১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর একদল কর্মকর্তা ও সৈনিক মিলে সপরিবারে হত্যা করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এ ঘটনার অব্যবহিত পরেই স্বাধীন বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলো যেভাবে চোখের পলকে ভোল পরিবর্তন করে ফেলেছিল, তা আজও মানুষের মনে প্রবল বিস্ময়ের জন্ম দেয়।
যা ছিল ১৫ আগস্টের সংবাদমাধ্যমে
ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল ১৫ আগস্ট ভোরের দিকে। অথচ সংবাদপত্র ছাপার জন্য প্রেসে চলে যায় মধ্যরাতের আগেই। তাই ১৫ আগস্ট প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলোতে বঙ্গবন্ধুর হত্যাবিষয়ক কোনো সংবাদ ছিল না।
কেবল বেতারে মেজর শরিফুল হক ডালিমের একটি ঘোষণা এসেছিল। সেখানে বলা হয়েছিল,
“শেখ মুজিবকে হত্যা করা হইয়াছে এবং খন্দকার মুশতাকের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করিয়াছে। দেশবাসী সবাই শান্ত থাকুন। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।”
তার ওই ভাষণ পরে আরো অনেকবারই বেতারে প্রচার করা হয়েছিল, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর পরিবার বা স্বজনদের হত্যার কথা তো নয়ই, এমনকি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কথাটিও আর বলা হয়নি। সেগুলোতে কেবল ‘স্বৈরাচারী মুজিব’কে উৎখাতের কথা বলা হয়েছিল।
যেহেতু ১৫ আগস্ট প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলোর খবর আগের রাতেই ছাপা হয়েছিল, যখনও বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়নি, তাই ওই খবরগুলো থেকে আমরা ধারণা লাভ করতে পারি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর আগে তার ব্যাপারে সংবাদপত্রগুলোর দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে।
১৫ আগস্ট ছিল একটি বিশেষ দিন। সেদিন বঙ্গবন্ধুর যোগ দেয়ার কথা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে। তাই দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, দ্য বাংলাদেশ অবজারভার ও দ্য বাংলাদেশ টাইমস- চারটি দৈনিক পত্রিকাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করেছিল এ সংবাদটিতে, এমনকি কেউ কেউ এটিকেই প্রধান শিরোনামও করেছিল। এছাড়া এ বিষয়ক ক্রোড়পত্রও প্রকাশ করে তারা।
যেমন- নুরুল ইসলাম পাটোয়ারী সম্পাদিত দৈনিক ইত্তেফাকে প্রধান শিরোনাম করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে বঙ্গবন্ধুর যাওয়ার কর্মসূচি। তারা বঙ্গবন্ধুর ছবি তো ছেপেছিলই, এছাড়া প্রকাশ করেছিল একটি বিশেষ ক্রোড়পত্রও।
এদিকে এহতেশাম হায়দার চৌধুরী সম্পাদিত দৈনিক বাংলার প্রধান শিরোনাম ছিল “গ্রাম পর্যায়ে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে”। বাকশাল জেলা সম্পাদক প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশ নিয়ে তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান যে বক্তব্য রেখেছিলেন, সেটির ওপর ভিত্তি করে এ সংবাদটি করা হয়েছিল।
ওবায়দুল হক সম্পাদিত দ্য বাংলাদেশ অবজার্ভার সেদিন প্রথম পাতায় যতগুলো সংবাদ প্রকাশ করেছিল, তার মধ্যে ছয়টিতেই তারা সরাসরি ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি এনেছিল। যেমন- তাদের প্রধান শিরোনামই ছিল: “Bangobandhu visits D.U. today, Hearty welcome will be accorded”. আবার ডানপাশেই আরেকটি সংবাদের শিরোনাম ছিল: “Korean envoy lauds leadership of Bangobandhu”. বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে অংশ নেয়া প্রসঙ্গে তারাও একটি ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছিল।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর
এতক্ষণ তো জানলেন ১৫ আগস্টের পত্রিকাগুলোর সংবাদ কেমন ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর প্রথম পত্রিকা বের হয় ১৬ আগস্ট, তাই দেশবাসী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে ছিল সেগুলোতে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ব্যাপারে কী লেখা হবে, তা জানতে। অথচ মাত্র একদিনের ভেতরই নিজেদেরকে বদলে ফেলেছিল প্রতিটি দৈনিক পত্রিকা। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার খবরটি প্রত্যাশিতভাবেই এসেছিল প্রতিটি পত্রিকায়, কিন্তু কোথাও প্রধান সংবাদ হিসেবে নয়। এমনকি বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যসহ বাকিদের হত্যার বিষয়টিও চেপে যাওয়া হয়েছিল।
যেমন দৈনিক বাংলার প্রথম পাতায় সবগুলো কলাম জুড়ে শিরোনাম করেছিল: “খোন্দকার মুশতাক নয়া রাষ্ট্রপতি”। আর শোল্ডারে লেখা ছিল: “শেখ মুজিব নিহত: সামরিক আইন ও সান্ধ্য আইন জারি: সশস্ত্র বাহিনীসমূহের আনুগত্য প্রকাশ”। অথচ গোটা পত্রিকার কোনো জায়গাতেই তারা বঙ্গবন্ধুকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে, সে ব্যাপারে ন্যূনতম বর্ণনাও করেনি। কেবল প্রধান প্রতিবেদনে তারা লিখেছিল:
“শুক্রবার সকালে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী ‘বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে’ সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের পতন ঘটিয়ে প্রেসিডেন্ট খোন্দকার মুশতাক আহমদের নেতৃত্বে ক্ষমতা গ্রহণ করে।”
দৈনিক বাংলা সেদিন তাদের প্রথম পাতাতেই একটি সম্পাদকীয়ও প্রকাশ করেছিল, যেখানে বঙ্গবন্ধুর পতন ঘটিয়ে মুশতাকের ক্ষমতা গ্রহণকে একটি ‘ঐতিহাসিক পদক্ষেপ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল।
দ্য বাংলাদেশ অবজার্ভারেও দেখা গিয়েছিল অভিন্ন চিত্র। সেখানে শিরোনাম করা হয়েছিল: “Mushtaque becomes President”, আর নিচে ছোট করে লেখা ছিল: “MUJIB KILLED : SITUATION REMAINS CALM”. প্রথম পাতাতেই তারা একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছিল যার শিরোনাম: “Historical Necessity”.
দৈনিক ইত্তেফাক তাদের প্রধান শিরোনামে লিখেছিল: “দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি উচ্ছেদ: খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনীর শাসনক্ষমতা গ্রহণ”। তারাও বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের হত্যার বিষয়টি চেপে যায়, এবং তাদের প্রথম পাতার সম্পাদকীয় ছিল “ঐতিহাসিক নবযাত্রা” শিরোনামে।
আব্দুল গনি হাজারি সম্পাদিত বাংলাদেশ টাইমসের প্রধান শিরোনাম ছিল: “MUSHTAQUE ASSUMES PRESIDENCY”, আর সেটির শোল্ডারে লেখা ছিল: “Martial law proclaimed in the country : Mujib killed”. তারাও প্রথম পাতায় একটি সম্পাদকীয় ছেপেছিল “Our Comments” হিসেবে, যেটির শিরোনাম ছিল: “ON THE THRESHOLD OF A NEW ERA”.
সেদিনের পত্রিকাগুলোতে নতুন রাষ্ট্রপতির বেতার ভাষণ ছাপা হয়, এবং তাকে ‘বিভিন্ন স্তরের জনসাধারণের’ অভিনন্দনের খবরও ছাপা হয়। ‘বিভিন্ন স্তরের জনসাধারণ’ বলতে জায়গা পেয়েছিল বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ গণকর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ, জাতীয় হকার্স লীগের সভাপতির ভাষ্য। এছাড়া কয়েকজন সংসদ সদস্যও এ ঘটনায় আনন্দিত হয়ে সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছিল।
নতুন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের নামও প্রকাশ করা হয়। মন্ত্রীরা হলেন: বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ আলী, ফণী মজুমদার, মোহাম্মদ সোহরাব হোসেন, আবদুল মান্নান, মনোরঞ্জন ধর, আব্দুল মোমিন, আসাদুজ্জামান খান। প্রতিমন্ত্রী: শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, দেওয়ান ফরিদ গাজী, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, নুরুল ইসলাম চৌধুরী, নুরুল ইসলাম মজুর, কে এম ওবায়দুর রহমান, ড. আজিজুর রহমান মল্লিক, ড. মোজাফ্ফর আহমদ চৌধুরী।
আগস্টের বাকি দিনগুলো
১৬ আগস্টের পত্রিকাগুলো থেকেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, শেখ মুজিব পরবর্তী বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা কীরকম হবে, এবং ঠিক কেমন আচরণ তারা করবে। এবং বাস্তবিকও সে অনুমানেরই প্রতিফলন ঘটতে থাকে পত্রিকাগুলোতে।
১৭ আগস্ট দেশের চারটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকাতেই মুশতাকের জীবনালেখ্য প্রকাশিত হয়, যেখানে আওয়ামী লীগের সাথে তার সম্পর্কের সবিস্তার বর্ণনা ছিল। তবে ঐদিন প্রধান সংবাদ ছিল সৌদি আরব ও সুদান কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতির বিষয়টি। এছাড়া আগের দিনের মতোই দেশের সার্বিক পরিস্থিতি যে স্বাভাবিক রয়েছে, সে সংক্রান্ত প্রচারণাও চালানো হতে থাকে।
আগেরদিন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের মরদেহ দাফন করা হলেও, সেটিকে খুব একটা গুরুত্বের সাথে প্রকাশ করেনি কোনো পত্রিকাই। যেমন- দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত সংবাদের বিস্তৃতি ছিল দুই লাইন, দৈনিক ইত্তেফাকের খবরটি ছিল ৩৭ শব্দের, দ্য বাংলাদেশ অবজার্ভারের সংবাদটি ২৪ শব্দের।
এ সময়ে পত্রিকাগুলোয় মুশতাক সরকারের প্রতি স্তুতি প্রকাশের ক্ষেত্রে বেশ বাড়াবাড়ি দেখা যায়। বিদেশি কোনো সরকারের স্বীকৃতি, দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অব্যাহত প্রভৃতি সংবাদও অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে প্রকাশ করা হচ্ছিল। ‘লন্ডনে প্রায় দুই’শ বাঙালি কর্তৃক’ বঙ্গবন্ধুর ছবি পোড়ানোর খবরটিকে গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছিল দ্য বাংলাদেশ অবজার্ভার।
১৫ আগস্টের পর বঙ্গবন্ধুর শুভানুধ্যায়ীদের খবর প্রথম পত্রিকার পাতায় গুরুত্বের সাথে প্রকাশিত হয় ২৪ আগস্ট। কারণ তার আগের দিনই দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে সাবেক উপ-রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ ২৬ জন গ্রেফতার হন। জাতীয় চার নেতা মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এএইচএম কামরুজ্জামানসহ অনেক সিনিয়র আওয়ামী লীগের নেতাদের বন্দি করা হয়। এ সংবাদের শেষ পরিণাম কী ছিল, তা আজ আমরা সকলেই খুব ভালো করে জানি। সে বছরেরই ৩ নভেম্বর ঢাকার জেলখানার মধ্যে জাতীয় চার নেতাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছিল।
বেতারের অবস্থা
যেমনটি আগেই বলেছি, ১৫ আগস্ট বেতারে বঙ্গবন্ধুর হত্যা ও সেনাবাহিনী কর্তৃক ক্ষমতা গ্রহণের কথা বলা হয়েছিল। ওটাই ছিল ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের সরকার গঠনের আগপর্যন্ত বেতারে শেষবারের মতো বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ। কারণ, এরপরই মেজর শাহরিয়ার রশিদ কড়া নির্দেশনা দেন, যেন শেখ মুজিবুর রহমান বা তার দলের নাম, রবীন্দ্রসঙ্গীত, জয় বাংলা স্লোগান কিছুই প্রচার করা না হয়। পরবর্তীতে খন্দকার মুশতাক মৌখিক নির্দেশের মাধ্যমে বাংলাদেশ বেতারের নাম বদলে ‘রেডিও বাংলাদেশ’ করে দেন।
কলকাতার সংবাদমাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হত্যার সংবাদ
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যখন বঙ্গবন্ধু সপরিবারে খুন হন, সেদিন ছিল ভারতের স্বাধীনতা দিবস। এছাড়া গোটা দেশই তখন খুবই নড়বড়ে সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। দেশে জারি ছিল জরুরি অবস্থা, সংবাদমাধ্যমের উপরও ছিল সেন্সরশিপ।
বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর কলকাতায় পৌঁছানো মাত্রই সেখানে স্থগিত করে দেয়া হয়েছিল স্বাধীনতা দিবসের সকল অনুষ্ঠান। কিন্তু ওইদিন দেশে ছুটির দিন থাকায়, পরেরদিন সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়নি। ফলে কলকাতার পত্রিকাগুলোতে বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর কীভাবে প্রকাশিত হবে, তা জানার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল ১৭ আগস্ট পর্যন্ত।
১৭ আগস্ট কলকাতার সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী পত্রিকা আনন্দবাজার পত্রিকায় শিরোনাম ছিল: “বন্ধুর মৃত্যুতে ভারত শোকাহত”। এই সংবাদে তারা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের বুলেটে মৃত্যুর কথা উল্লেখ করলেও, তারপরই লিখেছিল:
“ভারত সরকার বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলির খবরাখবর সতর্কভাবে খতিয়ে দেখছেন এবং অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রেখেছেন।”
আনন্দবাজারের আরেকটি সংবাদে বঙ্গবন্ধুর নিজ গ্রামে সমাহিত হওয়ার ব্যাপারে লেখা হয়।
এদিকে কলকাতার আরেক পত্রিকা যুগান্তর ১৭ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু বিষয়ক সংবাদের শিরোনাম করে: “অভ্যুত্থান: মুজিব ও মনসুর আলী নিহত, সামরিক আইন জারি”। দ্য সানডে স্টেটম্যান শিরোনাম করে: “India Keeping Watch On Events In Bangladesh Grief Over Mujib’s Tragic Death”. সেখানে নয়া দিল্লীর এক দাপ্তরিক মুখপাত্রের বরাত দিয়ে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে শোক জ্ঞাপনের পাশাপাশি এটিও পরিষ্কার করে দেয়া হয় যে,“এটি বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়।”
১৯ আগস্ট আনন্দবাজার পত্রিকায় শিরোনাম করা হয় “বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী শোকাহত”। তৎকালীন ভারত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কর্তৃক শোক প্রকাশ গুরুত্ব পায় এ সংবাদে। বঙ্গবন্ধুর স্মরণে একটি স্মৃতিসভার আয়োজন করার ব্যাপারেও সংবাদটিতে জানানো হয়, যেখানে বক্তব্য রেখেছিলেন কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা। সেখানে কমিউনিস্ট নেতা ইন্দ্রজিত গুপ্ত বলেছিলেন,
“মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সিআইএ-র মদদ নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে।”
এরই মধ্যে যুগান্তর পত্রিকাও তাদের এক উত্তর সম্পাদকীয়তে মুজিব হত্যার জন্য সরাসরি দায়ী করে বসে সিআইএ-কে। এতে ভয়ানক চটে যায় আমেরিকা, এবং এক মার্কিন প্রতিনিধি নিজে গিয়ে উপস্থিত হন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের কাছে। দাবি জানানো হয় যে যুগান্তরকে প্রথম পাতায় ক্ষমা প্রার্থনা করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে হবে। কোনোমতে ওই পরিস্থিতি সামলেছিলেন সিদ্ধার্থশঙ্কর, কিন্তু এরপর থেকেই বাংলাদেশ বিষয়ক সংবাদ প্রকাশে আরো সাবধান হয়ে যেতে হয় কলকাতার সংবাদমাধ্যমগুলোকে। কোনো সংবাদ ছাপার আগে রাইটার্স বিল্ডিং থেকে অনুমোদন নিয়ে আসতে হতো। তাই পরবর্তী সময়ে কলকাতার সংবাদমাধ্যমও আর বাংলাদেশ ইস্যুতে স্বাধীন সাংবাদিকতা অব্যাহত রাখতে পারেনি।
বিশ্ব সংবাদমাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হত্যার সংবাদ
শুধু বাংলাদেশ বা কলকাতার সংবাদমাধ্যমই নয়, বঙ্গবন্ধু হত্যার সংবাদকে নিজেদের আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী ব্যাখ্যা ও প্রচার করেছিল বিশ্বের সব নামজাদা সংবাদমাধ্যমই।
১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট ওয়াশিংটন পোস্ট তাদের নয়া দিল্লী প্রতিনিধির পাঠানো সংবাদ প্রকাশ করেছিল, যেখানে বলা হয়েছিল যে নতুন ক্ষমতায় বসা সরকারটি ইসলাম ও পশ্চিমা বিশ্বের পক্ষের। এছাড়া ওই সংবাদে বঙ্গবন্ধুকে ‘বামপন্থী রাষ্ট্রপতি’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়েছিল।
ওয়াশিংটন পোস্ট বিস্তারিতভাবে বিষয়টিকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করলেও, তা করেনি তৎকালীন সোভিয়েত পত্রিকা ইজভেস্তিয়া। তারা ভেতরের পাতায় সংক্ষেপে একটি সংবাদ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু সোভিয়েত কমিউনিস্ট পত্রিকার মুখপাত্র প্রাভদা লিখেছিল, বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের আশঙ্কা এই যে,
“বাংলাদেশের আশা-আকাঙ্ক্ষার ‘প্রতিকূল শক্তিরা’ হয়তো দেশটির ভবিষ্যৎ উন্নয়নের উপর প্রভাব ফেলতে পারে।”
যুক্তরাজ্যের দ্য সানডে টাইমস প্রকাশ করেছিল অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের একটি প্রতিবেদন, যেখানে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পেছনে সম্ভাব্য তিনটি কারণ তুলে ধরা হয়েছিল: সামরিক বাহিনীর প্রতি বঙ্গবন্ধুর অবিশ্বাস, ইসলামের অবনয়ন এবং জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া।
বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের হত্যাকাণ্ডের এক সপ্তাহ পর দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস পূর্বাভাস দিয়েছিল,
“শেখ মুজিবুর রহমানের উৎখাত হয়তো দেশটিকে (বাংলাদেশ) সোভিয়েত ইউনিয়নের থেকে দূরে সরিয়ে চীনের দিকে নিয়ে যেতে পারে।”
তবে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সবচেয়ে বিস্তারিত বর্ণনার একটি ছিল সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলৎজ ও মার্টিন উলাকটের লেখা। ওই দিন ঠিক কী কী হয়েছিল এবং তার পেছনে কী কী কাজ করেছিল, তার অনেক কিছুই উন্মোচিত হয়েছিল তাদের প্রতিবেদনটি, যেটি ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান ২৮ আগস্ট তাদের প্রধান সংবাদ হিসেবে প্রকাশ করেছিল। ১৯৭৯ সালের ১৫ আগস্ট দ্য গার্ডিয়ানেই লিফশুলৎজের আরেকটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল, যেখানে তিনি বঙ্গবন্ধুর উৎখাতের নিমিত্তে সেনা অভ্যুত্থানের পেছনের চক্রান্ত নিয়ে লিখেছিলেন। সে প্রতিবেদনে তিনি লিখেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র আগে থেকেই বঙ্গবন্ধু হত্যার জন্য ঘটানো সেনা অভ্যুত্থান সম্পর্কে জানত, এমনকি মার্কিন দূতাবাসের কয়েকজন কর্মকর্তা নাকি মূল ঘটনার ছয় মাসেরও বেশি সময় আগে থেকেই বিদ্রোহ পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িতদের সাথে দফায় দফায় আলোচনায় বসতে শুরু করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর সুলভ সংস্করণ অনলাইনে কিনতে চাইলে ক্লিক করতে পারেন নিচের লিংকে-