বৈরাম খাঁ মোগল সাম্রাজ্যের ইতিহাসে প্রায় বিস্মৃত এক নাম। তিনি ছিলেন মোগল সৈন্যবাহিনীর প্রধান সেনাপতি। সম্রাট হুমায়ুনের অত্যন্ত আস্থাভাজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং এক ক্ষুরধার কূটনীতিবিদ; ছিলেন সম্রাট আকবরের একজন অভিভাবক, প্রধান পরামর্শদাতা, উপদেষ্টা, শিক্ষক এবং সম্রাটের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহযোগী। ভারত উপমহাদেশে মোগল সাম্রাজ্য বিস্তারে তার একনিষ্ঠতা, বিশ্বস্ততা এবং অবদান ছিল প্রশ্নাতীত।
১৫০১ খ্রিস্টাব্দে আফগানিস্তানের বাদাখশানে তার জন্ম। তিনি কারা ফনলু গোত্রের বাহারলু বংশের উত্তরাধিকারী ছিলেন। এই কারা ফনলু গোত্রটি কয়েক দশক পশ্চিম পারস্য শাসন করে। সম্রাট বাবরের সেনাবাহিনীতে বাবরের নিরাপত্তায় নিযুক্ত ছিল বৈরাম খাঁ’র পূর্বপুরুষরা। ‘জওহর আবতাচির’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, বৈরাম খাঁ’র মূল পদবী ছিল ‘বেগ’। ইরানের শাহ তামাস্প তাকে ‘খাঁ’ বা ‘খান’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তার সাহসীকতা ও বিশ্বস্ততার স্বীকৃতি হিসেবে মোগল দরবারে তাকে ‘ইয়ার-ই-ওয়াফাদর’ (অনুগত বন্ধু), ‘বারদার-ই নিকু-সিয়ার’ (সুপ্রভাত ভাই), ‘ফারজান্দ-ই-আদাতমন্দ ‘(সৌভাগ্যবান পুত্র), ‘খান-ই- খানান’ (রাজাদের রাজা) উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
সম্রাট বাবরের অধীনে বৈরাম খাঁ‘র কর্মজীবনের শুরু
বাবর যখন দিল্লীর মসনদ দখল করেন তখন বৈরাম খাঁ’র বয়স মাত্র ১৬। এই বয়সেই তিনি যোগ দিলেন বাবরের মোগল সেনাবাহিনীতে। সময়টা ছিল মোগল সাম্রাজ্যের উত্থানের সময়। ভারতবর্ষে সম্রাজ্য বিস্তারে মোগল সেনাবাহিনী ভারতবর্ষের বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। অল্প বয়সেই বৈরাম খাঁ তার শৌর্য-বীর্যে মোগল সেনাবাহিনীতে নিজস্ব এক পরিচয় তৈরি করে নিতে সক্ষম হন। তিনি হয়ে উঠলেন সম্রাটের আস্থাভাজন বিশ্বস্ত এক সৈনিক।
হুমায়ুনের সাথে বৈরাম খানের সম্পর্ক
সম্রাট হুমায়ুনের আমলে বৈরাম খাঁ ছিলেন সম্রাটের এক বিশ্বস্ত সহচর। হুমায়ুনের আমলে তিনি মোহরাদারের পদ অলঙ্কৃত করেন। এ সময় মোগল সেনাপতি হিসেবে বৈরাম খাঁ বেনারস, গুজরাট, বাংলা প্রভৃতি জায়গায় সফল অভিযান পরিচালনা করেন। শের শাহ সুরির সাথে যুদ্ধে পরাজয়ের মাধ্যমে মোগল সাম্রাজ্যের পতনের সময়েও বৈরাম খাঁ সম্রাটকে ছেড়ে যাননি। পরাজিত হয়ে সম্রাট হুমায়ুন যখন পারস্যে নির্বাসিত ছিলেন, তখন তার একনিষ্ঠ সহচর হিসেবে ছিলেন বৈরাম খাঁ। মোগল সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য সম্রাটকে তিনি প্রতিনিয়ত উদ্বুদ্ধ করে গেছেন। সম্রাটের নির্দেশে বিশ্বস্ত সেনাপতি হিসেবে বৈরাম খাঁ কান্দাহার পুনরুদ্ধার করেন।
পরবর্তীতে স্থায়ী মোগল সাম্রাজ্য পুনঃনির্মাণে সাহসী এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। সম্রাট হুমায়ুন বৈরাম খাঁ’র কর্মদক্ষতা, পান্ডিত্য, বিচক্ষণতা আর আনুগত্যে খুবই প্রসন্ন ছিলেন। তিনি বৈরাম খাঁকে তার মন্ত্রিসভার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য অনুসারী হিসেবে গণ্য করতেন। আর সে কারণেই তিনি তার এই বিশ্বস্ত সেনাপতিকে সর্বোচ্চ সম্মান ‘খান-ই-খানান’ যার অর্থ ‘রাজাদের রাজা’ সম্মানে ভূষিত করেন।
হুমায়ুনকে দিল্লীর মসনদে পুনরায় আরোহণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন বৈরাম খাঁ। হুমায়ূনের শাসনামলে বৈরাম খাঁ তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করেন। তিনি সবসময় সম্রাটকে সবধরনের ঝামেলা থেকে মুক্ত রাখতে সচেষ্ট থাকতেন। হুমায়ুনও তাই বৈরাম খাঁকে খুবই পছন্দ করতেন। মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য তাই মোগল পরিবারেররই এক কন্যার সাথে বৈরাম খাঁ’র বিয়ে দেন তিনি।
সম্রাট আকবরের সাথে সাথে বৈরাম খানের সম্পর্ক
সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যুর পর ১৫৫৬ সালে মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে সিংহাসনে বসেন হুমায়ূনের পুত্র আকবর। সে সময় বৈরাম খাঁকে আকবরের অভিভাবক, প্রধান পরামর্শদাতা, উপদেষ্টা ও শিক্ষক নিযুক্ত করা হয়। সময়টা ছিল মোগল সাম্রাজ্যের জন্য এক অশনি সংকেত। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল খুবই নাজুক। অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙে পড়ার দশা। সবদিকে যেন এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি।
নাবালক আকবরের অভিভাবক হিসেবে অন্তবর্তীকালীন শাসকের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন বৈরাম খাঁ। পরোক্ষভাবে ভারতবর্ষের শাসনভারের দায়িত্ব এসে পড়ে তার ওপর। সেনাপতিই মূলত দায়িত্ব পালন করে চললেন মোগল সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণের। বৈরাম খাঁ’র সাহায্যে কৌশলী আকবর সাম্রাজ্য সংহত করতে সচেষ্ট হন। বৈরাম খাঁ’র দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণ পরামর্শে আকবর মোগল সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটাই আয়ত্ত্বে নিয়ে আসতে সক্ষম হন। আকবর বৈরাম খাঁকে ‘খান বাবা’ বলে ডাকতেন এবং প্রধান সেনাপতি থেকে ওয়াকিল-আল-সালতানা (প্রধানমন্ত্রীর) পদে অভিষিক্ত করেন। মোগল সাম্রাজ্যের অভিভাবক এবং বিশ্বস্ততার স্বীকৃতিস্বরূপ আকবর হুমায়ূনের বোন, গুলরুখের মেয়ে সালিমা বেগমের সাথে বৈরাম খাঁ’র দ্বিতীয় বিয়ের সম্মতি দেন।
সম্রাট আকবরের বিরাগভাজন হওয়ার মধ্য দিয়ে বৈরাম খাঁ’র পতনের সূত্রপাত
নাবালক সম্রাটের অভিভাবক হিসেবে বৈরাম খাঁ চার বছর ধরে ১৫৫৬ থেকে ১৫৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মোগল সাম্রাজ্যের শাসন ক্ষমতা নিজের মতো করে পরিচালনা করতে থাকেন। কিন্তু এর পর থেকেই তার পতনের শুরু। জীবনের চল্লিশটি বছর মোগল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন পদে থেকে সম্রাটের অনুগত, অভিভাবক এবং বিশ্বস্ততার প্রতীক হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে সক্ষম হন বৈরাম খাঁ। কিন্তু মোগল দরবারের অন্য সহকর্মীদের কাছে তিনি খুব একটা পছন্দের পাত্র ছিলেন না।
বৈরাম খাঁ ছিলেন শিয়া সম্প্রদায়ের লোক। সংখ্যাগরিষ্ঠ মোগল আধিকারিকরা সুন্নি ধর্মের অনুসারী ছিলেন। ফলে মুসলিম সম্প্রদায়ের একটা বৃহৎ অংশের কাছে খুব একটা জনপ্রিয় ছিলেন না তিনি। এছাড়া নাবালক সম্রাটের অভিভাবক হিসেবে তিনি যে রাজক্ষমতা ভোগ করতে শুরু করেন, তাতে সহকর্মীদের আস্থায় না নেয়া, সম্রাটের অনেক নির্দেশকে আমলে না নেয়ায় ধীরে ধীরে নিজেকে দাম্ভিক এবং অহংকারী হিসেবে অন্যদের কাছে প্রতিষ্ঠা পেতে থাকেন। আর এভাবে তিনি হয়ে পড়েন অনেকেরই বিরাগভাজন।
বৈরাম খাঁ ছিলেন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। তার পরিচালনা ও আকবরের নেতৃত্বে পানিপথের যুদ্ধ জয় করতে মোগল সেনাদের খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। দিল্লি ও আগ্রা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয় মোগল সেনাবাহিনী। তবে এই যুদ্ধেই বৈরাম খাঁর সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটে আকবরের। দিল্লী জয়ের সময় সম্রাটের নির্দেশ অমান্য করে সেনাপতি হিমুকে নির্মমভাবে হত্যা করেন বৈরাম খাঁ। এমনকি যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রেও অনেক বিষয়ে সম্রাট অবগত ছিলেন না। ফলে এই যুদ্ধে সম্রাটের ভূমিকার থেকেও বৈরাম খাঁ’র নির্দেশ ও যুদ্ধ পরিচালনায় তারই প্রধান ভূমিকা ছিল, যেখানে সম্রাটের ভূমিকা ছিল নিতান্তই গৌণ। এছাড়াও প্রধান সেনাপতি বৈরাম খাঁ আকবরকে পুতুল ভূমিকায় রেখে মোগল প্রশাসনের সকল সিদ্ধান্ত প্রদানে ভূমিকা রাখতে শুরু করেন। আর এতে আকবরের মাতা হামিদা বানু প্রতিনিয়ত বৈরাম খাঁ’র কার্যক্রমে শঙ্কাবোধ করতেন এই ভেবে যে, বৈরাম খাঁ হয়তো কখনো তার সন্তান এবং মোগল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী আকবরের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন না। আকবরকে সারা জীবন হয়তো থেকে যেতে হবে বৈরাম খাঁ’র পুতুল হিসেবে।
এদিকে আকবর বৈরাম খাঁ’র তত্ত্বাবধানে নিজেকে একজন আদর্শ সম্রাট হিসেবে গড়ে তুলতে প্রতিনিয়ত সচেষ্ট ছিলেন। শুধুমাত্র পুতুল সম্রাট হিসেবে থাকার জন্য নয়, তার চিন্তা চেতনায় আর ভাবনাতে ভারত উপমহাদেশে মোগল সাম্রাজ্যের একমাত্র ক্ষমতাধর ব্যক্তি হবেন তিনি। ভবিষ্যতের একমাত্র মোগল সম্রাট হিসেবে নিজেকে তৈরি করতে থাকেন।
আর তাই ১৫৬০ সালে আকবর যখন আঠারো বছর পূর্ণ করেন, তখনই মোগল সাম্রাজ্যের শাসন ক্ষমতা নিজের অধীনে নিয়ে আসতে সংকল্পবদ্ধ হন। ক্ষমতাধর অনেককেই ধীরে ধীরে প্রশাসন থেকে সরিয়ে দিতে থাকেন যাতে তার ওপর কেউ প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। কিছুদিনের মধ্যেই সম্রাট বৈরাম খাঁকে শাসন ক্ষমতা পরিচালনার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে তাকে এবং তার পরিবারের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি জায়গা বরাদ্দ করেন।
সম্রাটের এমন অপ্রত্যাশিত সিদ্ধান্তে বৈরাম খাঁ অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। কিন্তু ততদিনে মোগল সেনার সবধরনের নিয়ন্ত্রণ আকবর নিজের হাতে নিয়ে ফেলেছেন। ফলে এই বিদ্রোহ বৈরাম খাঁর জন্য লাভজনক হলো না। তিনি পরাজিত হন। পরে তিনি তার কৃতকর্মের জন্য সম্রাটের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। আকবর বৈরাম খাঁকে ক্ষমা করে দিলেও তাকে বিশ্রামে যাওয়ার শর্ত দেন। এতে বৈরাম খাঁ আকবরের ওপর মনঃক্ষুণ্ন হন। কিন্তু সম্রাটকে কিছু না বলে তিনি আকবরের সাম্রাজ্যেই বাকি জীবন কাটিয়ে দেওয়ার আর্জি জানান। কিন্তু সম্রাট এতে রাজি হননি। সম্রাট বৈরাম খাঁকে মক্কায় পাঠাতে চান বিশ্রামের জন্য।
ঐতিহাসিক আবুল ফজলের লেখা ‘আইন-ই-আকবর’ বইয়ের ৩২৪-২৫ পৃষ্ঠায়ে উল্লেখিত আকবরের এমনি এক বার্তা। এই বার্তাতে লেখা ছিল-
“আপনার সততা ও বিশ্বস্ততা সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত রয়েছি। আমি আপনাকে এই সাম্রাজ্যের সবধরনের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে অব্যাহতি প্রদান করছি। এখন থেকে এই সাম্রাজ্য পরিচালনায় সবধরনের সিদ্ধান্ত নিজের হাতে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার একান্ত ইচ্ছে আপনি দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে অবসর নিয়ে পবিত্র মক্কার উদ্দেশে তীর্থযাত্রা শুরু করুন। এই মোগল সাম্রাজ্যকে দীর্ঘদিন সেবা করার জন্য হিন্দুস্থানের একটি উপযুক্ত জায়গা আপনার পরিবার, আপনার জীবনধারণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রদান করা হচ্ছে যা থেকে উপার্জিত রাজস্ব আপনার এবং আপনার পরিবারের ভরণপোষণের জন্য প্রেরণ করা হবে। ”
বৈরাম খাঁ আহত ও বিষণ্ন হৃদয়ে বিশাল মোগল সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতির পদ ত্যাগ করে মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা হন। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, মক্কায় যাওয়ার পথে সম্রাট আকবরের পাঠানো গুপ্তঘাতকরা বৈরাম খাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে। আবার আরেক পক্ষের মতে, এই গুপ্তহত্যার পেছনে সম্রাট আকবর নন, রয়েছে শের শাহের প্রধান সেনাপতি হিমুর আজ্ঞাবহ সৈনিকরা, যে হিমুকে বৈরাম খাঁ হত্যা করেছিলেন অত্যন্ত নির্মমভাবে। সেই হত্যারই প্রতিশোধ নিয়েছিল হিমুর সৈন্যবাহিনী।
মোগল এই সেনাপতি ১৫৬১ খ্রিস্টাব্দের ৩১ জানুয়ারি গুজরাটে মৃত্যুবরণ করেন।
ফিচার ইমেজ: flickr.com