নেলসনের সারি
তরতর করে পানি কেটে ব্রিটিশ পতাকাবাহী জাহাজ ভিক্টরি এগিয়ে চলেছে ফ্রেঞ্চ-স্প্যানিশ লাইনের দিকে। প্রায় চল্লিশ মিনিট তার উপর তুমুল গোলাবর্ষণ করে গেল শত্রুরা। নেলসনের ভ্রুক্ষেপ নেই। তার লক্ষ্য স্বয়ং ভিল্যেনুভের জাহাজের দিকে। প্রত্যেক নাবিককে নির্দেশ দেয়া আছে শত্রুদের ফ্ল্যাগশিপ বা পতাকাবাহী জাহাজ দেখামাত্র জানাতে। নেলসন বিলক্ষণ জানেন, সেখানেই আছেন ফরাসি অ্যাডমিরাল, তাকে কব্জা করতে পারলেই লড়াই শেষ।
শত্রুদের যত কাছে যেতে থাকলেন নেলসন, ততই গোলার পরিমাণ বাড়তে লাগল। অনেক গোলা পাশ কেটে পানিতে পড়ে গেলেও কয়েকটি ঠিকই লক্ষ্যভেদ করে। ভিক্টরির একটি মাস্তুল ভেঙে গেল। ১২:২০ মিনিটে দেখা গেল তার পাল গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। তবে নেলসন ফরাসি ফ্ল্যাগশিপ বুস্যান্টর খুঁজে পেলেন।
সরাসরি বুস্যান্টরে আক্রমণ না করে নেলসন প্রথমে তুমুল বেগে ধেয়ে গেলেন শত্রু লাইনের মধ্যভাগের দিকে। গোলায় তার আরেকটি মাস্তুল উড়ে গেল। আরেক আঘাতে মুহূর্তেই থেঁতলে গেলেন নেলসনের এক সহকারী জন স্কট । তার ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ ফেলে দেয়া হলো পানিতে। বুস্যান্টরে আক্রমণের অপেক্ষায় থাকা একদল মেরিন সেনাও ঝাঁঝরা হয়ে যায়। নেলসন থোরাই কেয়ার করেন। তিনি শত্রুদের মধ্যভাগে পৌঁছে হঠাৎ করেই জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে ছুটলেন বুস্যান্টরের দিকে। ভিল্যেনুভকে সুরক্ষা দিচ্ছে দুটি ফরাসি জাহাজ, নেপচুন আর রিডাউটেবল।
নেলসন ভিক্টরির ক্যাপ্টেন হার্ডির সাথে আলোচনা করে বেলা ১ টার দিকে বুস্যান্টরের খুব কাছে চলে আসলেন। তার ১০০টি কামান সমান দুই ভাগে দুই পাশে বসানো ছিল। নেলসন প্রথমেই প্রচণ্ড আঘাত হানলেন বুস্যান্টরের উপর। কামানের গোলায় জাহাজের অভ্যন্তরভাগ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। মারা পড়ল বহু নাবিক। সেদিকে বিরতি না দিয়েই অন্যপাশ থেকে অগ্রসরমান রিডাউটেবলের দিকে কামান দাগা হলো।
রিডাউটেবলের ক্যাপ্টেন দুঃসাহসী ফরাসি কম্যান্ডার লুকাস সরাসরি ভিক্টরিতে লাফিয়ে পড়ার ফয়সালা করলেন। তার নাবিকেরা দড়ি ছুড়ে ভিক্টরির গায়ে লাগাতে চেষ্টা করল। নেলসনের জাহাজ কিছুটা উঁচু হওয়ায় তাদের অসুবিধা হচ্ছিল। তবে মাস্তুলের উপর বসে থাকা ফরাসি বন্দুকধারিদের জন্য পোয়াবারো। উচ্চতার কারণে ব্রিটিশ জাহাজ ছিল তাদের থেকে স্বল্প দূরত্বে। ফলে ফরাসিদের গুলিতে প্রচুর ব্রিটিশ হতাহত হতে থাকে। ওদিকে কামানের আঘাত, আর ব্রিটিশদের ছুড়ে মারা গ্রেনেড একের পর এক রিডাউটেবলের ডেকে বিস্ফোরিত হতে থাকলে ফরাসিদের অবস্থাও সঙ্গিন হয়ে দাঁড়ায়।
বেলা ১:১৫ মিনিট।
ডেকে ছুটে বেড়াচ্ছিলেন নেলসন। এমন সময় রিডাউটেবলে ওঁত পেতে থাকা বন্দুকধারির নজরে এলো তার পদবি সম্বলিত পরিচ্ছদ। নিশানা করে গুলি ছুঁড়ল ফরাসি আততায়ী। বন্দুকের গুলি আঘাত করল নেলসনের বাম কাঁধে। দ্রুত কয়েকজন সৈনিক তাকে বয়ে নিয়ে যায় কেবিনে। সেখানে ডাক্তার বেটি তাকে পরীক্ষা করে দেখেন। তিনি অনুমান করলেন গুলি নেলসনের শিরদাঁড়ায় গিয়ে ঢুকেছে। নেলসন তার শরীরের নিচের অংশে কোনো সাড়া পাচ্ছিলেন না। কাশির দমকে দমকে তার মুখ দিয়ে উঠে আসছিল রক্ত। তিনি ডাক্তারকে বললেন তার জন্য আর কিছু করার নেই।
ক্যাপ্টেন হার্ডি কেবিনে এলে বেটি তাকে জানান নেলসনের সময় ঘনিয়ে এসেছে। হার্ডি দ্রুত ডেকে ফিরে গিয়ে কমান্ড বুঝে নেন। কলিংউড ফিরে এলে তিনিই হবেন বহরের সর্বাধিনায়ক, তবে এখন পরিস্থিতি অনুযায়ী আইনমতে ক্যাপ্টেন হার্ডি কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করবেন।
এদিকে ফরাসিদের প্রায় সমস্ত কামানই অকেজো হয়ে পড়ে। ব্রিটিশদেরও খুব কম সংখ্যক কামান কার্যকর আছে। সেগুলোও এমন গরম হয়ে গেছে যে নাবিকেরা দ্রুত পানি ঢেলে কামান ঠাণ্ডা করবার চেষ্টা করছে। বহু নাবিকই মারা গেছে। এই সুযোগ নিয়ে লুকাসের সেনারা বারবার চেষ্টা করল ভিক্টরির ডেকে লাফিয়ে পড়তে। কিন্তু ভিক্টরির উচ্চতা প্রতিবারই তাদের সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। যতবারই তারা সফল হতে যাচ্ছিল, ততবারই ব্রিটিশরা তেড়ে এসে তাদের ব্যর্থ করে দেয়।
এমন সময় ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে রণক্ষেত্রে প্রবেশ করল ক্যাপ্টেন এলিয়াব হার্ভির ৯৮ কামানের ব্রিটিশ জাহাজ টেমেরেইর। নেপচুনের কামানে ইতোমধ্যেই জর্জরিত হার্ভি নেপচুন আর রিডাউটেবলের মাঝ দিয়ে ঢুকে পড়লেন। তার একদিকের কামান গর্জাতে শুরু করল রিডাউটেবলের দিকে। অন্যদিকের কামানের টার্গেট হলো বুস্যান্টর আর স্যান্টিসিমা ত্রিনিদাদ জাহাজ। বেলা ১:৪০ এর দিকে টেমেরেইর আর রিডাউটেবল অনেকটা ধাক্কাধাক্কির পর্যায়ে পৌঁছে গেলে ব্রিটিশরা প্রচণ্ড গোলাগুলিতে ফরাসিদের কচুকাটা করতে থাকে। একপাশে ভিক্টরি আর অন্যপাশে টেমেরেইরের আক্রমণে লুকাসের তখন চিড়েচ্যাপ্টা অবস্থা। তবে তিনি দমলেন না, বন্দুক আর গ্রেনেড দিয়ে জবাব দিতে থাকলেন।
এদিকে কলিংউডের দিক থেকে ফুগু সরে এসেছিল লুকাসকে সাহায্য করতে। কিন্তু তার নিজের অবস্থাই কাহিল। ফলে হার্ভি তোপ দেগে ফুগুকে মোটামুটি অচল করে দিলেন। ফুগু কিছুটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে টেমেরেইরের একদম পাশে চলে এলে নাবিকেরা দ্রুত ফুগুকে টেমেরেইরের সাথে আটকে দেয়। ফলে পাশাপাশি ভিক্টরি, রিডাউটেবল, টেমেরেইর আর ফুগু তুমুল লড়াই করতে থাকে। ভিক্টরি অন্যদিকে কিন্তু বুস্যান্টর আর স্যান্টিসিমা ত্রিনিদাদের উপরেও আঘাত করে যাচ্ছিল। এদিকে দশ মিনিট লড়াই করবার পর ফুগু ব্রিটিশদের হস্তগত হয়।
বেলা ২ টার দিকে ভিক্টরি জ্বলন্ত রিডাউটেবলের থেকে নিজেকে মুক্ত করে উত্তরে যাত্রা করল। ২:২২ মিনিটে ডুবুডুবু রিডাউটেবলও হার্ভির কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। তার ৬৪৩ নাবিকের মধ্যে ৩০০ জন মারা গেছে, আহত আরো ২০০। সম্ভবত রিডাউটেবলের মতো লড়াই ট্রাফালগারে আর কোনো ফরাসি জাহাজ দেখাতে পারেনি।
ফরাসিদের মতো ব্রিটিশ বাহিনীতেও ছিল নেপচুন জাহাজ, যার পরিচালনার ভার ক্যাপ্টেন থমাস ফ্রিম্যান্টলের হাতে। তিনি মনোযোগ দিয়েছিলেন স্যান্টিসিমা ত্রিনিদাদের উপর। ১৪০ কামানের এই জাহাজ সম্ভবত তখনকার সময়ের বৃহত্তম যুদ্ধজাহাজ। দু’জাহাজের মধ্যে চলতে থাকল তুমুল লড়াই। বেলা ২টার কিছু আগে ত্রিনিদাদের মাস্তুল ভেঙে পড়ল, সমস্ত পাল, দড়িদড়া ছিন্নভিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়ল ডেকে। প্রায় অকেজো ত্রিনিদাদ অসহায়ভাবে ভাসতে লাগল সাগরের বুকে।
ওদিকে ব্রিটিশ নেপচুনের পিছু পিছু নেলসনের বহরের দুই জাহাজ লেভিয়াথান আর কনকারার ঢুকে পড়েছে। তিন জাহাজই তাদের কামান তাক করল ফরাসি ফ্ল্যাগশিপ বুস্যান্টরের দিকে। যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি তার পক্ষে যাচ্ছে না দেখে ভিল্যেনুভ ভ্যান অংশে থাকা অ্যাডমিরাল ল্যু পেলির বহরকে এগিয়ে আসতে সংকেত দিয়ে পতাকা উত্তোলন করলেন। পেলির উপর আদেশ ছিল নিজ অবস্থান ধরে রাখা, তিনি নিষ্ঠার সাথে সেই কাজ করে যাচ্ছিলেন। তিনি পরে দাবি করেন, এত ধোঁয়া আর গণ্ডগোলে ভিল্যেনুভের পতাকা তিনি নাকি দেখতেই পাননি। যা-ই হোক, পেলির বহর যুদ্ধে অংশ নেয়নি। ফলে ব্রিটিশরা ভিল্যেনুভকে মোটামুটি ফাঁকা মাঠে পেয়ে যায়।
ভিল্যেনুভ পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে পারলেন। তার জাহাজ পুরোপুরি বিধ্বস্ত। প্রায় ৪৫০ জন নাবিক ও সৈনিক হতাহত। ফরাসি অফিসারদের মৃতদেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তার আশেপাশে। ভিল্যেনুভ জাহাজ ত্যাগ করতে মনস্থ করলেন। ত্রিনিদাদের কাছে নৌকা পাঠাতে বলে বার্তা দিলেন তিনি। কিন্তু ত্রিনিদাদ নিজেই তখন গ্যাঁড়াকলে, ফলে ভিল্যেনুভের কাছে আর কোনো পথ খোলা রইল না। বেলা ২টার দিকে তার আদেশে আত্মসমর্পণের চিহ্নস্বরূপ পতাকা নামিয়ে ফেলা হলো। ব্রিটিশ জাহাজ কনকারারের মেরিন সেনাদের ক্যাপ্টেন জেমস অ্যাশারলির কাছে তিনি নিজের তরবারি সমর্পণ করেন। ফরাসি অ্যাডমিরালকে নিয়ে যাওয়া হলো ব্রিটিশ জাহাজ মার্সে, যা এত গোলাগুলির মধ্যেও আশ্চর্যজনকভাবে অক্ষত ছিল।
ফ্রেঞ্চ-স্প্যানিশ সেন্টার আর রিয়ার পতনের পর ব্রিটিশরা প্রায় যুদ্ধ জিতে গিয়েছিল। তাদের একমাত্র ভয় ল্যু পেলির বহর।বেলা ৩:৩০ মিনিটের ভেতর আরো ব্রিটিশ জাহাজ রণক্ষেত্রে একে একে প্রবেশ করে। প্রায় প্রতিটি জাহাজই গোলাগুলিতে ক্ষতবিক্ষত। বেলেইল তো প্রায় অচলের মতো ভাসছে। ব্রিটিশ জাহাজ সুইফটশুর আর পলিফেমাস তাকে সুরক্ষা দিতে এগিয়ে যায়। প্রায় চার ঘণ্টা গোলাগুলির পর বেলেইলের নাবিকেরা শেষ অবধি অস্ত্র নামিয়ে জাহাজ পরিষ্কারে মনোযোগ দিল। নিজেদের করুণ অবস্থাতেও তারা কব্জা করেছে স্প্যানিশ জাহাজ আর্গোন্যাট। এর ক্যাপ্টেন এখন হারগুড আর তার অফিসারদের সাথে কেবিনে চা পান করছেন।
এদিকে ত্রিনিদাদের পতাকা গুলিতে উড়ে গেছে, কামানগুলোও নিস্তব্ধ। জাহাজের রিয়ার-অ্যাডমিরাল হিডালগোঁ সিসেরনোস আর তার দুই সিনিয়র অফিসার গুলিবিদ্ধ। ত্রিনিদাদের পতাকা উড়তে না দেখে ব্রিটিশরা ধরে নিল তারা বোধহয় আত্মসমর্পণে আগ্রহী। ফলে আফ্রিকা জাহাজের ক্যাপ্টেন ডিগবি নৌকায় করে রওনা হলেন। কিন্তু ত্রিনিদাদে পৌঁছানোর পর স্প্যানিশ এক অফিসার ডিগবিকে ভদ্রভাবে জানালেন তার লড়াই জারি রাখতে চান। ফলে ডিগবি ফিরে গেলেন নিজ জাহাজে। প্রথা অনুসারে তিনি জাহাজে না পৌঁছান পর্যন্ত ত্রিনিদাদ গোলাগুলি বন্ধ রেখেছিল। এরপর পুনরায় লড়াই শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত ত্রিনিদাদের ভাগ্য পরিবর্তন হলো না। অন্যান্য জাহাজের মতো এটিও ব্রিটিশদের হস্তগত হয়।
এদিকে যুদ্ধ শুরু হবার প্রায় দুই ঘণ্টা পর ল্যু পেলি ভিল্যেনুভের সিগন্যাল দেখতে পাবার কথা জানান। বাতাস তার প্রতিকূলে, ফলে তিনি চাইলেও দ্রুত এগিয়ে আসা সম্ভব ছিল না। পেলি ছিলেন তার জাহাজ ফরমিডেবলে। সাথে থাকা দশটি জাহাজের পাঁচটি নিয়ে তিনি ভিল্যেনুভের সেন্টারের দিকে যেতে চাইলেন, আর বাকি পাঁচটি পাঠালেন রিয়ারে স্প্যানিশ কম্যান্ডার গ্র্যাভিনার সহায়তায়। ইন্ট্রেপ্রিড আর মন্ট-ব্ল্যা নামের দুই জাহাজ এই সময় একে অপরের সাথে ধাক্কা লেগে অচল হয়ে যায়। আরো দুটি স্প্যানিশ জাহাজ বাতাসের ধাক্কায় সরে যায় অন্যদিকে। ফলে বাকি জাহাজ নিয়ে বাতাস ঠেলতে ঠেলতে প্রায় এক ঘণ্টা পর তিনি ভিল্যেনুভের দিকে এসে পৌঁছেন।
ইতোমধ্যে কলিংউড নেলসনের ব্যাপারে অবগত হয়েছেন। নিয়মানুযায়ী তিনিই এখন কমান্ডার। পেলির জাহাজগুলো বাধা দিতে তিনি ব্রিটিশদের একত্রিত হবার সংকেত পাঠান। তবে ধোঁয়া আর গোলমালে মাত্র সাতটি জাহাজ তার সংকেত দেখতে পেয়ে অগ্রসরমান পেলির বিপক্ষে লাইন তৈরি করে। পেলি এতে আরো নিরুৎসাহিত হয়ে যান। একে তো বাতাস তার পক্ষে নয়, তার উপর ব্রিটিশদের সাথে লড়াই করে জিতবেন যে সেই ভরসাও নেই।
মিনোটর আর স্পারশিয়েট নামে দুটি ব্রিটিশ জাহাজ তখন পর্যন্ত লড়াইয়ে সেভাবে অংশ নেয়নি। তার অনুধাবন করল ভিক্টরি আর টেমেরেইর এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত যে পেলি হামলা করলে তারা টিকবে না। ফলে দুঃসাহসীভাবে মিনোটর আর স্পারশিয়েট ফরমিডেবলের দিকে ছুটে যায়। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গোলা মেরে পেলির নাভিশ্বাস উঠিয়ে দেয়। ভিক্টরি আর টেমেরেইরের সামনে নিজেদের দাঁড়া করিয়ে এই দুই জাহাজ পেলিকে বাধা দিতে থাকে। তারা স্প্যানিশ জাহাজ নেপচুনের সাথে এক ঘণ্টা গোলা বিনিময়ের পর সেটাও দখল করে নেয়।
স্প্যানিশ জাহাজ অ্যাস্টুরিয়াস থেকে গ্র্যাভিনা বুঝে গেলেন যুদ্ধে পরাজয় হয়েছে। এগারটি জাহাজ নিয়ে তিনি কাদিজের পথ ধরলেন। তাকে পালাতে দেখে পেলিও পিঠটান দিলেন। চারটি জাহাজ নিয়ে তিনি প্রথমে জিব্রাল্টারের দিকে যাত্রা করেন, সেখান থেকে তার গন্তব্য হয় রশোফাঁ।
এদিকে রয়ে যাওয়া কয়েকটি জাহাজ বিক্ষিপ্তভাবে সংঘর্ষ চালিয়ে যায়। বেলা ২:১৫ মিনিটের দিকে স্যান্টা অ্যানা হার স্বীকার করে নেয়। ছয়টি ব্রিটিশ জাহাজে একযোগে গোলা মারছিল নেপোমুসেনোর উপর। অ্যাডমিরাল চুরুকার ডান পা প্রায় চুরমার হয়ে যায়। তাকে ডেকের নিচে নিয়ে যাওয়া হলেও কিছুক্ষণ পর তিনি মারা যান। এরপর নেপোমুসেনোর আত্মসমর্পণ ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র।
ইন্ট্রেপ্রিডের ক্যাপ্টেন ইনফারনেট ওদিকে তুমুল উদ্যমে রিডাউটেবলের সাহায্যে এগিয়ে যেতে চাইছিলেন। তার জাহাজের অবস্থা তথৈবচ। নাবিকদের লাশ পড়ে আছে ডেকে। দড়িদড়া, পাল, মাস্তুল গড়াগড়ি খাচ্ছে। পানি উঠতে শুরু করেছে জাহাজে। এর মধ্যেই ক্যাপ্টেন খোলা তলোয়ার হাতে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অবস্থা সঙ্গিন হয়ে উঠলে অফিসারেরা তাকে নিরস্ত করলেন, আত্মসমর্পণ মেনে নিল ইন্ট্রেপ্রিড। দখলকৃত রিডাউটেবল ততক্ষণে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ব্রিটিশ সুইফটশুর।
অন্যদিকে ফরাসি জাহাজ এইশিলের সাথে মঞ্চস্থ হচ্ছিল ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ প্রিন্সের যুদ্ধ। গোলাবর্ষণে এইশিলের সমস্ত অফিসার মারা যান, নিহত হয় প্রায় ১০০ নাবিক। জাহাজের পালে আগুন ধরে যায়, ফরাসিরা জীবন বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে পানিতে। প্রিন্স নিরাপদ দূরত্বে সরে গিয়ে পানি থেকে তুলে নেয় ফরাসি নাবিকদের। ৫:৪৫ এ জাহাজে থাকা গোলাবারুদ তুমুল শব্দে বিস্ফোরিত হয়। ডুবে যায় এইশিল। এরপর আস্তে আস্তে থেমে যায় ফ্রেঞ্চ-স্প্যানিশ প্রতিরোধ।
ট্রাফালগারের লড়াইয়ে শত্রুদের ৩৩টি জাহাজের মধ্যে ১৮টি হয় ব্রিটিশদের হস্তগত হয় নাহয় ধ্বংস হয়ে যায়। অনেক ব্রিটিশ জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কোনোটিই পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়নি। মনে করা হয়, ১,০৩৮ জন স্প্যানিশ আর ৩,৩৭০ জন ফরাসি মারা যায় যুদ্ধে, আহত হয় তাদের প্রায় ২,৫০০ জন। ব্রিটিশদের নিহত ছিল ৪৪৯ জন, আহত ১,২১৪। শত্রুদের কমান্ডার ভিল্যেনুভসহ ৭,০০০ জন বন্দি হয়।
নেলসনের মৃত্যু
বিকেল ৪ টার দিকে যুদ্ধজয় যখন প্রায় সুনিশ্চিত, ক্যাপ্টেন হার্ডি তখন মুমূর্ষু নেলসনের সামনে হাজির হলেন। অ্যাডমিরালকে আসন্ন বিজয়ের সংবাদ দিয়ে তিনি ১৪-১৫টি শত্রুজাহাজ কব্জা করার সুখবর দেন। নেলসন জানান, তিনি ২০টি জাহাজ আশা করেছিলেন। সময় ঘনিয়ে আসছে বুঝতে পেরে সহকারী অ্যালেক্সান্ডার স্কটকে নেলসন ফিসফিস করে বললেন, “ঈশ্বরের ইচ্ছায় আমার কর্তব্য আমি সুসম্পন্ন করতে পেরেছি”। হার্ডির কানে কানে এরপর তিনি আশীর্বাদ করলেন। ৪:৩০ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ট্রাফালগারের বিজয়ী।