বিশাল সমুদ্রের বুকে যেমন ছড়িয়ে আছে হাজারও রহস্য, তেমনই রহস্য ছড়িয়ে আছে সমুদ্রের বাহন জাহাজের ব্যাপারেও। যার কিছু ঘটনা সত্য, কিছু সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়ে এমন রূপকথায় পরিণত হয়েছে, যার থেকে প্রাচীন সত্যি ঘটনা বের করা মোটামুটি অসম্ভব। তেমনই এক বাস্তব আর রূপকথার মিশেলে তৈরি ইতিহাস এস এস অরাং মেডান জাহাজের। ঠিক কী ঘটেছিল সেই ‘ভৌতিক’ জাহাজে? অভিশপ্ত সেই জাহাজের পরিণতিই বা কী হলো? তার থেকে বড় প্রশ্ন থেকে যায়, আসলেও কি অস্তিত্ব ছিল অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় ধরে প্রচলিত রূপকথার জাহাজ অরাং মেডানের?
বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকের ঘটনা। একেবারে নির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও সময়টা আনুমানিক ১৯৪৭-৪৮ সালের দিকে। এমন সময়, যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলেও এর রেশ রয়ে গিয়েছিল দেশে দেশে। বেআইনি দ্রব্য পাচার থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র মুছে দেয়ার মতো কাজ সেসময় ছিল আজকের যুগের চেয়ে অনেক সহজ। তেমনই এক সময়ে মালাকা প্রণালীতে এ ঘটনার শুরু।
সিলভার স্টার নামের এক বাণিজ্যিক জাহাজ সেই পথ দিয়ে যাবার সময় জাহাজের রেডিও অপারেটর অদ্ভুত ধরনের একটি রেডিও বার্তা শুনতে পান। মোর্স কোডে পাঠানো সেই বার্তা অভিজ্ঞ অপারেটর অনুবাদ করলে এর অর্থ দাঁড়ায়, জাহাজের সকল অফিসার, সেই সাথে ক্যাপ্টেন মারা গেছে, চার্টরুম আর জাহাজের ব্রিজে তাদের দেহ ছড়িয়ে পড়ে আছে। সম্ভবত ক্রুরাও কেউ বেঁচে নেই। আর সেই বার্তা শেষ হয় দুটো শব্দ দিয়ে, “আই ডাই”। স্বভাবতই এ ধরনের সংবাদ রেডিওতে ধরা পড়লে দ্রুততার সাথে ক্যাপ্টেনের কানে পৌঁছে দেয়ার নিয়ম। এ ক্ষেত্রেও নিয়মের ব্যতিক্রম হলো না।
রেডিওতে পাঠানো বার্তায় জানানো হয়েছিল রহস্যময় সেই জাহাজের শেষ অবস্থান আর নাম। কোনো দেরি ছাড়াই ‘এস ও এস’ পাঠানো জাহাজের উদ্দেশে উদ্ধারকারী দল পাঠিয়ে দেন সিলভার স্টারের ক্যাপ্টেন। সর্বশেষ অবস্থানে পৌঁছে খুঁজে না পেলেও সেখান থেকে পঞ্চাশ মাইলের ভেতরেই জাহাজকে দেখতে পায় দলটি। ডাচ ফ্রাইটার ধরনের জাহাজ দেখেই তাদের মনে হয়, কোনো নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই ভাসছে সেটি। মাঝসাগরে ভাসতে থাকা সেই জাহাজের আরো কাছে যেতে নাম স্পষ্ট হয় উদ্ধারকারীদের কাছে, ‘এস এস অরাং মেডান’।
কোনো বাধা ছাড়াই অরাং মেডানের মেইন ডেকে উঠে আসে সিলভার স্টার থেকে আসা দলটি। উঠেই তারা আবিষ্কার করে, রেডিওতে আসা বার্তাটি কতখানি সত্যি। প্রধান ডেকের উপর পড়ে আছে বেশ কয়েকজন নাবিকের মৃতদেহ। আঘাতের চিহ্ন নেই শরীরে। ছিল না কোনো রক্তপাত বা যুদ্ধের চিহ্ন। তবে মৃত্যুগুলো যে খুব স্বাভাবিকভাবে হয়েছে, তেমনটাও নয়। প্রত্যেকের উপরের আর নিজের চোয়ালের দাঁত আটকে গেছে দৃঢ়ভাবে। মুখগুলোতে পাশবিক একটা আতঙ্কের ছাপ স্পষ্টভাবে দেখতে পেল উদ্ধারকারী দলের লোকেরা। শুধু তা-ই নয়, প্রত্যেকের মুখ সোজা উপরে গনগনে সূর্যের দিকে তাক করা।
ভয়ানক সেই দৃশ্য দেখার কারণে হোক, অথবা অন্য কারণে- উদ্ধারকারী দলের ভাষ্য অনুযায়ী প্রচণ্ড গরমের মাঝেও তাদের শীত করতে আরম্ভ করেছিল। সেখান থেকে এগিয়ে জাহাজের অন্য অংশগুলোতে খোঁজ করার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। অরাং মেডানের ব্রিজে ক্যাপ্টেনকে পড়ে থাকতে দেখে দলটি। হুইল হাউজ, চার্ট রুম আর ওয়ার্ডরুমে খোঁজ মেলে বাকি সব অফিসার আর ক্রুদের। প্রত্যেকের মৃত্যু হয়েছে একইভাবে। সবাই যেন দম দেয়া ঘড়ির মতো একসাথে থমকে গেছে গেছে নিজেদের কাজের মাঝপথেই।
রেডিওরুমে খোঁজ মিললো হতভাগ্য সেই রেডিও অপারেটরের। চেয়ারে বসা অবস্থায় বার্তা পাঠাবার যন্ত্রে হাত রেখেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল সে। তার পাঠানো শেষ বার্তার ব্যাখ্যা এভাবে পাবে, উদ্ধারকারী দল সেটা আশা করেনি। মৃত্যুর মিছিল কেবল মানুষের মাঝেই শেষ হয়নি। জাহাজে থাকা ছোট টেরিয়ার ধরনের কুকুরটিও তারা দেখতে পায়, একইরকম রহস্যময় কারণে মরে পড়ে আছে।
উদ্ধারকারী দলটি নিজেদের জাহাজে ফিরে এসে পুরো ব্যাপারটা ক্যাপ্টেনকে জানায়। যত অবাস্তব আর ভয়ানকই মনে হোক, সেই ব্যাখ্যা শুনে সিলভার স্টারের ক্যাপ্টেন সিদ্ধান্ত নেন, অভিশপ্ত জাহাজকে নিজেদের জাহাজের সাথে বেঁধে নিকটবর্তী বন্দরে নিয়ে যাওয়ার। নির্দেশ অনুযায়ী সিলভার স্টারের সাথে অরাং মেডানকে রশি দিয়ে সংযুক্ত করার পরে ঘটে আরো ভয়াবহ ঘটনা।
জাহাজে কোনো সমস্যা না থাকা সত্ত্বেও অরাং মেডানের চার নম্বর কার্গো হোল্ড থেকে আচমকা ধোঁয়া বের হতে শুরু করে। কিছুক্ষণের মাঝেই সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো জাহাজের গায়ে। কোনোক্রমে সিলভার স্টার নিজেদের জাহাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে অরাং মেডানকে। আর তার পরপরই ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে রহস্যময় জাহাজটিতে। সিলভার স্টারের কর্মীদের ভাষ্যমতে, সেই বিস্ফোরণ এতটাই ভয়াবহ ছিল যে বিশাল আকারের অরাং মেডান পানি থেকে শূন্যে লাফিয়ে উঠে অবশেষে সমুদ্রে ডুবে যায়।
এখানেই শেষ নয় অরাং মেডানের রহস্যের। এ জাহাজের সময়কার রেজিস্ট্রেশন বই এবং সে সময়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনার কোনো নথিতেই ‘অরাং মেডান’-এর উল্লেখ পাওয়া যায় না। যে জাহাজ কোনোকালে ছিলই না, সে জাহাজ কীভাবে বিস্ফোরিত হলো, যা প্রত্যক্ষদর্শীরা দেখতেও পেল- এ প্রশ্নের ব্যাখ্যা দেয়া সত্যি কঠিন।
চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় চারিদিকে শোরগোল পড়ে যাবার কথা নিশ্চিত। কিন্তু সবাই একসাথে বলা শুরু করলে যেমন কারো কথাই শোনা যায় না, তেমনটাই ঘটে অরাং মেডানের ক্ষেত্রে। একেক সংবাদপত্র একেক সময়ে নিজেদের মতো ছাপাতে শুরু করে মুখরোচক ভৌতিক এই জাহাজের গল্প। এতে শুধু মূল কাহিনীই নয়, বরং সাল-তারিখ আর স্থানের বিষয়েও সৃষ্টি হয় বিভ্রান্তির।
আরো বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দেয় এত বড় ঘটনার কোনো নির্ভরযোগ্য দলিল না থাকা। এ জাহাজের ব্যাপারে সব নথিপত্র যেন বেমালুম হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। আরো অবাক করা বিষয়, এস এস অরাং মেডান দুর্ঘটনার হদিস কোস্ট গার্ডের নথিতে পাওয়া যায় ১৯৫৪ সালে, অর্থাৎ দুর্ঘটনার আনুমানিক সময়ের প্রায় ছয় বছর পর!
পুরো ঘটনার ব্যাপারে অন্যতম দলিল হিসেবে ধরা হয় সম্প্রতি সি.আই.এ-এর ডিক্লাসিফাইড হওয়া এক রিসিপ্টকে। যেখানে সে সময়ের একজন কর্মকর্তা পুরো ঘটনার ব্যাখ্যা লিখে রেখেছিলেন। তবে শেষপর্যন্ত এ ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল, সেই বিষয়ে বিস্তারিত হয়তো কখনোই জানা সম্ভব হবে না।
জাহাজের অস্তিত্ব আর নাবিকদের মৃত্যুর কারণ নিয়ে গবেষণার শেষ নেই। সাগরের অমীমাংসিত রহস্যের মাঝে অন্যতম হিসেবে দেখা হয় এই অরাং মেডানের রহস্যকে। রেজিস্ট্রেশন বইয়ে নাম না থাকার ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হয়, সম্ভবত এই জাহাজটি রেজিস্ট্রেশন হয়েছিল সুমাত্রায়। সে কারণে চেক করা রেজিস্ট্রেশন বইয়ের তালিকায় এ নামের উল্লেখ নেই। এ ব্যাখ্যার পেছনের যুক্তি হলো, ‘অরাং’ শব্দের আঞ্চলিক অর্থ ‘ম্যান’; আর পুরো নামের অর্থ ‘ম্যান ফ্রম মেডান’। মেডান হচ্ছে সুমাত্রার একটি উল্লেখযোগ্য দ্বীপের নাম। তাই জাহাজ সুমাত্রায় নিবন্ধিত হবার সম্ভবনা বেশি।
নাবিকদের মৃত্যু আর রহস্যময় বিস্ফোরণের যুক্তির কোনো শেষ নেই। জলদস্যুর আক্রমণ থেকে শুরু করে মহাজাগতিক প্রাণীর হামলা, আন্তর্জাতিক চক্রান্ত থেকে শুরু করে বিষাক্ত গ্যাস অস্ত্রের ব্যবহারসহ অনেক যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা হয়েছে। তবে কাল্পনিক সব যুক্তির ভিড়ে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য এবং সত্যের কাছাকাছি যে ব্যাখ্যাটি রয়েছে, সেটি প্রদান করেন থিওডর সিয়ার্সডোরফার নামের এক জার্মান গবেষক, যিনি এই জাহাজের উপর প্রায় অর্ধশত বছর গবেষণা করেছেন। তিনি পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে লেখা ছোট একটি বইয়ের ব্যাপারে উল্লেখ করেন যার নাম Das Totenschiffin der Südsee; অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘দ্য ডেথ শিপ অব দ্য সাউথ সি’। সিয়ার্সডোরফারের ভাষ্য অনুযায়ী, এ বই থেকে অরাং মেডানের জাহাজের অস্তিত্বের সত্যতা পাওয়া যায়।
এ বইতে অরাং মেডানের বিস্ফোরণের কারণ হিসেবে বলা আছে পটাশিয়াম সায়ানাইড আর নাইট্রো গ্লিসারিনের মজুদকে। কার্গোহোল্ডে বিষাক্ত রাসায়নিক পরিবহন করলে সেখান থেকে সৃষ্ট মিশ্র বাষ্পের কারণে জাহাজের সবার মৃত্যু ঘটা কিংবা জাহাজ বিস্ফোরিত হওয়া, দুই বিষয়েরই সত্যনির্ভর ব্যাখ্যা দেয়া যেতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে এ ধরনের অতি সংবেদনশীল রাসায়নিক জাহাজে পরিবহন ঠিক কী উদ্দেশ্যে বা কারা করেছিল, সেই বিষয়ে আজ আর জানা সম্ভব না হলেও হয়তো সত্যি ঘটেছিল এই কল্পনাতীত ঘটনা। কোনো একদিন জাহাজের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার হলে হয়তো জানা যাবে মূল সত্য। তার আগপর্যন্ত অমীমাংসিত রহস্যের তালিকাতেই রয়ে যাবে অরাং মেডানের অন্ধকার এই রূপকথা।