উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের প্রান্ত ঘেঁষে, জাপানের বৃহত্তম দ্বীপ তোওহোকুর ছয়টি প্রশাসনিক অঞ্চলের একটি ফুকুশিমা। জাপানের রাজধানী টোকিও থেকে ২৫০ কিলোমিটার উত্তরে ফুকুশিমার অবস্থান। উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় উপকূলের এই অঞ্চলটি মূলত কৃষি প্রধান। সমান্তরাল পর্বতশ্রেণী এই নগরের চারপাশ ঘিরে রেখেছে। প্রায় ২০ লাখ মানুষের বাস ছিল এই নগরে। কৃষিকাজ, গবাদি পশু পালন এবং মৎস্য আহরণ মূল জীবিকা ছিল এখানকার অধিবাসীদের। গবাদি পশুর মাংসের জন্যে বেশ খ্যাতি ছিল এখানকার, সবুজে পরিপূর্ণ এই অঞ্চল থেকে বিভিন্ন ধরনের গবাদি পশুর মাংস সরবরাহ করা হতো জাপানের বিভিন্ন স্থানে। উপকূলীয় অঞ্চল বলে মাছের প্রাপ্যতাও ছিল প্রচুর। নাগরিক সুযোগ-সুবিধার কম-বেশি সবকিছুই ছিল এই নগরীতে।
তবে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক কারণে ফুকুশিমার এই অঞ্চলের বিশেষ গুরুত্ব ছিল। বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদনের জন্যে ফুকুশিমার ৩.৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে গড়ে উঠেছিল পারমাণবিক চুল্লী, যার নাম ছিল দাইচি। এটি জাপানের প্রথম পারমাণবিক চুল্লী। ১৯৬৭ সালে পরমাণু কেন্দ্রটির কাজ শুরু হয় এবং ১৯৭১ সাল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যায় এটি। সেই থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে আসছিল প্রকল্পটি।
কিন্তু সবকিছুতে পরিপূর্ণ এই শহরটি অপ্রত্যাশিত এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে এক লহমায় অতীত হয়ে যায়। তারিখটি ছিল ২০১১ সালের ১১ মার্চ, রোববার। সেদিনের নতুন ভোরে ফুকুশিমাবাসী হয়তো কল্পনাও করতে পারেনি কী বিশাল দুর্যোগ আসতে চলেছে তাদের জীবনে। দিনের কর্মক্লান্ত ব্যস্ততায় সকলে ছুটছে জীবিকার তাগিদে। দুপুর ৩টার কিছু সময় পূর্বে তোওহোকুর আরেকটি প্রশাসনিক অঞ্চল মিয়াগিতে নয় মাত্রার একটি ভয়ানক ভূমিকম্প অনুভূত হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ভূমিকম্পের জন্য জাপানের অবস্থান বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। জাপানের ইতিহাসে এই ভূমিকম্প ছিল দেড়শ বছরের মধ্যে সবচাইতে শক্তিশালী ভূমিকম্প। এই ভূমিকম্পের পূর্বে, জাপানের সবচাইতে ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্প ছিল দেশটির বৃহত্তম দ্বীপ হনশুর কাটো অঞ্চলে। প্রায় ১,৪৩,০০০ মানুষ নিহত হয় ৮.৩ রিক্টার স্কেলের ঐ ভূমিকম্পে। ১৯৯৫ সালে ৭.২ মাত্রার আরও একটি ভয়াবহ ভূমিকম্প হয় জাপানের কোবে অঞ্চলে। সেবার প্রায় ৬,৪০০ জন লোক প্রাণ হারায়। ২০১১ সালের এই ভূমিকম্প প্রাথমিকভাবে নয় মাত্রার বলা হলেও পরবর্তীতে এর যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
তবে ভূমিকম্পের মাত্রা যা-ই হোক না কেন, এর পরবর্তী প্রভাব ছিল জাপানের ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা বিভীষিকাময় বাস্তবতা। ভূমিকম্পের প্রভাবে এক ধ্বংসাত্মক সুনামি বয়ে যায় ফুকুশিমা ও এর আশেপাশের বেশ কিছু অঞ্চলের উপর দিয়ে। সুনামির ফলে উত্তাল সাগরের ঢেউ আঘাত হানে পুরো ফুকুশিমায়। এক লহমায় পুরো শহর জুড়ে ঘনিয়ে আসে তীব্র ভয়ানক পরিস্থিতি। মুহুর্তের মধ্যে সমুদ্রের ঢেউ জলোচ্ছ্বাসে রূপ নেয়। বাড়ি-ঘরে আছড়ে পড়তে থাকে পানির বিশাল ঢেউ। তবে আসল আঘাতটা আসে কিছু সময় পরে। উঁচু উঁচু ঢেউগুলো আঘাত হানে ফুকুশিমার পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে। ফলে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পরমাণু কেন্দ্রটির কাঠামো।
ভূমিকম্প ও সুনামির ফলে ফুকুশিমার দাইচি পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের ছয়টি রিয়্যাক্টরের দুটিতে স্বাভাবিক পরিচালনা বিঘ্নিত হয়। একসময় একটি স্থানে ফাটল দেখা দেয় এবং রিয়্যাক্টর দুটি বিস্ফোরিত হয়। কিছুক্ষণ পরেই আরও তিনটি রিয়্যাক্টরে আগুন লাগতে শুরু করে। ফলে খুব দ্রুত আগুনের তীব্রতা বাড়তে থাকে। রাসায়নিক তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে গিয়ে জনসম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হবে বলে অঞ্চলটিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় খুব দ্রুত মানুষদের নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে ফেলা হয়। নিকটবর্তী অঞ্চলের প্রায় কয়েক লাখ মানুষকে নিরাপদ দূরত্বে সরকারী আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়া হয়। তা সত্ত্বেও ধারণা করা হয়, প্রায় বিশ হাজারের উপর লোকের মৃত্যু হয় এই জলোচ্ছ্বাসে। পানির সাথে ভেসে যায় গবাদি পশু-পাখি। এত ব্যাপক হতাহতের ঘটনা থেকেই বোঝা যায় কী ভয়াবহ দুর্যোগ ঘনিয়ে এসেছিল সেদিন জাপানের বুকে।
প্রথমে সরকার থেকে পারমাণবিক চুল্লি থেকে রাসায়নিক তেজস্ক্রিয়া বেরিয়ে আসার কথা অস্বীকার করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ফুকুশিমা নিয়ে প্রতিবেদন ও ছবি প্রচারিত হওয়ার পর কর্তৃপক্ষ স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে, তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবেই ঐ সকল অঞ্চল বসবাস অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ধারণা করা হয়, তেজস্ক্রিয় পদার্থ সমুদ্রের পানির সাথে মিশে আশেপাশের অনেক মাছ ও পশু-পাখির জীবন নষ্ট করে। জাপান সরকারের মতে, প্রায় ১১৮ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয় এই ভূমিকম্পে।
তবে সরকারের পক্ষ থেকে আশা করা হয় যে, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সব আগের অবস্থায় ফিরে আসবে। আবার লোকালয়ে ফিরে যেতে পারবে সেখানকার অধিবাসীরা। কিন্তু বারবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরও কর্তৃপক্ষ কোনো আশাব্যাঞ্জক কথা শোনাতে পারেনি। সর্বশেষে পারমাণবিক চুল্লির বিশ কিলোমিটারের বাইরে কিছু বসতি করা হয়। কিন্তু রাসায়নিক বিশ্লেষকদের মতে, পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব এখনও শহরটিতে রয়ে গেছে। তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে এখনও সেখানে গাছপালা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেনি।
শহরে এখনও অবহেলায় পড়ে থাকতে দেখা যায় বিভিন্ন আসবাবপত্র, গাড়ি, বাড়ি, দোকানপাট। পুরো শহরকে এখন কোনো ভুতুড়ে শহর বলে ভুল হবে। সেখানে নেই কোনো গাছপালা, পশুপাখি। মাঝে মাঝে রাতের নীরবতা ভেঙে একটি কুকুর বা শেয়ালের ডাক ছাড়া কোনো শব্দ পাওয়া যায় না। কদাচিৎ কিছু সেনাবাহিনীর গাড়ি আসে নিয়মিত টহল দেয়ার ছলে। ফুকুশিমার এই ব্যস্ত শহরের প্রকৃতি থমকে গেছে প্রাণের অভাবে।
সরকারের প্রশাসনিক কাজকর্ম চালানোর জন্য যে ক’টি অফিস আদালত ছিল সেখানে, তার প্রত্যেকটি ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল থেকে বিশ কিলোমিটার দূরে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে শহরটির বাইরে সব মিলিয়ে শ’খানেক বাসিন্দা এবং একটি নার্সিং হোমে কর্মরত কিছু লোকজনের বাস রয়েছে। সরকারিভাবে এখানে বসবাস করার উপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। যতদিন পর্যন্ত না তেজস্ক্রিয়তা বন্ধের ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছে সরকার, ততদিন পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা থাকবে। আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থিত মানুষগুলো দিন গুনছে, কবে পাবে তাদের নিজেদের বসত-ভিটে, ফিরে যাবে নিজের চেনা জায়গায়।
তবে কিছুটা হলেও আশার বাণী শোনাচ্ছে জাপান সরকার। সম্প্রতি রোবটের মাধ্যমে ঐ স্থান পরিদর্শনের মাধ্যমে কিছু ভালো ফলাফল উঠে এসেছে। সাগরের পানি পরীক্ষা করে দেখা গেছে, পানির মধ্যে জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের ভারসাম্য ফিরে এসেছে। সমুদ্রের আশেপাশে মাছ শিকার শুরু হয়েছে। একটি রাসায়নিক বিশেষজ্ঞ দল পারমাণবিক চুল্লীর জায়গাটি ভালোভাবে পরীক্ষা করে আসছেন কয়েক বছর ধরে। ধারণা করা হচ্ছে, রাসায়নিক তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব অনেকটাই কমে এসেছে। চারপাশের গাছপালাতেও প্রাণের আভাস মিলছে বলেও জানা গেছে। এভাবে চলতে থাকলে আর সরকারের সদিচ্ছা অব্যাহত থাকলে, হয়তো একসময় ফিরে আসবে ফুকুশিমার পুরনো চেহারা।