১৯৬১ সালের জুলাই মাসের এক সকালে নিজের প্রিয় দোনলা বন্দুকটা মাথায় ঠেকালেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। পরপারে পাড়ি জমালেন কালজয়ী উপন্যাস ‘দ্য ওল্ড ম্যান এন্ড সী’ সহ অনেক মাস্টারপিসের রচয়িতা আর ১৯৫৪ সালে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হওয়া এই সাহিত্যিক। পুরষ্কারের ঝুলিতে এই মানুষটির আছে একটি পুলিৎজার প্রাইজও। বন-অরণ্য কিংবা সমুদ্রে শিকার করতে ভীষণ পছন্দ করা এই মানুষটি তার পাখি শিকার করার দোনলা বন্দুকে নিজের খুলি উড়িয়ে দেবেন এমনটা তার ভক্ত শুভাকাঙ্ক্ষীদের কেউ কল্পনাতেও চিন্তা করেননি। ‘ওল্ড ম্যান এন্ড সী’ নামক কালজয়ী উপন্যাসে এই হেমিংওয়ে বৃদ্ধ সান্তিয়াগোকে দিয়ে বলিয়েছেন,
“Man is not made for defeat . . . [a] man can be destroyed but not defeated”
সেই হেমিংওয়ে কি নিজেই হতাশার কাছে পরাজিত হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিলেন? জীবনযুদ্ধের রণক্ষেত্রে মাত্র ৬১ বছর বয়সেই ইস্তফা দিলেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। কিন্তু কেন এই বিদায়? মৃত্যুর খবর চাউর হবার পরপরেই তার স্ত্রী মেরি হেমিংওয়ে সাংবাদিকদের বলেন,
“আর্নেস্ট ভোরে শিকারে বের হবার আগে হয়তো তার বন্দুক পরিষ্কার করছিলেন, ভুলক্রমেই হয়তো বন্দুক থেকে গুলি বেরিয়েছে।”
আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, তার বাবা ক্লারেন্স হেমিংওয়ে, ভাই লিস্টার হেমিংওয়ে আর বোন উরসালা হেমিংওয়েও আত্মহত্যা করেছেন। হেমিংওয়ে পরিবারের রক্তেই কি মিশে আছে এই আত্মহত্যার বাতিক? নাকি তারা ভুগছিলেন কোনো ব্যাধিতে?
হেমিংওয়ের জন্ম
১৮৯৯ সালের কথা, ডাক্তার ক্লারেন্স হেমিংওয়ে আর গায়িকা গ্রেস হেমিংওয়ের শিকাগোর ওক পার্কের বাড়িতে জন্ম নিয়েছিলেন আর্নেস্ট। ওক পার্ক এন্ড রিভার ফরেস্ট হাই স্কুলে পড়াশোনায় হাতেখড়ি হয় তার। ইংরেজী সাহিত্যের প্রতি তার অনুরাগ জন্মাতে থাকে স্কুলে পড়ার সময় থেকেই।
তবে হেমিংওয়ে একদম ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলা করতে ভীষণ পছন্দ করতেন। বক্সিং, ওয়াটার পোলো কিংবা ফুটবল সুযোগ পেলেই খেলতে নেমে পড়তেন হেমিংওয়ে। কাকতালীয়ভাবে মার্ক টোয়েন, স্টিফেন ক্রেইন কিংবা সিনক্লেয়ার লুইসের মতো বিখ্যাত সাহিত্যিকদের ন্যায় তারও লেখালেখির যাত্রা শুরু হয় সাংবাদিক হিসেবে। হাই স্কুলে পড়াকালীনই স্কুলের সংবাদপত্র ‘ট্রাপিজি এন্ড টাবুলা’ (Trapeze and Tabula) তে খেলাধুলা নিয়ে লেখালেখি শুরু করেন। পড়ালেখা শেষ করে ‘ক্যানসাস সিটি স্টার’ পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন হেমিংওয়ে। সফল সাহিত্যিক হিসেবে তার পরবর্তী জীবনের ভিত গড়ে দিয়েছিল এই সাংবাদিকতা। তাই সাংবাদিকতা জীবনের হাতেখড়ি আর ক্যানসাস সিটি স্টার পত্রিকার অভিজ্ঞতা নিয়ে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে একবার বলেছিলেন–
“On the Star you were forced to learn to write a simple declarative sentence. This is useful to anyone. Newspaper work will not harm a young writer and could help him if he gets out of it in time.”
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হেমিংওয়ের প্রেম এবং প্রত্যাখ্যান
সময়টা ১৯১৮, আমেরিকা ততদিনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। যুদ্ধাহতদের সেবা দেওয়ার ছোট শহর ক্যানসাসে স্বেচ্ছাসেবীর খোঁজে আসা রেডক্রসের দলে যোগ দিলেন হেমিংওয়ে।
পাড়ি জমালেন ইতালিতে। যুদ্ধাক্রান্ত ইতালির রাস্তাধরে রেডক্রসের অ্যাম্বুলেন্স চালাতে শুরু করেন হেমিংওয়ে। মর্টারে আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হয়েও অ্যাম্বুলেন্সে করে মরণাপন্ন যাত্রীদের পৌঁছে দিয়েছেন গন্তব্যে। আহত হেমিংওয়ে ছয় মাস হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। ইতালিয়ান সরকার অবশ্য তার এই সাহসিকতার জন্য তাকে ভূষিত করেন ‘ইতালিয়ান সিলভার মেডেল অভ ব্রেভারী’ দিয়ে। হাসপাতালেই হেমিংওয়ে ভালোবেসে ফেলেন এগনেস ভন কুরোস্কি নামের রেডক্রসের এক নার্সকে।
এগনেস আর হেমিংওয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কয়েক মাসের মধ্যে আমেরিকাতেই হবে তাদের বিয়ে। ১৯১৯ সালের জানুয়ারী মাসে হেমিংওয়ে ফিরে এলেন আমেরিকায়। অপেক্ষা করতে লাগলেন এগনেসের জন্য। কিন্তু হঠাৎ ইতালি থেকে এগনেসের প্রত্যাখ্যানের চিঠি এলো। এক ইটালিয়ান কর্মকর্তার সাথে এগনেসের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে শুনে হেমিংওয়ে ভেঙে পড়েছিলেন। ২০ বছর বয়সে জীবনের প্রথম প্রেমে ব্যর্থ হয়েছিলেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। কিন্তু ব্যর্থ হেমিংওয়ে এখান থেকেই জোগাড় করলেন তার বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম ‘এ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস’-এর অনুপ্রেরণা।
আবারো প্রেমে পড়লেন হেমিংওয়ে
লেখালেখির পাশাপাশি পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাকেই বেছে নিয়েছিলেন হেমিংওয়ে। টরেন্টো স্টার নামক পত্রিকায় চাকরি নিলেন তিনি। এবার তার জীবনে এলেন এলিজাবেথ হ্যাডলি রিচার্ডসন। হেমিংওয়ে ভালোবাসলেন তাকে, বিয়ে করে শুরু করলেন সংসার।
টরেন্টো স্টারের ফ্রান্স প্রতিনিধি হিসেবে হেমিংওয়ে চলে এলেন প্যারিসে। প্যারিসে তিনি বিশ্বের অন্যতম সেরা সব লেখক আর শিল্পীর সান্নিধ্যে আসেন। স্কট ফিটজেরাল্ড, জেমস জয়েস, পাবলো পিকাসো, এজরা পাউন্ডের মতো অনেক সাহিত্যিক আর শিল্পীর তরুণ হেমিংওয়ের পরিচয় হয় এই প্যারিসেই। ১৯২৬ সালে প্রকাশিত হয় হেমিংওয়ের রচিত অন্যতম সেরা উপন্যাস ‘The Sun Also Rises’।
অন্যদিকে প্যারিসে এসেই হেমিংওয়ে প্রেমে পড়েন পলিন পাইফার নামের এক আমেরিকান সাংবাদিকের। ফাটল ধরে হেমিংওয়ের সংসারে। ১৯২৭ সালের মে মাসে হ্যাডলি রিচার্ডসনকে ডিভোর্স তিনি দিয়ে বিয়ে করেন পলিন পাইফারকে। এ সময় হেমিংওয়ে লেখা শুরু করেন তার ছোট গল্প সংকলন ‘Men Without Women’।
হেমিংওয়ের বাবার আত্মহত্যা
১৯২৮ সালে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের বাবা ক্লারেন্স হেমিংওয়ে আত্মহত্যা করেন। বাবার মৃত্যুর খবরে অনেকটাই গুটিয়ে যান হেমিংওয়ে। তার শ্বাশুড়ি মেরি পাইফারকে এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন–
“I’ll probably go the same way”
বাবার মৃত্যুর পরে হেমিংওয়ের জীবনে বিশাল পরিবর্তন আসে। মদ্যপানের মাত্রা বাড়িয়ে দেন তিনি। বেশ কয়েকবার গুরুতর প্লেন ক্র্যাশ আর সড়ক দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গেলেও মাথায় গুরুতর আঘাতের চিহ্ন বয়ে বেড়িয়েছেন আজীবন। নিজের মনের সবটুকু শক্তি সঞ্চয় করে লেখালেখি চালিয়ে যান হেমিংওয়ে। সামনে থেকে দেখা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে তার লেখা উপন্যাস ‘এ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস’ প্রকাশিত হয় ১৯২৯ সালে। বেস্টসেলার এই উপন্যাসের মধ্য দিয়েই আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি লাভ করেন।
স্প্যানিশ সিভিল ওয়ারে হেমিংওয়ে
১৯৩৭ সালে হেমিংওয়ে স্প্যানিশ সিভিল ওয়ারের রিপোর্টার হিসাবে কাজ শুরু করেন। এই যুদ্ধে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার সুবাদে মার্থা গেলহর্ন নামে এক নারী সাংবাদিকের সাথে পরিচয় হয় হেমিংওয়ের। মার্থার অনুপ্রেরণাতেই হেমিংওয়ে রক্তক্ষয়ী এই যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা শুরু করেন তার আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস ‘For Whom the Bell Tolls’, যেটি পরবর্তীতে পুলিৎজার পুরষ্কারের জন্যে মনোনীত হয়। মার্থার সাথে হেমিংওয়ের এই সম্পর্ক তার পরিবারে আবারো ভাঙন ডেকে আনে। পলিন পাইফারকে ডিভোর্স দিয়ে মার্থা গেলহর্নকে বিয়ে করেন হেমিংওয়ে।
১৯৪০ সালে মার্থাকে নিয়ে তিনি চলে আসেন কিউবা। রাজধানী হাভানা থেকে খানিকটা দূরেই একটা বাগানবাড়ি কিনেছিলেন হেমিংওয়ে। উত্তাল সমুদ্রে মাছ শিকার করতে দারুণ পছন্দ করতেন হেমিংওয়ে। উত্তাল সমুদ্রে মাছ শিকারে যাওয়া জেলেদের নিত্যদিনের কাজের সাথে একটু একটু করে পরিচিত হচ্ছিলেন তিনি। কালজয়ী উপন্যাস ‘The old man and the sea’ এর উপাদানগুলোও সংগ্রহ করে চলছিলেন তিনি। তবে হেমিংওয়ে সাংবাদিকতার সাথে তখনও যুক্ত ছিলেন। ১৯৪১ সালে যখন চীন-জাপান যুদ্ধ চলছে, তখন মার্থা আর হেমিংওয়ে পাড়ি জমান চীনে যুদ্ধের খবর সংগ্রহের জন্য। তবে আমেরিকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অংশগ্রহণের আগেই হেমিংওয়ে আর মার্থা আবারো কিউবা ফেরত আসেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আমেরিকার অংশগ্রহণের পরপরই সংবাদ সংগ্রহে ইউরোপে আসা হেমিংওয়ের সাথে দেখা হয় টাইম ম্যাগাজিনের সাংবাদিক ম্যারি ওয়েলস এর সাথে। ভালো লাগা থেকে ভালোবাসা। আর তাই ১৯৪৫ সালে তৃতীয় স্ত্রী মার্থাকে ডিভোর্স দিয়ে বিয়ে করেন ম্যারি ওয়েলসকে।
তার একাধিকবার বিয়ে করার ব্যাপারে তাকে একবার জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছিলেন-
“Funny how it should take one war to start a woman in your damn heart and another to finish her. Bad luck.”
১৯৫২ সালে প্রকাশিত হয় আর্নেস্ট হেমিংওয়ের কালজয়ী সাহিত্যকর্ম ‘The Old Man and the Sea’। এই উপন্যাস দিয়েই পাঠকদের মনে স্থান করে নেন হেমিংওয়ে।
১৯৫৩ সালে এই বইয়ের জন্যই পুলিৎজার পুরষ্কার জিতে নেন হেমিংওয়ে। ১৯৫৪ সালে তাকে সাহিত্য নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত করা হয়। বেশ কয়েকবার দুর্ঘটনার কবলে পড়ে অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণে স্টকহোমে নোবেল পুরষ্কার গ্রহণের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেননি হেমিংওয়ে। ১৯৬০ সালের ২৫ জুলাই হেমিংওয়ে কিউবা থেকে স্থায়ীভাবে আমেরিকায় ফিরে আসেন তিনি। আমেরিকার আইডাহোর বাড়িতেই ১৯৬১ সালের ২ জুলাই সকালে আত্মহত্যা করেন কালজয়ী এ সাহিত্যিক।
কেন এই আত্মহত্যা?
হেমিংওয়ে বংশের রক্তেই ছিলো ‘বাইপোলার মোড ডিসঅর্ডার’ নামের একধরনের ব্যাধি। বংশ পরম্পরায় বাহিত হওয়া এই রোগে যারা ভোগেন তাদের চরিত্রে থাকে দুটি দিক। একদিকে থাকে ম্যানিক কন্ডিশন বা অতিরিক্ত উচ্ছাস, আর অন্যদিকে থাকে ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা। তাই খেলাধুলা, শিকার করা আর সামাজিক জীবনের উচ্ছাসে মেতে থাকা বাইপোলার মোড ডিসঅর্ডারের রোগীরা হঠাৎ করেই ডুবে যান বিষণ্ণতার এক অতল গভীরে। তার বাবা, ভাই কিংবা বোনের মতো তার ভেতরেও নীরবে বাসা বেঁধেছিল এই রোগ। আর তাই শুধু আমেরিকা নয়, বরং পুরো ইংরেজি সাহিত্যের জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন হয় ৬২ বছর পূর্ণ হবার ১৯ দিন আগে।
ফিচার ইমেজ- biography.com