বর্তমানে পৃথিবীতে সবচেয়ে সামরিক শক্তিধর দেশগুলোর প্রতিটিরই নিজস্ব ‘স্পেশাল মিলিটারি ইউনিট’ রয়েছে। সন্ত্রাস ও উগ্রপন্থা দমন কিংবা রাষ্ট্রের যেকোনো জরুরি প্রয়োজনের সময় শতভাগ সাফল্যের সাথে বিভিন্ন অপারেশন সম্পন্ন করার জন্য এসব বিশেষায়িত ইউনিটকে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আমেরিকার ডেল্টা ফোর্স, রাশিয়ার স্পেৎসনাজ, চীনের স্নো লিওপার্ড কমান্ডো ইউনিট কিংবা ইসরায়েলের সায়েরেত মাতকাল এ ধরনেরই কিছু স্পেশাল ইউনিটের নাম, যাদেরকে সচরাচর যেকোনো বিশৃঙ্খলায় দেখা যায় না, শুধু কিছু বিশেষ ঘটনার সময় দৃষ্টিগোচর হয়। এসব স্পেশাল ইউনিটের প্রায় সব তথ্য ‘ক্লাসিফাইড’ তথা গোপন রাখা হয়।
স্পেশাল ইউনিটের ধারণা একেবারে নতুন নয়। আধুনিক সময়ে এসে স্পেশাল ইউনিটগুলো প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী উঠলেও মধ্যযুগেও বিভিন্ন সভ্যতা কিংবা সাম্রাজ্যের অধীনে বিশেষ সামরিক ইউনিট ছিল, যেগুলো সেই সভ্যতা কিংবা সাম্রাজ্যের আভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা ও বহিঃশত্রুদের আক্রমণ রুখে দেয়া, দুটোতেই চরম সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছিল। এই লেখায় অ্যাজটেক সভ্যতার সেরকমই একটি বিশেষ সামরিক অভিজাত ইউনিট ‘জাগুয়ার নাইট’ সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।
অ্যাজটেক সভ্যতার শুরু হয়েছিল জীবন বাঁচাতে পালিয়ে আসা একদল লোকের হাত ধরে, যারা দুর্বিষহ খরা থেকে জীবন বাঁচাতে আজকের মেক্সিকোতে পালিয়ে এসেছিলেন। অ্যাজটেক সভ্যতাও মূলত গড়ে ওঠে আজকের মেক্সিকোকে কেন্দ্র করেই। অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে, এই পালিয়ে আসা মানুষগুলোর আদি নিবাস ছিল আজকের দক্ষিণ মেক্সিকোতে। দেবতার কাছ থেকে স্বাপ্নিক আদেশ পেয়ে পালিয়ে আসা লোকেরা ১৩২৫ সালের দিকে এমন একটি স্থানকে তাদের রাজধানী হিসেবে বেছে নেয়, যেটি ছিল যাতায়াত, পণ্যপরিবহন ও কৃষিকাজের জন্য বেশ প্রতিকূল। কিন্তু দেবতার আদেশ রক্ষার্থে সেই কর্দমাক্ত অঞ্চল এড়িয়ে অন্য কোনো সুবিধাজনক স্থানকে রাজধানী হিসেবে বেছে নেয়ার দুঃসাহস দেখায়নি তারা। সেই কর্দমাক্ত অঞ্চলকেই একসময় পরিশ্রম ও কৌশলের মাধ্যমে বাসযোগ্য, চাষযোগ্য করে তোলা হয়।
অ্যাজটেকদের সমাজে ছিল চারটি শ্রেণী: অভিজাত, সাধারণ জনগণ, সার্ফ বা কৃষিকাজের সাথে জড়িত থাকা সাধারণ মানুষ ও দাস। অভিজাত মানুষেরা সাধারণত রাজার কাছাকাছি থাকতেন। রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদ ও অ্যাজটেক সেনাবাহিনীর উঁচু পদে অভিজাতদের আধিপত্য ও সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। বিচারক ও ধর্মীয় যাজকদের দায়িত্ব পালন করা মানুষেরাও সমাজে অভিজাতদের সমান মর্যাদা ভোগ করতেন। সাধারণ মানুষদের দায়িত্ব ছিল কর দিয়ে রাজ্য টিকিয়ে রাখা। এই কর কখনও শারীরিক শ্রমের বিনিময়ে দেয়া হতো, কখনও পণ্যের মাধ্যমেও দেয়া হতো। অ্যাজটেক সভ্যতার অর্থনীতিতে কৃষির অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি, তাই সার্ফ বা কৃষকদের পরিশ্রম করে ফসল ফলানোর দায়িত্ব পালন করতে হতো। আর সমাজের একেবারে নিচের শ্রেণীতে ছিল দাসরা, যাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ছিল না, মালিকের হুকুম তামিল করতে বাধ্য থাকতো।
অ্যাজটেক সভ্যতায় প্রায় সবাইকেই সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে হতো। সমাজের অভিজাতদের জন্য সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের বিষয়টি বাধ্যতামূলক ছিল না। তবে সাধারণ জনগণ, কৃষক ও দাসেরা চাইলেও এই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাওয়ার সুযোগ ছিল না। তবে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও যুদ্ধের সময় কৃতিত্ব প্রদর্শনের একটি বিশেষ সুবিধা ছিল। কেউ যুদ্ধক্ষেত্রে পারদর্শিতা প্রদর্শন করতে পারলে তাকে একটি সেনাবাহিনীর অভিজাত দলে অন্তর্ভুক্ত করা হতো। অভিজাত বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হলে সমাজে সম্মান বেড়ে যেত, রাজার কাছে বাড়তি কদর থাকত এবং আলাদা বেশ কিছু সুবিধা ভোগ করা যেত। সাধারণত অ্যাজটেক সভ্যতায় নিচু শ্রেণীর মানুষদের উঁচু শ্রেণীতে ওঠার কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু সাধারণ শ্রেণীর হয়েও যুদ্ধে পারদর্শিতা প্রদর্শন করতে পারলে অভিজাত ‘জাগুয়ার নাইট’ বাহিনীর সদস্য হয়ে সমাজে বাড়তি সম্মান পাওয়ার একটু সুযোগ তৈরি হয়েছিল। এটিই ছিল কৃষক ও সাধারণ মানুষদের উঁচু শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়ার একমাত্র পথ।
অ্যাজটেক সভ্যতায় ১৪ বছর বয়স হতেই কিশোরদের সামরিক শিক্ষার হাতেখড়ি হতো। তাদের উপাসনার জন্য যেসব মন্দির তৈরি করা হয়েছিল সেখানেই বিজ্ঞ ব্যক্তিরা কিশোরদের যুদ্ধের মৌলিক বিষয়গুলো শিক্ষা দিতেন। এরপর ১৭ বছর হলে কিছু অভিজাত মানুষ বাদ দিয়ে সবাইকে সামরিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণে বাধ্য করা হতো। এই প্রশিক্ষণের পর যুদ্ধের সময় যারা শত্রুপক্ষের চারজন মানুষকে ‘জীবিত বন্দী’ হিসেবে ধরে আনতে পারবে, তাদেরকে অভিজাত ‘জাগুয়ার নাইট’ হিসেবে বিশেষ বাহিনীতে সুযোগ দেয়া হতো। অর্থাৎ ‘জাগুয়ার নাইট’ হতে হলে সাধারণ প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই নিজেকে গড়ে তুলতে হতো, কোনো বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল না।
তবে প্রশ্ন হতে পারে, এত নাম থাকতে অ্যাজটেক সেনাবাহিনীর এই অভিজাত ইউনিটের নাম ‘জাগুয়ার নাইট’ কেন হলো? কিংবা বনে এত প্রাণী থাকতে জাগুয়ারের নামেই কেন এই ইউনিটের নামকরণ করা হলো?
অ্যাজটেক সভ্যতায় সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাণী ছিল জাগুয়ার। এই সভ্যতা ছিল বর্তমান মেক্সিকোতে। উত্তর আমেরিকার এই অঞ্চলে এখনও সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাণী হলো জাগুয়ার। অনেকটা বাঘের মতো দেখতে এই প্রাণী হিংস্র হয়ে ওঠলে অস্বাভাবিক রকমের শক্তি নিয়ে প্রতিপক্ষের উপর আক্রমণ চালাতে পারে। প্রাণীবিজ্ঞানীদের মতে, এই প্রাণী এতই ক্ষিপ্র ও তীক্ষ্ণ মস্তিষ্কের অধিকারী যে, এটি যে প্রাণীকে আক্রমণ করতে চায় সেটি সাধারণত ভাগ্যের সহায়তা ছাড়া বাঁচতে পারে না। জাগুয়ারের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এটি সরাসরি শিকারের মাথার খুলিতে অতর্কিত আক্রমণ চালায়, ফলে শিকারের মৃত্যু একপ্রকার নিশ্চিত হয়ে পড়ে। এ কারণেই অ্যাজটেক সভ্যতার সবচেয়ে তুখোড়, দুধর্ষ সেনা ইউনিটকে জাগুয়ারের নাম দেয়া হয়।
জাগুয়ার যোদ্ধারা অ্যাজটেক সেনাবাহিনীর হয়ে স্বভাবতই যুদ্ধক্ষেত্রে প্রচন্ড রকমের হিংস্রতা প্রদর্শন করত। প্রতিপক্ষের কাছে তারা ছিল সাক্ষাৎ যমদূত। তাদের হাতে খুব ধারালো একধরনের কুড়াল থাকতো, যেটির একেবারে উপরে থাকতো স্বচ্ছ পাথরের তৈরি একটি ফলা। এই ধরনের কুড়ালের জোরাল আঘাতে একটি ঘোড়াও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পারত, মানুষের বেলায় কী ঘটতে পারে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই যুদ্ধক্ষেত্রে ত্রাস সৃষ্টি করতে জাগুয়ার যোদ্ধাদের জুড়ি মেলা ছিল ভার।
অ্যাজটেক সভ্যতা প্রাথমিক যাত্রায় যুদ্ধের উপর বেশ খানিকটা নির্ভরশীল ছিল। কারণ যুদ্ধের পরে বিধ্বস্ত নগরগুলোতে তারা লুট করে প্রচুর মালামাল হস্তগত করতে পারছিল। এসব মালামাল পরবর্তীতে অ্যাজটেকরা রাজধানীতে জমা করে নিজেদের সমৃদ্ধি নিশ্চিত করে। এছাড়াও যুদ্ধে পরাজিত পক্ষ থেকে অনেক সামর্থ্যবান মানুষকে দাস হিসেবে ধরে আনা হয়, যাদেরকে পরবর্তীতে বেগার খাটানো কিংবা দেবতাদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হতো। ‘বন্দী’ হিসেবে ধরে আনা যেহেতু অ্যাজটেক সভ্যতায় বীরত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হতো এবং এর মাধ্যমেই অভিজাত ‘জাগুয়ার যোদ্ধা’দের বাছাই করা হতো, তাই অ্যাজটেক সৈন্যরা বেশি করে ‘বন্দী’ ধরে আনার চেষ্টা করতো।
অ্যাজটেক সেনাবাহিনীতে আরেকটি বিশেষায়িত ইউনিট ছিল, যাদেরকে ‘ঈগল বাহিনী’ হিসেবে ইতিহাসবিদরা আখ্যায়িত করে থাকেন। জাগুয়ার যোদ্ধাদের মতো এই বিশেষ ইউনিটের সদস্যরাও অ্যাজটেক সমাজে আলাদা মর্যাদা পেত। তবে তাদের সাথে জাগুয়ার যোদ্ধাদের পার্থক্য ছিল মূলত পোশাকে। তারা ঈগলের পাখনাযুক্ত যুদ্ধের পোশাক পরিধান করত। এছাড়া বাকি সবকিছু জাগুয়ার যোদ্ধাদের মতোই ছিল।
সম্পদের প্রাচুর্যের কারণে অ্যাজটেক সভ্যতার উপর বাইরের অন্যান্য রাজ্যের নজর পড়তে দেরি হয়নি। তাদে হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য জাগুয়ার যোদ্ধারা রক্ষাকর্তা হয়ে আবির্ভূত হয়। আভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রেও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত।
সবমিলিয়ে জাগুয়ার যোদ্ধারা সমাজে বিশেষ সুবিধা ভোগ করা কিংবা রাজার কাছে বাড়তি কদর লাভের বিনিময়ে পুরো অ্যাজটেক সভ্যতা রক্ষা করতে নিজেদের জীবন বিপন্ন করতেও পিছপা হত না। যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের নামের যথার্থতা প্রমাণ করে দিনশেষে অ্যাজটেক সভ্যতারই ত্রাতা হয়ে দাঁড়াত তারা।