দেশে দেশে হোয়াইট টেরর: গৃহযুদ্ধ-পরবর্তী স্পেনে সুপরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় নৈরাজ্য

যারা স্পেনের ক্লাব ফুটবল সম্পর্কে কিছুটা ধারণা রাখেন, তারা নিশ্চয়ই জেনারেল ফ্রাঙ্কোর নাম শুনে থাকবেন। যদি স্পেনের কাতালোনিয়া প্রদেশের বিখ্যাত ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনা কিংবা বাস্ক অঞ্চলের ক্লাব অ্যাথলেটিক বিলবাওয়ের সমর্থক হয়ে থাকেন, তাহলে নিশ্চিতভাবেই আপনি এই ব্যক্তির নাম কখনও শুনেছেন কিংবা কোথাও পড়েছেন। বার্সেলোনা ফুটবল ক্লাবের ইতিহাসে সবচেয়ে অন্ধকার সময়ের সাথে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর নাম খুব গভীরভাবে জড়িত। খোদ বার্সেলোনা ক্লাবের নাম পরিবর্তন, কাতালান স্বাধীনতাকামীরা যারা ক্লাবটির পাঁড় সমর্থক ছিলেন, তাদের অন্যায়ভাবে গ্রেফতার কিংবা ক্লাবের প্রথমদিকের একজন প্রেসিডেন্টকে শুধুমাত্র ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের জন্য রীতিমতো হত্যা করা– এসব কারণে জেনারেল ফ্রাঙ্কোকে আজও বার্সেলোনার সমর্থকরা অভিসম্পাত করে থাকেন। স্পেনে গৃহযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ভিন্ন মতাদর্শের মানুষের উপর চরম নিপীড়ন ও নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালানো হয় ফ্রাঙ্কো সরকারের পক্ষ থেকে। স্পেনের ইতিহাসে এই সময়কেই ‘হোয়াইট টেররের যুগ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

জেনারেল ফ্রাঙ্কোর হোয়াইট টেরর চালানোর প্রেক্ষাপট বুঝতে হলে গৃহযুদ্ধের সমীকরণগুলো মাথায় রাখা জরুরি। স্পেনে ১৮৭৩ সালে প্রথমবারের মতো রাজতন্ত্রকে উৎখাত করার মাধ্যমে স্প্যানিশ রিপাবলিক প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে স্প্যানিশ আইনসভার রিপাবলিকান সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সূচনা হয় এবং এই দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তারা সামরিক অভ্যুত্থানে যোগ দিলে আবার স্পেনে রাজতন্ত্র ফিরে আসে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৩১ সালে স্পেনের রাজা ব্যাপক দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নতুন সংবিধান প্রণয়নে বাধ্য হন। এই সংবিধানে রাজার ক্ষমতা একেবারে কমিয়ে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার গোড়াপত্তন করা হয়। ১৯৩৩ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের জনসমর্থন নিয়ে সমাজতান্ত্রিক উদারনৈতিক দল স্পেনের শাসনক্ষমতা দখল করে। তিন বছর পর ১৯৩৬ সালে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অব্যাহত দাবিতে আবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং এবারও বামপন্থী জোট পপুলার ফ্রন্ট জয়লাভ করে। বামপন্থীরা নির্বাচনের মাধ্যমে স্পেনের ক্ষমতা দখলের পর স্পেনে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করে এবং সমাজের শ্রমিক শ্রেণীর মানুষের উন্নয়নের লক্ষ্যকে সামনে রেখে বেশ কিছু উদারনৈতিক সংস্কার নিয়ে আসে, যেগুলো বেশ জনপ্রিয়তা পায় স্পেনজুড়ে।

হডকতলগক
বার্সেলোনা সমর্থকদের কাছে জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো এক ঘৃণিত নাম; image source: fcbarcelonanotocias.com

১৯৩৬ সালে নির্বাচনে জনসমর্থনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে ব্যর্থ হওয়ার পর স্পেনের সামরিক বাহিনীর বেশ কিছু অবসরপ্রাপ্ত ও চাকরিরত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সিদ্ধান্ত নেন, সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নবনির্বাচিত পপুলার ফ্রন্ট সরকারকে উৎখাত করা হবে। তাদের আশঙ্কা ছিল- হয়তো সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো স্পেনেও অক্টোবর বিপ্লবের মতো কোনো ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু তাদের এই পরিকল্পনা কোনোভাবে তৎকালীন রিপাবলিক সরকারের কানে পৌঁছায়। রিপাবলিক সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, যেসব উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা প্রজাতন্ত্রকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে, তাদের শাস্তি হিসেবে দূরের উপনিবেশগুলোর দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হবে। এতে হয়তো তারা স্পেনের মূল ভূখণ্ডের রিপাবলিক সরকারের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্রের নীলনকশা আঁকতে পারবে না।

তারা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন শুরু করে। যেমন- স্পেনে হোয়াইট টেরর পরিচালনার সাথে যার নাম আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে, সেই জেনারেল ফ্রাঙ্কোকে আফ্রিকার ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জের সেনানায়ক বানিয়ে স্পেন থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু তাদের এই সিদ্ধান্তে সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের টলানো যায়নি। শেষপর্যন্ত তারা সামরিক অভ্যুত্থান করেই বসে।

আফ্রিকায় স্পেনের উপনিবেশগুলোতে জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো ছিলেন বেশ শ্রদ্ধেয় একজন ব্যক্তি। সামরিক আমলারা যখন অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা তাকে জানায়, তখন তিনি প্রথমদিকে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগলেও পরে রাজি হন এবং মূল নেতৃত্বের ভার গ্রহণ করেন। গৃহযুদ্ধ শুরু হলে মরক্কোর বিশাল সেনাবাহিনীর মাধ্যমে তিনি স্পেনের রিপাবলিক সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক আক্রমণ পরিচালনা করেন। জেনারেল ফ্রাঙ্কো ও অন্য সামরিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা যেহেতু স্পেনের গণতন্ত্রকে উৎখাত করে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন, তাই হিটলারের জার্মানি ও বেনিতো মুসোলিনির মতো ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রপ্রধানরা তার প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন। অপরদিকে স্পেনের রিপাবলিক সরকারের প্রতি সোভিয়েত ইউনিয়ন, আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মতো দেশগুলো সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। অর্থাৎ রিপাবলিক সরকার বনাম জেনারেল ফ্রান্সিসকে ফ্রাঙ্কো ও অন্যান্য সামরিক কর্মকর্তার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদী সেনাবাহিনীর যে গৃহযুদ্ধ চলছিল, সেটিতে বাইরের দেশগুলোও হস্তক্ষেপের চেষ্টা করে।

জবপগপহহেহ
১৯৩১ সালে দ্বিতীয় রিপাবলিক প্রতিষ্ঠিত হয় স্পেনে; image source: telesureenglish.net

জেনারেল ফ্রাঙ্কোর জন্য এই গণঅভ্যুত্থানে সফল হওয়াটা কিন্তু সহজ ছিল না। গৃহযুদ্ধ শুরুর পর স্পেনে টানা দুবার নির্বাচনে সমাজতন্ত্রীদের বিজয় প্রমাণ করে, দেশটিতে সাধারণ মানুষের মাঝে বামপন্থীদের বেশ জনপ্রিয়তা ছিল। এছাড়াও জাতীয়তাবাদী এই গণঅভ্যুত্থানে বাস্ক, কাতালোনিয়া প্রভৃতি অঞ্চলের মানুষরা মোটেও খুশি ছিলে না। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, জাতীয়তাবাদীরা ক্ষমতায় আসলে স্বাধীনতাকামী আন্দোলনকে চিরতরে থামিয়ে দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে। তাই বাস্ক কিংবা কাতালান অঞ্চলের স্বাধীনতাকামী মানুষেরা কখনোই চায়নি জাতীয়তাবাদীরা ক্ষমতায় আসুক। জার্মানি বা ইতালিতে দেখা গিয়েছে উগ্র জাতীয়তাবাদীরা খুব পরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ পরিচালনার মাধ্যমে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের জন্য গঠিত হওয়া ট্রেড ইউনিয়নগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে, শ্রমিকনেতাদের গুম কিংবা জেলখানায় ভরে রাখা হয়েছে। তাই স্পেনের বিশাল শ্রমিকসমাজ শুরু থেকেই জাতীয়তাবাদীদের ক্ষমতা দখল থেকে বিরত রাখতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা করে। টানা তিন বছর গৃহযুদ্ধ চলার পর অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী সেনাবাহিনী শেষ পর্যন্ত স্পেনের ক্ষমতা দখল করেএবং জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো স্পেনের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।

জেনারেল ফ্রাঙ্কো ভেবেছিলেন, তিনি ক্ষমতা দখল করে থাকলেও হয়তো পরবর্তীতে বামপন্থীরা আবার সংগঠিত হয়ে তার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটাতে পারে। এই ভয় থেকেই স্প্যানিশ সমাজে বিশুদ্ধিকরণ অভিযান পরিচালনার বিশদ পরিকল্পনা গ্রহণ করেন তিনি। স্পেনের গৃহযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে যে হোয়াইট টেররের যুগ চলে, তা ছিল স্প্যানিশ সমাজ বিশুদ্ধিকরণ অভিযানের অংশ। স্পেনের বাইরে ইউরোপ ও আমেরিকায় জেনারেল ফ্রাঙ্কো ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হলেও তিনি কখনোই পরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ ও বিচারবহির্ভূত গুম এবং হত্যার পথ থেকে সরে আসেননি। স্পেনের কোনো অঞ্চল নেই যেখানে ফ্রাঙ্কোর হোয়াইট টেরর অভিযান পরিচালিত হয়নি। ১৯৩৯ সালের পর থেকে মৃত্যুর আগপর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে স্পেনে জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ ছাড়া অন্য যেকোনো মতাদর্শ ধারণ করা মানুষের মাঝে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন এই একনায়ক। মৃত্যুর এত বছর পরও তাকে সমানভাবে ঘৃণা করা হয়।

ওতকতকগলহ
জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো, স্প্যানিশ হোয়াইট টেরোরের মূল হোতা; image source: theconversation.com

জেনারেল ফ্রাঙ্কোর প্রধান লক্ষ্য ছিল বামপন্থী মতাদর্শের মানুষেরা। তিনি ছিলেন স্প্যানিশ রাজতন্ত্রের একনিষ্ঠ সমর্থক, এবং এই রাজতন্ত্রকে উৎখাত করার জন্য সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিল বামপন্থীরা। স্বাভাবিকভাবেই ফ্রাঙ্কোর সমস্ত ক্ষোভ গিয়ে পড়ে বামপন্থী দলগুলোর নেতাকর্মীদের উপর। রিপাবলিক সরকারকে উৎখাত করে যখন তিনি ১৯৩৯ সালে স্পেনের শাসনভার গ্রহণ করেন, তারপর সদ্য উৎখাতকৃত রিপাবলিক সরকারের অনুগত ব্যক্তিদের জীবন রাতারাতি নরক হয়ে ওঠে। আইনের মাধ্যমে রিপাবলিক সরকারের অনুগত শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের সংগঠন ট্রেড ইউনিয়ন নিষিদ্ধ করা হয়। এরপরও যখন দেখা যাচ্ছিল শ্রমিক ও কৃষকরা গোপনে সংগঠন পরিচালনা করছে, তখন নিয়মিত পুলিশি অভিযান চালানো শুরু হয়। শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য যাদের গ্রেফতার করা হতো, তাদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গুম করে ফেলা হতো। যারা গুমের হাত থেকে বেঁচে যেত, তাদের অতি তুচ্ছ কারণে বছরের পর বছর জেলখানায় আটক করে রাখা হতো। এভাবে প্রাণের মায়া ও দীর্ঘদিন কারাবাসের হাত থেকে বাঁচতে শ্রমিক ও কৃষকরা সংগঠন থেকে নিজেদের সরিয়ে নিতে শুরু করে।

হগগসসসস
গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর কমিউনিস্টদের উৎখাত করার জন্য দীর্ঘ পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়; image source: nytimes.com

বাস্ক কিংবা কাতালান প্রদেশের মতো কিছু অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরে দীর্ঘদিন ধরে স্বাধীনতাকামী আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল। ইতিহাসে দেখা যায়, স্প্যানিশ রাজতন্ত্র জোর খাটিয়ে এসব অঞ্চলের স্বাধীনতা হরণ করে অতীতে। জেনারেল ফ্রাঙ্কো কাতালোনিয়া এবং বাস্ক অঞ্চলে সবধরনের আন্দোলন নিষিদ্ধ করেন। এসব অঞ্চলে যাতে কোনো ধরনের আন্দোলন দানা বেঁধে উঠতে না পারে তাই বেশ কিছু সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। জেনারেল ফ্রাঙ্কোর অনুগত সেনাবাহিনীর সদস্যরা নিয়মিত এই প্রদেশগুলোর রাস্তায় সশস্ত্র টহল দিত। স্পেনের বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর শক্ত ঘাঁটি ছিল এই প্রদেশগুলোতে। বামপন্থীদের ধরার জন্য অন্যান্য প্রদেশের মতো এসব জায়গাতেও ব্যাপক আকারে সামরিক অভিযান পরিচালনা করা হতো। প্রশিক্ষিত খুনী দলের মাধ্যমে গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে অনেক বামপন্থী রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীকে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়।

জেনারেল ফ্রাঙ্কোর হোয়াইট টেররের বিশেষ শিকার ছিলেন রিপাবলিক দল সমর্থনকারী নারীরা। এক ঘটনার মাধ্যমে বোঝা যাবে, হোয়াইট টেরর চলাকালে স্পেনের রাষ্ট্রযন্ত্র ঠিক কতটা নির্মম ছিল নারীদের প্রতি। রিপাবলিক দলের প্রতি যেসব নারী নিজেদের সমর্থন ব্যক্ত করেন, তাদের অনেককে পরবর্তীতে হোয়াইট টেররের অংশ হিসেবে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃত নারীদের মধ্যে অনেকে গর্ভবতীও ছিলেন। তখন স্পেনে জেনারেল ফ্রাঙ্কো সরকারের সামনে একটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে, যেসব গর্ভবতী নারীদের মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেয়া হয়েছে, তাদের শাস্তি কার্যকরের জন্য সন্তান জন্মদান পর্যন্ত অপেক্ষা করা হবে কিনা। তিন মাসের গর্ভবতী একজন নারীকে ফাঁসি দেয়ার ক্ষেত্রে স্প্যানিশ ফৌজদারি আদালতের একজন বিচারক খুব দম্ভভরে বলেছিলেন, “শাস্তি কার্যকরের জন্য সাত মাস অপেক্ষা করা রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব নয়।” এরপর থেকে অনাগত সন্তানসহ গর্ভবতী নারীদের শাস্তি কার্যকরের বিধান আনা হয়। এছাড়া রিপাবলিকান সরকারের সমর্থক যেসব মহিলা সরকারি কোনো চাকরিতে নিয়োজিত ছিলেন, তাদের কোনো কারণ ছাড়া বরখাস্ত করা হয়। অসংখ্য স্প্যানিশ নারী চাকরি হারিয়ে অর্থাভাবে শেষপর্যন্ত পতিতাবৃত্তি বেছে নিতে বাধ্য হন।

হগগসস
গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে সামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়; image source: scotsman.com

ধারণা করা হয়, জেনারেল ফ্রাঙ্কোর শাসনামলে প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞের শিকার হন। শুধু তা-ই নয়, বিশাল সংখ্যক বন্দীকে কাজে লাগানোর জন্য অনেকগুলো কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প তৈরি করা হয়। এক পরিসংখ্যানের মাধ্যমে বোঝা যাবে কী পরিমাণ ব্যক্তি হোয়াইট টেররের মাধ্যমে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। গৃহযুদ্ধ শুরুর আগে, ১৯৩৩ সালে পুরো স্পেনে যত জেলখানা ছিল, সেগুলোতে বন্দীর পরিমাণ ছিল বারো হাজারের কাছাকাছি। এর সাত বছর পর, ১৯৪০ সালে স্পেনে কারাবন্দীর সংখ্যা দাঁড়ায় দুই লাখ আশি হাজারে! এই বন্দীদের লেবারক্যাম্পে শ্রমিক হিসেবে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেই ক্যাম্পগুলোতে যেসব বন্দী থাকতেন, তাদের পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার দেয়া হতো না, রোগাক্রান্ত হলে ঠিকমতো ওষুধ দেয়া হতো না, এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত নাজুক। ফলে কর্তৃপক্ষের ইচ্ছাকৃত অবহেলায় হাজার হাজার বন্দী মৃত্যুবরণ করে।

আধুনিক স্পেনের ইতিহাসে জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো সম্ভবত শান্তিকামী মানুষের কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত নাম। প্রায় সাড়ে তিন দশক ধরে স্পেনের গণতন্ত্রকে কবর দিয়ে তিনি ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা তিনি বিদ্যমান রেখেছিলেন। তার অপশাসনের বলি হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। পৃথিবীর ইতিহাসে যতগুলো রাষ্ট্র হোয়াইট টেরর চালিয়েছে, সেসবের মধ্যে সর্বোচ্চ নির্মমতা খুঁজতে গেলে স্পেনের ফ্রাঙ্কো সরকারের শাসনই সবার উপরে থাকবে।

Related Articles

Exit mobile version