ঐতিহাসিক অনেক চরিত্রের সাথেই আমরা বিভিন্নভাবে পরিচিত, হয়ত কোনো বিখ্যাত ঘটনার মাধ্যমে বা ঐ চরিত্রগুলোর কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে। কিন্তু এই বিখ্যাত ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোর কোনটির অস্তিত্ব আসলেই ছিল আর কোনটি কাল্পনিক চরিত্র থেকে ধীরে ধীরে মানুষের কাছে বাস্তবে পরিণত হয়েছে, তা আলাদা করা একটু দুঃসাধ্য বটে। অনেক ঐতিহাসিক ঘটনাই দেখা যায় অসম্পূর্ণ বা শোনা কথার উপর ভিত্তি করে বর্ণিত। সেসব ঘটনার সাথে যুক্ত মানুষগুলোর ব্যাপারেও তাই সঠিক করে কিছু বলা যায় না। আজ জানানো হবে তেমনই কিছু ঐতিহাসিক চরিত্রের ব্যাপারে, খুব বিখ্যাত হওয়া সত্ত্বেও যাদের অস্তিত্ব আসলেই ছিল কিনা তা নিয়ে রয়ে গেছে সংশয়।
১) আনারকলি
লাহোরের সাংস্কৃতিক-ঐতিহাসিক ও সমৃদ্ধ স্থাপত্য দেখতে গিয়ে যে কীর্তি দেখে বিমোহিত না হয়েই পারা যায় না, তা হলো রাজকীয়তা ও রহস্যে ঘেরা মুঘল আমলের বিবর্ণ সাদা রঙের একটি সমাধি। এই সমাধিক্ষেত্রটি মুঘল সম্রাট আকবরের পুত্র সেলিমের প্রেয়সী আনারকলির শেষ নিবাস হিসেবে পরিচিত।
কিন্তু এই আনারকলি চরিত্রটি সাধারণ মানুষ তো বটেই, ইতিহাসবিদদের কাছেও রহস্যের খোরাক। আনারকলির ঘটনা মূলত একটি কিংবদন্তী, যা মানুষের মুখে মুখে প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলে আসছে। কিন্তু কে এই আনারকলি আর কীভাবে ঘটেছিল তার মৃত্যু- এ নিয়ে আছে বেশ জল্পনা কল্পনা। ভারতীয় চলচ্চিত্র ‘মুঘল-ই-আজম’ এ দেখানো হয় আনারকলি ছিলেন সামান্য এক নাচনেওয়ালী, যার প্রণয় ঘটে রাজপুত্র সেলিমের সাথে। এই অপরাধে সম্রাট আকবর তাকে দেয়ালের মধ্যে জীবন্ত কবর দেন। তবে আনারকলিকে নিয়ে বিভিন্ন ঘটনার পার্থক্য এতোই বেশি যে, এই নামে আসলেই কেউ ছিলেন কিনা তা নিয়েই সংশয় সৃষ্টি হয়।
বিভিন্ন ঐতিহাসিক গবেষণা থেকে মোটামুটি যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে বলা হয়, লাহোরের সেই সমাধিক্ষেত্রটি নাদিরা বেগম বা শরফ-উন-নেসা নামে এক ইরানী মহিলার, যিনি বণিকদের এক কাফেলার সাথে লাহোরে আসেন। তিনি এতোই সুন্দরী ছিলেন যে, আকবরের রাজসভায় তিনি স্থান পান এবং সৌন্দর্যের কারণে তার নামকরণ করা হয় ‘আনারকলি’। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, সম্রাট জাহাঙ্গীর তার আত্মজীবনী ‘তুজক-ই-জাহাঙ্গীরী’তে আনারকলির কথা উল্লেখ করেননি। এমনকি সমসাময়িক কোনো ঐতিহাসিকও তার ব্যাপারে কোনো সূত্র রেখে যাননি।
আনারকলির প্রথম ঐতিহাসিক উল্লেখ পাওয়া যায় ইংরেজ পর্যটক ও ব্যবসায়ী উইলিয়াম ফিঞ্চের ভ্রমণ বিবরণীতে, যিনি ১৬০৮ থেকে ১৬১১ সালের মধ্যে লাহোরে এসেছিলেন। তার লেখনী মতে, আনারকলি ছিল সম্রাট আকবরের একজন স্ত্রী। এই তথ্য পরে নূর আহমেদ চিশতির বই ‘তেহকিকাত-ই-চিশতিয়া’ এবং সাইয়্যিদ আব্দুল লতিফের বই ‘তারিখ-এ-লাহোরে’ও পাওয়া যায়। পরের দুজনের মতে, সেই নাদিরা বেগমই ছিলেন এই আনারকলি এবং সম্রাট আকবরের প্রিয় স্ত্রী। ধারণা করা হয়, আকবরের এই স্ত্রীর সাথে তার পুত্র সেলিমের (জাহাঙ্গীর) মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা আকবরের কাছে অনৈতিক সম্পর্ক হিসেবেই প্রতীয়মান হয়। তাদের সম্পর্কের ব্যাপারে জানার পর ক্রুদ্ধ আকবর আনারকলিকে দেয়ালে জ্যান্ত কবর দিয়ে দেন। সিংহাসনে বসার পর জাহাঙ্গীর প্রিয়জনের স্মৃতিতে সেখানে জমকালো একটি সমাধিক্ষেত্র তৈরি করেন। তবে পরবর্তীতে বেশ কিছু ইতিহাসবিদই এই সমাধিক্ষেত্রটিকে আনারকলির নয় বলে দাবি করেন।
আনারকলি চরিত্রটি নিয়ে অস্পষ্ট এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য থাকলেও সমাধিক্ষেত্রের আকার এবং জাঁকজমক দেখে এটা সহজেই অনুমেয় যে, এর মধ্যে যে মৃত ব্যক্তির স্থান হয়েছিল, তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কেউ। তবে আনারকলিকে ঘিরে নতুন পুরোনো বিভিন্ন তথ্য কখনোই আমাদের নিশ্চিত হতে দেবে না যে, চরিত্রটি আসলেই কেমন ছিল বা আদৌ ছিল কিনা।
২) রাজা আর্থার
ক্যামেলট (আর্থারের বিখ্যাত দুর্গ) এর রক্ষক হিসেবে পরিচিত ইতিহাসের এক সুপরিচিত সম্রাট আর্থার। ব্রিটেনের এই রাজাকে বীরত্বের এক উদাহরণ হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়। কিন্তু অনেক বিদ্বান ব্যক্তি বিশ্বাস করেন, আর্থারের গল্পটি ‘সোর্ড ইন দ্য স্টোন’ উপন্যাস থেকে অনুপ্রাণিত একটি কিংবদন্তী ছাড়া কিছুই না।
সাহসী রাজা আর্থার মূলত ৫ম থেকে ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে ব্রিটিশদের উপর স্যাক্সনদের (জার্মান উপজাতিদের একটি দল) আক্রমণ দমনের পথিকৃৎ হিসেবে পরিচিত। আগ্রাসকদের বিরুদ্ধে পরপর ১২টি যুদ্ধে জয়ী ধরা হলেও এই মহান রাজার উপস্থিতি সেই সময়ের যুদ্ধের ইতিহাসগুলোতে পাওয়া যায় না। প্রকৃতপক্ষে আর্থারের সম্পূর্ণ রূপায়ন ৯ম শতাব্দীর আগে কোথাও উল্লেখই করা হয়নি। আর্থারের কথা প্রথম উল্লেখ করেন জফ্রি অফ মনমুথস তাঁর লেখা ‘হিস্টোরি অফ দ্য কিংস অফ ব্রিটেন’-এ।
যদিও আর্থারের আধুনিক রূপায়ন বিভিন্ন লেখার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা বলেই মনে করা হয়, তবু কিছু ইতিহাসবিদ মনে করেন, সেই লেখাগুলো এমন কাউকে নিয়েই লেখা, যিনি বাস্তব ছিলেন। তাদের মতে, যোদ্ধা এম্ব্রসিয়াস অরেলিয়ানাস (সম্রাট কন্সটানটাইনের দ্বিতীয় পুত্র ও বীরযোদ্ধা), সম্রাট রিওথেমাস, এমনকি একজন রোমান জেনারেল লুসিয়াস আরটোরিয়াসের ঘটনার উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে কিংবদন্তী আর্থার।
৩) পিথাগোরাস
পিথাগোরাসের সূত্র কার না জানা? আমরা সবাই কমবেশি জ্যামিতি ক্লাসে পিথাগোরাসের থিওরি অনেকবার শুনেছি। কিন্তু খোদ পিথাগোরাসের অস্তিত্ব নিয়েই কোনো সুষ্ঠু প্রমাণ পাওয়া যায় না ইতিহাসে। কিছু সূত্রানুযায়ী, এই গ্রিক চিন্তাবিদকে পাওয়া যায় খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম ও ৬ষ্ঠ শতাব্দীর দিকে। যদিও তাকে একজন দার্শনিক এবং গণিতবিদ হিসেবে মনে করা হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রাচীনকালে তিনি অধিক পরিচিত ছিলেন একজন আধ্যাত্মিক ধর্মতাত্ত্বিক হিসেবে, যিনি সংখ্যাতত্ত্ব এবং মানবাত্মার স্থানান্তরের ব্যাপার নিয়ে অতিরিক্ত আগ্রহী ছিলেন।
তার অস্তিত্বের ব্যাপারে সমসাময়িক কোনো মজবুত প্রমাণ পাওয়া যায় না। এই বিখ্যাত চিন্তাবিদের সমস্ত উল্লেখ এবং হয়ত তার বহুল পরিচিত ধারণা ও সূত্রগুলোও এসেছে তার অনুসারীদের কাছ থেকে, যারা নিজেদের ‘পিথাগোরিয়ান্স’ বলে পরিচয় দিত। পিথাগোরাসের যত গল্পই আমরা পাই, প্রায় সবই পুরাণ বা অতিপ্রাকৃত ঘটনার সাথে জড়িত। সেখানে এক কাহিনীতে বলা হয়, তার স্বর্ণের উরুর কথা। আরেক কাহিনীতে বলা হয়, তিনি ছিলেন দেবতা অ্যাপোলোর পুত্র। কারো কারো জন্য এসব মিথ্যা ও অসঙ্গতি পিথাগোরাসকে একজন অতিরঞ্জিত, এমনকি কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সাজানো কাল্পনিক নেতা হিসেবে প্রতীয়মান করে। এমনকি যদি পিথাগোরাসের অস্তিত্ব আসলে থেকেও থাকে, তিনি সম্ভবত তার বিখ্যাত তত্ত্বের প্রথম আবিষ্কারক নন। বিভিন্ন প্রমাণ এটি সিদ্ধ করে যে, মিশরীয়রা বহু পূর্বেই এই তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল এবং বিভিন্নভাবে এর প্রয়োগ করেছিল।
৪) হোমার
যেখানে পন্ডিতরা দীর্ঘকাল ধরে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন হোমারের মহাকাব্য ‘ইলিয়াড’ এবং ‘ওডিসি’-তে বর্ণিত ঘটনাগুলোর বাস্তবতার প্রমাণ খুঁজতে, সেখানে কবির নিজের অস্তিত্ব নিয়েই সৃষ্টি হয়েছে সংশয়! হোমারের অস্তিত্ব আদৌ ছিল কিনা তা নিয়েই আছে প্রশ্ন। এই সন্দেহের প্রাথমিক কারণ হলো হোমারের জীবন নিয়ে পাওয়া একদমই অল্প কিছু তথ্য। কিছু তত্ত্বানুসারে, এই মহান কবির অস্তিত্ব যদি থেকেও থাকে, এটি প্রায় নিশ্চিত যে তিনি এই বিখ্যাত লেখা দুটির একমাত্র লেখক নন।
ইতিহাসের জনক হেরোডোটাসের মতে, হোমার সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব নবম শতকের মাঝামাঝি সময়ের ছিলেন। অন্য কিছু পুরোনো সূত্র তাকে ট্রোজান যুদ্ধের কাছাকাছি সময়ের মনে করেন। আবার আধুনিক পন্ডিতদের মতে, তিনি ছিলেন খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকের। তাকে সাধারণত কিওস দ্বীপে জন্মানো একজন অন্ধ লোক হিসেবে বর্ণনা করা হয়।
কিন্তু এই তথ্যগুলো নিয়েও আছে বিতর্ক। তার জীবনী সংক্রান্ত এসব বিভ্রান্তিই এই ধারণার উদ্রেক ঘটায় যে, ইলিয়াড এবং ওডিসি মূলত অনেক কবির মিলিত প্রচেষ্টার ফল কিংবা মুখে মুখে প্রচলিত বিখ্যাত ঘটনাবলী থেকে অনুপ্রাণিত।
৫) রবিন হুড
মধ্যযুগীয় লোককাহিনীতে রবিনহুড একটি বড় জায়গা দখল করে আছেন। কিন্তু এই দস্যু, যে ধনীদের সম্পদ চুরি করে গরীবদের দান করে, আসলেই কি বাস্তবতার উপর নির্ভর করে সৃষ্টি? শেরউড ফরেস্টের সবচেয়ে বিখ্যাত এই অপরাধীর বিভিন্ন গাথা ও কবিতায় প্রথম আবির্ভাব ঘটে চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতাব্দীতে। এর আগে র্যাবানহড (Rabunhod) বা রোবহড (Robehod) নামে কিছু অপরাধী থাকার বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায়। বেশিরভাগ সাহিত্যে রবিন চরিত্রটিকে একজন সাধারণ ব্যক্তি হিসেবে বর্ণনা করা হয়, যে নটিংহামের অসৎ শেরিফের বিরুদ্ধে একটি ডাকাত দলকে নেতৃত্ব দেয়। আবার পরবর্তী সংস্করণগুলো তাকে দেখিয়েছে একজন অভিজাত হিসেবে, যে অপরাধীতে পরিণত হয়।
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইতিহাসবিদগণ সত্যিকার রবিনহুডকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তেমন কোনো চরিত্র সামনে আসেনি। বেশ জনপ্রিয় মতবাদ আছে যে, রবিনহুড ছিলেন রাজা রিচার্ডের (যিনি ‘সিংহহৃদয়’ নামেও পরিচিত ছিলেন) অনুসারী। তবে বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ইতিহাসবিদ এখন মনে করেন, রবিনহুডের গল্পগুলো কেবলই নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সম্পর্কে জনপ্রিয় উপকথায় পরিণত হয়েছিল।
৬) লাইকারগাস
গ্রীসের নগররাষ্ট্র স্পার্টাকে প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম পরাক্রমশালী সামরিক শক্তিতে পরিণত করার পেছনে যার কৃতিত্ব সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, তিনিই লাইকারগাস।
খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম থেকে নবম শতাব্দীর মধ্যে এই বিখ্যাত আইনপ্রণেতা বিয়ে থেকে শুরু করে সম্পদের জন্য, এমনকি সন্তান ধারণের জন্য আইনের বেশ কিছু কঠোর সংশোধন আনেন। সম্ভবত এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল ‘Agoge’, যা ছিল স্পার্টার তরুণদের নির্ভীক যোদ্ধা বানানোর জন্য কয়েক বছরের কঠোর প্রশিক্ষণ কর্মসূচী।
লাইকারগান সংস্কারগুলো প্রণয়ন করা হয়েছিল এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ না থাকলেও ইতিহাসবিদরা এখনো নিশ্চিত হতে পারেননি যে, লাইকারগাসের নিজেরই আসলে অস্তিত্ব ছিল কিনা। স্পার্টানরা তাদের ইতিহাস লিখিতভাবে সংরক্ষণ করত না, তাই তারা তাদের বিশিষ্ট নেতা সম্পর্কে যা-ই জানতো, তার বেশিরভাগই অনেক পরে ও পরস্পরবিরোধী কিছু উৎস থেকে পাওয়া। এছাড়া লাইকারগাসের জীবনীও কিছু পৌরাণিক ঘটনায় ভরা। এক সূত্র দাবি করে, তিনি তার জীবন স্বেচ্ছা উপবাসের মাধ্যমে শেষ করেন। ফলে অনেকেই মনে করেন, লাইকারগাস স্পার্টানদের দ্বারা সৃষ্ট ঈশ্বরতুল্য চরিত্র।