প্রাচীনকালের মানুষজন কীভাবে বসবাস করতো, কেমন ছিলো তাদের সমাজ ব্যবস্থা, আইন-কানুন, খাদ্যাভ্যাস, সংস্কৃতি ইত্যাদি নিয়ে আমাদের আগ্রহের কোনো শেষ নেই। তখনকার সময়ের নানা ধ্বংসাবশেষ, লেখালেখি আমাদের ইতিহাস বিশেষজ্ঞদের এসব সম্পর্কে বেশ চমৎকার ধারণাই দেয়। সেসব কিছু বিষয়কে একত্রিত করেই প্রাচীনকালে চীনের সাধারণ মানুষদের জীবন-যাপনের অদ্ভুত কিছু দিক নিয়ে সাজানো হয়েছে আজকের পুরো লেখা।
মূত্রে সিদ্ধ করা ডিম
প্রাচীনকাল থেকেই ওষুধ প্রস্তুতিতে বেশ দক্ষতা অর্জন করেছিলো চীনের অধিবাসীরা। আর চীনাদের সেসব কৌশল বাকি বিশ্বের কাছে অনেকদিন ধরেই ছিলো অপরিচিত। তবে তাদের সব কৌশল যে সবার ভালো লাগবে, সেটাও কিন্তু না।
এই যেমন দেশটির ঝেজিয়াং প্রদেশের ডংইয়াং শহরের কথাই ধরা যাক। এখানে এককালে ‘টংজি ড্যান’ নামে একটি খাবারের আইটেম প্রচলিত ছিলো। মজার কথা হলো- এই টংজি ড্যান কিন্তু আপনি নিজেও এখনই বানানো শুরু করে দিতে পারেন! কীভাবে? এজন্য তারা প্রথমেই একটি পাত্রে বাচ্চা ছেলেদের প্রস্রাব সংগ্রহ করতো। যে ছেলেটির প্রস্রাব সংগ্রহ করা হচ্ছে, তার বয়স অবশ্যই বয়ঃসন্ধিকালের চেয়ে কম হতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় যদি তার বয়স ১০ বছরের কম হয়। এরপর একটি পাত্র সেই প্রস্রাব দিয়ে কানায় কানায় পূর্ণ করে তাতে ডজনের পর ডজন ডিম সিদ্ধ করা হতো! এটাই ছিলো সেই টংজি ড্যানের রেসিপি।
আসলে তৎকালে ডংইয়াংয়ের মানুষজন ছিলো বেশ গরীব। চীনের অন্যান্য অঞ্চলের অধিবাসীরা চায়ের পাতা সিদ্ধ পানিতে ডিম সংরক্ষণ করতো। কিন্তু ডংইয়াংয়ের অধিবাসীদের সেই সামর্থ্যটিও ছিলো না। তাই তারা বেছে নিয়েছিল বিনামূল্যে প্রাপ্ত উষ্ণ এ জলধারাকে! অনেকদিন ধরেই এ টংজি ড্যান ছিলো শহরটির অধিবাসীদের প্রধান খাদ্য। তাই এটি এখন তাদের সংস্কৃতিরই একটি অংশ।
এখনো অনেক চাইনিজ ডাক্তার মনে করেন যে, টংজি ড্যান মানুষকে সুস্বাস্থ্য দান করে। ডংইয়াংয়ের অনেক মানুষ এখনো প্রস্রাবে সিদ্ধ এ ডিম খেয়ে থাকে। আর বাচ্চা ছেলেদের প্রস্রাব সংগ্রহ করার জন্য বিভিন্ন প্রাইমারী স্কুলে দেখা মেলে বালতির!
পদ্মের মতো পা
এখন যে প্রথাটির কথা বলতে যাচ্ছি তা আমাদের সবার চোখেই বেশ অমানবিক ঠেকবে। তবে এমন অমানবিক প্রথাই এককালে চীনে ছিলো বেশ জনপ্রিয়।
ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে এককালে চীনের অনেক নারীকেই তাদের পা যতটা শক্ত করে সম্ভব বাঁধতে উৎসাহিত করা হতো। এর লক্ষ্য ছিলো পায়ের পাতা যাতে কোনোভাবেই ৪ ইঞ্চির বেশি বড় না হয়! আর উদ্ভট এ প্রক্রিয়ার ফলে দুমড়ানো-মোচড়ানো যে পা পাওয়া যেত, তাকে তারা বলতো ‘পদ্মের মতো পা’!
দুঃখজনক ব্যাপার হলো, প্রাচীন চীনা সমাজ ব্যাবস্থায় বিকৃত এ পা-ই ছিলো পুরুষদের কাছে সর্বাপেক্ষা যৌনাবেদনময় অঙ্গ। স্ত্রীর সাথে মিলিত হবার আগে তারা অনেকক্ষণ ধরে কেবল তার সেই পায়েই হাত বুলিয়ে আদর করতো। কিং রাজবংশের সময়কালে একটি নির্দেশিকাও প্রকাশ করা হয়েছিলো এ বিষয়টি নিয়ে। সেখানে নারীদের পদ্ম পায়ে আদর করার ৪৮টি পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিলো!
নারী শরীরের সেই বিকৃত পা-কে যদি শুধু যৌনাবেদনময় অঙ্গ বলা হয়, তাহলে ভুল বলা হবে, বরং এর আগে ‘সবচেয়ে’ শব্দটিও যোগ করতে হবে। কারণ প্রাচীন চীনের যৌনতা বিষয়ক নানা বইয়ে নারীদের এমন ছবি দেখা গেছে যেখানে তারা সারা শরীর উন্মুক্ত রাখলেও ঢেকে রেখেছে তার সেই ‘পদ্মের মতো পা’। পায়ের বাঁধনগুলো নিয়ে তাদের এমনভাবে খেলা করতে দেখা যেতো যে, এখনই যেন তারা পাগুলো সবার সামনে দেখাতে যাচ্ছে, তবুও দেখাচ্ছে না!
গায়ের গন্ধ
গায়ের গন্ধ যে কারো জন্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ঘর থেকে বেরোবার সময় এজন্য আমরা প্রতিদিনই কোনো না কোনো সুগন্ধী মেখে তারপর বের হই।
ব্যাতিক্রম ছিলো না প্রাচীন চীনেও। তৎকালে ধনী পরিবারের নারীরা কোমরে সুগন্ধি দ্রব্যের ব্যাগ নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। সম্রাটের সামনে কোনো মানুষকে অবশ্যই লবঙ্গ খেয়ে যেতে হতো যাতে তার মুখের দুর্গন্ধ সম্রাটের নাকে না যায়!
এত কসরত করে সুগন্ধি দ্রব্য ব্যবহারের মতো আর্থিক সঙ্গতি ছিলো না দরিদ্রদের। তবে তারাও নিজেদের পরিষ্কার রাখতো। কীভাবে? প্রাচীন এক চীনা ডাক্তারের কথা জানা যায় যিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন বছরে অন্তত একবার হলেও প্রস্রাব দিয়ে বগল পরিষ্কার করতে! দেশটির উত্তরাঞ্চলের মানুষেরা তো পুরো শীতকাল গোসলের নামটিও মুখে আনতো না। কারণ তারা ভাবতো যে, ঠান্ডা পানিতে গোসল করলে তাদের অসুখ করবে।
টাওবাদীরা ছিলো আরো এক ডিগ্রি উপরে। তারা বিশ্বাস করতো যে, গোসলের ফলে অসুখ ছড়ায়! তাই গোসল করে নিজেদের ‘অপবিত্র’ করার মতো কাজ থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকতো তারা!
উকুন যখন খাদ্য
এতদিন ধরে গোসল না করলে শরীরে যে এর প্রভাব দেখা দিবে, তা তো সবারই জানা কথা। প্রাচীনকালে চীনে হয়েছিলোও ঠিক এমনটি। দেশটিতে যেন উকুনের মেলা বসেছিলো। অপরিষ্কার মানুষগুলোর মাথায় একেবারে কিলবিল করতো উকুনের দল।
মজার ব্যাপার হলো, তৎকালীন ডাক্তাররা সেসব উকুন দিয়েই রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন! কীভাবে? চীনের একটি প্রাচীন মেডিকেল ডকুমেন্ট থেকে জানা যায় যে, উকুন যদি রোগীর সারা শরীরে হেঁটে বেড়াতো, তাহলে ডাক্তার বলতেন যে রোগী বাঁচবে! পক্ষান্তরে উকুনগুলো যদি রোগীর গা বেয়ে উঠতে যেয়ে একটু পরপরই নিচে পড়ে যেতো, তাহলে ডাক্তার রোগীর মৃত্যুর আশঙ্কা করতেন!
এ সমস্যায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ছিলো দেশটির দরিদ্র জনগোষ্ঠী। তবে তারাও উকুন থেকে মুক্তি পেতো এক বিচিত্র উপায়ে। যখনই ইচ্ছা হতো, তখনই মাথা থেকে উকুন এনে খেয়ে নিতো তারা!
খোজাকরণ
দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে চায় না এমন লোক খুঁজে যাবে না কখনোই। প্রাচীনকালে চীনও এর ব্যতিক্রম ছিলো না। তবে পছন্দমতো চাকরি খুঁজে না পেলে তারা এমন এক উপায় বেছে নিতো যা জেনে বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই।
প্রাচীনকালে চীনে সম্রাটের চাকর হিসেবে খোজাদের (Eunuch) বেশ সমাদর ছিলো। তাই একজন গরীব লোক যদি চাকরি না পেতো, তাহলে প্রায় সময়ই তাকে স্বেচ্ছায় নিজেকে খোজা বানাতে দেখা যেতো। এমনকি অনেক বাবা-মা তো তাদের ছেলেদের একেবারে শৈশবেই খোজা বানিয়ে দিতেন!
এ খোজাদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হয়ে যায় মিং রাজবংশের সময়কালে। তখন দেশজুড়ে প্রায় ১,০০,০০০ খোজা রাজপরিবারের হয়ে কাজ করতো। শেষে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিলো যে, চাকরির সন্ধানে আসা সেসব খোজাদের তাড়িয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলো রাজ কর্তৃপক্ষ। ফলে যারা নিজেদের জীবনের অন্যতম একটি সুখের চিন্তা (!) বিসর্জন দিয়েছিলো একটিমাত্র ভালো চাকরির আশায়, তাদের অনেকেই নিজেদের আবিষ্কার করে ফুটপাতে ভিক্ষারত অবস্থায়!
অর্থকরী মানবমল
প্রকৃতির বড় ডাকে সাড়া দিয়ে প্রাপ্ত দুর্গন্ধযুক্ত, হলুদাভ পদার্থটিরও সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতেন প্রাচীন চীনের অনেক কৃষক। তারা তাদের টয়লেটটি শূকর থাকার জায়গার উপর এমনভাবে বানাতেন, যাতে সব পায়খানা এসে নিচে শূকরদের খাবার রাখার একটি নির্ধারিত জায়গায় জমা হয়। এরপর সেই পায়খানাই মজা করে খেতো শূকরেরা। ওদিকে নিজেদের কিছুটা খরচও সাশ্রয় হতো সেসব দরিদ্র কৃষকের।
১০০০ শতকের কাছাকাছিতে চীনের শহরাঞ্চলে গণশৌচাগার চালু হলে তা আরো বড় ব্যবসার দুয়ার খুলে দেয়। তখন অনেক কৃষকই সেসব শৌচাগার থেকে পায়খানা সংগ্রহ করতে ছুটে যেতেন শহরগুলোতে। পরবর্তীতে সেগুলো তারা তাদের ক্ষেতে সস্তা সার হিসেবে ব্যবহার করতেন!
মূত্রের পিল
প্রকৃতির ছোট ডাকে সাড়া দিয়ে ত্যাগ করা মানবমূত্রও বাদ যায় নি চাইনিজদের ওষুধের তালিকা থেকে।
এজন্য তারা দেড়শ গ্যালন মানবমূত্র সংগ্রহ করে সেগুলো বিশাল বড় এক পাত্র নিতো। তারপর সেটি উত্তপ্ত করা হতো যতক্ষণ না তা বাষ্পীভূত হয়ে উড়ে যাচ্ছে। এরপর সেই পাত্রে অবশিষ্ট হিসেবে থেকে যেত কিছু স্ফটিক যাকে তারা বলতো ‘অটাম মিনারেল (Autumn Mineral)’। এ স্ফটিককেই তারা ওষুধ হিসেবে খেতো! খাওয়ারও ছিলো বিশেষ নিয়ম। সকালের নাস্তায় গরম স্যুপ কিংবা ওয়াইনের সাথে সেই স্ফটিকের ৫-৭টি পিল মিশিয়ে খেয়ে নিতো প্রাচীন চাইনিজরা। এগুলোকে তারা হরমোন পিল হিসেবে ব্যবহার করতো।
ওষুধ যখন মানববর্জ্য
প্রাচীন চীনের ডাক্তাররা পানির সাথে গাঁজন প্রক্রিয়া শেষে প্রাপ্ত একজন সুস্থ ব্যক্তির মল মিশিয়ে একটি মিশ্রণ তৈরি করতে যার নাম ছিলো ‘হলুদ স্যুপ’। মূলত ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীদেরকেই খেতে দেয়া হতো এ হলুদ স্যুপটি। পুরোটা শেষ না করে উঠতে দেয়া হতো না কোনো রোগীকেই! পাঠকদের গা গুলিয়ে উঠলেও মজার ব্যাপার হলো মানবমল দিয়ে তৈরি এ স্যুপ কিন্তু আসলেই ডায়রিয়ার বিরুদ্ধে বেশ কার্যকর ছিলো।