দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বাহিনীর অন্যতম প্রধান ভুল ছিল হঠাৎ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করা, যার ফলে ইস্টার্ন ফ্রন্টে নাৎসিদের করুণ পরাজয়ের পাশাপাশি যুদ্ধের মোড়ও ঘুরে গিয়েছিল। সোভিয়েত রাজধানী পর্যন্ত নাৎসিদের হাত পৌঁছে গেলে হয়তো পশ্চিম ইউরোপে নাৎসিদের আধিপত্য আরো শক্তিশালী হতো, কিংবা হয়তো পার্ল হারবারও আক্রমণ করা হতো না।
হিটলার যদি মস্কো নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো তবে কী হতে পারতো, তা নিয়েই এক সাক্ষাৎকারে আলোচনা করেছেন নিউ ব্রান্সউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের যুদ্ধ ও সমাজ বিভাগের পরিচালক প্রফেসর মার্ক মিলনার। ‘দ্য ব্যাটল অফ দ্য আটলান্টিক’ বইটির জন্য ২০০৪ সালে সেরা সামরিক ইতিহাস রচনাকারী হিসেবে সিপি স্টেসি অ্যাওয়ার্ড পাওয়া এই অধ্যাপক সাম্প্রতিক সময়ে নরম্যান্ডির ঘটনা নিয়ে ‘দ্য আনটোল্ড স্টোরি অফ ডি-ডে’ বইটি রচনা করেছেন। তার মুখ থেকেই শুনে নেওয়া যাক এই ‘কী হতো’ ঘটনাটি।
কী হতো যদি অপারেশন বারবারোসায় হিটলার মস্কো দখল করে ফেলতে পারতো?
হিটলার, অবশ্যই ভেবেছিল যে মাত্র ছয় থেকে দশ সপ্তাহের মধ্যেই পুরো সোভিয়েত ইউনিয়নের দখল নিতে পারবে। কিন্তু বাস্তবে এটি পুরোটাই ছিল অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষার ফসল। তাছাড়া জার্মান গুপ্তচররাও সোভিয়েত রিজার্ভ বাহিনীর আসল সংখ্যাসহ আরো নানা বিষয়েই অজ্ঞ ছিল। যা-ই হোক, অলৌকিকভাবে নাৎসিরা যদি সোভিয়েত ইউনিয়নের দখল নিতে পারতো, তবে ঘটনাটি হয়তো অনেকটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতো হতো, যেখানে জার্মানরা ইস্টার্ন ফ্রন্টে জয়লাভ করেছিল।
বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে রুশ জারের পতনের পর বলশেভিকরা জার্মানির সাথে শান্তিচুক্তি করে, এবং জার্মানরা পশ্চিম ফ্রন্টে মনোনিবেশ করে। যদি হিটলার মস্কোর উপর নিয়ন্ত্রণ আনতে পারতো, তবে এরকমই কিছু হতো আর এরপরের ঘটনা যেকোনো কিছুই হতে পারতো।
তো সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর পূর্ণ দখল আনতে জার্মানির তখন কী করা উচিৎ ছিল?
সোভিয়েতের উপর পূর্ণ জয়লাভ করাটাই আসলে বেশ একটু বিতর্কের ব্যাপার। মূল কথাটা হচ্ছে, মস্কোর ভূমিকাটা কী হতো? আরএইচএস স্টোলফি তার ‘হিটলার’স পাঞ্জারস ইস্ট’ বইতে মতামত দিয়েছেন, অপারেশন বারবারোসাই ছিল পুরো বিশ্বযুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া ঘটনা। তার মতে, ১৯৪১-এর আগস্টে জার্মানি যদি ইউক্রেনের দিকে গিয়ে লেনিনগ্রাদ অবরোধ করে, পরবর্তীতে মস্কো আক্রমণ করার পরিকল্পনার পরিবর্তে সরাসরি মস্কোতে আক্রমণ চালানোর পরিকল্পনা করতো তবে হয়তো সোভিয়েতের উপর নিয়ন্ত্রণ আনতে পারতো। তো মূল প্রশ্নটা থেকে যাচ্ছে, “সোভিয়েত শাসকদের পতন ঘটাতে আসলে কী প্রয়োজন ছিল?”
জার্মানি ১৯১৭-১৮ সালে যা করেছিল, তখন ছিল সরকার পরিবর্তনের সময়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি মস্কোর ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারেনি, তারা শুধুমাত্র কিয়েভ আর রিগার দখল নিয়েছিল, এবং এটুকুই প্রয়োজন ছিল জারের রাশিয়ার পতন ঘটাতে। বলশেভিকরাও ঝামেলা এড়াতে জার্মানির চুক্তি মেনে নিয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সোভিয়েত শাসন সম্পূর্ণ ভিন্ন, স্তালিন জনগণের উপর যেরকম প্রভাব ফেলতে পেরেছিল, জার দ্বিতীয় নিকোলাসের তেমন কিছু ছিল না। তাছাড়া, লেনিনগ্রাদে নাৎসিদের নৃশংসতা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, নির্দয় স্তালিনের পতন দেখতে চাওয়া জনগণও বুঝতে পেরেছিল নাৎসিদের চেয়ে স্তালিনই মন্দের ভালো।
আমার নিজস্ব মতামত হচ্ছে যে, নাৎসিরা কোনোভাবেই ১৯৪১ শেষ হওয়ার আগে মস্কো দখল করতে পারতো না। যদি নিতোও, তবুও ঠাণ্ডার সুযোগ নেওয়া সোভিয়েত প্রতি-আক্রমণে তা পুনরায় হাতছাড়া হয়ে যেত, যেমনটা হয়েছিল স্তালিনগ্রাদে, ১৯৪২-৪৩ এ। এরপরেও কথা থেকে যায়, মস্কোর পতন মানেই রাশিয়ার পতন নয়, যেমনটা হয়েছিল নেপোলিয়নের ক্ষেত্রে। নাৎসিরা যদি মস্কো দখল করে নিতোও, তবুও সোভিয়েতদের দেশে সীমিত রসদ নিয়ে টিকতে পারতো না। সোভিয়েত রিজার্ভ বাহিনীর আকার, সোভিয়েতদের মৃত্যুকঠিন প্রত্যয় আর তাদের বিশাল মানচিত্রটার কথাই ভাবুন।
অক্ষশক্তির কাছে রাশিয়ার পতন ঘটতে দেখলে মিত্রবাহিনী কী প্রতিক্রিয়া দেখাতো বলে আপনি মনে করেন?
এর অনেককিছুই নির্ভর করে এটি কোন সময়ে হচ্ছে, এবং ঐ সময়ে পৃথিবীতে আর কী কী ঘটছে। খেয়াল করে দেখুন, নাৎসিদের ঐ পরাজয়ের পরপরই কিন্তু জাপান পার্ল হারবার আক্রমণ করে, এবং আমেরিকানরা পুরোপুরিভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যদিও তারা ব্রিটিশদেরকে সাহায্য করে যাচ্ছিলো, কিন্তু ঐ আকস্মিক আক্রমণের কারণেই কিন্তু তারা পুরোদমে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর তখনই জার্মানি আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সুতরাং মস্কোর পতন হলেও জার্মানিকে ব্রিটেন আর আমেরিকার সাথে যুদ্ধ করতে হতো।
তবে একে অন্যভাবেও কল্পনা করা যায়, যেখানে আমেরিকাকে যুদ্ধ থেকে বিরত রাখা যেত। কল্পনা করুন, জাপান পার্ল হারবার আক্রমণ না করে সাইবেরিয়ার দিকে নজর দিলো। এদিকে একদিকে যেমন সোভিয়েতের পতন দ্রুত ঘটতো, অন্যদিকে আমেরিকাকেও যুদ্ধ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা যেত। সোভিয়েতরা সাইবেরিয়া থেকে তখনই সৈন্য সরিয়ে নিয়েছিলো, যখন তারা নিশ্চিত হয়েছিল যে সাইবেরিয়া দিয়ে জাপানের আক্রমণ করার কোনো সম্ভাবনা নেই। আর সাইবেরিয়ায় রাখা সৈন্য দিয়েই পরবর্তীতে তারা পূর্ব ইউরোপে জার্মানির বিরুদ্ধে পুরোটা শক্তি কাজে লাগাতে পেরেছিল। রাশিয়ার পতন হলে এবং আমেরিকা যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়লে, ব্রিটেনের জন্য পরিস্থিতি ক্রমেই নিরাশাজনক হয়ে পড়তো।
এরকম পরিস্থিতিতে জার্মানি ব্রিটেনকে হয়তো একঘরে করে ফেলতে পারতো। মনে করে দেখুন, নেপোলিয়ন রাশিয়া আক্রমণ করেছিল ইউরোপে ব্রিটেনের শেষ মিত্রকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য, যাতে করে ব্রিটিশরা যুদ্ধ করার আর কোনো উপায় না খুঁজে পেতে পারে।
সুতরাং, এরকম একটা পরিস্থিতি কল্পনাই করা যায়, যেখানে হিটলার পুরো মহাদেশ দখল করে নিয়েছে, যেখানে শেষ বাধা একমাত্র ব্রিটেন। ইউ-বোট আর লুতওয়াফে বোম্বারগুলোর বিরতিহীন আক্রমণে ব্রিটেন হয়তো শেষমেশ সাদা পতাকা ওড়াতে বাধ্য হতো।
যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধক্ষেত্রে নামার পরেও কি অপারেশন বারবারোসার জয় প্রভাব রাখতো?
ধরে নেই, জাপানের পার্ল হারবার আক্রমণের পরও সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়েছে, আমেরিকাও সম্পূর্ণভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। পরিস্থিতিটা অনেকটাই ১৯১৮ সালের মতো, যেখানে জার্মানরা ইস্টার্ন ফ্রন্টে জয়লাভ করেছে, এবং ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে পুরোপুরি মনোযোগ দিয়েছে। কিন্তু তারপরও তারা ব্যর্থ হয়েছিল যখন মার্কিন সৈন্যরা হানা দেওয়া শুরু করলো। ১৯৪২-৪৩ সালেও কী হতে পারে সেটা বেশ আগ্রহোদ্দীপক বিষয়। সোভিয়েতের পতন ঘটলেও ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টে মিত্রবাহিনী নাৎসিদেরকে কি হারাতে পারতো?
এ নিয়ে বেশ বড় ধরনের বিতর্ক রয়েছে। একদিকে রয়েছে নরম্যান ডেভিসের (ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ) মতো ব্যক্তিরা, যারা মনে করেন যুদ্ধের বেশিরভাগটাই নির্ভরশীল ছিল ইস্টার্ন ফ্রন্টের ফলাফলের উপর, ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টের যুদ্ধ ছিল নিছকই ছেলেখেলা ইস্টার্ন ফ্রন্টের তুলনায়। এবং যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর জয় নয় বরং সোভিয়েত ইউনিয়নের জয়ই বেশি প্রভাব রেখেছিল।
অন্যদিকে ফিলিপস ও’ব্রায়েনসহ (মার্কিন ইতিহাসবিদ) অন্যান্যদের মতে, সোভিয়েতের পতন ঘটলেও নাৎসিদেরকে হারানো মিত্রবাহিনীর জন্য খুব একটা কঠিন হতো না। আমার নিজস্ব মতামত এই দুই মতের মাঝামাঝি। ইস্টার্ন ফ্রন্টে নাৎসিরা জয়লাভ করলে পুরো ইউরোপকে তারা একটি শক্তিশালী দুর্গের মতো বানিয়ে রাখতো, যার ফলে মিত্রবাহিনীর আক্রমণগুলো নস্যাৎ হয়ে যেত।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, ফ্রান্সে কোনো পদাতিক বাহিনী না থাকা মিত্রবাহিনীর জন্য বেশ বড় একটা বাধা ছিল। এ অবস্থায় হয়তো চ্যানেল আর ভূমধ্যসাগর দিয়ে আক্রমণই ছিল মিত্রবাহিনীর একমাত্র ভরসা। ও’ব্রায়েনের যুক্তির একটি অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো, তিনি মনে করেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বেশিরভাগটাই হলো আকাশযুদ্ধ। এবং ১৯৪২-৪৩ এর সময়ে মিত্রবাহিনী আকাশপথে নাৎসিদেরকে পরাস্ত করে জার্মানিতে বোমাবর্ষন করা শুরু করেছিলো। এ অবস্থায় নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে গ্র্যাউন্ড ওয়্যারে নামতে মিত্রবাহিনীর কয়েক বছর লেগে যেত, কিন্তু আকাশপথে তারা ক্রমেই যুদ্ধ চালিয়ে যেত। বোম্বারের আক্রমণে জার্মান শহরগুলো ধ্বংস হলেও বাস্তবে জার্মানরা কিন্তু তখনো পুরো ইউরোপ নিয়ন্ত্রণ করছে।
অবশেষে ১৯৪৫ সালে মার্কিনদের হাতে পারমাণবিক বোমা আসার পর জার্মানদের অবস্থাও হয়তো জাপানীদের মতো হতো। বার্লিন, মিউনিখের পরিণতিও হয়তো হিরোশিমা আর নাগাসাকির মতো হতো। তবে জাপানীদের তুলনায় অনেক বেশি এলাকা আর সম্পদ থাকায় নাৎসিদেরকে সম্পূর্ণভাবে গুড়িয়ে দিতে আরো বেশি বোমার প্রয়োজন হতো মিত্রবাহিনীর।