শ্রমিকদের ধর্মঘট ডাকার সিদ্ধান্ত যৌথভাবে মোকাবিলার সিদ্ধান্ত নেয় উইনিপেগ শহরের অভিজাত ব্যবসায়ীসমাজ। তারা উইনিপেগ শহরের প্রশাসনকে বোঝাতে সম্ভব হয় যে, এই ধর্মঘট যদি বানচাল করা সম্ভব না হয় এবং শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে ফেরানো না যায়, তাহলে শহরের অর্থনীতি ধ্বসে পড়বে। শুধু উইনিপেগেই নয়, ব্যবসায়ীরা কানাডার জাতীয় সরকারকেও ধর্মঘট সম্পর্কে বোঝাতে সক্ষম হয়। শ্রমিকরা যেমন ধর্মঘট পর্যবেক্ষণের জন্য ‘স্ট্রাইক কমিটি’ গঠন করেছিল, এর পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ব্যবসায়ীরাও ‘সিটিজেন্স কমিটি অব ওয়ান থাউজ্যান্ড’ গঠন করে। এর সদস্যরা ব্যবসায়ীসমাজের প্রতিনিধি হিসেবে সরকারের বিভিন্ন পক্ষের সাথে আলোচনায় বসত। তাদের সক্রিয় তৎপরতায় সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, শ্রমিকদের এই ধর্মঘট যেকোনো মূল্যে বানচাল করতে হবে। কমিটির সদস্যরা এটাও সতর্ক করেছিলেন যে, যদি শ্রমিকদের দাবিদাওয়া মেনে নেওয়া হয়, তাহলে তারা ভবিষ্যতে বিপ্লবের অনুপ্রেরণা পেতে পারে।
উইনিপেগ শহরের ব্যবসায়ীসমাজ নিজেদের কথাগুলো পৌঁছে দেয়ার জন্য একটি সংবাদপত্রের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। পরবর্তীতে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তারা একটি পত্রিকা প্রকাশ শুরু করে। তবে এতে যতটা না বাস্তব তথ্য প্রকাশ করা হতো, তার চেয়ে বেশি প্রকাশ করা হতো প্রোপাগাণ্ডা। পত্রিকায় দাবি করা হয়েছিল, বিদেশি শক্তির অদৃশ্য ইশারায় উইনিপেগ শহরের শ্রমিকেরা কানাডার জাতীয় সংহতি নষ্ট করে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। ধর্মঘট হচ্ছে তাদের এই ষড়যন্ত্রের অংশ। তাদের এই প্রোপাগাণ্ডামূলক সংবাদে প্রভাবিত হয়ে আমেরিকার বিখ্যাত গণমাধ্যম দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস ‘বলশেভিজম ইন উইনিপেগ’ (Bolshevism in Winnipeg) শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যাতে দাবি করা হয়- কানাডার গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাতের জন্য শ্রমিকরা ধর্মঘটের আশ্রয় নিয়েছে।
আসলেই কি শ্রমিকরা কানাডার সরকারকে উৎখাতের জন্য ধর্মঘটের আশ্রয় নিয়েছিল? শ্রমিকদের দাবিদাওয়াগুলোর দিকেই নজর দেয়া যাক। তাদের প্রধান দাবি ছিল– বেতনবৃদ্ধি, অধিক কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনা ও কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ উন্নয়ন করা। কানাডার প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে যে মুদ্রাস্ফীতি হয়েছিল, সেজন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়ে যায়। ফলে আগের বেতন দিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন সম্ভব ছিল না। এজন্য বেতনবৃদ্ধির দাবি তোলা হয়। আর বিভিন্ন কারখানার পরিবেশ ছিল অত্যন্ত নোংরা ও দুর্ঘটনার সহায়ক। শ্রমিকেরা প্রায়ই বিভিন্ন রোগশোকে আক্রান্ত হতো ও ভারী যন্ত্রপাতির অপরিকল্পিত স্থাপনে শারীরিকভাবে আহত হতো। এই কারখানার পরিবেশের মানোন্নয়নের দাবি তোলা হয়। তাদের দাবিগুলোর মধ্যে কোনো সরকার পরিবর্তনের দাবি ছিল না। তাদের ধর্মঘটের পেছনে বাইরের কোনো দেশেরও প্রভাব ছিল না। তাহলে দেখাই যাচ্ছে, শ্রমিকদের ধর্মঘটের পেছনে কানাডার সরকারকে উৎখাতের মতো কোনো কারণ ছিল না।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যখন চলছে, তখনই সোভিয়েত ইউনিয়নে বলশেভিক বিপ্লবীরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। সমাজতন্ত্রে সমাজে কোনো শ্রেণী থাকত না, ব্যক্তিগত কোনো অর্থনৈতিক উদ্যোগের সুযোগ ছিল না এবং রাষ্ট্র সকল ধরনের ব্যক্তিগত পুঁজি অধিগ্রহণ করত। আমেরিকাসহ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়মে পরিচালিত রাষ্ট্রগুলোর ব্যবসায়ীরা এতে ভয় পেয়ে গিয়েছিল, কারণ যদি বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ে তাহলে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোতে শ্রমিক শোষণের মাধ্যমে মুনাফা অর্জনের যে পথ, তা বন্ধ হয়ে যাবে। কানাডাও এর বাইরে ছিল না। উইনিপেগ শহরের শ্রমিকদের ধর্মঘটের ঘটনা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বলশেভিক বিপ্লবের সমকালীন ঘটনা, এতে অভিজাত ব্যবসায়ীসমাজের শঙ্কা আরও বেড়ে যায়। এজন্যই তারা ধর্মঘটকে বিপ্লবীদের কাজ হিসেবে দেখানোর প্রচেষ্টা করে, যাতে কানাডার সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নেয়।
উইনিপেগ শহরের ব্যবসায়ীরা হুমকি প্রদান করে– যেসব শ্রমিক ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে কাজে যোগদান করবে না, তাদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভিক্টোরিয়া পার্কে শ্রমিকদের প্রতিনিধিদের জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, দাবি মেনে নেওয়ার আগপর্যন্ত একজন শ্রমিকও কর্মক্ষেত্রে ফেরত যাবে না। সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান দেখিয়ে চাকরি চলে যাওয়ার ভয় থাকা সত্ত্বেও সমস্ত শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে পুনরায় যোগদান থেকে বিরত থাকে। ধর্মঘটরত শ্রমিকদের প্রতিহত করতে যেসব পুলিশকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, তারাও আশ্চর্যজনকভাবে শ্রমিকদের ধর্মঘটের সাথে সংহতি প্রকাশ করে। এই সংবাদ পাওয়ার পর উইনিপেগ শহরের মেয়র পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের বরখাস্ত করে। এরপর ব্যবসায়ীদের পরামর্শক্রমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধফেরত সৈন্যদের নিয়ে বিশেষ বাহিনী গঠন করা হয়।
বিশেষ বাহিনী ও ধর্মঘটরত শ্রমিকদের মধ্যে প্রথম সংঘর্ষ বাধে ১০ জুন, ১৯১৯ তারিখে। ধর্মঘটকারী শ্রমিকেরা বিশেষ বাহিনীর সদস্যদের দিকে প্রচুর পাথর নিক্ষেপ করে ও অসংখ্য সদস্য এতে আহত হয়। এর পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিশেষ বাহিনীর সদস্যরা অসংখ্য শ্রমিকের উপর নির্বিচারে লাঠিচার্জ করে। অসংখ্য শ্রমিক এতে আহত হয়। বিশেষ বাহিনীর সদস্যরা স্ট্রাইক কমিটির সদস্য ও নেতাদের বাড়িতে হানা দেয় এবং অনেক শ্রমিক নেতাকে গ্রেফতার করে। এছাড়া অসংখ্য অভিবাসী শ্রমিককে গ্রেফতার করার জন্য কানাডার অভিবাসী আইনেও বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়।
তবে ধর্মঘটরত শ্রমিক ও বিশেষ বাহিনীর আসল সংঘর্ষ হয় ২১শে জুন, ১৯১৯ তারিখে। দিনটি ছিল শনিবার। সেদিন যেসব যুদ্ধফেরত সৈন্য শ্রমিকদের ধর্মঘটের সাথে সংহতি জানিয়েছিলেন, তারা শ্রমিক নেতাদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে মৌন পদযাত্রা করেন উইনিপেগ শহরে। এই ধরনের পদযাত্রা মেয়র নিষিদ্ধ করেছিলেন, কিন্তু তারপরও যুদ্ধফেরত সৈন্যরা সেই মৌন পদযাত্রা চালিয়ে যান। কিছুক্ষণ পর একজন ব্যবসায়ী রাস্তা দিয়ে ট্রামগাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তার এই গাড়ি চালানোকে কেন্দ্র করে ধর্মঘটকারী শ্রমিকেরা উত্তেজিত হয়ে ওঠে এবং গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেন। খবর পেয়ে বিশেষ বাহিনী ও মেয়র দ্রুত ঘটনাস্থলে হাজির হন। মেয়র আধা ঘন্টার মধ্যে ধর্মঘটকারীদের রাস্তা ফাঁকা করার নির্দেশ প্রদান করেন। ধর্মঘটকারীরা মেয়রের নির্দেশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অবস্থান করতে থাকে এবং বিশেষ বাহিনীর উপর পাথর ও বোতল নিক্ষেপ করে। বিশেষ বাহিনীও পাল্টা গুলি চালালে একজন শ্রমিক নিহত হন। পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য স্থানীয় মিলিশিয়া বাহিনী ডাকা হয়।
সহিংসতা এড়ানোর জন্য শ্রমিকদের স্ট্রাইক কমিটি কানাডার ম্যানিটোবা প্রদেশের প্রিমিয়ার বা সর্বোচ্চ প্রশাসনিক ব্যক্তিত্ব টি. সি. নোরিসের সাথে আলোচনার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা দাবি জানায়, এমন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হোক, যে কমিটি শ্রমিকদের ধর্মঘটের পেছনের কারণগুলো অনুসন্ধান করে সরকারকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করবে। বেশ কয়েকবার আলোচনার পর অবশেষে উভয়পক্ষ সমঝোতায় রাজি হয় এবং ২৬শে জুন, ১৯১৯ তারিখে ধর্মঘট বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
উইনিপেগ শহরের এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তীতে দ্য ইনডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টিসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে, যাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল কানাডার বিশাল শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণ করা। আপাতদৃষ্টিতে এই ধর্মঘটের ফলাফলকে শ্রমিক শ্রেণীর পরাজয় মনে হলেও বাস্তবে এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। বর্তমানে কানাডার শ্রমিকেরা যে ইউনিভার্সাল হেলথকেয়ার, ন্যূনতম মজুরি আইন, এমপ্লয়মেন্ট ইন্সুরেন্স এবং বৈষম্যবিরোধী আইনের মতো যে অধিকারগুলো ভোগ করছে, সেগুলোর অনেকটা কৃতিত্ব প্রায় শতবছর আগের সেই ধর্মঘটের। এই ধর্মঘট ছিল কানাডার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের জন্য একটি সতর্কবার্তা।
শ্রমিকদের সংগ্রাম এখনও শেষ হয়ে যায়নি। কিন্তু তাদের সংগ্রামের দীর্থপথে উইনিপেগ শহরের ধর্মঘটের মতো ঘটনাগুলো বারবার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।