অমরত্বের খোঁজে বিফল হয়ে বারুদ আবিষ্কারের অদ্ভুত গল্প

মধ্যযুগীয় ভারতীয় উপমহাদেশে প্রতিনিয়ত যুদ্ধবিগ্রহ লেগে থাকতো। ঢাল-তলোয়ার হাতে ভারতীয়, আফগানি, মঙ্গোল সৈনিকরা একত্রে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তো। তরবারির শক্ত ধাতুর ঝনঝনানিতে নির্ধারিত হতো ভারতবর্ষের মসনদের পরিণতি। যুদ্ধের পঞ্জিকার পাতা উল্টাতে থাকে, আর একের পর এক যুদ্ধ সংঘটিত হতে থাকে। ভারতবর্ষের ইতিহাস এবং সভ্যতার কাঠামো তৈরিতে এসব যুদ্ধ বেশ বড় ভূমিকা পালন করেছে। তরাইনের যুদ্ধ, পানিপথের তিনটি যুদ্ধ, কনৌজের যুদ্ধ, পলাশীর যুদ্ধ, বক্সারের যুদ্ধের মতো বড় বড় যুদ্ধের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে বারবার বদলেছে উপমহাদেশের রাজনৈতিক হালচিত্র। একটা সময় যুদ্ধাস্ত্র মানেই ছিল ঢাল, তরবারি, বর্শা, তীর-ধনুক। হাতি-ঘোড়ায় চড়ে অথবা পায়ে হেঁটে সৈনিকরা যুদ্ধ করতো। কিন্তু একবার এই ঘটনার ব্যতিক্রম হলো।

পানিপথের প্রথম যুদ্ধে পানিপথ প্রান্তরে মুখোমুখি হয়েছিলেন মোঘল সেনানী বাবর এবং ইব্রাহিম লোদি। সৈন্যবল, ঢাল-তরবারি, তীরন্দাজ বাহিনী সবদিক থেকে সেবার এগিয়ে ছিলেন লোদি। কিন্তু পাঁচগুণ বড় বাহিনী নিয়েও সেবার মোঘলদের নিকট পরাজিত হয়েছিলেন তিনি। মোঘলরা কোনো দেও-দানব ছিল না। তাহলে তারা কোন জাদুবলে হারিয়ে দিয়েছিল লোদি বাহিনীকে? এর উত্তর হলো বারুদ। সেবার বারুদ নামক এক বিধ্বংসী জাদুর সাহায্যে ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক নতুন সূর্যের আবির্ভাব ঘটেছিল। সেটা হচ্ছে মোঘল সূর্য। এভাবে বিভিন্ন যুগে, বিভিন্ন দেশে এই বারুদ সভ্যতার ভাগ্য গড়ে দিয়েছে।

বারুদের ব্যবহার পানিপথ যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়; Image Source: YugaParivartan

অমরত্বের খোঁজ

কথায় বলে, ‘প্রয়োজনীয়তাই আবিষ্কারের প্রসূতি’। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কথাটি সত্যি হলেও সেটা বারুদের ক্ষেত্রে কতটুকু সত্যি সেটা বিচারের ভার পাঠকদের হাতেই তুলে দিলাম। কারণ, বারুদ আবিষ্কারের কোনো প্রয়োজনীয়তা বোধ না করতেই সেটা আবিষ্কার হয়ে যায়। এই অদ্ভুত গল্পের শুরু হয় প্রাচীন ক্যাথে সাম্রাজ্যে (বর্তমান চীন)। খ্রিস্টপূর্ব ১৫৬ অব্দে চীনের হান সাম্রাজ্যের অধিপতি ছিলেন সম্রাট উ দি। তিনি তার রাজ্যের রসায়নবিদদের নির্দেশ দিলেন অমরত্বের পথ্য আবিষ্কার করার। সম্রাটের আদেশ মেনে নিয়ে তারা গবেষণা শুরু করলো। দিনরাত খাটার পর তারা সালফার এবং পটাসিয়াম নাইট্রেটের সংমিশ্রণে এমন একটি রাসায়নিক পদার্থ আবিষ্কার করলেন, যা আচমকা সবকিছু বিস্ফোরিত করে ধ্বংস করে দিলো। তারা ভাবলো, অমরত্বের পথ্য কী যেন তেন জিনিস, একটু তেজ তো দেখাবেই! তারা তাই এই ফর্মুলার পেছনে লেগে থাকলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা বুঝতে পারলেন, তারা যা আবিষ্কার করেছেন, সেটা কোনোমতেই অমরত্বের পথ্য হতে পারে না। উল্টো একটু এদিক সেদিক হলে সেটা সোজা মৃত্যুপুরীতে পাঠিয়ে দিতে পারে।

চীনা রসায়নবিদ দ্বারা বারুদ আবিষ্কৃত হয়; Image Source: Wikimedia Commons

প্রাচীন বারুদ প্রস্তুত প্রণালী

৩০০ খ্রিস্টাব্দে জে হুং নামক এক  চীনা বিজ্ঞানী সেই অমরত্বের ছদ্মবেশে আসা বিধ্বংসী বারুদের প্রস্তুত প্রণালী লিপিবদ্ধ করেন। সালফার, সল্টপিটার, কয়লার মিশ্রণে তিনি সেটি তৈরি করেছিলেন। প্রাণিজ সার থেকে বিশেষ উপায়ে চীনারা সল্টপিটার তৈরি করতো তখন। বারুদে আগুন লাগলে তা দ্রুত পুড়তে থাকে এবং এটা থেকে নির্গত গ্যাস বেশ বড় রকমের আয়তন দখল করে ফেলে। এর ফলে দ্রুত বড় রকমের বিস্ফোরণ ঘটে যায়।

বারুদের সঠিক মিশ্রণ অজ্ঞাত ছিল চীনাদের; Image Source: Youtube

শুরুর দিকে এই বারুদ ব্যবহার করে চীনারা আকাশে বাজি ফুটাতো। এর মাধ্যমে তারা অশুভ আত্মা দূর করার প্রার্থনা করতো। ধারণা করা হয়, আধুনিক আতশবাজির চল চীনাদের এই পূজা থেকে আগত হয়েছে। শুরুর দিকে তারা বারুদ তৈরির মিশ্রণের সঠিক পরিমাণ এবং অনুপাত সম্পর্কে অবগত ছিল না। তাই এর ব্যবহার পূজার মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য শত্রুর দিকে বারুদ পোড়া কাপড় ছুঁড়ে মারা হতো।

চীনে বারুদ বিপ্লব

৭০০ সালের দিকে টাং সাম্রাজ্যের বিজ্ঞানীরা সঠিক অনুপাতে উপাদান মিশিয়ে বারুদ তৈরি করা শুরু করে। তখন সম্রাটের বিশেষ দিন উপলক্ষ্যে বাজি পোড়ানোর উদ্দেশ্যে বারুদ ব্যবহার করা হতো। বারুদ ব্যবহার করে যুদ্ধ জয় করা যাবে, এই ধারণা আসতে আসতে চীনাদের কেটে যায় আরো দু’শত বছর। ৯০৪ সালে চীনারা বারুদের সাহায্যে কাঠের রকেট তৈরি করে। আগুন লাগালে সেটা দ্রুত বেগে শত্রুর দিকে ধাবিত হতো। এছাড়া বাঁশের ফাঁকা অংশে পাথর ঢুকিয়ে বারুদে অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে ক্ষুদ্রাকার কামানও আবিষ্কার করেছিলো তারা।

বারুদ চালিত চীনা রকেট; Image Source: ThoughtCo

চীনারা বারুদের সাহায্যে একের পর এক যুদ্ধ জয় করতে থাকে। চীনা সম্রাটরা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন যেন বারুদের রহস্য পুরো বিশ্বের কাছে ফাঁস না হয়ে যায়। কিন্তু ১১০০ সালের শেষদিকে বারুদ চীনের ভূখণ্ড পেরিয়ে বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

অগ্নি নিশ্বাসী দানো

চীনারা মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বারুদ ব্যবহার করেছিলো। চীনাদের এই বিধ্বংসী অস্ত্র দেখে মঙ্গোলরা কৌতূহলী হয়ে উঠলো। মোঘল বিজ্ঞানীরাও তখন চীনাদের এই অস্ত্রের রহস্য উদ্ঘাটনে লেগে গেলো। কয়েক বছর গবেষণার পর তারা বারুদ রহস্য উদ্ঘাটনে সক্ষম হলো। মূলত মঙ্গোলদের আবিষ্কৃত পদ্ধতি পরবর্তীতে পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে বলে ধারণা করা হয়। চীনাদের বারুদ ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বিখ্যাত সিল্ক রোড দিয়ে ভারতবর্ষ এবং মধ্যপ্রাচ্য পাড়ি দিয়ে ইউরোপের জমিনে গিয়ে পদার্পণ করলো। ঠিক কারা এবং কী উদ্দেশ্যে বারুদ ইউরোপে পাচার করেছে, সেটা নিয়ে মতবিরোধ আছে। অনেকের মতে, তৃতীয় ক্রুসেডের সময় যোদ্ধারা ইউরোপ ফেরত যাওয়ার সময় বারুদ পাচার করেছিল। দেশে ফিরে তারা বারুদকে এক অতিকায় দৈত্যের নিশ্বাস হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলো।

ইউরোপে চলে এলো বারুদ; Image Source: Realm of History

আরেক মতানুযায়ী, ইউরোপে বারুদ আনা হয়েছিলো খনির কাজ করা, পাহাড় ভেঙে রাস্তা বানানোর উদ্দেশ্যে। সপ্তদশ শতকের পূর্বে ইউরোপে যুদ্ধে বারুদ ব্যবহৃত হয়নি। বিংশ শতাব্দীতে ডিনামাইট আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত বারুদ দ্বারাই পাহাড় ভাঙার কাজ চলতো। কিন্তু কোন বর্ণনা সঠিক, সেটা এখনও নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। তবে এই বারুদ পাচারের পেছনে একজন ব্যক্তির নাম বারবার বিভিন্ন সূত্রে উঠে এসেছে। তিনি হলেন উইলিয়াম রুবরাক। তিনি মঙ্গোল রাজসভার একজন দূত ছিলেন। তার সহযোগীতায় বারুদ প্রস্তুত প্রণালী মঙ্গোল রাজসভা থেকে ইউরোপীয়দের হস্তগত হয়েছিলো।

আরব দেশে বারুদ

দ্বাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে আরবদের বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি ঘেঁটে বারুদ প্রস্তুত প্রণালী সম্পর্কে জানা যায়। আরবদের নিকট বারুদ ‘চীনা তুষার’ নামে পরিচিত ছিল। ধারণা করা হয়, সিল্ক রোড দিয়ে বারুদ ইউরোপে পাচারকালীন সময়ে আরবদের কাছে পৌঁছে যায়। চতুর্দশ শতাব্দীতে আরবরা বারুদ ব্যবহার করে হাত কামান তৈরি করে। এর মাধ্যমে আরবরা বিভিন্ন যুদ্ধে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কর্তৃত্ব খাটাতে সক্ষম হয়। কামান ব্যবহারে বিপ্লব আসলেও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তারা বন্দুকে বারুদ ব্যবহারে তেমন দক্ষতা অর্জন করতে পারেনি।

দ্বিতীয় প্রজন্মের বারুদ

একসময় ইউরোপীয়রা বারুদ ব্যবহারে বিভিন্ন ত্রুটি দেখতে পায়। বিশেষ করে বারুদের মিহি দানা খুব দ্রুত জ্বলে উঠে এবং তা অস্ত্রের উপর অত্যাধিক চাপ তৈরি করে। তাই পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইউরোপীয়রা কিছুটা বড় দানার বারুদ তৈরি করলো। দেখা গেলো, বারুদের দানার আকার ছোট-বড় করে এর দাহ্যতা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এই আবিষ্কারের ফলে বন্দুকে বারুদ ব্যবহার করার পথ সুগম হয়। প্রথমদিকে বন্দুককে মূলত কামানের পকেট সংস্করণ হিসেবে দেখা হতো। বন্দুক ব্যবহার সহজ হয়ে যাওয়ায় বারুদ নির্ভর বাহিনীতে বৈচিত্রের সৃষ্টি হয়। এমনকি এই বন্দুক পরবর্তীতে সম্পূর্ণভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে তরবারির ব্যবহার বিলুপ্ত করে দেয়।

বারুদ দানার আকারের উপর এর দহন কাল নির্ভর করে; Image Source: Steemit

ততদিনে ইউরোপের জার্মানি, ফ্রান্সসহ কয়েকটি দেশ বেশ উন্নতমানের বারুদ প্রস্তুতকারক হিসেবে সুনাম অর্জন করে। এই উন্নত বারুদকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক মাত্রায় বাণিজ্য শুরু হয়। বারুদ বাণিজ্যের ফলে এটি আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। ইউরোপের পর বারুদের পরবর্তী সংস্করণ করেন এক মার্কিন সৈনিক। থমাস রডম্যান নামক এক সৈনিক একধরনের বারুদ প্রস্তুত করেন যার দহনক্ষেত্র পূর্বের তুলনায় কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়।

থমাস রডম্যান; Image Source: Wikimedia Commons

অমরত্বের অজুহাতে আবিষ্কৃত বারুদ ধীরে ধীরে যুদ্ধের সংজ্ঞা বদলে দিতে থাকে। দেশে দেশে সেনাবাহিনীতে আমূল পরিবর্তন সাধিত হতে থাকে, যা এখন পর্যন্ত চলমান রয়েছে। দক্ষতার সাথে গোলন্দাজ বাহিনী ব্যবহারের মাধ্যমে বহু বিখ্যাত সেনাপতি যুদ্ধ জয় করতে সক্ষম হয়েছেন। এদের মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেনাপতি জেনারেল প্যাটনের কথা না বললেই নয়। তিনি তার গোলন্দাজ বাহিনী সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন,

কে যুদ্ধে জয়লাভ করেছে, সেটা নিশ্চয় তোমাদের নতুন করে জানাতে হবে না। তোমরা সবাই জানো, এই যুদ্ধে আমার গোলন্দাজরা জয়লাভ করেছে।

জেনারেল প্যাটন; Image Source: History

এই মন্তব্য থেকে বোঝা যায়, বারুদ আবিষ্কার পৃথিবীর ইতিহাসকে কীভাবে নিজের হাতে গড়ে দিচ্ছে। বিকল্প সহজলভ্য অস্ত্র আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত গোলাবারুদ সর্বদা যুদ্ধক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণ করবে, এটা চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়।

This is a Bangla article about the history of gunpowder. It was actually an accidental invetion as the chemists were looking for the potion of eternity. Instead, they ended up inventing something quite opposite. 

References: All the references are hyperlinked.

Feature Image: Colonial Ghost. 

 

Related Articles

Exit mobile version