১৯৮৬ সালের কথা। অডিও কোম্পানী “চেনাসুর” এর কর্ণধার,গীতিকার হাসান মতিউর রহমান একটা বিষয় নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে এক গভীর ভাবনায় ডুবে আছেন। তাঁর এবারের পরিকল্পনাটি গতানুগতিক ধারার বাইরে, একটু ভিন্নই বলা যায়। উনি এমন কাউকে খুঁজছেন, যিনি প্রখ্যাত গজল গায়ক পংকজ উদাসের মতো হারমোনিয়ামের তালে সাবলীলভাবে গাইতে পারেন এবং গলার সুরটাও এমন শ্রুতিমধুর যে, যার গান শুনে শ্রোতারা নিমিষেই কখনোই সুরের মায়াজালে আটকে পড়বেন।
হাসান সাহেবের একটি ছেলের কথা মনে পড়লো। একবার খিলগাঁওয়ের কোনো এক ঘরোয়া আসরে তিনি ছেলেটির গান শুনেছিলেন। তাঁর গায়কীর ধরন হাসান সাহেবকে এতটাই মু্গ্ধ করেছিলো, উনি হঠাৎ করে একপ্রকার সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেললেন যে, পরবর্তী অ্যালব্যামটি সেই ছেলেটিকে দিয়েই করাবেন। একেবারে যেই ভাবা,সেই কাজ! অল্প সময়ের ব্যবধানে তাঁর ঠিকানা যোগাড় করা হলো। হাসান সাহেব বিক্রমপুরের ওয়াইজ ঘাটের দিকে রওয়ানা দিলেন। গিয়ে দেখলেন, তাঁর সম্বন্ধে যা শুনেছিলেন, তার পুরোটাই সত্যি।
ছেলেটির নাম মুজিবুর রহমান মোল্লা এবং সে ও তাঁর বাবা ইউসুফ আলী মোল্লা মিলে একটি ফলের দোকান চালায়। অবসরে মুজিব গান করেন এবং গানের প্রতি তাঁর নেশাটাও প্রচন্ড রকমের। তবে সেটা নিতান্তই ব্যক্তিগত শখের বশে। হাসান সাহেব যেন একটু দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন। মুজিব ক্যাসেট করার প্রস্তাবটি পেয়ে আদৌ সাড়া দিবে কি দিবে না এ ভাবনা ভাবতে ভাবতে তাঁর সময় কেটে যায়। একটা পর্যায়ে উনি মুজিবকে তাঁর প্রস্তাবের কথা জানান, তবে একটু ভিন্নভাবে। দেখা গেলো ক্যাসেট করার প্রস্তাব পেয়ে মুজিব যেন খুশির চেয়ে, রোমাঞ্চিতই বেশি হয়েছিলেন। মুজিব বিনা ভাবনায় সম্মতি প্রকাশ করার পরপরই হাসান সাহেব নির্ভার হলেন। শুরু হলো অ্যালব্যামের কাজ। তারপরের অধ্যায়টা বাংলা সঙ্গীত জগতের ইতিহাসের এক নতুন মাইলফলকের গল্প। আজ সে গল্পই বলতে এসেছি।
হাসান মতিউর রহমান চেয়েছিলেন এই অ্যালব্যামের সব গান পঙ্কজ উদাসের মতো হারমোনিয়ামের তালে গজল সঙ্গীত ধাঁচের হবে। কিন্তু মুজিব চাইলেন জীবনের প্রথম অ্যালব্যাম যেহেতু, সেহেতু সেখানে সব ধরনের বাদ্যযন্ত্রের সঠিক ব্যবহার হোক। বাদ্যযন্ত্র ব্যবহারের খরচ মুজিব নিজেই দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হাসান মতিউর রহমান যেন নিজস্ব সিদ্ধান্তে অনড়; তিনি সিদ্ধান্ত পাল্টালেন না।
১৯৮৬ সালের ২৮ শে ডিসেম্বর তারিখে মাত্র পৌনে ২ ঘণ্টায় অ্যালব্যামের ১ টা গান রেকর্ড করা হয়েছিলো। সর্বসাকুল্যে এই অ্যালব্যাম তৈরিতে খরচ পড়েছিল মাত্র ১৩৬০ টাকা। অথচ অ্যালব্যামটির ৬০ লাখেরও অধিক কপি বাজারে বিক্রি করেছিল মূল কোম্পানী ‘চেনাসুর’। ধারণা করা হয় এই অ্যালব্যামের নকল ক্যাসেট বিক্রি হয়েছিল আরো ২৫ থেকে ৩০ লাখ কপি, যা বাংলাদেশের অ্যালব্যাম বিক্রির ইতিহাসে এক অনন্য ভোরের ইতিকথা। আরো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে, মুজিবুর রহমান মোল্লার গাওয়া এই অ্যালব্যামের এগারোটি গানের সব কয়টি পরবর্তীতে বিভিন্ন বাংলা চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা হয়। তন্মধ্যে তোজাম্মেল হক বকুল পরিচালিত বেদের মেয়ে জোসনা সিনেমায় ব্যবহৃত “আমি বন্দী কারাগারে” গানটি সর্বাধিক আলোড়ন তোলে। সমালোচকদের ধারণা গানটির জনপ্রিয়তাই “বেদের মেয়ে জোসনাকে” জনপ্রিয়তার তুঙ্গে আরো একধাপ এগিয়ে দিয়েছিলো। পরবর্তীতে এই সিনেমাটিও বাংলা চলচ্চিত্র জগতের ইতিহাসে সর্বাধিক ব্যবসা সফল সিনেমাদের কাতারে নাম লেখায়।
পাঠকদের মনে হয়তো প্রশ্ন জেগেছে তাঁর নাম মুজিবুর রহমান মোল্লা থেকে মুজিব পরদেশী কেমন করে হলো। সে আরেক গল্প। চলচ্চিত্র জগতে বিক্রমপুরের এক নায়ক ছিলেন, মুজিব বঙ্গবাসী তাঁর নাম। অ্যালব্যামের কন্ট্রাক্টে সাইন করবার পরপরই হাসান মতিউর রহমান মুজিবের নাম সেই নায়কের আদলে ছোট করে মুজিব পরদেশী রাখেন। প্রথম অ্যালব্যাম “আমি বন্দী কারাগারে” তাঁর মুজিব পরদেশী নামেই বাজারে এসেছিলো ৷
একের পর এক অ্যালব্যাম হিট, মর্মস্পর্শী সুর তার সঙ্গে গানকে ভালোবাসা এক গানপাগলের সুনাম অচিরেই দেশ থেকে বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিলো। মুজিব পরদেশী গান দিয়ে শুধু যে দেশের মানুষের মন জয় করেছিলেন তা কিন্তু নয়, বিদেশে শো করতেও বারংবার তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। শেষে তিনি সাড়া দিলেন। চার মাসের ভিসা নিয়ে লন্ডনে গেলেন গান গাইতে। সেখানেও তাঁর জনপ্রিয়তার এমন মাত্রা তাঁকে অভিভূত করেছিলো। সেবার শো করে দেশে ফিরে আসবার পরপর আদম ব্যবসায়ী দালালদের চক্করে পড়েন। সরল মানুষ, গানই যার প্রথম নেশা তাঁকে জড়িয়ে ফেলা হয় দালাল চক্রের ভয়ানক জালে। ফাঁদের গভীরতা বুঝতে বুঝতে জেল-জরিমানা আর আদালতের শাঁসানী ৷ হ্যাঁ, তারপর একজন নক্ষত্রের শুধুই থমকে থাকার ইতিবৃত্ত ৷
গায়কী আর গানে গানে সরল অনুভূতি বলে যাবার জন্য অসংখ্যবার টিভি-ক্যামেরার মুখোমুখি হওয়া মৃদুভাষী এ মানুষটি হয়তো নিজেকে কোনোদিনই এভাবে দেখতে চাননি। চাননি বলেই চলে গেলেন অখন্ড অবসরে, কেউ তাঁর খোঁজ পায় না; অথচ যাকে ভালোবাসে ফেরানো যেতো বারংবার সুরের জগতে, সে মানুষটি নিভৃতেই গানে মজে থাকেন, কাঁদেন আর পায়চারী করেন আরেকটি সুযোগের জন্য ৷
জীবন কাউকে ফেরায় না। মুজিব পরদেশীকেও ফেরায়নি। মানুষের ভালোবাসা ছাড়া যার কাছে আর কিছুই অবশিষ্ট ছিলো না, সে মানুষটিই একদিন উদীয়মান এক নির্মাতার ফোন পেলেন। সেই নির্মাতার নাম – মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ৷ ফারুকী নিজেও মুজিব পরদেশীর ভক্ত। সেই ফারুকী মুজিব পরদেশীর “কলমে নাই কালি” গানটি নতুন করে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে দর্শকদের সামনে আনতে চান। আরেক তরুণ সঙ্গীত পরিচালক অর্ণবের হাত ধরে গানটিকে নতুনভাবে সাজানোর মধ্য দিয়ে মুজিব পুনরায় ভক্তদের মাঝে ফিরে এলেন। আবার সেই রাজকীয় উত্থান, আধুনিক ফোক গানের পুরনো সম্রাটের আরেকবার রাজকীয় প্রত্যাবর্তনের ইশারা।
মুজিব রাজকীয় ভাবেই ফিরেছেন। ফেরার আগে তাঁর মোট একক অ্যালব্যামের সংখ্যা ছিলো একচল্লিশটি। নতুন অ্যালব্যাম নিয়ে তিনি শীঘ্রই ফিরবেন ঘোষণা দিয়েছেন। ছেলে সজীব পরদেশীকে নিয়ে স্টেজ শো এবং নিয়মিত লাইভ শো করছেন বিভিন্ন চ্যানেলে, দর্শকরা এখনো উদ্বেলিত তার সুরের মূর্ছনায়; অতটুকু একজন গায়কের জন্য কম কিছু কী? বড় চমকের কথা হলো, তিন দশক পর আবারো মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর “ডুব” চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে বড় পর্দায় তাঁকে দেখা যাবে ৷
মুন্সীগঞ্জ জেলার টঙ্গীবাড়ি উপজেলার বেতকা গ্রামে জন্ম মুজিব পরদেশীর। সংগীত জীবনে তিনি বিভিন্ন সময়ে তালিম নিয়েছেন ওস্তাদ গোলাম হায়দার আলী খান, ওস্তাদ কোরাইশী, ওস্তাদ ফজলুল হক ও ওস্তাদ আমানউল্লাহর কাছে। তিনি তবলাতেও পারদর্শী। সুরকার হিসেবেও তাঁর প্রশংসা রয়েছে সংগীতপাড়ায়। বরেণ্য সুরকার এবং সংগীত পরিচালক সত্য সাহা, সুবল দাস, ধীর আলী, খন্দকার নূরুল আলমের সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।
প্রথম সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন ‘অশান্ত ঢেউ’ চলচ্চিত্রে। এরপর তিনি হাফিজ উদ্দিনের ‘অসতী’সহ আরও প্রায় বিশটি চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছিলেন। সর্বশেষ ফিরোজ আল মামুনের ‘দৌড়’ চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স সম্পন্ন করা মুজিব পরদেশী প্রথম অভিনয় করেন সিরাজ হায়দার পরিচালিত ‘সুখ’ চলচ্চিত্রে। সর্বশেষ আশির দশকের শেষ প্রান্তে ফিরোজ আল মামুনের নির্দেশনায় ‘মোহন মালার বনবাস’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এখন অপেক্ষায় আছেন তিনি একটি বড় চমক দেওয়ার। ভারতের একটি চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব পেতে যাচ্ছেন শিগগিরই। আর যদি তা চূড়ান্ত হয় তাহলে তা হবে তার জীবনের অন্যতম বড় একটি প্রজেক্ট ৷
চিরকাল মাটির সঙ্গেই ছিলেন। মাটির টান তাঁকে জড়িয়ে রেখেছে বহুভাবে। দায়মুক্তির উপায় হিসেবে গানকে বেছে নিয়েছিলেন মুজিব। গেয়েছেন মানুষের জন্য, মানুষও তাঁকে ফেরায়নি। ভালোবাসা বোঝাই মন নিয়ে যখন গেয়েছেন –
“চাতুরী করিয়া মোরে,
বান্ধিয়া পিরিতেরই ডোরে
হায় হায় বিচ্ছেদ সাগরে ভাসায় গেলি”
কিংবা-
“আমি কেমন করে পত্র লিখি রে বন্ধু?
গ্রাম পোস্টঅফিস নাই জানা
তোমায় আমি হলেম অচেনা”
এগুলোর মতো গান কত মানুষের বুক ফাঁকা, চোখে জল এসেছে তার কোনো হিসেব করা হয়নি, হয়তো হবেও না। তবে সেই হিসেব কিংবা বেহিসেবের অবসরে একজন মুজিব পরদেশী হারিয়ে যাবেন না, অতটুকু নির্দ্বিধায় বলতে পারি। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আধুনিক বাংলা ফোকের এই গুণী শিল্পীর প্রতি।