ব্যাটল অফ কোরাল সি (পর্ব-২): দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও ভুলে ভরা এক নৌযুদ্ধ

আগের পর্বের শেষে বলা হয়েছিল যে, কোরাল সি যুদ্ধে দু’পক্ষ এমন সব ভুল করেছিল যে ইতিহাসবিদেরা একে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও ভুলভ্রান্তিতে ভরা এক নৌযুদ্ধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এসব ভুলের কারণ হলো একপক্ষের অ্যাকশন ও বিরোধী পক্ষের রিঅ্যাকশন।

প্রিয় পাঠক, দিক নির্দেশক বিষয়গুলো সহজে বুঝতে ম্যাপের দিকে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে; Image source : youtube.com

উপরে দেয়া কোরাল সি যুদ্ধের মুভমেন্ট ম্যাপটি খেয়াল করুন। মার্কিনীরা ধরে নিয়েছে জাপানি নৌ-বহর তাদের চতুর্থ ফ্লিটের হেডকোয়ার্টার তুর্ক আইল্যান্ড থেকে থেকে সোজা দক্ষিণে প্রায় ১,২৯৫ কিলোমিটার দূরে আরেক শক্তিশালী নৌ-ঘাঁটি রাবাউলে রিফুয়েলিংয়ের জন্য আসবে। উল্লেখ্য, মাইক্রোনেশিয়ার অন্তর্গত তুর্ক আইল্যান্ড ১৯১৪ সালে জাপান দখল করে নিয়েছিল। আর ১,০৫৭ কিলোমিটার দূরে গুয়াম আইল্যান্ডে ১৮৯৮ সাল থেকে মার্কিনীদের উপস্থিতি ছিল। এটি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বিবাদ থাকা সত্ত্বেও ১৯৩৯ সালে তুর্কে চতুর্থ ফ্লিটের হেডকোয়ার্টার স্থাপন করা হয়। মাইক্রোনেশিয়ার দখলকৃত অঞ্চলগুলোকে “Southern Resources Area” আখ্যায়িত করে থাকে জাপান।

যা-ই হোক, রাবাউলে না থেমে জাপানি নৌ-বহর তিনভাগে ভাগ হয়ে যায়। দুটো ইনভেশন ফোর্স নিউ আয়ারল্যান্ড ও বুগেনভাইল দ্বীপের মাঝের ৫০৭ কিলোমিটার বিস্তৃত বিশাল চ্যানেল দিয়ে কোরাল সাগরে প্রবেশ করে। পোর্ট মোর্শবি ইনভেশন ফোর্স ও তার এয়ার কাভার ফোর্স ডানে তথা পশ্চিম দিকে, তুলাগি ইনভেশন ফোর্স সোজা তথা দক্ষিণে যায় এবং ল্যান্ড করে। কিন্তু তাকাগির মূল ক্যারিয়ার স্ট্রাইক ফোর্স ঐ চ্যানেল না ধরে ঘুরপথে কোরাল সাগরে প্রবেশ করে। তুলাগি ইনভেশন ফোর্স এর পিছু পিছু সোজা দক্ষিণে না এসে তারা সলোমন দ্বীপপুঞ্জের পশ্চিম পাশ ঘুরে শেষ দ্বীপ ‘মাকিরা’ দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্ত ঘুরে কোরাল সাগরে প্রবেশ করে। এ কারণে মার্কিনীরা ভেবেছিল জাপানিরা আছে বুগেনভাইলের দিকে, আর জাপানিরা ভেবেছিল মার্কিনীরা আছে দক্ষিণ-পশ্চিমের রোসেল আইল্যান্ডের দিকে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা ছিল তার বিপরীত।

এরিয়াল রিকনসিস

এডমিরাল ফ্লেচার টাস্কফোর্স ১১ ও টাস্কফোর্স ৪৪-কে নিজের বাহিনীতে একীভূত করেন এবং জাপানি নৌবহর খুঁজতে বিভিন্ন দিকে স্কাউট বিমান পাঠান। কিন্তু তারা উত্তর-পূর্বে বুগেনভাইল দ্বীপ ও তার আশেপাশের অঞ্চলে ম্যাক্সিমাম রেঞ্জে অনুসন্ধান করেও ব্যর্থ হয়। আসলে পোর্ট মোর্শবি ইনভেশন ফোর্স ইচ্ছা করেই ধীরে ধীরে আসছিল এবং ভাগ্যক্রমে ঠিক তাদের রেঞ্জের বাইরে ছিল। এডমিরাল তাকাগি ৬ মে সকালে রিফুয়েলিংয়ের জন্য গুয়াডালক্যানাল ও রেমিংটেল আইল্যান্ড মাঝখানে অবস্থান নেন যেন এ সময় আক্রমণ হলেও মিত্রবাহিনী তেমন সুবিধা করতে না পারে। তাছাড়া সেদিন সকাল ব্যতীত সারাদিন আর রিফুয়েলিংয়ের সময় পাবেন না তিনি।

এ সময় তিনি মার্কিন নৌবহর থেকে মাত্র ৫৬০ কিলোমিটার উত্তরে ছিলেন। সকাল ১০ টায় শর্টল্যান্ড আইল্যান্ড আরেকটি স্কাউট প্লেন মার্কিন নৌবহরের অবস্থান শনাক্ত করে খবরটি হেডকোয়ার্টারে পাঠিয়ে দেয়। সকাল ১০:৫০ এ খবর পেলেও তাকাগি তার বাহিনীকে নিয়ে রওনা হতে পারছিলেন না। কারণ তখনও বহরের কয়েকটি জাহাজের রিফুয়েলিং বাকি। কিন্তু মার্কিন নৌবহর দক্ষিণ দিকে এগিয়ে চলছে এবং ক্রমশ তাদের রেঞ্জের বাইরে চলে যাচ্ছে। তাই ভাইস এডমিরাল তাকাগি এবার নিজের ডানহাত এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ‘শকাকু‘ এর কমান্ডার রিয়াল এডমিরাল ‘চুইচি হারা‘ এর নেতৃত্বে দুটি ক্যারিয়ার এবং দুটি ডেস্ট্রয়ার অবিলম্বে মার্কিন বহরের পশ্চাৎবধনে পাঠান। তাকাগির নিজের জাহাজ অর্থাৎ ফ্ল্যাগশিপ ব্যাটলক্রুজার ‘ময়োকো’সহ বহরের অন্যান্য জাহাজ রিফুয়েলিং শেষ হলেই এডমিরাল ‘হারা’র সাথে যোগ দেবে। 

৭ মে অর্থাৎ কোরাল সি যুদ্ধ চলাকালে মার্কিন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার খুঁজতে যাওয়ার সময় তোলা জাপানি যুদ্ধবিমান; Image source : wikipedia.org

এদিকে অস্ট্রেলিয়ায় থাকা মার্কিন বি-১৭ বোম্বারগুলো পোর্ট মোর্শবি ইনভেশন ফোর্সের জাহাজগুলোতে কয়েকবার আক্রমণ করে তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি করতে পারেনি। বি-১৭ মূলত গ্রাউন্ড টার্গেটে হামলা করার উপযোগী হেভি বোম্বার। এটি চলন্ত যুদ্ধজাহাজে বোমা ফেলতে সক্ষম নয়। ফলে জাপানি ইনভেশন ঠেকানোর জন্য নিযুক্ত জেনারেল ডগলাস ম্যাকআর্থার এডমিরাল ফ্লেচারকে অবিলম্বে ইনভেশন ফোর্সের উপর হামলা করতে বলেন। কেননা নতুন ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট অনুযায়ী ফ্লেচারের টাস্কফোর্স ১৭ এর ৭৮৭ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে থাকা ইনভেশন ফোর্সে একটি ফ্লিট ক্যারিয়ার রয়েছে যা এতক্ষণ ধরে খুঁজছেন ফ্লেচার। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেটি ছিল ইনভেশন ফোর্সের এয়ার কাভার হিসেবে থাকা রিয়াল এডমিরাল আরিটোমো গোটোর নৌবহরের লাইট ক্যারিয়ার ‘শহো’।

তুলাগি ইনভেশন ফোর্সে ইয়র্কটাউন অ্যাটাক করার সময় এটি অদূরেই ছিল। কিন্তু মার্কিনীরা সেটিতে আক্রমণ করেনি, কারণ লাইট ক্যারিয়ার ছিল মূলত ফাইটার প্লেন এয়ার কভার, এখানে মার্কিন ক্যারিয়ারের উপর হুমকি- এমন বিমান নেই। এটি ডুবিয়ে তেমন লাভ হবে না, উল্টো একে আক্রমণ করতে গিয়ে প্রাণ হারাবে ডাইভ ও টর্পেডো বোম্বারের পাইলটরা। জেনারেল ডগলাস ম্যাকআর্থারের নির্দেশ পেয়ে সেদিকে ছুটলেন রিয়ার এডমিরাল ফ্লেচার।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বহুল ব্যবহৃত বোম্বার বি-১৭ সর্বোচ্চ ৭,৮০০ কেজি বোমা ফেলতে পারতো; Image source : smithsonianmag.com

উল্লেখ্য, তিনি প্যাসিফিক ফ্লিট কমান্ডার এডমিরাল নিমিটজের অধিভুক্ত অফিসার হলেও তাকে আর্মি কমান্ড ফলো করার নির্দেশ দিয়েছিলেন নিমিটজ নিজেই। ফ্লেচার যখন টাস্কফোর্স ১৭ এর কোর্স বদলে নেন তখন জাপানি ক্যারিয়ার থেকে মাত্র ১৩০ কিলোমিটার দূরে ছিলেন। এর আগে শত্রু দুই দেশের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার কখনও এত কাছাকাছি চলে আসেনি। এদিকে এডমিরাল হারা শত্রুর কাছে নিজের অবস্থান ফাঁস হয়ে যেতে পারে- এই ভয়ে নিজের কোনো বিমানকে রিকনসিস মিশনে পাঠাননি। মূলত তিনি ও তাকাগি জাপানি ল্যান্ড বেজড লংরেঞ্জ রিকনসিস বিমানের উপর ভরসা করছিলেন, যা পরবর্তীতে এই যুদ্ধের সবচেয়ে বড় ভুল হিসেবে পরিগণিত হয়। ফলে সেদিন তিনি একটু জন্য শত্রুকে ধরতে পারেননি।

প্রত্যাশামতো লোকেশনে এসে মার্কিনীদের খুঁজে না পেয়ে আবার কোর্স ঘুরিয়ে নেন এবং তাকাগির সাথে মিলিত হতে পেছনে যেতে থাকেন। কেননা রাত হয়ে যাওয়ায় কেউই এখন আর আক্রমণ করতে আসবে না। এর চেয়ে শক্তি বৃদ্ধি করা উত্তম।

মাঝ সাগরে এক জাহাজ থেকে আরেক জাহাজে রিফুয়েলিং রীতি বেশ পুরনো। উপরের ছবিটি ১৯১৭ সালে এবং নিচেরটি ২০১০ সালে তোলা; Image source : usnhistory.navylive.dodlive.mil

৭ মে সকালে রোসেল আইল্যান্ডের ২১৩ কিলোমিটার দক্ষিণে থাকতেই ফ্লেচার অস্ট্রেলিয়ান ক্রুজার ফোর্সকে জামর্যান্ড প্যাসেজে মোতায়েন হতে নির্দেশ দেন। ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের শক্তি কমানোর দুটো কারণ ছিল। প্রথমত, ক্রুজারগুলোর এন্টি এয়ারক্রাফট ডিফেন্স শক্তি কম ছিল, ক্যারিয়ারকে তো দূরের কথা নিজেকেই পর্যাপ্ত সুরক্ষা দিতে পারবে কিনা সন্দেহ। দ্বিতীয়ত, ফ্লেচার জাপানি ফোর্সকে আক্রমণের সময় যেন শর্টকাট ধরে এডমিরাল গোটো যেন আবার হাজির না হয়ে যেতে পারে। নাহলে দুই দিক থেকে বিপদে পড়ে যাবে টাস্কফোর্স ১৭।

গোটো ইনভেশন সাপোর্ট ফোর্সে একটি লাইট ক্যারিয়ার ছাড়াও ভারী ভারী ক্রুজার ও ডেস্ট্রয়ার ছিল যা অরক্ষিত ক্যারিয়ারের জন্য হুমকি। এটা করার মূল কারণ হলো- ফ্লেচার ভেবেছিলেন তাকাগি আছে তার উত্তরে, যা ছিল সম্পূর্ণ ভুল অনুমান। সকাল ৬ টায় তিনি ১০টি টর্পেডো বোম্বারকে উত্তরে রিকনসিস মিশনে পাঠান। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাকাগি ছিলেন ৫৬০ কিলোমিটার পশ্চিমে! এদিকে এডমিরাল হারা ভেবেছিলেন ফ্লেচার আছেন তার দক্ষিণে! তিনি তাকাগিকে ১২টি স্কাউট বিমান পাঠাতে রাজি করিয়ে ফেলেন। দুই পক্ষই ভুল করলেও তাদের মূল স্ট্রাইকার বিমানগুলো তৈরি ছিল যেন শত্রু জাহাজ শনাক্ত হওয়া মাত্রই আক্রমণে যাওয়া যায়।

এ সময় ইনভেশন ফোর্সের এয়ার কাভার হিসেবে থাকা রিয়ার এডমিরাল আরিটোমো গোটো চারটি সি-প্লেন পাঠান দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। এডমিরাল মারুমোর সি-প্লেন ক্যারিয়ার থেকে টেকঅফ করা একাধিক বিমান, সদ্য নির্মিত তুলাগি ঘাঁটি থেকে উড্ডয়ন করা স্কাউট বিমান ও দূরবর্তী রাবাউল ঘাঁটি থেকে আসা লংরেঞ্জ বোম্বার পুরো সাগর জুড়ে মার্কিন ফোর্সকে খুঁজতে শুরু করে। এই যুদ্ধে তাকাগির একটি বড়সড় ভুল হলো তিনিও এডমিরাল হারার মতো নিজের বিমান দিয়ে রিকনসিস না করে গ্রাউন্ড বেজড বিমানের তথ্যের উপর ভরসা করছিলেন। তা না হলে আগের দিনই রিফুয়েলিংরত অবস্থায় অরক্ষিত মার্কিন ক্যারিয়ারে হামলা করতে পারতেন।

মার্কিন (নীল) ও জাপানি (লাল) এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের অবস্থান ও রুট। ম্যাপে ভুল দিকে পাঠানো বিমান আক্রমনের রুট ও দেখতে পাবেন; Image source : youtube.com

ততক্ষণে টাস্কফোর্স-১৭ আবার কোর্স পরিবর্তন করেছে। সকাল সাড়ে সাতটায় রিয়াল এডমিরাল হারার স্কাউট প্লেন মার্কিন ফোর্সকে তাকাগির পশ্চিমে ৩০২ কিলোমিটার দূরে শনাক্ত করে (যেটি আগে এডমিরাল হারা ভেবেছিলেন দক্ষিণে)। সকাল পৌনে আটটায় আরেকটি স্কাউট বিমানও একই তথ্য নিশ্চিত করে যে ‘একটি ক্যারিয়ার, একটি ক্রুজার, তিনটি ডেস্ট্রয়ার’ দেখা গিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তারা অয়েল ট্যাংকার ইউএসএস ন্যেশো এবং ডেস্ট্রয়ার ইউএসএস সিমস কে দেখে বাজে আবহাওয়ার কারণে ক্যারিয়ার ভেবে ভুল করছিল। বিশাল সাইজের তেলের ট্যাংকারকে কয়েক হাজার ফুট উপর থেকে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার বলে মনে হতেই পারে। কিন্তু ঐ পাইলটরা দুটো জাহাজকে তিনটে দেখলো কেন সেটাই নিশ্চিত নয়। আবার দুজন পাইলটের একই ভুল করার বিষয়টিও গ্রহণযোগ্য নয়।

এই দুটো মার্কিন জাহাজকে আগেরদিন রিফুয়েলিং শেষ করে জাপানি হামলা থেকে নিরাপদ রাখতে বহরের বাইরে নতুন রঁদেভূ পয়েন্টে অবস্থান নিতে বলেছিলেন এডমিরাল ফ্লেচার। এই ভুল তথ্যের উপর ভিত্তি করে তাকাগি ও হারা আক্রমণ করার জন্য একমত হন এবং ঐ মুহূর্তে উড্ডয়নযোগ্য সবগুলো বিমান (৭৮টি) পাঠিয়ে দেন! সকাল সোয়া আটটার মধ্যেই ১৮টি জিরো ফাইটার, ৩৬টি আইচি ডাইভ বোম্বার ও ২৪টি টর্পেডো বোম্বার আকাশে উড়াল দেয়। এদের কমান্ডার ছিলেন ভেটেরান পাইলট লেফটেন্যান্ট কমান্ডার কাকুইচি তাকাহাসি এবং সিজকাজু শিমাজাকি। 

জাপানি হামলার মুখে আগুন ধরে যাওয়া অয়েল ট্যাংকার ইউএসএস ন্যেশো; Image source : wikipedia.org

এবার নাটকের আসল অংশ শুরু। সকালে পাঠানো এডমিরাল গোটোর সেই চারটি সি-প্লেনের একটি ৮টা ২০ মিনিটে ফ্লেচারের নৌবহর শনাক্ত করে তথ্যটি রাবাউল ঘাঁটিতে কোরাল সি যুদ্ধের কমান্ডার ইন চিফ এডমিরাল শিগিওসি ইনোয়ির কাছে পাঠিয়ে দেয়। রেডিও সাইলেন্স বজায় রাখার নির্দেশ তিনি দিলেও নিজের নির্দেশ নিজে ভেঙে তাকাগিকে খবরটি দ্রুত পাঠিয়ে দেন। নতুন গোয়েন্দা রিপোর্ট পাওয়ার পর তাকাগি হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন। কেননা একটু আগে পশ্চিমে ফ্লেচারের ক্যারিয়ার আছে শুনে প্রায় সবগুলো বিমান পাঠিয়ে দিয়েছেন। এখন বলা হচ্ছে শত্রু ক্যারিয়ার আছে দক্ষিণে! তার মানে এডমিরাল হারা র অনুমান সঠিক? হয়তো কোনো কারণে তাকাগিকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রিকনসিস মিশনে পাঠানো এডমিরাল হারার ঐ ১২টি স্কাউট বিমান মার্কিন নৌ-বহরকে শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে।

তারপরও তাকাগি তার ৭৮টি বিমানকে মিশন বাতিল করে ফিরে আসার নির্দেশ দেননি। কেননা আগের তথ্য ছিল যে মার্কিনীরা এই দুটো ক্যারিয়ার ব্যবহার করছে। এখনকার তথ্যানুযায়ী দেখা যাচ্ছে দুই জায়গায় দুটো ক্যারিয়ার রয়েছে। তার মানে তারা আলাদাভাবে স্ট্রাইক গ্রুপ গঠন করে অপারেশন চালাচ্ছে। মার্কিন নৌবাহিনীর অতীত অপারেশনের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় তারা ঝুঁকি নিয়ে এককভাবে ক্যারিয়ার নিয়ে অপারেশন চালিয়েছে যা জাপানি নীতির বিপরীত। জাপানিরা সবসময় দুটো ক্যারিয়ার নিয়ে নিয়ে স্ট্রাইক ফোর্স গঠন করে অপারেশন চালিয়ে থাকে। 

Nakajima B5N ছিল জাপানের অন্যতম সেরা টর্পেডো বোম্বার; Image source : wikipedia.org

এদিকে মার্কিনিরা আবার দুর্ভাগ্যের স্বীকার হয়। সোয়া আটটার সময় ইয়র্কটাউনের স্কাউট পাইলট জন নেলসন রিয়াল এডমিরাল আরিটোমো গোটোর নৌবহরকে টাস্কফোর্স ১৭ এর ৪১৭ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে শনাক্ত করে। তার কোডেড মেসেজে তথ্য ছিল “দুটি ক্যারিয়ার, চারটি ক্রুজার“। ফ্লেচার এই খবর পাওয়ার পর গোটোর নৌবহরকে জাপানি মেইন ক্যারিয়ার ফোর্স মনে তিনি আরো সামনে এগিয়ে যান এবং সকাল সোয়া ১০টায় তার কাছে সব উড্ডয়নযোগ্য বিমান লঞ্চ করে দেন। এতে ছিল ১৮টি ওয়াইল্ডক্যাট ফাইটার, ৫৩টি ডাউন্টলেস ডাইভ বোম্বার ও ২২টি টর্পেডো বোম্বার।

১০টা ১৯ মিনিটে নেলসন ল্যান্ড করার সময় ফ্লাইট ডেক খালি হয়ে গেছে দেখে বোকা হয়ে যান। কেননা তিনি “দুটো ক্রুজার, চারটি ডেস্ট্রয়ার” এর মেসেজ পাঠিয়েছিলেন। এগুলো ডোবানোর জন্য তো সব বিমান পাঠানোর দরকার নেই। পরে তদন্তে পাওয়া যায় যে নেলসনের বিমানের রেডিওর কোডিং সিস্টেমে কারিগরি সমস্যা দেখা দিয়েছে যার ফলে তিনি চোখে সঠিক দেখলেও ভুল মেসেজ ট্রান্সমিট হয়েছে!

একটু পর জেনারেল ডগলাস ম্যাকআর্থারের আরেকটি বি-১৭ বিমানও নেলসনের তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে। তবে বি-১৭ বাড়তি তথ্য দেয় যে সেখানে একটি লাইট ক্যারিয়ার ও আছে। এডমিরাল ফ্লেচার বুঝতে পারলেন যে তিনি ভুল করে শত্রুর ইনভেশন ফোর্সের সাপোর্ট গ্রুপকে আক্রমণ করতে বিমান পাঠিয়েছেন। কিন্তু ঐ বিমানগুলোকে ফিরে আসার নির্দেশ দিয়ে তাকাগির কাছে নিজের পজিশন ফাঁস করতে চাইলেন না। রেডিও মেসেজ জাপানিরা ইন্টারসেপ্ট করবে তা জানতেন তিনি। তাই ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’ বাংলা প্রবাদের ন্যায় এডমিরাল গোটো এর লাইট ক্যারিয়ার ‘শহো’র উপর হামলা করার সিদ্ধান্ত নেয় মার্কিন বিমানগুলো।

জাপানিদের মূল স্ট্রাইকার বিমান D3A1 আইচি ডাইভ বোম্বার (বামে), মার্কিন ট্যাংকার ইউএসএস ন্যেশো (ডানে); Image source : wikipedia.org

কোরাল সাগরের অপরপ্রান্তে জাপানিরা সকাল সোয়া ৯টায় অয়েল ট্যাংকার ও ডেস্ট্রয়ারটিকে খুঁজে পায়। কিন্তু তাদেরকে আক্রমণ না করে আরো সামনে এগিয়ে গিয়ে সোয়া এগারোটা পর্যন্ত মার্কিন ক্যারিয়ার ফোর্সকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু কীসের ক্যারিয়ার? ঐ অঞ্চলে তো উক্ত ট্যাংকার ছাড়া আর কোনো বড় জাহাজই নেই! তারা বুঝতে পারে যে তাদের স্কাউট ভুল করেছে, খুবই বড় ধরনের ভুল। ফলে তারাও ফেরার পথে ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’ মনে করে সেকেন্ডারি টার্গেট মার্কিন অয়েল ট্যাংকার ‘ ইউএসএস ন্যেশো’ ও ডেস্ট্রয়ার ‘ইউএসএস সিমস’ এ হামলা চালায়। এতে ডেস্ট্রয়ারটি ডুবে যায়, ট্যাংকারটি পরবর্তী চারদিন পর্যন্ত আগুনে জ্বলতে থাকে। এই হামলায় ১৭৮ জনের অধিক মার্কিন নাবিকের মৃত্যু হয়, ডেস্ট্রয়ারটির বেঁচে থাকা ক্রুদের উদ্ধার করে ট্যাংকার। কিন্তু সে নিজেই একটু একটু করে ডুবতে থাকে। ট্যাংকারটি নিজের রেডিও সিস্টেম নষ্ট হওয়ার আগেই আক্রান্ত হওয়ার খবর ফ্লেচারকে পাঠায়।

ইউএসএস সিমস ভয়াবহ জাপানি হামলার মুখে ইঞ্জিন রুম বিস্ফোরিত হয়ে ডুবে যায়; Image source : wikipedia.org

কিন্তু এডমিরাল ফ্লেচার ভেবেছিলেন সেটি আশেপাশের কোনো জাপানি ঘাঁটি থেকে আসে কোনো ডাইভ বোম্বারের হামলা। অথচ তার কয়েকশ কিলোমিটারের মধ্যে শত্রু এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার বসে বসে ভুল চাল দিচ্ছে সেটি তার জানা নেই। তবে তার বিমানগুলো আংশিক সঠিক চাল দিয়ে দিয়েছিল। লাইট ক্যারিয়ার ‘শহো’তে ১৩টি ১ হাজার পাউন্ডের একটি বোমা ও দুটি টর্পেডো মেরে ডুবিয়ে দেয়া হয়। ফলে ৮৩৪ জন নাবিকের মধ্যে কেবলমাত্র ২০৩ জন ডেস্ট্রয়ার ‘সাজানামি’ কর্তৃক উদ্ধার হয়েছিল। আরো বিমান হামলার আশঙ্কায় ইনভেশন ফোর্সের বাকি জাহাজ নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন এডমিরাল গোটো।

দুই পক্ষের এই ভুলের ফলে জাপানিরা আর আকাশে ফাইটারের সাহায্য পাবে না। কারণ ‘শহো’ ১৮টি জিরো ফাইটার ধ্বংস হয়েছিল এবং পেট্রোলিংয়ের কাজে থাকা বাকি তিনটি ল্যান্ড করার জায়গা না পেয়ে স্থানীয় জাপানি ঘাঁটিতে কোনো রকমে ফিরে যায়। এদিকে মার্কিনীরা আর রিফুয়েলিং করতে পারবে না। কারণ প্রথম ট্যাংকারটি ডুবে যাওয়ার আগে দ্বিতীয় ট্যাংকারটিকে পুনরায় তেল নিতে ঘাঁটিতে পাঠানো হয়েছিল। দুই পক্ষই নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে এবার আসল টার্গেটের দিকে নজর দেয়।

জাপানি লাইট ক্যারিয়ার ‘শহো’তে একটি ১ হাজার পাউন্ডের একটি বোমা হিট করার মুহূর্তে তোলা ছবি, ভালো করে তাকালে বিস্ফোরণের ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখতে পাবেন; Image source : wikipedia.org

ফাইনাল অর্ডার

দুপুর দেড়টার মধ্যে ধ্বংস হওয়া ৩টি বাদে বাকি মার্কিন বিমান ক্যারিয়ারে ফেরত আসে এবং আড়াইটার মধ্যেই সব বিমানেই জ্বালানি ভরা ও অস্ত্র সংযোজনের কাজ শেষ করে আবারও উড্ডয়নযোগ্য করা হয়। ফ্লেচার ও এডমিরাল ফিচ আলোচনা করে দেখেন যে এই মুহূর্তে অরক্ষিত ইনভেশন ফোর্সের উপর হামলা করে তাদের মিশনের বারোটা বাজানো উচিত, তবে সর্বশেষ মার্কিন রেডিও মেসেজ ইন্টারসেপ্ট করে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী তারা জাপানি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার দুই নাকি চারটি সেটি নিশ্চিত হতে পারছিল না। এদিকে তাকাগির ফোর্সকে এখনো খুঁজেই পায়নি টাস্কফোর্স ১৭। তাই তিনি আজকের মতো হামলা চালানো বন্ধ রাখলেন।

তিনি সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন। কেননা ‘শহো’ ডুবে যাওয়ায় ফ্লিট কমান্ডার ভাইস এডমিরাল শিগিওসি ইনোয়ি ইনভেশন ফোর্সকে সাময়িকভাবে আগের পজিশনের উত্তরে সরিয়ে নেন। ফলে হামলা করলে ফ্লেচারের বিমানগুলো টার্গেট খুঁজে পেত না। আবার তাকাগিকে অবিলম্বে টাস্কফোর্স ১৭-কে খুঁজে বের করে ধ্বংসের নির্দেশ দেন। এ সময় জাপানি ক্যারিয়ার ফোর্স ছিল ফ্লেচার বাহিনীর মাত্র ৪১৭ কিলোমিটার পূর্বে। এ সময় ইনভেশন ফোর্সের উপর মার্কিন বি-১৭ বোম্বারগুলো আবার হামলা করে। তারা জামর্যান্ড প্যাসেজে থাকা অস্ট্রেলিয়ান ক্রুজার ফোর্সেও ভুল করে হামলা করে! তবে এতে কোনো ক্ষতি হয়নি। এডমিরাল গোটো বুঝতে পারেন যে শত্রু যুদ্ধজাহাজ আশেপাশেই আছে এবং ফাঁদ পেতেছে। এ সময় তিনি ‘ডিবোনে’ এয়ারবেজ এর সাহায্য চান এবং তার বাহিনীকে আসন্ন রাত্রিকালীন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেন।

 লাইট ক্যারিয়ার ‘শহো’কে টর্পেডো হামলার মুহূর্তে তোলা ছবি; Image source : wikipedia.org

পৌনে একটার সময় ‘ডিবোনে’ এয়ারবেজ এর মাত্র ১৪৪ কিলোমিটার দূরে এডমিরাল ক্রেসের অস্ট্রেলিয়ান ক্রুজার ফোর্সকে শনাক্ত করে। আবার সোয়া একটার সময় রাবাউল থেকে আসা লং রেঞ্জ রিকনসিস বিমান একই পজিশনে শত্রু নৌবহরের কথা উল্লেখ করে। তবে সেই বিমানটি ভুল রিপোর্ট দিয়েছিল যে ডিবোনে থেকে ২১৩ কিলোমিটার দূরে দুটি ক্যারিয়ারসহ অন্যান্য ক্রুজার ফোর্স রয়েছে। এই রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে তাকাগি আড়াইটার সময় আরো পশ্চিমে সরে যান যেন মার্কিন ট্যাংকার ও ডেস্ট্রয়ার ডুবিয়ে ফেরত আসা বিমানগুলোকে দ্রুত ক্যারিয়ারে ফেরত আসতে পারে এবং এডমিরাল শিগিওসি ইনোয়িকে বিকাল চারটায় জানিয়ে দেন যে মার্কিন বাহিনী এখন তার আরো ৮০০ কিলোমিটার পশ্চিমে আছে। যার ফলে আগামীকাল আক্রমণ করা ছাড়া কোনো বিকল্প উপায় নেই।

ফলে এডমিরাল গোটোকে সাহায্য করতে এডমিরাল শিগিওসি ইনোয়ি রাবাউল থেকে ১২টি টর্পেডো বোম্বার, ১৯টি গ্রাউন্ড অ্যাটাকে সক্ষম ফাইটার বোম্বার দিয়ে অস্ট্রেলিয়ান ক্রুজার ফোর্সে হামলা চালান। জাপানিরা ঘাঁটিতে ফিরে গিয়ে একটি ব্যাটলশিপ ডোবানোর কৃতিত্ব দাবি করে। প্রকৃতপক্ষে সেখানে কোনো ব্যাটলশিপ শ্রেণীর যুদ্ধজাহাজই ছিল না। এডমিরাল ক্রেসের ক্রুজার ফোর্সের সামান্যই ক্ষতি হয়েছিল, কোনো জাহাজ ডোবেনি। এই আক্রমণের রিপোর্ট পেয়ে আবার তাকাগি ও হারা বুঝতে পারেন যে তারা আবারো ভুল রিকনসিস রিপোর্ট পেয়েছেন। যুদ্ধ শেষে এডমিরাল হারা পরবর্তীতে ইম্পেরিয়াল জাপানিজ নেভির চীফ অফ স্টাফ এডমিরাল মাটোমে উগাকিকে দেয়া তদন্ত রিপোর্টে বলেছিলেন, কোরাল সি যুদ্ধে দুর্ভাগ্য এবং নিজেদের ভুলের কারণে তিনি এতটাই হতাশ হয়েছিলেন যে সেদিনই ঐ মুহূর্তে তার নৌবাহিনী থেকে পদত্যাগ করতে মন চেয়েছে। ১৯৭২ সালে মার্কিন ভাইস এডমিরাল এইচ.এস. ডাকওয়ার্থ যুদ্ধের জাপানি নথি নিয়ে গবেষণা করার সময় বলেছিলেন, “Without a doubt, May 7, 1942, vicinity of Coral Sea, was the most confused battle area in world history.”

নিজেদের ভুল শুদ্ধ করে পরদিন সকালেই চূড়ান্ত আক্রমণ করার জন্য দুই পক্ষই  তৈরি হতে থাকে। ফলে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সংগঠিত হয় এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার বনাম এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার যুদ্ধ।

(চলবে)

এই সিরিজের পূর্ববর্তী পর্বসমূহ:

১) ব্যাটল অফ কোরাল সি (পর্ব-১): ২য় বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র-জাপানের প্রথম বড় নৌযুদ্ধ

Related Articles

Exit mobile version