“এমন কোনো বিদেশি সাবানের কথা আমার জানা নেই যা গোদরেজের চেয়ে ভালো। তাই আমি গোদরেজ ব্যবহার করি” – বাক্যটি পড়বার সাথে সাথে যে কেউ বলতে পারবে যে এটি একটি সাবানের বিজ্ঞাপনের অংশ। কিন্তু যদি বলা হয় সেই বিজ্ঞাপনে কথাগুলো বলেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাহলে নড়েচড়ে না বসে কি উপায় আছে?
গল্পটা ভারতের প্রয়াত উকিল আরদেশির গোদরেজে একজন দূরদর্শী ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার। ১৮৯৫ সালের কথা যখন ওকালতিতে খুব একটা সুবিধা করতে না পেরে সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতির ব্যবসা শুরু করেন গোদরেজ। কিন্তু পণ্যের গায়ে ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ সিল এর জন্য এক বড় ক্রেতা হাতছাড়া হয়ে যায় তার। এই ব্যবসা ছেড়ে তাই তালা বানানোর ফ্যাক্টরি খোলেন যেখানে প্রথম সাফল্য আসে। অবশ্য দেশমাতাকে ছোট করে দেখার ব্যাপারটা ভুলে যাননি তিনি।
২০ শতকের শুরুতে ভারতবর্ষে স্বাধীনতার আন্দোলন জোরদার হতে শুরু করেছে। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব গড়ে উঠতে থাকে সকলের মাঝেই। গোদরেজও যুক্ত হন স্বাধীনতার আন্দোলনে। সে সময় তালার ব্যবসার পাশাপাশি তার আগ্রহ তৈরি হয় সাবানের প্রতি, যা তখনো ইউরোপ থেকে আসা নতুন আবিষ্কার মাত্র। স্বদেশী ভাবনায় নিমজ্জিত গোদরেজ দেখলেন যে এসব সাবান তৈরি হয় পশুর চর্বি (লার্ড ও ট্যালো) থেকে, যার মাঝে গরু, মহিষ আর শুকরের চর্বি আছে। উল্লেখ্য, বন্দুকের কার্টিলেজে পশুর চর্বি আছে এরকম ধারণা থেকেই ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লব ঘটে।
এই সুযোগ হাতছাড়া করেননি গোদরেজ, ১৯১৯ সালে বাজারে আনেন বিশ্বের প্রথম শতভাগ বিশুদ্ধ ভেজিটারিয়ান (নিরামিষ) সাবান ‘চাবি’। মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতে স্বদেশী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। একদিকে ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের স্পৃহা, অন্যদিকে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের জন্যই অশুচি (গরু ও শূকরের চর্বি) উপাদান- দুইয়ে মিলে এই সাবান ব্যাপক সাড়া ফেলতে সক্ষম হয় তৎকালীন ভারতে।
এই সাবানের দীর্ঘস্থায়িত্বের সবচেয়ে বড় কারণ ছিল এর মান। স্বদেশী আন্দোলনের কল্যাণে তখন ভারতীয়রা অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের দেশীয় পণ্যও সাগ্রহে গ্রহণ করছিল। কিন্তু গোদরেজ জানতেন এই আবেগ টেকসই হবে না এবং ভারতীয় পণ্য উৎপাদকদের অবশ্যই মানসম্মত পণ্য দিয়েই বিদেশি পণ্য প্রতিস্থাপন করতে হবে।
গোদরেজের এই ভাবনার প্রশংসা করেছিলেন স্বয়ং গান্ধীও। স্বদেশী আন্দোলনের সমর্থন দিতে তৎকালীন প্রখ্যাত ভারতীয় রাজনীতিবিদ সি রাজাগোপালচারি এবং ব্রিটিশ সমাজ সংস্কারক ডক্টর এনি বেসান্ত গোদরেজ সাবানের বিজ্ঞাপনে অংশ নেন। তবে সবকিছু ছাপিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি সম্বলিত বিজ্ঞাপনটির পর গোদরেজ সাবান ভারতীয়দের নিত্যদিনের ব্যবহার্য হয়ে পড়ে।
আরদেশির গোদরেজের দূরদৃষ্টি ব্যর্থ হয়নি। স্বদেশী আন্দোলনের প্রভাব মিটে যেতে কয়েক বছর সময় নিলেও গোদরেজ ভারতবর্ষে চিরস্থায়ী হয়েছে। শতবর্ষী গোদরেজ সাবান আজও ভারতীয়দের প্রথম পছন্দ, যা বছরে বিক্রি হয় ৩৮ কোটির বেশি।