আপনি যদি কোনো ব্রিটিশ নাগরিককে প্রশ্ন করেন, সর্বপ্রথম কে এভারেস্ট জয় করেছিলেন? মনে মনে হয়তো আপনি ভেবে নিয়েছেন যে, উত্তরে স্যার এডমুন্ড হিলারি এবং তেনজিং নোরগের নাম শুনবেন। কিন্তু আপনাকে চমকে দিয়ে ব্রিটিশ সেই নাগরিক যদি প্রশ্নের উত্তরে অন্য কোনো পর্বতারোহীর নাম উল্লেখ করে, তাহলে অবাক হবার কিছু নেই। অনেক ব্রিটিশ নাগরিক আছেন, যারা ঘুণাক্ষরেও বিশ্বাস করেন না যে, এডমুন্ড হিলারি ও তেনজিং নোরগে সর্বপ্রথম এভারেস্ট জয় করেছেন। তাদের বিশ্বাস, হিলারি এবং নোরগেরও ত্রিশ বছর আগে সর্বপ্রথম এভারেস্ট জয় করেছিলেন ব্রিটিশ পর্বতারোহী জর্জ ম্যালরি এবং তাঁর সহযোগী স্যান্ডি অরভিন।
তবে ব্রিটিশদের বিশ্বাস একেবারেই যে অমূলক তা কিন্তু নয়। এভারেস্টকে বলা হয় পৃথিবীর তৃতীয় মেরু। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকেই পৃথিবীর দুই মেরুতে মানুষ তার পদচিহ্ন এঁকে দিয়েছিল। বাকি ছিল শুধু এভারেস্ট। আর এভারেস্টের চূড়ায় নিজেদের পদচ্ছাপ এঁকে দেয়ার জন্য সবার আগে আগ্রহী হয়ে উঠেছিল ব্রিটিশ পর্বতারোহীরা। এবং সেই কারণেই বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ১৯২১ সালে এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণ করার প্রথম পরীক্ষামূলক চেষ্টাটিও করেছিল তারা। এই পরীক্ষামূলক অভিযানের একজন সদস্য ছিলেন ইংল্যান্ডের মবেরিতে ১৮৬৬ সালে জন্ম নেয়া জর্জ ম্যালরি। এই অভিযানে তিব্বতের দিক দিয়ে এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার রাস্তা আবিষ্কার করেছিলেন জর্জ ম্যালরি এবং গাই বুলক।
জর্জ ম্যালরি ছিলেন ধর্মযাজক বা পাদ্রীদের বংশদর। তিনি উইনচেস্টার কলেজে পড়াশোনার করার সময় তাঁর একজন শিক্ষকের অধীনে আল্পস পর্বতমালায় ভ্রমণে গিয়েছিলেন এবং আল্পসের অনেক উঁচুতে উঠে গিয়েছিলেন। এভাবেই তাঁর পর্বতারোহণের দক্ষতা প্রথমবার প্রকাশ পায়। এরপর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে শিক্ষকতায় নিজেকে নিযুক্ত করেছিলেন। এর পাশাপাশি আল্পস এবং ওয়েলস পর্বতে তিনি তাঁর পর্বতারোহণের দক্ষতা ঝালাই করে নিচ্ছিলেন। তৎকালীন সময়ের অন্যান্য পর্বতারোহণকারীরা খেয়াল করেছিলেন, ম্যালরির পর্বতারোহণের কৌশল, দক্ষতা এবং অজেয়কে জয় করার বাসনা অন্য সকলের থেকে একেবারেই আলাদা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ম্যালরি ফ্রান্সের হয়ে যুদ্ধও করেছিলেন। ১৯১৯ সালে যুদ্ধ থেকে ফিরে তিনি আবারো শিক্ষকতায় মনোনিবেশ করেন। কিন্তু যুদ্ধের ভয়াবহতা তাঁর মধ্যে থেকে কাটেনি। ১৯২১ থেকে ১৯২৪- এই সময়ের মধ্যে যে তিনটি এভারেস্ট অভিযান চালানো হয়েছিল, এতে ২৬ জনের মধ্যে ২০ জনই যুদ্ধের দামামা ও ভয়াবহতার সাক্ষী। এর আগে তিনি দীর্ঘ সময় ধরে ব্রিটেনের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ আল্পাইন ক্লাবের সদস্য ছিলেন। তাই ক্লাবটি যখন ১৯২১ সালে সর্বপ্রথম এভারেস্ট জয়ের অভিযান পরিচালনার কথা ভাবছিল, স্বাভাবিকভাবে এই অভিযাত্রিক দলের সদস্য ম্যালরিই ছিল তাদের অন্যতম পছন্দ।
যেহেতু এভারেস্ট জয় করতেই হবে এমন কোনো পরিকল্পনা ছিল না, বরং পরীক্ষামূলক অভিযান ছিল, তাই তারা নর্থ কোল এর বেশি উপরে উঠতে পারেন নি। রাস্তা তো আবিষ্কার হলো, এবার চূড়ায় ওঠার নেশাও আগের চাইতে বেড়ে গেল। ফলে এর পরের বছর ১৯২২ সালেই আরেকটি অভিযান চালানো হয়েছিল, যা ছিল এভারেস্ট জয়ের সর্বপ্রথম পরিকল্পিত অভিযান। এই অভিযানে ৭ জন শেরপা তুষার ঝড়ের কবলে পড়ে মারা গিয়েছিলেন। এই অভিযানের সাথেও যুক্ত ছিলেন ব্রিটিশ পর্বতারোহী ম্যালরি। ব্যর্থ মন নিয়ে এভারেস্টের চূড়ার অনেকটা কাছ থেকে ফিরে আসেন তিনি। অনেকে ধরেও নিয়েছিলেন তাঁর আর এভারেস্টের চূড়ায় ওঠা হবে না। ইতোমধ্যে বয়স এসে ঠেকেছে ৩৬ এ এবং ৩ সন্তানের জনক হয়েছেন।
কিন্তু এভারেস্টের নেশা তাঁকে আর ছাড়তে চায় না। যে করেই হোক এভারেস্ট জয় করতেই হবে- এই ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। তাই শেষবারের মতো আবারো এভারেস্টে জয়ের নেশায় ছুটে চলা। ১৯২৪ সালে এভারেস্ট জয়ের অদম্য ইচ্ছা নিয়ে আবারো অভিযানের পরিকল্পনা করছিলেন জর্জ ম্যালরি।
এই অভিযানের পরিকল্পনা করতে দেখে বেশ মুষড়ে পড়েছিলেন ম্যালরির স্ত্রী রুথ। সন্তান এবং পরিবারের কথা বলে স্ত্রী তাঁকে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, তাঁকে পরিবারের পাশে, সন্তানদের পাশে থাকা খুব প্রয়োজন। কিন্তু মন যার পড়ে আছে এভারেস্টে, তাঁকে কি আর ফেরানো যায়! তবে স্ত্রীর মন রক্ষা নাকি স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ করতেই তিনি স্ত্রীকে বলেছিলেন,
এবার যদি এভারেস্ট জয় করতে পারি তাহলে পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়ায় তোমার একটা ছবি রেখে আসব।
স্ত্রীকে দেয়া এই প্রতিশ্রুতিই পরবর্তীতে গোটা পৃথিবীর মানুষকে নিয়ে গেছে রহস্যের অন্তরালে। স্ত্রীকে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে, স্ত্রীর নিষেধ সত্ত্বেও ম্যালরি যাত্রা করেন এভারেস্টের দিকে। অবশ্য ১৯২৪ সালে এভারেস্টে অভিযানের যাওয়ার আগে থেকেই পত্রপত্রিকায় আসতে থাকে ম্যালরির নাম। নিউ ইয়র্কে হয় ম্যালরিকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন। এই সংবাদ সম্মেলন থেকে ম্যালরিকে একটি প্রশ্ন করা হয়েছিল, এবং এর উত্তরে তিনি যা বলেছিলেন, তা মানব ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত একটি উক্তি। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনি কেন মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় উঠতে চান? এর উত্তরে তিনি বলেছিলেন,
বিকজ ইটস দেয়ার!
এবার তাঁর সঙ্গী ছিলেন মাত্র ২২ বছর বয়সী স্যান্ডি অরভিন। ১৯২৪ সালের এই অভিযানের প্রথম দুটি প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ করতে পারেননি তারা। এদিকে জুন মাস, আসছে মৌসুমি আবহাওয়া। এখানে দেরি করা সম্ভব নয়। সম্ভবত এখান থেকেই স্ত্রীকে শেষবারের মতো চিঠি পাঠিয়েছিলেন জর্জ। লিখেছিলেন, “বর্ষাকাল এগিয়ে আসছে। এর পর আর ওঠার সুযোগ পাবো কি না জানি না। আমি এখানে পড়ে থাকতে চাই না। পরশুদিন আমরা যাত্রা শুরু করতে চাই।”
এরপর এই দুজন এভারেস্ট জয়ের পণ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো অভিযান পরিচালনা করেন। ৪ জুন তারা দুজন অ্যাডভান্স বেজক্যাম্প থেকে রওনা করে পরের তিন দিনে ৬ নাম্বার বেজক্যাম্পে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছিলেন। এর পরদিন ৮ জুন দুজন ৬ নং বেজক্যাম্প থেকে রওনা করে সেদিন দুপুরের মধ্যে চূড়ার খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন। তাদেরকে শেষবারের মতো দেখা গিয়েছিল ৮,৬০০ মিটার উচ্চতায়। এখান থেকে চূড়ায় উঠতে বাকি আর মাত্র আড়াইশো মিটার। অর্থাৎ খুব কাছাকাছিই চলে গিয়েছিলেন তারা। কিন্তু তাদেরকে আর কখনো দেখা যায়নি। প্রচণ্ড তুষার ঝড়ে দুজনই প্রাণ হারিয়েছিলেন। তাদের এই মৃত্যু পর্বতারোহণের ইতিহাসে সবচাইতে বড় রহস্যের জন্ম দেয়। সকলের মনেই প্রশ্ন দানা বাঁধে, তারা কি পেরেছিলেন শেষ পর্যন্ত?
রহস্য আরো ঘনীভূত হয়েছিল ১৯৭৫ সালের এক এভারেস্ট অভিযানের পর। সেই অভিযানে একজন চীনা পর্বতারোহী একজন ইংরেজের মৃতদেহ দেখতে পেয়েছেন বলে জানান। এর আগে ১৯৩০ সালের এক অভিযানে অরভিনের আইস এক্স খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল ৮,৪৪০ ফুট উচ্চতায়। এরপর ১৯৯১ সালের এক অভিযানে ১৯২০ সালের অভিযানে ব্যবহৃত অক্সিজেন ক্যানিস্টারও খুঁজে পেয়েছিল একটি অভিযাত্রী দল। এভাবেই ছোট ছোট কিছু নমুনা পাওয়া যাওয়াতে ১৯৯৯ সালে শুধুমাত্র এই দুজনকে খুঁজতে একটি আলাদা অভিযান পরিচালনা করা হয়েছিল। এই অভিযানের মূল উদ্দেশ্য ছিল তাদের মৃতদেহ এবং তাদের ক্যামেরা খুঁজে বের করা। কারণ, যদি ক্যামেরাটি খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলে হয়তো সেখান থেকে জানা যেতে পারে তারা আসলেই এভারেস্টের চূড়ায় পা রেখেছিলেন কি না। ১৯৯৯ সালের এই অভিযানে অরভিনের মৃতদেহ বা তাঁর কোডাক ক্যামেরার কোনোটিই আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল জর্জ ম্যালরির মৃতদেহ। আর বেজক্যাম্প থেকে সাথে নিয়ে যাওয়া সবকিছুই ম্যালরির পোষাকের মধ্যেই পাওয়া গিয়েছিল। শুধু ছিল না তাঁর স্ত্রীর ছবি, যে ছবিটি তিনি এভারেস্টের চূড়ায় রেখে আসার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তাঁর স্ত্রীর কাছে। তাহলে কি এভারেস্টের চূড়ায় রেখে এসেছিলেন সেই ছবি আর নেমে আসার সময় তুষার ঝড়ে তাদের মৃত্যু হয়েছিল? এই অভিযানে ম্যালরির গগলসটিও পাওয়া গিয়েছিল তার জামার পকেটে।
চোখের গগলস পকেটে থাকার কারণে তাদের এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার সম্ভাবনাও আর দৃঢ় হয়ে উঠে। ধারণা করা হয়, শেষবার তাদেরকে যেখানে দেখা গিয়েছিল সেখান থেকে চূড়ায় উঠতে গেলে সন্ধ্যার আগেই উঠে যাওয়া সম্ভব ছিল। অর্থাৎ তারা চূড়ায় উঠেই আই গগলস খুলে পকেটে রেখেছিলেন। কারণ এমন বৈরি পরিবেশে রাতের বেলা বা সন্ধ্যার পর গগলস পরার কোনো সম্ভাবনাই নেই।
এরপর থেকে নানা সময়ে নানা বিতর্ক হয়েছে, তত্ত্ব এসেছে তাদের এভারেস্ট জয় করা নিয়ে, কিন্তু কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারেননি তারা কি আসলেই এভারেস্ট জয় করতে পেরেছিলেন কি না। শেষমেষ সব রহস্যের অবসান করতে এগিয়ে আসেন জর্জ ম্যালরির ছেলে। তিনি বলেছিলেন, “শুধু এভারেস্টের চূড়ায় উঠতে পারাটাই এভারেস্ট জয় করা নয়, সেখান থেকে সফলভাবে নেমে আসাও এর অংশ।”
ম্যালরির ছেলে হয়তো অনেকটা আক্ষেপ নিয়েই কথাটি বলেছিলেন। তবুও প্রশ্ন থেকেই যায়, আসলেই কি ম্যালরি মানব ইতিহাসের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে এভারেস্টের চূড়ায় নিজের পদচিহ্ন এঁকে দিয়েছিলেন?