দাসপ্রথা! মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন বিনিময় ব্যবস্থার একটি হলো এই দাসপ্রথা। সেই খ্রিস্টপূর্ব অষ্টাদশ শতাব্দীতে ব্যাবিলনীয়দের ‘দ্য কোড অফ হাম্মুরাবি’-তে প্রথমবার দেখা মিলেছিল ক্রীতদাসদের। তারপর থেকে প্রায় প্রতিটি সভ্যতাই আপন প্রয়োজনে সৃষ্টি করেছে সামাজিক বৈষম্যতার। আর সেই বিভেদের ফলে নিজেদের মধ্যেই তৈরি করেছে তথাকথিত দাসত্বের। আর অন্য জাতিগোষ্ঠীর লোকদেরও ঠেলে দিয়েছে এই অমানবিকতার দিকে।
দাসব্যবসা শুনে নিশ্চয় চোখে ভাসছে একদল কৃষ্ণাঙ্গের ছবি, যাদেরকে আটলান্টিক পাড়ি দিতে হয়েছিলো সাদা চামড়ার লোকদের অধীনে গতর খাটাবার জন্য? ইউরোপীয়রা নিজেদের উপনিবেশগুলোকে আরও চাঙ্গা করে তুলতে অন্ধকার মহাদেশ থেকে যাদের ধরে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলেছিল এক নতুন বিশ্বে। পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে শুরু করে উনবিংশ শতাব্দীর প্রায় শেষদশক পর্যন্ত চলা এই নির্মম দাস ব্যবসার শিকার হয়েছিলো প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ কৃষ্ণাঙ্গ।
আটলান্টিকের উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বিশাল আমেরিকা মহাদেশে ইংরেজ-ওলন্দাজ-ফরাসি-স্প্যানিশ-পর্তুগিজ ঔপনিবেশিকরা যখন ঝাঁকে ঝাঁকে জাহাজ ভর্তি করে পশ্চিম আফ্রিকা থেকে কৃষ্ণাঙ্গ দাসদেরকে নিয়ে আসছিলো, ঠিক ঐ সময়েই প্রায় দশ লক্ষেরও বেশি ইউরোপিয়ান শ্বেতাঙ্গ শিকার হয়েছিলো উত্তর আফ্রিকার উপকূল জুড়ে রাজত্ব করা ‘আমজাঘি’ দাসব্যসায়ীদের! ইতিহাস দাসদের সাথে প্রায় সবসময়ই একইরকম আচরণ করে এসেছে, গায়ের চামড়ার রঙ তাতে খুব একটা প্রভাব ফেলেনি। ব্যতিক্রম হয়নি এই শ্বেতাঙ্গ দাসদের ক্ষেত্রেও। কিন্তু এই শ্বেতাঙ্গ দাস ব্যবস্থার দিকে ইতিহাসবিদেরা তেমন একটা দৃষ্টিপাত করেনি কেন? কারণ হিসেবে ইতিহাসবিদ রবার্ট ডেভিস তার বইয়ে ব্যাখ্যা করেছেন, “ইতিহাস শ্বেতাঙ্গদেরকে শোষণকারী ঔপনিবেশিক হিসেবেই তুলে ধরতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছে, যতটা না করেছে দাসব্যবস্থার শিকার হিসেবে।” আসুন তবে ঘুরে আসা যাক ইতিহাসের নিচে চাপা পড়ে যাওয়া এক অন্য ইতিহাস থেকে, যখন ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গরা শিকার হয়েছিলো আফ্রিকানদের দাসব্যবসার।
বারবার জলদস্যুদের উত্থান
“আমরা যখন কর্কে পৌঁছেছিলাম, আমরা লর্ড ইনচাকুইওনকে অনুরোধ করেছিলাম শুধুমাত্র ইংল্যান্ডে যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার জন্য। তারপর আয়ারল্যান্ডের ইউঘাল থেকে ১২০ জন যাত্রী নিয়ে যখনই ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম, ডাঙার সীমারেখা অদৃশ্য হওয়ার আগেই নিজেদেরকে আবিষ্কার করলাম আলজেরীয় জলদস্যুদের জাহাজে, লোহাঘেরা বাক্সের মধ্যে!”, এভাবেই ডায়েরিতে নিজের দাস জীবনের শুরুটা বর্ণনা করেছিলেন রেভারেন্ড স্প্রাট।
চতুর্দশ শতাব্দীর শুরু থেকে পরবর্তী প্রায় দুইশো বছর ভূমধ্যসাগর নিজেদের দখলে রেখেছিলো খ্রিস্টান জলদস্যুরা, বেশিরভাগেরই আবাসস্থল ছিলো বর্তমান স্পেনের কাতালোনিয়া কিংবা সিসিলি দ্বীপ। সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদের হাতে কন্সট্যান্টিনোপলের পতন ঘটলে অটোম্যান সাম্রাজ্যের বিস্তারের সাথে সাথে ভূমধ্যসাগরও নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে মুসলিমরা।
সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুর কথা, ইউরোপীয় জলদস্যুদের হাত ধরে আধুনিক প্রযুক্তির নৌযানবিদ্যা পৌঁছে যায় উত্তর আফ্রিকার উপকূলে, ফলাফল হিসেবে বারবার জলদস্যুরা নিজেদেরকে তৈরি করতে থাকে ইউরোপের উপকূলীয় অঞ্চলে অভিযান চালানোর জন্য। স্পেন-পর্তুগাল পার হয়ে তারা হানা দেয় ব্রিটিশ আইল, এমনকি সুদূর আইসল্যান্ডেও! এভাবে উপকূলীয় বিভিন্ন গ্রাম থেকে জেলে থেকে শুরু করে গ্রামের সাধারণ নারী-শিশুদেরকেও ধরে নিয়ে আসা হয় উত্তর আফ্রিকায়, দাস হিসেবে বিক্রি করার জন্য।
নারকীয় ভাগ্য
জলদস্যুদের হাতে যারা ধরা পড়তো, তাদের ভাগ্য আসলেই বেশ খারাপ ছিলো। তারা যা সবচেয়ে ভালো আশা করতে পারতো তা হচ্ছে, কারো ব্যক্তিগত চাকর হিসেবে জীবন শেষ করা। অল্পবয়সী নারীদেরকে কিনে নেওয়া হতো হারেমের জন্য এবং সেখানেই তারা চিরদিনের জন্য উধাও হয়ে যেত। শক্ত-সমর্থ পুরুষদেরকে কিনে নিত শহর কর্তৃপক্ষ, তাদেরকে কাজে লাগানো হতো জাহাজ ধোয়া-মোছা, দাঁড় টানাসহ বিভিন্ন ধরনের কঠিন পরিশ্রমের কাজে। জাহাজের ডেকের উপর তাদেরকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হতো, কষ্ট সহ্য করতে না পেরে ওখানেই মারা যেত শত শত দাস।
শীতের মৌসুমে গালিওত্তি নামে পরিচিত এসকল দাসদেরকে রাষ্ট্রের কাজে লাগানো হতো। পাথর পরিবহন, বন থেকে কাঠ কেটে নিয়ে আসা, জাহাজ তৈরি কিংবা বন্দর সংস্কার, এসবই ছিল তাদের কাজ। প্রতিদিন তাদেরকে দুই থেকে তিন টুকরা রুটি দেওয়া হতো, সাথে খুবই অল্প পরিমাণ পানি। বছরে মাত্র এক খন্ড কাপড়ই তাদের জন্য বরাদ্দ ছিল। কঠোর পরিশ্রম আর সীমিত খাবারে টিকে থাকা যে সকল ক্রীতদাসরা কাজ করতে করতে লুটিয়ে পড়তো, উঠে দাঁড়ানো পর্যন্ত তাদেরকে চাবুক দিয়ে পেটানো হতো। বুড়ো হয়ে গেলে কিংবা দাসমালিকদের টাকার প্রয়োজন হলে এসব ক্রীতদাসদেরকে পুনরায় বিক্রি করে দেওয়া হতো। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যবানদের শেষ গন্তব্য হতো সুয়েজ শহর, কিংবা সুলতানের জাহাজে, আমৃত্যু তাদেরকে সেখানেই থাকতে হতো।
ইউরোপীয়দের জবাব
ইউরোপিয়ানরা মাঝেমধ্যেই মুক্তিপণের মাধ্যমে ক্রীতদাসদেরকে ছাড়িয়ে আনার চেষ্টা করতো, কিন্তু ১৬৪০ এর আগপর্যন্ত ঐরকমভাবে তেমন কোনো পদ্ধতি গড়ে ওঠেনি। এ সময়ের পর থেকে ফ্রান্স আর স্পেনে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে ওঠে, যাদের কাজ ছিল টাকা সংগ্রহ করা, বারবার অঞ্চলে যাওয়া, দাসমালিকদের সাথে কথা বলে দাসদেরকে ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করা, আর উপযুক্ত মুক্তিপণের বিনিময়ে দাসদেরকে নিরাপদে পুনরায় ইউরোপে ফিরিয়ে আনা।
স্পেন আর ইতালির গির্জাগুলোতে ‘গরীব দাসদের সাহায্য করুন’ লেখা ডাকবাক্স ঝুলিয়ে রাখা হতো। ধনী ব্যক্তিরা তাদের সাধ্যমতো দান করার চেষ্টা করতো। ইউরোপের শহর আর গ্রামের সবজায়গাতেই এ ধরনের ডাকবাক্স চোখে পড়তো। গির্জা কর্তৃপক্ষও লোকজনের কাছে ছড়িয়ে দেন যে, বারবার উপকূলের দাসদের মুক্তিপণের জন্য দান করা সবচেয়ে ভালো কাজগুলোর একটি। ইউরোপীয়দের এরকম পদক্ষেপের কারণে অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরু থেকেই দাসদের উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যেতে থাকে, বারবাররা দাসদের দাম বাড়িয়ে দিলেও ইউরোপীয়রা তা পরিশোধ করতে দ্বিরুক্তি করেনি।
ক্যাথলিকদের চেয়ে প্রোটেস্ট্যান্ট রাষ্ট্রগুলো তাদের দাস ছাড়িয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে খানিকটা পিছিয়েই ছিল, কারণ হিসেবে তাদের বিশৃঙ্খল অবস্থা আর অনাগ্রহকেই দায়ী করা যায়। ওলন্দাজ, জার্মান আর ইংরেজ দাসদেরকে তাই আফ্রিকার উপকূলে বহুদিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল, বেশিরভাগই আর পিতৃভূমিতে ফিরে যেতে পারেনি। রাষ্ট্রের উদ্যোগ ছাড়াও অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে চেষ্টা করেছিলো ক্রীতদাসদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনতে, এদের মধ্যে উল্লেখ করা যায় এডমুন্ড কোসেনকে, যিনি ২৪৪ জন নারী-পুরুষ-শিশুকে নিজ খরচে মুক্ত করে এনেছিলেন।
ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন জীবন
অত্যাচারের মাত্রা সহ্য করতে না পেরে অনেক ক্রীতদাসই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলো। এর সুবিধাটা হলো, তাকে আর জাহাজের দাঁড়টানার কাজে লাগানো হবে না। খ্রিস্টান যুবতী, যাদেরকে পাশার হারেমে নিয়ে যাওয়া হতো, তাদেরকে তুর্ক মহিলা হিসেবেই ধরা হতো, আর তাদের বাচ্চাদেরকে মুসলিম হিসেবে বড় করে তোলা হতো।
পুরুষরা আরো সহজ কাজে যোগ দিতো, বেশিরভাগ সময়েই অন্যান্য দাসদের তদারকি করার কাজ গ্রহণ করতো। অনেকেই আবার এ কারণে দাসত্ব থেকে মুক্তিও পেতো। ১৫৮০ থেকে ১৬৮০ সালের মধ্যে প্রায় ১৫ হাজার ধর্মান্তরিত ব্যক্তি অর্থাৎ ‘রেনেগেড’রা ক্রীতদাস থেকে জাহাজের ক্যাপ্টেন, রে’ইস, এমনকি অনেক সময় পাশাও (অটোমান সাম্রাজ্যের নাইটহুড) বনে যেত। তবে বারবার উপকূলে যে শুধু খ্রিস্টানদেরকেই ধরে ধরে বিক্রি করা হতো তা নয়, বরং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কালো-বাদামী-সাদা-ইহুদী-মুসলিম-ক্যাথলিক-প্রোটেস্ট্যান্ট, সবাইকেই দাসত্বের শৃঙ্খলে আটকা পড়তে হতো।
অনেকেই মনে করে, দাসদেরকে শুধু তাদের গায়ের চামড়ার রঙ কিংবা তাদের ধর্মবিশ্বাসের জন্যই দাস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ইতিহাস বলে ভিন্ন কথা, দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার আর ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করতেই আগমন ঘটেছে এই নিষ্ঠুর ব্যবস্থার।
তথ্যসূত্র:
1. The Travels of Reverend Olafur Egilsson: The Story of the Barbary Corsair Raid on Iceland in 1627 – Adam Nicholas & Karl Smith Hreinsson – The Catholic University of America Press
2. BBC History UK – January 2017
3. The Barbary Slaves – Stephen Clissold
ফিচার ইমেজ: SwaliAfrica Magazine