১৯৬২ সালের আগস্ট মাসের কথা। কিউবা থেকে ভুরিভুরি ‘সোভিয়েত মিসাইল’ বিষয়ক রিপোর্ট আসতে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে। রিপোর্টগুলোর প্রতিটিতে একই তথ্য উপস্থিত ছিল, সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবায় পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপন করছে! শত শত এরকম অস্বস্তিকর রিপোর্টের অধিকাংশই ভুয়া বলে উড়িয়ে দেয় মার্কিনরা। কিন্তু সেগুলোর মধ্যে ৪ কিংবা ৫টি রিপোর্ট তাদেরকে চিন্তায় ফেলে দেয়। সেগুলোতে বলা হয়, রাতের আঁধারে বিশাল সিলিন্ডার আকারের ক্ষেপণাস্ত্র ট্রাক ভর্তি করে নিয়ে যেতে দেখা গেছে। সেগুলো কিউবারই প্রতিরক্ষা বিষয়ক ক্ষেপণাস্ত্র কিনা তা নিয়ে সন্দেহ ছিল। তবে সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছিল না কোনোভাবেই।
এরকম পরিস্থিতিতে নজরদারি না করে বসে থাকার উপায় ছিল না। তবে প্রথম দিনই আসে বাঁধা। যুক্তরাষ্ট্রের একটি ‘ইউ-২ লকহিড’ বিমান (৭০ হাজার ফুট উচ্চতায় চলতে সক্ষম, নজরদারি করবার জন্য তৈরি বিশেষ বিমান) ভুলক্রমে একটি রাশিয়ান দ্বীপের উপর দিয়ে উড়ে যায়। ফুঁসে ওঠে রাশিয়া আর বাধ্য হয়ে বন্ধ করতে হয় নজরদারি। এমনকি ক্ষমাও চাইতে হয় রাশিয়ার কাছে। অন্যদিকে, দুই বছর আগে সিআইএ’র একটি ইউ-২ বিমান, ‘সারফেস টু এয়ার মিসাইল’ বা এসএএম ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা ভূপাতিত করেছিল রাশিয়ানরা। এই ঘটনার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কায়, সাময়িক সময়ের জন্য বিমানের নজরদারি বন্ধ রাখাটাই সমীচীন মনে করে মার্কিন প্রশাসন।
ইউ-২ বিমানের নজরদারি বন্ধ করে, কিউবার আকাশে নিজেদের ‘করোনো ফটোরিকনাইস্যান্স’ নামে একটি স্যাটেলাইট স্থাপন করে যুক্তরাষ্ট্র। যে সকল স্থানে সোভিয়েত ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপন করা হচ্ছে বলে তথ্য ছিল, সেসব স্থানের ছবি তোলার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ঘন মেঘের জন্য কোনো ছবিই পর্যাপ্ত তথ্য দিতে পারেনি। সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ, রহস্য অনাবৃত করতে এগিয়ে আসে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর টহল ইউনিট। তারা কিউবান উপকূলে একটি সোভিয়েত জাহাজের ছবি তুলতে সক্ষম হয়, যেটির ডেকে ক্ষেপণাস্ত্র পরিবহনের সরঞ্জামের উপস্থিতি দেখা যায়! জল কি তাহলে অনেক দূর গড়ালো?
ইউএস নেভির এই ছবি দেখে নড়েচড়ে বসলো ‘ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি’ বা ডিআইএ। এরই মাঝে, কিউবাতে সোভিয়েত আইসিবিএম বেসের এসএএম এর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ এসএএম তৈরির খবর পাওয়া যায়। এই তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করতে, এক সপ্তাহের মধ্যে ইউ-২ ফ্লাইট চালু করার সিদ্ধান্ত নেয় ডিআইএ। তবে এবার সিআইএ কে বাদ দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয় বিমানবাহিনীকে। ১৪ অক্টোবরের সেই ইউ-২ ফ্লাইট, কিউবার পশ্চিমাঞ্চলীয় ডেল রিও প্রদেশের নির্দিষ্ট কিছু স্থানের ৯২৮টি ছবি তুলতে সক্ষম হয়। সে ছবিগুলোতে স্পষ্ট দেখা গেলো, ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের জন্য প্রয়োজনীয় স্থাপনা নির্মাণকাজ চলছে কিউবাতে!
মোটামুটি নিশ্চিত হবার পরও ডিআইএ আরো দু’দিন সময় নিলো সম্যক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের জন্য। ১৬ অক্টোবর তারা প্রেসিডেন্ট কেনেডির সামনে সব ছবি এবং ব্যাখ্যা উপস্থিত করলো। পরিস্থিতি অনুভব করতে পেরে কেনেডি ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের ৯ জন সদস্য এবং পাঁচজন উপদেষ্টাকে একটি জরুরী সভায় আহ্বান করলেন। এই সভার নাম দেয়া হলো ‘এক্সিকিউটিভ কমিটি অব দ্য ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল’ বা এক্সকম। দু’দিনের আলোচনা-পর্যালোচনায় কয়েকটি সম্ভাব্য বিকল্প কর্মপন্থা ঠিক করলো এক্সকম। সেগুলো এক নজরে দেখে নেয়া যাক-
- আমেরিকায় সোভিয়েত ক্ষেপণাস্ত্র হামলার আশংকা নতুন নয়, তাই প্রতিক্রিয়া দেখানোর দরকার নেই।
- কূটনৈতিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নকে চাপ দিয়ে কিউবা থেকে মিসাইল সরিয়ে ফেলা।
- ফিদেল ক্যাস্ট্রোকে পুরোদস্তর সামরিক আক্রমণের ভয় দেখিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করানো।
- কিউবা আক্রমণ করে ক্যাস্ট্রো সরকার উচ্ছেদ এবং সোভিয়েত ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনাগুলো ধ্বংস করা।
- বিমান হামলা করে ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনাগুলো ধ্বংস করা।
- নৌবাহিনী দ্বারা অবরোধ সৃষ্টি করা, যেন সোভিয়েত ক্ষেপণাস্ত্র কিউবায় ঢুকতে না পারে।
এই কর্মপরিকল্পনার প্রথম দুটি ছাড়া যেকোনো পদক্ষেপই হতে পারতো মারাত্মক ভুল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ বাহিনীর প্রধানেরা কিউবাতে পুরোদস্তর আক্রমণের পক্ষেই নিজেদের মত দেন। তবে প্রেসিডেন্ট কেনেডির তৎপরতায় সাময়িকভাবে আক্রমণের পরিকল্পনা স্থগিত করা হয়। তার চেয়ে বরং সামরিক সক্ষমতা পর্যালোচনায় গুরুত্ব দেয় এক্সকম সদস্যরা। কিউবায় অতিরিক্ত ৪২টি ক্ষেপণাস্ত্র যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তেমন বড় কোনো হুমকি নয় বলে মনে করেন তারা! তবে এই ভাবনা বেশিক্ষণ টিকে থাকলো না।
কিছুতেই কোনো নির্দিষ্ট পদক্ষেপ ঠিক করতে পারছিল না এক্সকম। একপক্ষ কিউবা আক্রমণের পক্ষে মত দিচ্ছে, তো অন্য পক্ষ নৌ অবরোধকে বেছে নিচ্ছে। একপক্ষ মিসাইলগুলোকে হুমকি মনে করছে না, তো অন্যপক্ষ যুদ্ধ আসন্ন বলে ধরে নিচ্ছে। এমতাবস্থায়, কোনো পদক্ষেপ ঠিক হবার আগেই জাতির উদ্দেশ্যে এক ভাষণ দেন কেনেডি। এই ভাষণে তিনি কিউবায় সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনের প্রতি তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান। পাশাপাশি সোভিয়েত ইউনিয়নকে ছাড় না দেয়ার ঘোষণা দেন। আর বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা মার্কিন সামরিক বাহিনীর প্রতি ‘ডিফেন্স রেডিনেস কনডিশন’ বা ডেফকন এলার্ট বৃদ্ধি করে ২’-এ উন্নীত করেন! পরিস্থিতি ঠিক কতটা নাজুক ছিল বলে, ইতিহাসে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র ‘ডেফকন-২’ জারি করে, তা অনুধাবন করাটা কঠিন কিছু না।
“যদি কিউবা থেকে কোনো ক্ষেপণাস্ত্র, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা অন্য যেকোনো দেশে গিয়ে আঘাত করে, তাহলে সেটি যুক্তরাষ্ট্রকে সোভিয়েত ইউনিয়নের আক্রমণ বলে দেখা হবে। এবং পরিপূর্ণরূপে প্রতিশোধ নেয়া হবে!” – জন এফ কেনেডি
এদিকে, ডেফকন এলার্ট বাড়ার পর পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়। কখন যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, এরকম একটা আবহের সৃষ্টি হয়। এরই মাঝে, বিশ্বজুড়ে কেনেডির ভাষণের মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। চীনের তৎকালীন প্রধান সংবাদপত্র ‘পিপল’স ডেইলী’ দাবি করে, চীনের ৬৫ কোটি মানুষ কিউবার পাশে থাকবে। একইভাবে আমেরিকার পাশে দাঁড়ায় ইংল্যান্ড, ফ্রান্স আর জার্মানি। তবে জার্মান পত্রিকাগুলো এ ব্যাপারে আশংকা প্রকাশ করে যে, আমেরিকা কিউবা আক্রমণ করলে, প্রতিশোধ নিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন আবার বার্লিন না দখল করে নেয়। আর রাশিয়ান সাংবাদমাধ্যমে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কেনেডিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নিকিতা ক্রুশ্চেভের পাঠানো একটি টেলিগ্রামের খবর বের হয়। টেলিগ্রামে ক্রুশ্চেভ যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন-
“যেকোনো ধরনের অবরোধ যুদ্ধের উস্কানিরূপে দেখা হবে। সোভিয়েত সৈন্যদের উপর নির্দেশ থাকবে, সমুচিত জবাব দেয়ার!” – নিকিতা ক্রুশ্চেভ
অক্টোবরের ২৫ তারিখ, স্নায়ুযুদ্ধ প্রকৃত যুদ্ধে রূপ নেয়ার খুব নিকটে পৌঁছে যায়। এক্সকমের নানা আলোচনার পর প্রাথমিকভাবে নৌ অবরোধ চালু করার সিদ্ধান্ত হয়। এই নৌ অবরোধ শুরু হয় ২৫ তারিখ। অবরোধের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায়, রাশিয়া তাদের ১৪টি কিউবাগামী জাহাজ দেশে ফিরিয়ে আনে এবং ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায়। যুদ্ধ আসন্ন বলে প্রতীয়মান হয়। পুরোদমে প্রস্তুত হতে শুরু করে সোভিয়েত বাহিনী। আর যুক্তরাষ্ট্রও বুঝতে পারে, যুদ্ধ ছাড়া কিউবা থেকে ক্ষেপণাস্ত্র সরানোর কোনো উপায় নেই।
২৬ অক্টোবর পরিস্থিতির পুনরায় অবনতি ঘটে। সেদিন দুপুরে পৃথিবী পারমাণবিক যুদ্ধের সবচেয়ে নিকটে এসে পৌঁছেছিল! সোভিয়েত সাবমেরিন বি-৫৯ আমেরিকার অবরোধ সীমা অতিক্রম করতে গেলে একটি ‘ডেপথ চার্জ’ নিক্ষেপ করে মার্কিন নৌবাহিনী। ডেপথ চার্জ মূলত সাবমেরিন ধ্বংস করার জন্য ব্যবহার করা হয়। অমেরিকান বাহিনী জানতো না যে, এই সাবমেরিনে পারমাণবিক টর্পেডো রয়েছে! সাবমেরিনটি বাধ্য হয়ে পানির উপরিতলে উঠে আসে এবং পারমাণবিক টর্পেডো নিক্ষেপের সিদ্ধান্ত নেয় এর ভেতরে উপস্থিত কর্মকর্তারা! তবে সাবমেরিনের তিনজন কমান্ডারের মধ্যে একজন, ভাসিল আর্কিপোভ বোমা নিক্ষেপে অসম্মতি জানালে সাময়িকভাবে যুদ্ধ পরিস্থিতি থেমে যায়। উল্লেখ্য, সাবমেরিনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, তিনজন কমান্ডারের সম্মতি থাকলেই কেবল টর্পেডো নিক্ষেপ করা যাবে। পরবর্তীতে, বিশ্বজুড়ে ‘শান্তির নায়ক’ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন ভাসিল। তিনি না থাকলে যে কী হতো সেদিন!
সাবমেরিন ঘটনার টানটান উত্তেজনার কয়েকঘন্টা পরই, আমেরিকান একটি ইউ-২ বিমান আবারো ভুলক্রমে সোভিয়েত আকাশসীমায় ঢুকে পড়ে। এর জবাবে, সোভিয়েতরা আকাশে ওড়ায় এক ঝাঁক মিগ ফাইটার বিমান। শক্তি প্রদর্শনের এই মহড়ায় যুক্তরাষ্ট্রই বা পিছিয়ে থাকবে কেন? তারাও আকাশে ওড়ায় এক ঝাঁক এফ-১০২ যুদ্ধবিমান। এরই মাঝে ক্রুশ্চেভকে একটি চিঠি পাঠান ক্যাস্ট্রো, যেখানে তিনি ‘সাম্রাজ্যবাদের পতনের সময় এসে গেছে’ বলে উল্লেখ করেন। পাশাপাশি আমেরিকাকে পারমাণবিক অস্ত্র দ্বারা জবাব দেয়ার কথা বলেন ক্যাস্ট্রো। এই চিঠি বর্তমানে ‘আর্মাগেডন লেটার’ নামে পরিচিত।
এরই মাঝে চে গুয়েভারা ঘোষণা দিলেন, “আসন্ন যুদ্ধে আমেরিকার পরাজয় সুনিশ্চিত!” আর ক্যাস্ট্রো কিউবান বাহিনীকে নির্দেশ দিলেন, নিজেদের আকাশসীমার মাঝে যেকোনো মার্কিন বিমান ভূপাতিত করার। কিউবান উপকূলে তখন যুদ্ধ যুদ্ধ রব। প্রস্তুত আমেরিকান বাহিনী, প্রস্তুত সোভিয়েত বাহিনী। প্রস্তুত আছে বিধ্বংসী সব পারমাণবিক বোমা! পুরো বিশ্ব যেন পারমাণবিক যুদ্ধের উত্তাপ টের পেতে শুরু করেছে! উত্তর আটলান্টিকের উপকূলীয় দেশগুলোর বাতাসে গুমোট ভাব। পৃথিবী তখন নিদ্রাহীন রাত্রিযাপন করছে। যেকোনো মূহুর্তে শুরু হতে পারে পারমাণবিক ধ্বংসলীলা! হিরোশিমা আর নাগাসাকির করুণ পরিণতি তখন সবার চোখে ভাসছে! (চলবে)
ফিচার ছবি: The Globe and Mail