সোভিয়েতরা কেন নাগর্নো–কারাবাখকে আজারবাইজানের অন্তর্ভুক্ত করেছিল

নাগর্নো–কারাবাখ দক্ষিণ ককেশাসে অবস্থিত একটি স্থলবেষ্টিত অঞ্চল, যেটি নিয়ে আর্মেনীয় ও আজারবাইজানিদের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অঞ্চলটি আজারবাইজান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু কার্যত আর্মেনিয়া কর্তৃক সমর্থিত জাতিগত আর্মেনীয়–অধ্যুষিত ‘আর্তসাখ প্রজাতন্ত্র’ অঞ্চলটিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে অঞ্চলটির কর্তৃত্ব নিয়ে আজারবাইজানি ও আর্মেনীয়দের মধ্যে বিরোধ শুরু হয়, এবং ১৯২১ সালে সোভিয়েত রাশিয়া অঞ্চলটির কর্তৃত্ব আজারবাইজানকে প্রদান করে, যদিও অঞ্চলটির সিংহভাগ অধিবাসী ছিল জাতিগত আর্মেনীয়। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, সোভিয়েতরা কেন নাগর্নো–কারাবাখকে আজারবাইজানের অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল?

এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট করে নেয়া দরকার। ‘নাগর্নো–কারাবাখ’ অঞ্চলটি বৃহত্তর কারাবাখ অঞ্চলের অন্তর্গত। ‘কারাবাখ’ শব্দটির অর্থ ‘কালো বাগিচা’। অঞ্চলটি প্রধানত ‘উচ্চ কারাবাখ’ (Upper/Highland Karabakh) ও ‘নিম্ন কারাবাখ’ (Lower/Lowland Karabakh) এই দুইটি ভাগে বিভক্ত। উচ্চ কারাবাখ অঞ্চলটি পার্বত্য এবং আর্মেনীয়–অধ্যুষিত, আর নিম্ন কারাবাখ অঞ্চলটি সমতল এবং আজারবাইজানি–অধ্যুষিত। উচ্চ কারাবাখ অঞ্চলটি ‘নাগর্নো–কারাবাখ’ নামে পরিচিত, এবং ‘নাগর্নো’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘পার্বত্য’। এই উচ্চ কারাবাখ বা নাগর্নো–কারাবাখ অঞ্চলটি নিয়েই বর্তমানে আজারবাইজানি ও আর্মেনীয়দের মধ্যে বিরোধ, কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পুরো অঞ্চলটি নিয়েই উভয় পক্ষের মধ্যে বিরোধ ছিল।

Source: World Map

কারাবাখ অঞ্চলটি ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে ক্রমান্বয়ে ককেশীয় আলবেনীয়, আর্মেনীয়, সাসানীয় পারসিক সাম্রাজ্য, আরব খুলাফায়ে রাশিদিন ও উমাইয়া খিলাফত, আব্বাসীয় খিলাফত, মোঙ্গল ইলখানাত ও জালায়িরি রাজবংশ, তুর্কমেন কারা কোয়ুনলু ও আক কোয়ুনলু রাজবংশ এবং ইরানের সাফাভি সাম্রাজ্যের দ্বারা শাসিত হয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে একটি তুর্কি রাজবংশের শাসনাধীনে ‘কারাবাখ খানাত’ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এটি ইরানের একটি আশ্রিত রাষ্ট্র ছিল। ১৮০৫ সালে কারাবাখ খানাত রাশিয়ার একটি আশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত হয়, এবং ১৮০৪–১৮১৩ সালের রুশ–ইরানি যুদ্ধে ইরানিদের পরাজয়ের পর সরাসরি রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৮২৩ ও ১৮৩৬ সালের হিসাব অনুযায়ী, কারাবাখ খানাতের অধিবাসীদের মধ্যে প্রায় ৯১% ছিল জাতিগত আজারবাইজানি (যাদেরকে সেসময় ‘মুসলিম’, ‘ককেশীয় তুর্কি’ বা ‘ককেশীয় তাতার’ হিসেবে অভিহিত করা হত) এবং প্রায় ৯% ছিল জাতিগত আর্মেনীয়। কিন্তু উচ্চ কারাবাখের অধিবাসীদের মধ্যে ৯৬.৭% ছিল জাতিগত আর্মেনীয়।

মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি নাগর্নো–কারাবাখ অঞ্চলটি আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আজারবাইজানের অন্তর্ভুক্ত; Source: Humanitarian Aid Relief Trust

১৯১৭ সালে রুশ সাম্রাজ্যের পতন ঘটে, এবং আজারবাইজানি ও আর্মেনীয় জাতীয়তাবাদীরা পরস্পরের বিরুদ্ধে সংঘাতে লিপ্ত হয়। এই সংঘাতের অন্যতম একটি কারণ ছিল কারাবাখের কর্তৃত্ব নিয়ে বিরোধ, কারণ সদ্য স্বাধীন আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান উভয়েই কারাবাখের ওপর কর্তৃত্ব দাবি করছিল। আর্মেনীয়দের দাবি ছিল, অতি প্রাচীনকাল থেকে কারাবাখ আর্মেনিয়ার অংশ ছিল এবং কারাবাখের আর্মেনীয় অধিবাসীরা আর্মেনিয়ার সঙ্গে যোগ দিতে ইচ্ছুক। অন্যদিকে, আজারবাইজানিদের দাবি ছিল, ঐতিহাসিকভাবে কারাবাখ আজারবাইজানের অধীনস্থ ছিল। ফলশ্রুতিতে কারাবাখ ১৯১৮–১৯২০ সালের আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধের একটি সক্রিয় ক্ষেত্রে পরিণত হয়।

১৯২০ সালের এপ্রিলে আজারবাইজানি বলশেভিকরা লাল ফৌজের সহায়তায় আজারবাইজানি জাতীয়তাবাদী সরকারকে উৎখাত করে রাষ্ট্রটির শাসন ক্ষমতা দখল করে নেয়। ১৯২০ সালের মে মাসে লাল ফৌজ কারাবাখ দখল করে নেয়। ১৯২০ সালের নভেম্বর–ডিসেম্বরে আর্মেনীয় বলশেভিকরা লাল ফৌজের সহায়তায় আর্মেনীয় জাতীয়তাবাদী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং রাষ্ট্রটির ক্ষমতায় আসীন হয়। আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া উভয়েই বলশেভিক শাসনাধীনে আসায় তাদের মধ্যেকার বিরোধ নিষ্পত্তি করা মস্কোর জন্য অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়।

১৯২০ সালের নভেম্বরে আজারবাইজানি বিপ্লবী কমিটির সভাপতি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী নারিমান নারিমানভ ঘোষণা করেন যে, কারাবাখের ভবিষ্যৎ অঞ্চলটির অধিবাসীদের দ্বারা নির্ধারিত হবে। এর মধ্য দিয়ে আজারবাইজান পরোক্ষভাবে কারাবাখের ওপর আর্মেনিয়ার কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেয়, কারণ ‘কারাবাখ আর্মেনীয়’রা ছিল সাধারণভাবে আর্মেনিয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পক্ষপাতী। ধারণা করা হয়, মস্কোর চাপে নারিমানভ এই ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন, কারণ এ সময় আর্মেনীয় বিপ্লবী কমিটি সবেমাত্র ক্ষমতা লাভ করেছিল এবং আর্মেনিয়ায় তাদের অবস্থান ছিল দুর্বল। এজন্য আজারবাইজানি বলশেভিকরা কারাবাখে গণভোট অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়, যাতে করে আর্মেনীয় বলশেভিকরা আর্মেনীয় জনসাধারণের সমর্থন লাভ করতে পারে এবং দাশনাক বা আর্মেনীয় জাতীয়তাবাদীদের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থানকে শক্তিশালী করতে পারে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আজারবাইজানি বলশেভিকরা আর্মেনিয়ার কাছে কারাবাখ ছেড়ে দিতে ইচ্ছুক ছিল না।

প্রখ্যাত আজারবাইজানি বলশেভিক নেতা নারিমান নারিমানভ। কারাবাখকে আজারবাইজানের অন্তর্ভুক্ত করার পেছনে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল; Source: Wikimedia Commons

১৯২১ সালের ২২ জুন আর্মেনীয় বলশেভিক সরকার একটি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে কারাবাখকে আর্মেনিয়ার অংশ হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু আজারবাইজানি বলশেভিক সরকার তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে এবং এর ফলে নতুন একটি দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। এমতাবস্থায় রুশ বলশেভিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির ককেশীয় ব্যুরো এই সমস্যার নিষ্পত্তির জন্য ৭ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। রুশ বলশেভিক সরকারের জাতীয়তা বিষয়ক মন্ত্রী (‘জনকমিশার’) জোসেফ স্তালিন এই কমিটির বৈঠকে উপস্থিত হন, যদিও তিনি কমিটির সদস্য ছিলেন না। ১৯২১ সালের ৪ জুলাই কমিটি ৪–৩ ভোটে কারাবাখকে আর্মেনিয়ার অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু আজারবাইজানের প্রধানমন্ত্রী নারিমানভ এর তীব্র প্রতিবাদ জানান।

স্তালিন আজারবাইজানের পক্ষ অবলম্বন করেন এবং তার চাপে কমিটি পরবর্তী দিন তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। কারাবাখকে আজারবাইজানের অংশ হিসেবে রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, কিন্তু অঞ্চলটির আর্মেনীয়দের স্বায়ত্তশাসন প্রদান করতে হবে, এই শর্তও জুড়ে দেয়া হয়। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের পিছনে নানাবিধ কারণ ছিল।

প্রথমত, বলশেভিকরা কারাবাখকে আজারবাইজানের অন্তর্ভুক্ত রাখার জন্য তিনটি যুক্তি প্রদর্শন করে। এর মধ্যে একটি কারণ ছিল– আজারবাইজানি ও আর্মেনীয়দের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা। বস্তুত, বলশেভিকরা যখন ১৯২০ সালের এপ্রিলে আজারবাইজানের ক্ষমতা দখল করে, তখন কারাবাখ আজারবাইজানের নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিল। কিন্তু কারাবাখের আর্মেনীয়রা আজারবাইজানি সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল এবং আর্মেনিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে চাচ্ছিল। মস্কোর ধারণা ছিল, কারাবাখকে আজারবাইজানের অন্তর্ভুক্ত করার ফলে আজারবাইজানিরা সন্তুষ্ট হবে, অন্যদিকে কারাবাখের আর্মেনীয়দের স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হলে আর্মেনিয়া ও কারাবাখ আর্মেনীয়রাও সন্তুষ্ট হবে। আর আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া উভয়েই যেহেতু বলশেভিকদের নিয়ন্ত্রণে, সুতরাং রাষ্ট্র দুইটি মধ্যে ঘনিষ্ঠ সংযোগ থাকবে এবং কারাবাখ প্রশাসনিকভাবে আর্মেনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হবে না। এর ফলে আজারবাইজানি ও আর্মেনীয়দের মধ্যেকার দ্বন্দ্বের অবসান ঘটবে।

১৯১৮–১৯২০ সালের আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধের সময় বাকুতে আর্মেনীয় সৈন্যদল; Source: Wikimedia Commons

দ্বিতীয়ত, কারবাখকে আজারবাইজানের অন্তর্ভুক্ত রাখার পেছনে বলশেভিকদের প্রদর্শিত দ্বিতীয় কারণটি ছিল– কারাবাখের সঙ্গে আজারবাইজানের অর্থনৈতিক সংযোগ। কারাবাখ এবং আর্মেনিয়া ভৌগোলিকভাবে একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন এবং উভয়ের মধ্যে আজারবাইজানি ভূমি অবস্থিত। এজন্য কারাবাখের অর্থনীতি আজারবাইজানমুখী ছিল এবং অঞ্চলটির অর্থনৈতিক উন্নয়ন আজারবাইজানের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এছাড়া, আজারবাইজানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ফলে বাকুর তেলসম্পদ থেকে অর্জিত অর্থের একাংশ কারাবাখের উন্নয়নের জন্য ব্যয়িত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে, আর্মেনিয়ার সঙ্গে যোগদান করলে কারাবাখ এ ধরনের কোনো আর্থিক সহায়তা পেত না এবং কারাবাখের অর্থনীতিকে আর্মেনিয়ামুখী করার প্রয়োজন পড়ত। এজন্য, অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কারাবাখকে আজারবাইজানের সঙ্গে রাখার সিদ্ধান্ত ছিল যৌক্তিক।

তৃতীয়ত, কারাবাখকে আজারবাইজানে অন্তর্ভুক্তির জন্য বলশেভিকরা আরেকটি কারণ উল্লেখ করেছিল – কারাবাখের সঙ্গে আজারবাইজানের ঘনিষ্ঠ ঐতিহাসিক সম্পর্ক। এই যুক্তিটি অবশ্য কেবল আংশিকভাবে সঠিক, কারণ একদিকে যেমন কারাবাখ ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে তুর্কমেন কারা কোয়ুনলু ও আক কোয়ুনলু রাজবংশ এবং তুর্কি কারাবাখ খানাতের শাসনাধীন ছিল, অন্যদিকে তেমনি অঞ্চলটি ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন আর্মেনীয় রাজ্যের অধীনে ছিল এবং এমনকি কারাবাখ খানাতের অভ্যন্তরেও ৫টি আর্মেনীয়–শাসিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ছিল। সুতরাং, ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে আর্মেনীয় ও আজারবাইজানি উভয় জাতিই কারাবাখের ওপর কর্তৃত্ব দাবি করতে পারে।

অবশ্য, এই তিনটি উল্লেখিত কারণের বাইরেও কারাবাখকে আজারবাইজানে অন্তর্ভুক্ত করার পিছনে আরো কিছু কারণ ছিল বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

একটি আজারবাইজানি পোস্টারে সোভিয়েত নেতা স্তালিন। কারাবাখকে আজারবাইজানে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে স্তালিনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল; Source: Wikimedia Commons

প্রথমত, মস্কোর বলশেভিক সরকারের নিকট আর্মেনিয়ার চেয়ে আজারবাইজানের ভূকৌশলগত গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। আজারবাইজানের বিপুল জ্বালানি সম্পদ ছিল মস্কোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; রুশ প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির লেনিন তো সরাসরি উল্লেখই করেছিলেন যে, বাকুর তেল ছাড়া সোভিয়েত রাশিয়া টিকে থাকতে পারবে না! তদুপরি, আজারবাইজান ছিল একটি মুসলিম–অধ্যুষিত রাষ্ট্র এবং আজারবাইজানিরা বৃহত্তর তুর্কি জাতির অন্তর্ভুক্ত একটি জাতি। এ সময় বলশেভিকরা মুসলিম ও তুর্কি বিশ্বে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে চাইছিল এবং এক্ষেত্রে আজারবাইজান ছিল তাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘাঁটি।

আর্মেনিয়ার পক্ষে মস্কোকে এ ধরনের কোনো সুবিধা প্রদান করা সম্ভব ছিল না। আজারবাইজানের বলশেভিক নেতৃবৃন্দ এই বিষয়টি সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত ছিল এবং তারা কারাবাখকে আজারবাইজানের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য মস্কোকে চাপ দিচ্ছিল। এজন্য আজারবাইজানকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে মস্কো কারাবাখকে আজারবাইজানের অভ্যন্তরে রেখে দিয়েছিল।

দ্বিতীয়ত, দক্ষিণ ককেশাসের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আজারবাইজানে বলশেভিকদের জনপ্রিয়তা ছিল সবচেয়ে বেশি। বিশেষত বাকুর শিল্পশ্রমিকদের মধ্যে বলশেভিকরা ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় ছিল। অন্যদিকে, আর্মেনিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে বলশেভিকরা আর্মেনীয় জাতীয়তাবাদীদের ব্যাপক বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিল। স্বভাবতই, এর ফলে মস্কো আর্মেনিয়ার চেয়ে আজারবাইজানের প্রতি বেশি সহানুভূতিশীল ছিল, এবং কারাবাখকে আজারবাইজানের অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে এই বিষয়টি তাদের বিবেচনায় ছিল।

১৯২০ সালে বাকুতে আজারবাইজানি বলশেভিকদের একটি র‍্যালি; Source: Wikimedia Commons

তৃতীয়ত, ১৯২০ সালের নভেম্বর–ডিসেম্বরে যখন আর্মেনিয়ায় বলশেভিকরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, তখন আর্মেনিয়ায় বলশেভিকবিরোধী বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল এবং এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ও আর্মেনীয় জনসাধারণের সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে এসময় বলশেভিকরা কারাবাখকে আর্মেনিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু ১৯২১ সালের মাঝামাঝিতে আর্মেনিয়ায় বলশেভিকবিরোধী বিদ্রোহ স্তিমিত হয়ে এসেছিল এবং এজন্য আর্মেনীয়দের ছাড় প্রদান করা মস্কোর জন্য আর অত্যাবশ্যক ছিল না। এটিও কারাবাখকে আজারবাইজানে অন্তর্ভুক্তির পশ্চাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল।

চতুর্থত, আজারবাইজানি ও আর্মেনীয় বলশেভিকরা উভয়েই কারাবাখকে নিজেদের রাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য মস্কোতে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছিল, এবং মস্কোর বলশেভিক নেতাদের মধ্যে উভয় পক্ষেরই কিছু কিছু সমর্থক ছিল। কিন্তু আজারবাইজানি বলশেভিকরা এক্ষেত্রে আর্মেনীয় বলশেভিকদের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। আর্মেনীয় বলশেভিকরা আর্মেনিয়ার সীমানা বর্ধিত করার পরিবর্তে আর্মেনীয় বলশেভিকবিরোধীদের দমন করার ব্যাপারে বেশি মনোযোগী ছিল। অন্যদিকে, আজারবাইজানে বলশেভিকবিরোধীরা ছিল তুলনামূলকভাবে দুর্বল, ফলে আজারবাইজানি বলশেভিকরা অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমনের পরিবর্তে রাষ্ট্রসীমা বৃদ্ধির দিকে মনোযোগী হতে পেরেছিল।

এছাড়া, আজারবাইজানি বলশেভিক নেতা নারিমান নারিমানভ মস্কোর বলশেভিকদের মধ্যে অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন ছিলেন এবং বিশেষত লেনিন ও ত্রৎস্কি উভয়েই নারিমানভকে অত্যন্ত সমীহ করতেন। আর্মেনীয় বলশেভিকদের মধ্যে সেসময় অনুরূপ কোনো সমমানের নেতা ছিল না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই মস্কো কারাবাখ ইস্যুতে আজারবাইজানের প্রতি ঝুঁকে পড়েছিল।

আর্মেনীয় বলশেভিক দলের নেতা সার্গিস লুকাশিন কারাবাখকে আর্মেনিয়ার অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন; Source: Wikimedia Commons

পঞ্চমত, কিছু কিছু বিশ্লেষকের মতে, সোভিয়েত রুশ নেতৃবৃন্দ, বিশেষ করে জাতীয়তা বিষয়ক মন্ত্রী স্তালিন, সোভিয়েত ‘সাম্রাজ্যে’র অখণ্ডতা রক্ষার উদ্দেশ্য সংখ্যালঘু জাতিগুলোর প্রতি ‘বিভাজন ও শাসন’ (Divide and Rule) নীতি গ্রহণ করেছিলেন। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, আর্মেনীয়–অধ্যুষিত কারাবাখকে আজারবাইজানের অন্তর্ভুক্ত করার মধ্য দিয়ে সোভিয়েত রুশ নেতারা আর্মেনীয় ও আজারবাইজানিদের মধ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে চিরস্থায়ী দ্বন্দ্বের বীজ স্থাপন করেছিলেন। এর উদ্দেশ্য ছিল, আজারবাইজানি ও আর্মেনীয়রা যেন মস্কোর বিরুদ্ধে লড়াই না করে নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ে লিপ্ত থাকে এবং এর মধ্য দিয়ে উভয়ের ওপর মস্কোর কর্তৃত্ব স্থায়ী থাকে।

এই প্রস্তাবনাটি ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্বে’ বিশ্বাসীদের জন্য চিত্তাকর্ষক, এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু একটি বিষয় মনে রাখা দরকার, এই তত্ত্বটির প্রসার ঘটিয়েছে আর্মেনীয় ও আজারবাইজানি জাতীয়তাবাদীরা এবং অন্যান্য সোভিয়েতবিরোধীরা, এবং তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নকে হেয় প্রতিপন্ন করা। এখানে উল্লেখ্য যে, সোভিয়েত সরকার আর্মেনীয় ও আজারবাইজানিদের মধ্যেকার জাতিগত বিদ্বেষকে প্রশমিত করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছিল, কিন্তু সোভিয়েত ‘এক্সপেরিমেন্টে’র ব্যর্থতা শেষ পর্যন্ত এই প্রচেষ্টাকে সফল হতে দেয়নি।

সর্বোপরি, কিছু কিছু বিশ্লেষকের মতে, কারাবাখকে আজারবাইজানের অন্তর্ভুক্ত করার পেছনে মস্কোর মূল উদ্দেশ্য ছিল তুরস্ককে সন্তুষ্ট করা। এ সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত ওসমানীয় সাম্রাজ্যের স্থলে ‘গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি’র নেতৃত্বাধীন একটি জাতীয়তাবাদী সরকার তুরস্কের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল এবং তারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে একটি ‘স্বাধীনতা যুদ্ধে’ লিপ্ত ছিল। অনুরূপভাবে, বলশেভিকরাও এ সময় কার্যত মিত্রশক্তির সঙ্গে যুদ্ধাবস্থায় ছিল। ফলে বলশেভিকরা তুর্কি জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপনে আগ্রহী হয়ে উঠেছিল। মস্কোর ধারণা ছিল, কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বাধীন তুরস্ক সোভিয়েত ধাঁচের একটি সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে। তাছাড়া, বরাবরই মস্কোর নিকট তুরস্কের ভূকৌশলগত গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।

মস্কোতে ‘ভ্রাতৃত্ব চুক্তি’ স্বাক্ষরকালে রুশ বলশেভিক ও তুর্কি জাতীয়তাবাদী প্রতিনিধিবৃন্দ; Source: Wikimedia Commons

এজন্য ১৯২১ সালের ১৬ মার্চ মস্কোতে বলশেভিক ও তুর্কি জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে একটি ‘ভ্রাতৃত্ব চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী তুর্কিদের সন্তুষ্ট করার জন্য বলশেভিকরা কারাবাখকে আজারবাইজানের অন্তর্ভুক্ত করেছিল বলে অনেকে মনে করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তুর্কি ও আজারবাইজানিরা জাতিগতভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ এবং ১৯১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘আজারবাইজান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’ তুর্কিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ ছিল। অন্যদিকে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকেই আর্মেনীয়দের সঙ্গে তুর্কিদের জাতিগত সংঘাত চলে আসছিল এবং ১৯২০ সালেও তুর্কি জাতীয়তাবাদী সরকার আর্মেনিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। তুর্কিদের লক্ষ্য ছিল, আর্মেনিয়াকে যতদূর সম্ভব দুর্বল করে রাখা এবং স্বজাতীয় আজারবাইজানকে শক্তিশালী করে তোলা। এজন্য তুর্কিরা কারাবাখকে আজারবাইজানের অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষপাতী ছিল, এবং তুর্কিদের সন্তুষ্ট করার জন্য মস্কো এই পদক্ষেপ নিয়েছিল।

বর্ণিত কারণগুলোর জন্য মস্কো কারাবাখকে আজারবাইজানের অন্তর্ভুক্ত করেছিল। কারাবাখকে আজারবাইজানের অন্তর্ভুক্ত করার পর নিম্ন কারাবাখকে আজারবাইজানের মূল ভূখণ্ডের সাথে পুরোপুরিভাবে অঙ্গীভূত করে ফেলা হয়, এবং উচ্চ কারাবাখকে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদানের উদ্দেশ্যে সেখানে ‘নাগর্নো–কারাবাখ স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রদেশটি ছিল স্বায়ত্তশাসিত, কিন্তু প্রশাসনিকভাবে আজারবাইজানের অন্তর্গত। এই ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্য দিয়ে মস্কো ধারণা করেছিল যে, তারা আজারবাইজানের ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও আর্মেনীয়দের জাতিগত আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার উভয়ই রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে, এবং কারাবাখ নিয়ে আর্মেনীয়–আজারবাইজানি দ্বন্দ্বের অবসান ঘটেছে।

কিন্তু উগ্র জাতীয়তাবাদ যে কতটা প্রভাবশালী হতে পারে এটা বোঝার ক্ষেত্রে মস্কো ভুল করেছিল। যতদিন আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত ছিল, ততদিন কারাবাখ ইস্যুটি তেমন গুরুত্ব পায়নি, কারণ কার্যত উভয়েই ছিল একই রাষ্ট্রের অংশ। কিন্তু আর্মেনীয় ও আজারবাইজানিদের মধ্যেকার জাতিগত বিদ্বেষ আপাতদৃষ্টিতে প্রশমিত হলেও কার্যত সেটি পুরোপুরি মিলিয়ে যায়নি। ফলে ১৯৮০–এর দশকের শেষদিকে যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন আসন্ন হয়ে পড়ে, তখন এই জাতিগত সংঘাত পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং নাগর্নো–কারাবাখ নিয়ে আর্মেনীয় ও আজারবাইজানিদের মধ্যে যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যায়।

This is a Bengali article about the inclusion of Nagorno-Karabakh in Azerbaijan SSR.

Sources:

1. Robert Service. 2006. "Stalin: A Biography." Cambridge: Harvard University Press.

2. Svante E. Cornell. 1999. "The Nagorno-Karabakh Conflict." Report no. 46, Department of East European Studies, Uppsala University.

3. Thomas de Waal. 2003. "Black Garden: Armenia and Azerbaijan Through Peace and War." New York and London: New York University Press.

Source of the featured image: Wikimedia Commons

Related Articles

Exit mobile version