ইতিহাসে একটা সময় ছিল, যখন যুদ্ধ-বিগ্রহের কাজে পুরুষরাই ঝাঁপিয়ে পড়তো কেবল। তাদের তুলনায় নারীদের অংশগ্রহণ ছিল খুবই সামান্য। কিন্তু যেসব নারী হাতে অস্ত্র তুলে নিতো, তারা যথেষ্টই ভয়ঙ্কর সাহসী হতো।
পুরুষের সঙ্গে কাধেঁ কাঁধ মিলিয়ে লড়তো তারা, কখনো বা একজন পুরুষ থেকেও একজন নারী বেশি সাহসিকতার পরিচয় দিতো। তাদের যুদ্ধকৌশল আর নেতৃত্বগুণ প্রতিপক্ষকে তাজ্জব বানিয়ে ছাড়তো। ইতিহাসে এমনই দুজন নারী হলেন হেলিকার্নাসাসের রাণী আর্টেমিসিয়া এবং পালমিরার রানী জেনোবিয়া।
সমকালীন সব জাতির মতো জাপানেও পুরুষরাই মূলত যুদ্ধ পরিচালনার কাজে যুক্ত থাকতেন। কিন্তু দ্বাদশ শতাব্দী থেকে উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত জাপানে পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও অস্ত্রচালনা শেখানো হতো।
তাদেরকে মূলত তলোয়ার চালনা এবং তীর ছোঁড়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো, যাতে তারা যুদ্ধচলাকালীন নিজ পরিবারকে রক্ষা করতে পারে। নারীরা তখনই এসব অস্ত্র ব্যবহার করতো, যখন কেউ তাদের বাসস্থানে হামলা করতো। টোমোয়ি গোজেনও অন্য নারীদের মতো সবকিছু শিখেছিল। তবে টোমোয়ি সব নারীদের মতো শুধু ঘরবাড়ি রক্ষার ভেতরই সীমাবদ্ধ না থেকে নিজেকে পরিণত করেছিলেন যুদ্ধের ময়দানের কিংবদন্তিতে।
টোমোয়ি গোজেনের পরিচয় পাওয়া যায় দ্বাদশ শতাব্দীর এক সাহিত্যকর্মে, যেখানে গানপেই যুদ্ধে তার অসামান্য সাহসিকতা আর নেতৃত্বগুণ তুলে ধরা হয়। টোমোয়ি একজন সামুরাই ছিল এবং সামরিক বাহিনীতে তার পদবিও ছিল অনেক উপরে। এটি ছাড়া আর কোথাও টোমোয়ি’র নাম পর্যন্ত পাওয়া যায় না! তার জন্ম ও মৃত্যু নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। ‘টেল অব দ্য হেইকে‘-তে টোমোয়ি গোজেনকে এভাবে উপস্থাপন করা হয়-
“টোমোয়ি’র ছিল কালো ঘন লম্বা চুল, তার মুখের আকৃতি ছিল মানানসই এবং সুন্দরী। এই সৌন্দর্যের মাঝেই সমরে সে ছিল দুর্দান্ত, তেজী ঘোড়া কিংবা উঁচু-নিচু মাটি; সবই সে সামলে নিতো চরম দক্ষতায়।
তার তলোয়ারের সামনে হাজার শত্রুও কিছু না। বরং সে যেন স্বয়ং শয়তানের মুখোমুখি হওয়ার যোগ্য! টোমোয়ি যেখানে দাঁড়াতো, এর আশপাশের সবকিছু তার পায়ে লুটিয়ে পড়তো। পুরোদস্তুর সমরসাজে টোমোয়ি সবচেয়ে সাহসী ক্যাপ্টেনদের সঙ্গে লড়তো এবং পরাজিত করে তাদের মাথা জমাতো!
টোমোয়ি গোজেনকে সবচেয়ে বেশি স্মরণ করা হয় ১১৮৪ সালে সংগঠিত আওয়াজু যুদ্ধে তার বীরত্ব আর হার না মানা মানসিকতার জন্য। যখন মাত্র ৭ জন সঙ্গী বেঁচে ছিল, তাদের সঙ্গে টোমোয়ি ছিলেন; যে তখনও পিছু হটতে রাজি ছিল না।”
একজন সামুরাই টোমোয়ি গোজেন
সামুরাই এর আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে ‘যে নিরাপত্তা দেয়’। জাপানের ইতিহাস ও কিংবদন্তিতে এই সামুরাইরা সবসময়ই অভিজাত শ্রেণীর যোদ্ধা। একাদশ শতাব্দীতে তাদের উত্থান ঘটে মূলত তৎকালীন সামন্ততান্ত্রিক রাজাদের সেবা করার অভিপ্রায়ে। এসব রাজাদের বলা হতো ‘দাইমিও‘।
দাইমিওরা সামুরাইদের নিজের আস্থার সঙ্গী করে নিতে শুরু করে। নিজেদের নিরাপত্তা কিংবা গুপ্ত অভিযানে সামুরাইদের কদর বাড়তে থাকে। এভাবে তারা সামনাসামনি যুদ্ধেও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ষোড়শ শতাব্দীর পর থেকেই মূলত সামুরাইদের সামাজিক অবস্থান দৃঢ় হতে থাকে। তারা সমাজে সম্মানের পাত্র ছিল এবং নিজেদের সঙ্গে সবসময় তলোয়ার রাখার অনুমতি ছিল তাদের।
কিন্তু সামুরাইদের ভেতর মোটামুটি সবাই ছিল পুরুষ। নারীদের কাজ ছিল বিয়ে করা, সন্তান লালন-পালন এবং ঘরবাড়ি দেখাশোনা করা। তাদের স্বামীরা যুদ্ধে যেতেন এবং যুদ্ধশেষে ফিরে আসতেন বিজয়ীর বেশে।
তবে কিছু নারী ছিলেন, যারা যুদ্ধের বা অস্ত্রচালনার প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন। এদেরও অনেকের আবার অন্য নারীদের মতোই ভাগ্য ছিল। কেননা এরা কেবল কিন্তু সঙ্গে অস্ত্র রাখতে পারতেন, এবং শত্রুর আক্রমণ হলে কেবল নিজ পরিবারকে রক্ষার জন্যই তা ব্যবহার করতেন।
কিন্তু এই বৃত্তের বাইরে এসেও কিছু নারী সামুরাই সত্যিকার সমরে পুরুষের সঙ্গে যুদ্ধে যোগ দিতে পেরেছিলেন!
সামুরাইদের উত্থানেরও বহু আগে কিছু নারী যুদ্ধকৌশল শিখেছিলেন, যারা শত্রুর হাত থেকে নিজের পরিবারকে বাঁচাতে সক্ষম ছিলেন। তাদের বলা হতো ‘অন্না বুগেইসা‘, যার মানে নারী যোদ্ধা।
এসব নারী যোদ্ধারা নিজেদের সঙ্গে কাইকেন (একধরনের ছোটো ছোরা) রাখতে পারতেন। তাছাড়া তাদের সঙ্গে নাগিনাটা (অর্ধচন্দ্রাকৃতির তলোয়ার) থাকতো, যা একসময় তাদের ঐতিহ্যের অংশ হয়ে যায়।
অন্না বুগেইসাদের ঐতিহ্য সামুরাইদের মাঝেও স্থান লাভ করে। কোনো সামুরাই এর কাছে নাগিনাটা থাকার মানে সে একজন নারী যোদ্ধা। এটা তার গৌরবকে ফুটিয়ে তুলতো। বিয়ের পর যৌতুক হিসেবে কোনো কোনো নারী নাগিনাটা সঙ্গে করে নিয়ে আসতেন স্বামীর বাড়ি। টোমোয়ি গোজেনও সেসব নারীদের মতোই ছিলেন।
টোমোয়ি গোজেনের কিংবদন্তী
টোমোয়ি গোজেনকে জাপানি ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ নারী যোদ্ধা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু তার সম্পর্কে যা জানা, বেশিরভাগই সাহিত্য আর লোককথার অংশ। এসবের ভীড়ে তাই আসল পরিচয় পাওয়া কষ্টকর একটা ব্যাপার।
‘টোমোয়ি গোজেন’ নামটাই যে নকল নয় তারই বা কী ভরসা। ‘টোমোয়ি’ নাম দেওয়া হয়েছে তার কাঁধের আকৃতির কারণে, আর ‘গোজেন’ হলো তৎকালীন নারী যোদ্ধাদের সম্মান দেখানো একটি পদবি।
সাহিত্যে উঠে আসা টোমোয়ি গোজেন ছিল জেনারেল মিনিমোতো ইওশিনাকা-এর একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী (অনেকের মতে স্ত্রী)। ১১৮০ থেকে ১১৮৫ সালের ভেতর গানপেই যুদ্ধে টোমেন গোজেনের হাত ধরে অনেকগুলো বিজয় পেয়েছিলেন ইওশিনাকা।
কিন্তু পারিবারিক দ্বন্দ্বের জেরে লাগা যুদ্ধে ইওশিনাকা হেরে যান এবং রাজধানী কায়াতো থেকে তিনি পালিয়ে যান। পালিয়ে যাওয়ার সময় তার সঙ্গে কয়েকজন সৈনিক ছিল, যাদের ভেতর টোমোয়ি অন্যতম।
অন্য একটি গল্পে বলা হয়, ইওশিনাকার বাহিনী যখন পরাজিত হয়, তখন তারা পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পালানোর ঠিক আগমুহূর্তে টোমেন গোজেন বিপক্ষ শিবিরের দু’জন জেনারেলকে দ্রুততার সঙ্গে হত্যা করে। যাদের একজনের নাম হাতাকেয়ামা এবং অন্য আরেকজন জেনারেল উচ্চিদা।
অতর্কিত এই হামলার ফলে তাদের বাহিনী টোমেন গোজেনের কিছুই করতে পারেনি। সে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
একথাও শোনা যায় যে, হেরে যাওয়ার পর যখন কয়েকজন বেঁচে ছিল, জেনারেল ইওশিনাকা টোমোয়ি গোজেনকে এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। এটির সম্ভাব্য কারণ এমনও হতে পারে যে, টোমোয়ি হয়তো তাদের পরাজয়ের কথা পরিবারকে জানাতে সক্ষম হবে।
আবার হতে পারে, একজন জেনারেল হয়ে নারী যোদ্ধার সামনে মারা যেতে তিনি লজ্জাবোধ করবেন ( তৎকালীন সমাজে নারীদের হাতে কিংবা কোনো নারীর সামনে যুদ্ধে মারা যাওয়া কাপুরুষতা ছিল)!
‘টেল অব দ্য হেইকে’-এর অন্য একটি বর্ণনায় বলা হয়, জেনারেল টোমোয়িকে যে নির্দেশই দেন না কেন, টোমোয়ি সেটি পালন করেনি। বরং সে জেনারেলের সামনে শত্রু শিবিরের গুরুত্বপূর্ণ কারও মাথা এনে দেওয়ার অনুমতি চায়।
সেই সময় শত্রুদের অভাগা একটি দল জেনারেলকে পাকড়াও করতে এগিয়ে আসছিল। কিন্তু টোমোয়ির ক্ষীপ্র গতির কাছে পুরো ছোটো দলটাই নাস্তানাবুদ হয়ে যায়, সেই দলের প্রধানের কাটা মাথা টোমোয়ি জেনারেল ইওশিনাকা’র সামনে পেশ করে সে।
যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে তার ভাগ্যে কী ঘটেছিল সেটা তর্কের ব্যাপার। টোমোয়িকে নিয়ে মানুষের আগ্রহে কখনো ভাটা পড়েনি। বরং গল্পের কিছু শাখা-প্রশাখা গজাতে থাকে। যেখানে বলা হয়, যুদ্ধ থেকে পালিয়ে আসার সময় টোমোয়ি গোজেনের বয়স ছিল ২৮ বছর এবং সে বৌদ্ধ ধর্মের সন্ন্যাসী হিসেবে বাকি জীবন কাটিয়ে দেয়। তার মৃত্যু হয়েছিল ৯০ বছর বয়সে।
আরেকটি গল্পে উঠে আসে, যুদ্ধ শেষে টোমোয়ি গোজেনকে বন্দি করা হয় এবং শত্রু শিবিরের জেনারেল ওয়াদা ইওশিমোরার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের পর টোমোয়ি ইওশিমোরা’র একজন উপপত্নী হয়েই বাকি জীবন পার করে দেয়।
জাপানের কায়াতো’তে প্রতি বছরের ২২ অক্টোবর ইতিহাসের সেরা চরিত্রগুলোকে নিয়ে ‘জিদাই মাতসুরি‘ উৎসবের আয়োজন করা হয়।
সম্প্রতি টোমোয়িকে নিয়ে আমেরিকান লেখক জেসিকা স্যালমনসন ‘টোমোয়ি গোজেন সাগা‘ নামে একটি ফ্যান্টাসি ট্রিলজি রচনা করেন। এছাড়াও ২০১০ সালে মিনি টিভি সিরিজেও উপস্থিত করা হয় টোমোয়ি গোজেন চরিত্রকে। এনিমেশন, কমিকস এমনকি গেমসও বানানো হয়েছে রহস্যময় নারী চরিত্রটিকে ঘিরে।
টোমোয়ি গোজেনের ভাগ্যে যা-ই ঘটুক না কেন, কিংবা এই নারীচরিত্রটি বাস্তব-কল্পনা যা-ই হোক না কেন, মানুষের মনে টোমোয়ি গোজেন জায়গা করে নিতে পেরেছিল। একজন ভয়ঙ্কর নারী যোদ্ধা যে ভাগ্যের খেলায় হেরে গিয়ে স্বর্গ থেকে মর্ত্যে এসে পড়েছিল! তাকে অমর দাবি করা মানুষগুলো আজ বেঁচে নেই। তারা অনেকেই দেখে যেতে পারেনি তাদের দেবী হারের আস্বাদন পেয়েছিল!
কিন্তু লোকসাহিত্য আর গল্পগাথার জগতে টোমোয়ি গোজেন এক অমূল্য সম্পদ। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে টোমোয়ি গোজেন চরিত্রটি যেভাবে মানুষের হৃদয়ে জায়গা গেঁড়ে বসে আছে, আরও বহু শতাব্দী ধরে সে কিংবদন্তি হয়ে বেঁচে থাকলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিছু চরিত্রই এমন, মরেও অমর হয়ে থাকে মহাকালের ডায়েরিতে। একসময় গিয়ে মানুষ আর তার অস্তিত্ব খোঁজে না, সে নিজেই কিংবদন্তির একটি অংশ হয়ে যায় সবার অস্তিত্বের সঙ্গে।