১৯৭১ সালে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করা ফ্রেডেরিক স্মিথ পণ্য পরিবহন ব্যবস্থায় নতুন ধারণাকে বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা চালান। উত্তরাধিকারসূত্রে তিনি চার মিলিয়ন ডলার লাভ করেন। এরপর ভেঞ্চার ক্যাপিটালিজম ও ব্যাংক থেকে লোন নেয়ার মাধ্যমে আরও আশি মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেন। কিন্তু শুধু অর্থ থাকলেই এই ধরনের পণ্য পরিবহন ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব নয়। যেমন- একটা বিষয়ের কথা ধরা যাক। থিসিস পেপারে স্মিথ লিখেছিলেন যে তার প্রস্তাবিত পণ্য পরিবহন ব্যবস্থার জন্য যে লজিস্টিক্স কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা হবে, তাদের নিজস্ব বিমান থাকতে হবে। কিন্তু দেখা গিয়েছিল- রাতারাতি পরিবহনের জন্য বেশ কিছু বিমান কেনা সম্ভব নয়। সামরিক বাহিনী থেকে ফিরে আসার পর ১৯৭১ সালে আরকানসাসের লিটল রক শহরে বিমানবন্দরের পাশে নিজেদের অফিস স্থাপন করেন। এছাড়াও তখন পাশের বিমানবন্দরে কিছু বিমান বিক্রির জন্য নিলামের আয়োজন করা হয়। এই সুযোগে স্মিথ নিলামের মাধ্যমে পণ্য পরিবহনের জন্য বেশ কিছু কার্গো বিমান ক্রয় করেন।
১৯৭১ সাল থেকে মোটামুটি কোম্পানির কার্যক্রম শুরু হয়ে গেলেও প্রথম ফ্লাইট চালু হয় ১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাসে। তখনকার সময়ে আমেরিকায় এক শহর থেকে আরেক শহরে মালামাল পরিবহনে সময় লাগত প্রায় এক সপ্তাহের মতো। ফেডেক্সের মূল কাজ ছিল এই সময়ের ব্যপ্তি কমিয়ে আনা। তিনি চেয়েছিলেন সর্বোচ্চ দুই-তিন দিন কিংবা এরও কম সময়ের মধ্যে যেন আমেরিকার একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে পণ্য পরিবহন করা যায়। কিন্তু কাজটি মোটেও সহজ ছিল না। স্মিথের আগেও অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান চেষ্টা করেছিল এই ধরনের পণ্য পরিবহন সেবা নিশ্চিতের, কিন্তু বিভিন্ন কারণে সেগুলো শেষপর্যন্ত টিকে থাকতে পারেনি।
প্রথম কয়েক বছর ছিল ফেডেক্সের জন্য বেশ কঠিন। এই সময়ে ফেডেক্স কােনো মুনাফা অর্জন তো দূরে থাক, উল্টো লোকসানের মুখ দেখছিল। ফেডেক্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফ্রেডেরিক স্মিথ দেখছিলেন টানা অনেকগুলো পণ্য ডেলিভারি সম্পন্ন করার পরও কোনো লাভ হচ্ছিল না। তারপরও তিনি সেবা বন্ধ করে দেননি। কারণ এতে ব্যবসা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে নেতিবাচক ধারণা জন্ম নিত, এবং যেটুকু ব্যবসায়িক সুনাম ছিল সেটাও নষ্ট হয়ে যেত। তাই লোকসানের মুখেই তিনি ব্যবসায়িক কার্যক্রম সচল রাখার জন্য সমস্ত উদ্যোগ গ্রহণ করেন। যে উদ্দেশ্যে ফেডেক্স প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেই উদ্দেশ্য পালনে তারা ঠিকই সফল ছিল। আমেরিকার সাধারণ মানুষের মাঝে এই কথা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে যে ফেডেক্সের মাধ্যমে সহজে ও তুলনামূলক কম সময়ে পণ্য আদান-প্রদান করা যায়।
১৯৭৩ সালের দিকে আরব বিশ্বের সাথে ইসরায়েলের দ্বন্দ্বের সূত্রপাত থেকে ইয়ম কিপুর যুদ্ধ শুরু হয়। এই সময় আমেরিকা ও নেদারল্যান্ডস ইসরায়েলকে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করে। জ্বালানি তেলের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর উপরে আমেরিকার নির্ভরশীলতাকে কাজে লাগিয়ে খনিজ তেল উত্তোলনকারী দেশগুলোর সংগঠন ‘ওপেক’ (OPEC – Organisation of the Petroleum Exporting) তেল উত্তোলনের পরিমাণ কমিয়ে দেয়, কৃত্রিমভাবে সংকট সৃষ্টি করে। ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারকরা ভেবেছিল- যেহেতু মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনীতি তেল রপ্তানির উপর চরমভাবে নির্ভরশীল, তাই তারা শেষপর্যন্ত এই কৃত্রিম সংকটের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু বাস্তবে হয়েছিল ঠিক উল্টোটা। কৃত্রিম সংকটের জন্য জ্বালানি তেলের দাম অনেক বেড়ে যায় এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো অল্প উৎপাদনেই অনেক বেশি আয় করে। এই ঘটনায় বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের যে সংকট তৈরি হয়, তাতে অর্থনীতির সাধারণ নিয়মানুযায়ী জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যায়। দেখা গিয়েছিল- আগে যেখানে এক ব্যারেল তেলের দাম ছিল তিন ডলার, এই ঘটনার পর তেলের দাম গিয়ে দাঁড়ায় বারো ডলারে! জ্বালানি তেলের অত্যধিক মূল্যবৃদ্ধির জন্য আমেরিকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামও বৃদ্ধি পায়।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সরাসরি প্রভাব পড়ে ফেডেক্সের উপর। এমনিতে তাদের লাভ হচ্ছিল না, ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য তারা তাদের পরিবহন সেবা সচল রেখেছিল, তার উপর জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি বিপদ আরও বাড়িয়ে দেয়। এর পাশাপাশি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পণ্য আদান-প্রদানের খরচ তোলার জন্য যে পরিমাণ পণ্য পরিবহনের অর্ডার আসার দরকার ছিল, তা আসছিল না। সেসময় ফেডেক্স কী নিদারুণ সংকটে পড়েছিল, তা বোঝা যায় তখনকার ভাইস প্রেসিডেন্টের বক্তব্য থেকে। তিনি বলেন, “খরচ যেহেতু বেড়ে যাচ্ছিল, আমরাও গভীর অর্থনৈতিক সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। এতটাই খারাপ অবস্থা দাঁড়িয়েছিল যে একবার আমাদের একজন পাইলট নিজের পকেট থেকে একটি এয়ারপোর্টে ল্যান্ডিং ফি পরিশোধ করেন। নিজের পকেট থেকে ফি পরিশোধ না করলে তাকে এয়ারপোর্টে নামতেই দেয়া হতো না।“
একসময় এমন অবস্থা দাঁড়ায় যে, ফেডেক্সের নিজস্ব ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মাত্র পাঁচ হাজার ডলার ছিল। এরপর ফেডেক্সের কর্ণধার ফ্রেডেরিক স্মিথ যা করলেন, সেটি সম্ভবত কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ করার সাহস করবেন না। তিনি ব্যাংক থেকে পাঁচ হাজার ডলার বের করে পকেটে ঢুকিয়ে সোজা লাস ভেগাসের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। সেখানে সারারাত ব্ল্যাক জ্যাক খেলে পাঁচ হাজার ডলার থেকে সাতাশ হাজার ডলার হওয়ার পর নিজ শহর মেম্ফিসে ফিরে এলেন। ফিরবার পর কোম্পানির এক সিনিয়র কর্মকর্তা তাকে জিজ্ঞেস করেন, “কীসের প্ররোচনায় আপনি এই কাজ করেছিলেন?” উত্তরে স্মিথ বলেন, “ফুয়েল কোম্পানির পাওনা পরিশোধ না করলে তুমি উড়তেই পারবে না!” লাস ভেগাসে বাজিতে লাভ করার পর আরও এগারো মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ আনতে সক্ষম হন স্মিথ। এরপর আর ফেডেক্সকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পরবর্তী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই কোম্পানি লাভের মুখ দেখতে শুরু করে। ১৯৭৬ সালে তারা প্রথমবারের মতো বাৎসরিক ৩.৬ মিলিয়ন ডলার মুনাফা অর্জন করে।
বর্তমানে ফেডেক্সের ব্র্যান্ড ভ্যালু প্রায় ত্রিশ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে গড়ে কোম্পানিটি আশি বিলিয়ন ডলার আয় করে প্রতিবছর। এখন আর কোম্পানির কোনো কর্মকর্তাকে দেউলিয়াত্ব নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। একটি কোম্পানির মূলধনের শেষাংশ নিয়ে রীতিমতো বাজি খেলার পর আবার ফিরে এসে শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করার গল্প বোধহয় পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে না।