অসংখ্য গল্পগাথা, বই, সিনেমা, সিরিয়াল, কার্টুনে ব্যবহৃত বহুল পরিচিত একটি নাম ‘রবিন হুড’। তাকে নিয়ে বিতর্কের যেন কোনো শেষ নেই। একদল মনে করে তিনি কেবলই রূপকথার নায়ক, আরেক দলের কাছে তিনি কল্পনাকে হার মানিয়ে দেয়া বাস্তব জগতের এক দেবতা। আজ থেকে প্রায় ৭০০ বছর আগে নটিংহ্যামশায়ারের এক আইন অমান্যকারী ধনীদের অবৈধ সম্পদ কেড়ে নিয়ে বিলিয়ে দিতো দরিদ্রদের মাঝে। এই গল্প নানাভাবে কখনো রঙ চড়িয়ে, কখনো রবিন হুডকে ভিলেন বানিয়ে পরিবেশন করা হয়েছে পপ কালচারের আকর্ষণীয় উপাদান হিসেবে। এই গল্পের যে কত সংস্করণ আছে, তার ইয়ত্তা নেই! কিন্তু সত্যিই কি শেরউড জঙ্গলের এই রবিন হুড মানুষের উর্বর মস্তিষ্কের নিছক কল্পনা নাকি বাস্তব জগতের কোনো নায়কের জীবনীর অনুপ্রেরণায় তৈরি হয়েছে চরিত্রটি? চলুন তবে অনুসন্ধান করা যাক শত বছরের পুরোনো এই অজ্ঞাত প্রশ্নের উত্তর।
পঞ্চদশ শতাব্দীর শুরুর দিকের কথা, কিংবা এর আরো আগেও হতে পারে, ইংল্যান্ডের খ্রিস্টান অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে মে ডে উদযাপন করা হতো বেশ জাঁকজমকপূর্ণ উৎসবের মধ্য দিয়ে। সে সময়কার বিভিন্ন খেলা কিংবা নাটকে গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করা হতো রবিন হুডকে। একাধারে তিনি ডাকু, তীরন্দাজ এবং অসিযোদ্ধা। উনবিংশ শতাব্দীতে হওয়ার্ড পাইলের মতো লেখক-আঁকিয়েদের হাত ধরে শিশুতোষ গল্পের নায়ক চরিত্রে উপনীত হয় রবিন হুড। যুক্তরাষ্ট্র থেকে যুক্তরাজ্য হয়ে ধীরে ধীরে বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তেও ছড়িয়ে পড়ে এই কাহিনী। রিডলী স্কট, টেরি গিলিয়াম কিংবা মেল ব্রুকসের মাধ্যমে রূপালী পর্দায় এসে রবিন যেন পৌঁছে গেছে জনসাধারণের দোরগোড়ায়। কিন্তু এর শুরুটা কীভাবে হলো?
১৩৭৭ সালে সর্বপ্রথম সাহিত্যে রবিন হুডের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। ব্রিটিশ জাদুঘরে সংরক্ষিত স্লোয়ান পাণ্ডুলিপি অনুযায়ী রবিন জন্মগ্রহণ করেন ১১৬০ সালে লকারস্লি শহরে, দক্ষিণ ইয়র্কশায়ারের এই শহরটি বর্তমানে লক্সলি নামে পরিচিত। তবে বেশ কিছু কাহিনীতে তিনি ১৩২২ সালে ল্যাঞ্চেস্টারের রাজদ্রোহে অংশ নিয়েছিলেন বলে জানা যায়, সে হিসাবে রবিনের জন্ম আরও পরে। সে যা-ই হোক না কেন, রবিন হুড যে উত্তরাঞ্চলের লোক ছিলেন, তা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। শেরউড জঙ্গলের উপকূলে সৈন্য-সামন্ত নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছিলেন নিজের এক দুনিয়া। অবশ্য পরনের সবুজ রঙের জামাকাপড় দেখে অনেকেই তাকে রূপকথার রাজ্যের প্রতীক বলে মনে করেন, কে জানে কোনটা সত্যি! টারজান, হারকিউলিস কিংবা মোগলিরা সত্যি পৃথিবীর বুকে একদিন সগর্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল, নাকি সবই মানুষের লাল-নীল কল্পনা, তা নিয়ে ভেবে এখন আর কী লাভ?
রবিন আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা পরিচিত ছিল ‘মেরি ম্যান’ নামে। শেরউড জঙ্গলে আধিপত্য বিস্তার করা এই দলটির সদস্য সংখ্যা ২০ থেকে শুরু করে ১৪০ পর্যন্ত লিখিত আছে। মেরি ম্যানদের তিনজনকে বিশেষ প্রাধান্য দেয়া হয়েছে ইতিহাসে- লিটল জন, মাচ দ্য মিলার এবং উইল স্কারলেট। ভাইকিং জলদস্যুদের লুটতরাজের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হয়ে লড়াই করেছিল মেরি ম্যানরা। রবিন হুড আর তার ডান হাত লিটন জনকে নিয়ে বহু জনপ্রিয় কাহিনী প্রচলিত আছে। একবার ইয়র্কশায়ারের হুইটবিতে অনুষ্ঠিত এক প্রীতি আর্চারি (ধনুর্বিদ্যা) প্রতিযোগিতায় মেরি ম্যান দলের প্রধান দুই তীরন্দাজ রবিন আর জনকে মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়। বলা হয়, রবিন হুডের তীর বন্দুকের গুলির চেয়েও ভালো লক্ষ্যভেদ করতে পারতো। এমনকি তিনি নাকি চোখ বন্ধ করেও নিশানা ভেদ করতে পারতেন। তার পিঠে থাকতো ১০০ তীর ভরা একটি থলি। মঠের ছাদ থেকে তাদের দুজনকে তীর ছুঁড়তে বলা হলে সেই তীর প্রায় এক মাইলেরও বেশি দূরে গিয়ে হুইটবিতে পড়ে। এই সুদীর্ঘ এলাকার পুরোটাই রবিন হুডদের আওতায় চলে আসে। গল্পগাথাগুলোতে রবিন হুডকে যতটা প্রাধান্য দেয়া হয়েছে, লিটল জনকেও কিন্তু তার চেয়ে কোনো অংশে কম গুরুত্ব দেয়া হয়নি। জন শুধু রবিনের প্রধান লেফটেন্যান্টই ছিল না, বরং কিছু কিছু যুদ্ধে পুরো পরিস্থিতি সামলে নেয়ার একক কৃতিত্বের দাবিদারও চালাক এই যোদ্ধাই। লিটল জনের কথা নাহয় আরেকদিন হবে।
রবিন তার বদান্যতা আর গরীব-দুঃখীদের প্রতি ভালোবাসার পাশাপাশি শেরিফ এবং তার দলবলের মতো অত্যাচারী ধনীদের প্রতি বিতৃষ্ণার জন্য অধিক পরিচিত। বিশেষত প্রান্তিক চাষীদের উপর জোরপূর্বক চাপিয়ে দেয়া জঙ্গলের অনিয়ম বরদাস্ত না করে ইতিহাসে নিয়মভাঙা এক আউটল হিরোতে পরিণত হয়েছে রবিন। রাজা দ্বিতীয় এডওয়ার্ডের সময় এই ঘটনাগুলো অনেক বেশি হওয়ায় তাকে সেই সময়কার এক যোদ্ধা হিসেবে বিবেচনা করেন একদল ঐতিহাসিক, অন্য দলের মতে লায়নহার্ট খ্যাত রাজা প্রথম রিচার্ডের আমলে ছিল রবিনের বিচরণ। রবিন হুড মতান্তরে রবার্ট হুড সম্পর্কে ১৫২১ সালে স্কটিশ ঐতিহাসিক জন মেজর লেখেন,
“দলের সাথে রবিনের চুক্তি ছিল নারীদের কোনোরকম অসম্মান করা যাবে না, দরিদ্রদের কাছ থেকে কখনো অর্থ আত্মসাৎ করা যাবে না, বরং অত্যাচারী রাজার খাজাঞ্চি থেকে লুট করা অর্থের একটি নির্দিষ্ট অংশ তাদের মাঝে বিলিয়ে দিতে হবে।”
১৪৯২-১৫১০ সালের মধ্যে রবিনকে নিয়ে লিখিত সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতা বা গাথার নাম ‘দ্য লিটল জেস্ট অফ রবিন হুড’। এই কবিতাটি শেষ করা হয়েছে “দরিদ্রদের জন্য তিনি অনেক উপকার করে গেছেন”- কথাটির মাধ্যমে। ডাকুদের যেখানে সবাই ঘৃণা আর ভয়ের চোখে দেখে, সেখানে রবিনের নামে তখনকার সাধারণ মানুষরা ছড়া গান গেয়ে বেড়াতো।
স্যাক্সন গোত্রীয় হিসেবে পরিচিত রবিনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যাওয়া একটি নাম ‘মেইড মারিয়ান’, যদিও শুরুর দিকে রবিন ও মেইড মারিয়ান দুটি পৃথক চরিত্র হিসেবে গল্পগুলোতে উঠে আসে। মজার ব্যাপার হলো, সে সময়কার কোনো কাহিনীতে আউটল বা রবিন হুডের মতো ডাকুদের স্ত্রী-পরিবারের কথা কোথাও কিছু বলা হয়নি। কুমারী মেরির প্রতি রবিনের এই ভালোবাসা সেজন্য সাধারণ পাঠক থেকে শুরু করে ইতিহাসবেত্তাদের জন্যও কৌতূহলোদ্দীপক। বলা হয়, তখনকার যুগে সামাজিক স্বীকৃতি ব্যতীত নারী-পুরুষের মধ্যকার সম্পর্ককে গর্হিত অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হতো বলে রবিন ও মেরির কথা কোথাও বলা হয়নি। পরবর্তীতে দুজনের টুকরো টুকরো গল্প জোড়া লাগিয়ে ষোড়শ শতাব্দীতে প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্করণের এক গ্রন্থে প্রথমবারের মতো রবিনের স্ত্রী হিসেবে মারিয়ানকে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
প্রায় সব গল্পের প্রতিটি সংস্করণে একটি সাধারণ মিল খুঁজে পাওয়া গেছে, তা হলো রবিন হুডের মৃত্যুর কারণ। বৃদ্ধ ও অসুস্থ রবিন হাডারস্ফিল্ডের পাশে কার্কলেস প্রাইওরিতে লিটল জনের কাছে গিয়ে হাজির হয়। বাড়িতে অবস্থানরত মালকিন, লিটন জনের খালা, তার দেখাশোনা করবে এমনটাই ভেবেছিল সে। কিন্তু রাজার খাস অনুগত সহচর স্যার রজার ডনকাস্টার এসে জনের খালাকে অনুরোধ করে রাজার পথের কাঁটা দুটোকে সরিয়ে দিতে। বিপুল অর্থের বিনিময়ে রবিনের খাবারে বিষ মিশিয়ে দেয় সে আর নিজের ভাগ্নেকে হত্যা করে কিছুদিন পরে। রবিন যখন ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে, তখন সাহায্যের জন্য ছুটে আসে জন। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। রবিনের মৃতপ্রায় শরীরটাকে কোনোমতে জানালার পাশে টেনে নিয়ে আসে জন। সেখানে দাঁড়িয়ে শেষবারের মতো একটি তীর ছোঁড়ে নামজাদা এই যোদ্ধা। জনকে সে বলে যায়, এই তীরটি যেখানে গিয়ে পড়বে, সেখানেই যেন তাকে দাফন করা হয়। তার এই শেষ ইচ্ছা পূরণ করেছিল জন।
কার্কলিস পার্কের উপরে একটি ঢিপি এখনো দেখা যায়, কথিত আছে, এখান থেকেই তীর ছুঁড়েছিল রবিন হুড। ডার্বিশায়ারের হ্যাথারসেজ গির্জার প্রাঙ্গণে দেখা মিলবে লিটল জনের সমাধির। শেরউডের যে রবিনকে আমরা চিনি, হয়তো সেই রূপে নয়, বরং চোরদের যুবরাজ কিংবা প্রথাবিরোধী এক আউটল হয়েই চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে রবিন হুড। ‘টম অ্যান্ড জেরি’ কার্টুনের বাংলা ডাবিংকৃত একটি এপিসোডে একটি গানে উল্লেখ করা হয় ‘গরীবের বন্ধু রবিন হুডের চ্যালা’দের কথা। এই কিংবদন্তী নায়ক আরও শত শত বছর বেঁচে থাকবেন মানুষের মুখে মুখে ফেরা গল্পগাথার মধ্য দিয়ে।
ফিচার ইমেজ- history.com