখি না হলেও উত্তেজিত জনগণ তার বাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে তাকে শহরছাড়া করে। পরে লন্ডনে আস্তানা গাড়লেও তার সম্মান ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছে ততদিনে।
অপরাধে হেয়ারের সরাসরি সম্পৃক্ততা থাকা সত্ত্বেও তাকেও অপরাধের সাজা ভোগ করতে হয়নি। হেয়ার পুরো অপরাধটিই বার্কের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়, বার্কও তা স্বীকার করে নেয়। বার্ককে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। মৃত্যুর পর তার লাশ পাঠিয়ে দেওয়া হয় এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে তার ব্যবচ্ছেদ করা লাশ প্রদর্শনীর জন্য রেখে দেওয়া হয়। হেয়ার সাজা না পেলেও তাকে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যেতে হয়। কারণ তাকে কেউ চিনতে পারলে হয়তো তাকে সেখানেই শেষ করে দেওয়া হবে। বার্ক আর হেয়ারের কিংবদন্তী এতটাই প্রচলিত হয়ে পড়ে যে, লাশ চোরের আরেকটি নামই হয়ে যায় বার্ক-হেয়ার। লন্ডনের আরেক বিখ্যাত লাশ চোর জন বিশপ, যে তার ১২ বছরের লাশ চুরির ক্যারিয়ারে কবর থেকে ৫০০ থেকে ১ হাজার মৃতদেহ উঠিয়ে নিয়েছে, পরিচিতি পেয়েছিলো ‘দ্য লন্ডন বার্কারস’ নামে।
বার্ক আর হেয়ারের কর্মকাণ্ড কিংবদন্তীতে পরিণত হতে সময় লাগলো না। ইংল্যান্ডের বাচ্চাদের ভূতের গল্প আর ছড়ার তালিকায় যোগ হলো নতুন একটি ছড়া,
“Up the close and down the stair,
in the house with Burke and Hare.
Burke’s the butcher, Hare’s the thief,
Knox the man who buys the beef.”
বর্তমানে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে বার্কের ডেথ মাস্কের পাশেই রয়েছে একটি বই। গুজব রয়েছে, এই বইটি তৈরি করা হয়েছে বার্কের চামড়া দিয়ে, তার মৃত্যুর পর তার শরীর থেকে চামড়া আলাদা করে এই বই বানানো হয়েছে! অন্য ব্যক্তির লাশ বিক্রি করে নিজের পেট চালানো বার্কের জন্যও এটি অমানবিকই বলা চলে।