১০ জুন, ১৯৬৭। তৃতীয় আরব–ইসরায়েলি যুদ্ধের শেষ দিন। মাত্র ৬ দিনের যুদ্ধে তিনটি আরব রাষ্ট্র – মিসর, সিরিয়া ও জর্দান – শোচনীয়ভাবে ইসরায়েলের নিকট পরাজিত হয়েছে, এবং প্রতিটি ফ্রন্টে ইসরায়েলি অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে অবস্থিত সোভিয়েত নৌবহরের একটি ফ্রিগেটের একজন তরুণ অফিসারকে এক অদ্ভুত নির্দেশ দেয়া হলো। ইউরি খ্রিপুনকভ নামক সেই অফিসারকে বলা হলো, ৩০ সদস্যের একটি ‘স্বেচ্ছাসেবক’ বাহিনী নিয়ে তাকে ইসরায়েলি উপকূলে অবতরণ করতে হবে। তাদের লক্ষ্যবস্তু হবে ইসরায়েলি বন্দরনগরী হাইফা। তাদের পর আরেকটি শক্তিশালী সৈন্যদল হাইফায় অবতরণ করবে এবং সোভিয়েত যুদ্ধবিমান তাদের অগ্রযাত্রায় সহায়তা করবে।
খ্রিপুনকভের সৌভাগ্য যে, সেদিন শেষ পর্যন্ত তাকে এই বিপদসঙ্কুল অভিযানে অংশগ্রহণ করতে হয়নি। কারণ ঐদিনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের আহ্বানে ইসরায়েল যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয় এবং এর মধ্য দিয়ে আরবদের জন্য চরম বিপর্যয়কর এই ‘৬ দিনের যুদ্ধে’র অবসান ঘটে।
১৯৬৭ সালের ৫ জুন মিসরীয় বিমানবাহিনীর ওপর ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর অতর্কিত প্রচণ্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে তৃতীয় আরব–ইসরায়েলি যুদ্ধ আরম্ভ হয়। আরব রাষ্ট্রগুলোর মতে, এটি ছিল সম্পূর্ণ বিনা উস্কানিতে আরবদের বিরুদ্ধে ‘ইসরায়েলি আগ্রাসন’ এবং আরবদের ভূমি গ্রাসের অপচেষ্টা মাত্র। অন্যদিকে, ইসরায়েলিদের মতে, এটি ছিল সম্ভাব্য আরব আগ্রাসন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ইসরায়েল কর্তৃক পরিচালিত একটি ‘প্রিভেন্টিভ স্ট্রাইক’ বা ‘নিবারণমূলক আঘাত’। এই যুদ্ধ যে ইসরায়েল আরম্ভ করেছিল সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু এই যুদ্ধ অকস্মাৎ শুরু হয়নি। বরং পূর্ববর্তী মাসগুলোতে ইসরায়েল ও আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যে ক্রমবর্ধমান দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, এই যুদ্ধ ছিল তারই বহিঃপ্রকাশ।
১৯৬৬ সাল থেকেই আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের দ্বন্দ্ব খারাপের দিকে মোড় নিচ্ছিল। ১৯৬৭ সালের মে মাসের মাঝামাঝিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন মিসরকে জানায় যে, ইসরায়েল সিরীয়–ইসরায়েলি সীমান্তে সৈন্য জমায়েত করছে। সিরিয়া ও মিসরের মধ্যে একটি সামরিক সহযোগিতা চুক্তি ছিল, সুতরাং মিসর মিসরীয়–ইসরায়েলি সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন করতে শুরু করে। ১৬ মে মিসরীয় সৈন্যরা সিনাই উপদ্বীপে প্রবেশ করে, ১৯ মে মিসরীয়রা সিনাই থেকে ‘জাতিসংঘ ইমার্জেন্সি ফোর্স’কে বহিষ্কার করে এবং ২২ মে তিরান প্রণালীতে ইসরায়েলি জাহাজ চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ৩০ মে মিসর ও জর্দানের মধ্যে একটি সামরিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, এবং ৩১ মে জর্দানের আমন্ত্রণে ইরাক জর্দানে সৈন্য মোতায়েন করে।
ইসরায়েল ইতোপূর্বেই ঘোষণা দিয়েছিল, তিরান প্রণালী অবরুদ্ধ করাকে তারা ‘যুদ্ধ ঘোষণা’ হিসেবে বিবেচনা করবে, এবং নিজেদের চারপাশে আরব রাষ্ট্রগুলোর ‘ফাঁস’ দৃঢ় হতে দেখে ইসরায়েলি মন্ত্রিসভা ৪ জুন আরব রাষ্ট্রগুলোর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আগেই আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ৫ জুন সকালে ইসরায়েলি বিমানবাহিনী ‘অপারেশন ফোকাস’ আরম্ভ করে, এবং মিসরীয় বিমানবাহিনীকে প্রায় সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়। এর মধ্য দিয়ে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
এটি হলো এই যুদ্ধের উৎপত্তি সম্পর্কে প্রচলিত ব্যাখ্যা। পশ্চিমা ও ইসরায়েলি ইতিহাসবিদদের মতে, ১৯৬৭ সালের মে থেকে যে আরব–ইসরায়েলি সঙ্কট শুরু হয়েছিল, তার জন্য দায়ী ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক মিসরকে সরবরাহ করা ভুল তথ্য। ১৯৬৭ সালের মে মাসে মস্কো মিসরকে জানায় যে, ইসরায়েল সিরীয় সীমান্তে ৮ ব্রিগেড সৈন্য মোতায়েন করেছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এসময় সিরীয়–ইসরায়েলি সীমান্তে মাত্র এক কোম্পানি ইসরায়েলি প্যারাট্রুপার মোতায়েনকৃত ছিল। পশ্চিমা ও ইসরায়েলি ইতিহাসবিদরা সাধারণত মনে করেন, মস্কোর উদ্দেশ্য ছিল ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল তথ্য সরবরাহের মাধ্যমে আরব রাষ্ট্রগুলোকে ভীতি প্রদর্শন এবং এর মধ্য দিয়ে তাদেরকে মস্কোর ওপর আরো নির্ভরশীল করে তোলা। কিন্তু আরব রাষ্ট্রগুলো এই তথ্য পেয়ে মাত্রাতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে, যার ফলে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
এই তত্ত্ব অনুযায়ী, নতুন একটি আরব–ইসরায়েলি যুদ্ধ শুরুর কোনো উদ্দেশ্য মস্কোর ছিল না, বরং পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। কিন্তু ইসরায়েলি সাংবাদিক ও ইতিহাসবিদ ইসাবেলা গিনর এবং গিডিয়ন রেমেজ এই তত্ত্ব সমর্থন করেন না। ‘Foxbats over Dimona: The Soviets’ Nuclear Gamble in the Six-Day War’ বইতে তারা দাবি করেছেন, মস্কো ইচ্ছাকৃতভাবে ১৯৬৭ সালের আরব–ইসরায়েলি যুদ্ধ আরম্ভ করিয়েছিল, এবং মস্কোর মূল উদ্দেশ্য ছিল ইসরায়েলের পারমাণবিক প্রকল্পকে ধ্বংস করে দেয়া!
১৯৫৬ সালে মিসর কর্তৃক সুয়েজ খাল জাতীয়করণের পর ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইসরায়েল সম্মিলিতভাবে মিসরের ওপর আক্রমণ চালায়, এবং এই আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল মিসরের আরব জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রপতি গামাল আব্দেল নাসেরকে ক্ষমতাচ্যুত করা। কিন্তু তাদের এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। কারণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সমর্থন দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল, অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন মিসর থেকে ব্রিটিশ, ফরাসি ও ইসরায়েলি সৈন্য অবিলম্বে প্রত্যাহার করে নেয়া না হলে লন্ডন, প্যারিস ও তেল আভিভে পারমাণবিক আক্রমণ চালানোর হুমকি দিয়েছিল। সেসময় ব্রিটেন, ফ্রান্স বা ইসরায়েল কারোরই পারমাণবিক অস্ত্র ছিল না এবং এর ফলে তারা মিসর থেকে পশ্চাৎপসরণে বাধ্য হয়।
১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকেই ইসরায়েল পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রচেষ্টায় লিপ্ত ছিল, এবং ১৯৫৬ সালের সোভিয়েত ‘পারমাণবিক ব্ল্যাকমেইলে’র পর তারা এই প্রচেষ্টাকে ত্বরান্বিত করে। ফ্রান্সের সক্রিয় সহযোগিতায় ইসরায়েলি পরমাণু প্রকল্প শুরু হয় এবং ১৯৬৬ সাল নাগাদ তারা প্রথম পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে সক্ষম হয়। অবশ্য ইসরায়েল কখনোই তাদের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র থাকার কথা স্বীকার করেনি, এবং এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলিরা এই ব্যাপারে মৌনতা অবলম্বন করে আছে।
কিন্তু ইসরায়েলের এই ‘অতি গোপনীয়’ পরমাণু প্রকল্প গোপন থাকেনি। ১৯৬০ সালের জুলাইয়ে ইসরায়েলি গোয়েন্দারা দেশটির পরমাণু প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত একজন বিজ্ঞানীকে চেকোস্লোভাক গোয়েন্দা সংস্থার ‘গুপ্তচর’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। কুর্ট সিট্টে নামক সেই বিজ্ঞানী ছিলেন একজন জাতিগত জার্মান, যিনি এসেছিলেন তৎকালীন চেকোস্লোভাকিয়ার সুদেতেন অঞ্চল থেকে। তিনি ইসরায়েলি পরমাণু প্রকল্প সম্পর্কে চেকোস্লোভাক গোয়েন্দা সংস্থাকে জানিয়ে দেন, এবং যথারীতি চেকোস্লোভাকরা তাদের মিত্র সোভিয়েতদের এই তথ্য জানিয়ে দেয়। সোভিয়েতরা এই তথ্য মিসরীয়দের জানিয়ে দেয়, এবং মিসরীয় রাষ্ট্রপতি নাসের ডিমোনায় অবস্থিত ইসরায়েলি পারমাণবিক কেন্দ্র উড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেন। কিন্তু এরপর কিছুদিনের জন্য এই বিষয়টি আলোচনার বাইরে চলে যায়।
১৯৬৬ সালে এই বিষয়টি আবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। ইসরায়েলের পারমাণবিক সক্ষমতাকে সোভিয়েতরা মধ্যপ্রাচ্যে তাদের প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টার প্রতি হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছিল, সোভিয়েত নেতৃবৃন্দের একাংশের মধ্যে তীব্র ইহুদিবিদ্বেষী মনোভাব বিদ্যমান ছিল এবং ১৯৬৭ সালে বলশেভিক বিপ্লবের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে মস্কো মধ্যপ্রাচ্যে তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে একটি বড় ধরনের সাফল্য অর্জন করতে আগ্রহী ছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সরল: ইসরায়েলের গোপন পরমাণু প্রকল্পকে ধ্বংস করে দেয়া।
কিন্তু ইসরায়েলের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ, সুতরাং কোনো ‘ন্যায়সঙ্গত’ কারণ ছাড়া ইসরায়েলের ওপর সোভিয়েত আক্রমণের ফলে সরাসরি মার্কিন–সোভিয়েত যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারত। এজন্য মস্কোর উদ্দেশ্য ছিল, আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের নতুন একটি যুদ্ধের সূচনা করা, এবং তাতে ইসরায়েল যেন আগ্রাসনকারী হিসেবে চিহ্নিত হয় সেটি নিশ্চিত করা। তাহলে মস্কো আরব রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে ‘ইসরায়েলি আগ্রাসন’ প্রতিহত করার অজুহাতে এই যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করতে পারবে এবং ইসরায়েলি পরমাণু প্রকল্প ধ্বংস করে দেয়ার সুযোগ পাবে।
এই পরিকল্পনাটি সক্রিয় রূপ লাভ করে ১৯৬৬ সালের ২২–২৫ নভেম্বর মিসরীয় সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আব্দেল হাকিম আমেরের মস্কো সফরের সময়। আমের সোভিয়েত প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্শাল অফ দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন আন্দ্রেই গ্রেচকোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তাদের গৃহীত পরিকল্পনা ‘গ্রেচকো–আমের পরিকল্পনা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী, সম্ভাব্য ইসরায়েলি আক্রমণের প্রাক্কালে মিসরীয় সৈন্যরা সিনাই উপদ্বীপে জমায়েত হবে, এবং ইসরায়েলি আক্রমণের প্রথম ধাক্কা প্রতিহত করে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে অগ্রসর হবে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের সময় ইসরায়েলি সৈন্যরা সিনাই দখলকালে এই পরিকল্পনা সংক্রান্ত নথিপত্র হস্তগত করে, এবং এই পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে সোভিয়েতদের জড়িত থাকার প্রমাণও সংগ্রহ করে।
এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভূমধ্যসাগরে তাদের সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করতে থাকে এবং সেখান থেকে মার্কিন উপস্থিতি হ্রাস করার চেষ্টা চালায়। ১৯৬৭ সালের এপ্রিলে চেকোস্লোভাকিয়ায় অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট নেতাদের একটি সম্মেলনে সোভিয়েত ইউনিয়ন কমিউনিস্ট পার্টির মহাসচিব লিওনিদ ব্রেঝনেভ পূর্ব ভূমধ্যসাগর থেকে মার্কিন ৬ষ্ঠ নৌবহর প্রত্যাহার করে নেয়ার দাবি জানান। ১৯৬৭ সালের জুনে আরব–ইসরায়েলি যুদ্ধ শুরুর পর তাঁর দাবি কার্যত পূরণ হয়, কারণ এসময় আরব রাষ্ট্রগুলো অভিযোগ করছিল যে, মার্কিন বিমানবাহিনী ইসরায়েলের পক্ষে যুদ্ধ করছে। এই অভিযোগ খণ্ডন করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ৬ষ্ঠ নৌবহরকে পূর্ব ভূমধ্যসাগর থেকে দূরে সরিয়ে নেয়, যার ফলে যুদ্ধ চলাকালে মস্কো পূর্ব ভূমধ্যসাগরে স্বাধীনভাবে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ লাভ করে।
সোভিয়েতরা একদিকে পূর্ব ভূমধ্যসাগর থেকে মার্কিন নৌবহর প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছিল, অন্যদিকে সেখানে নিজেদের উপস্থিতি বৃদ্ধি করছিল। আরব–ইসরায়েলি যুদ্ধ শুরুর আগে সেখানে প্রায় ৭০টি সোভিয়েত নৌযান মোতায়েনকৃত অবস্থায় ছিল, যাদের মধ্যে ছিল ৩০টি বৃহৎ যুদ্ধজাহাজ ও ১০টি সাবমেরিন, যেগুলোর মধ্যে পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রবাহী সাবমেরিনও ছিল। তাদের ওপর নির্দেশ ছিল, ইসরায়েল যদি মিসর বা সিরিয়ার ওপর পারমাণবিক আক্রমণ চালায়, তাহলে যেন অবিলম্বে ইসরায়েলের ওপর পাল্টা পারমাণবিক আক্রমণ চালানো হয়! একই সময়ে সোভিয়েতরা মিসর ও সিরিয়াকে বিভিন্ন অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম প্রেরণ করতে শুরু করে, কিন্তু আরবরা এগুলোর ব্যবহারবিধি রপ্ত করার পর্যাপ্ত সময় বা সুযোগ পায়নি।
১৯৬৭ সালের ১৭ মে দুইটি ‘রহস্যময়’ বিমান ইসরায়েলের ডিমোনা শহরের সন্নিকটে নেগেভ মরুভূমিতে অবস্থিত নেগেভ পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রের ওপর দিয়ে উড়ে যায়। ডিমোনা কেন্দ্রটি মার্কিন–নির্মিত ‘হক’ বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপনাস্ত্র দ্বারা সুরক্ষিত ছিল, কিন্তু সেগুলো অনুপ্রবেশকারী বিমানগুলোকে আক্রমণ করেনি এবং ডিমোনার আশেপাশে থাকা রাডারেও বিমানগুলো ধরা পড়েনি। কেবল ইসরায়েলের কেন্দ্রীয় রাডারে বিমানগুলোর উপস্থিতি ধরা পড়েছিল। কয়েকদিন পর ২৬ মে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। প্রাথমিকভাবে ইসরায়েলিরা ধারণা করেছিল, এগুলো ছিল সোভিয়েত–নির্মিত মিসরীয় ‘মিকোইয়ান–গুরেভিচ মিগ–২১’ যুদ্ধবিমান, কিন্তু তাদের এই ধারণার পক্ষে কোনো প্রমাণ ছিল না।
তদুপরি, পরবর্তীতে যুদ্ধের সময় দেখা যায় যে, ইসরায়েলিরা খুব সহজেই মিসরীয় বৈমানিকদের দ্বারা চালিত বিমান ধ্বংস করতে সক্ষম। সেক্ষেত্রে ইসরায়েলিরা এই বিমানগুলোকে ধ্বংস করতে পারল না কেন? কিছু কিছু ইসরায়েলি বিশ্লেষকের মতে, এগুলো ছিল প্রকৃতপক্ষে সোভিয়েত বৈমানিকদের দ্বারা চালিত ‘মিকোইয়ান–গুরেভিচ মিগ–২৫’ যুদ্ধবিমান (যেগুলোকে ন্যাটো ‘ফক্সব্যাট’ নাম দিয়েছিল)। এই বিমানগুলো তখনও পরীক্ষামূলক পর্যায়ে ছিল এবং সেগুলোকে ধ্বংস করার ক্ষমতা ইসরায়েলের তখনো ছিল না। তাদের ধারণা, সোভিয়েতরা ডিমোনায় অবস্থিত ইসরায়েলি পরমাণু কেন্দ্র ধ্বংস করতে চাচ্ছিল এবং এজন্যই এটি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে বিমানগুলোকে প্রেরণ করেছিল। অবশ্য ইসরায়েলিরা এই ঘটনাগুলো চেপে যায়, এবং যুক্তরাষ্ট্রকেও তারা এ সম্পর্কে কিছু জানায়নি।
সামগ্রিকভাবে, ‘ফক্সব্যাটস ওভার ডিমোনা’র লেখকদের ধারণা, মস্কোর উদ্দেশ্য ছিল আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের দ্বন্দ্ব তীব্র করে তুলে আরবদের ওপর আক্রমণ করার জন্য ইসরায়েলকে ‘উস্কানি’ দেয়া। এরপর একদিকে আরবরা ইসরায়েলি আক্রমণ প্রতিহত করে ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে, অন্যদিকে সোভিয়েতরা পূর্ব ভূমধ্যসাগরে অবস্থিত তাদের নৌবহর থেকে ইসরায়েলি পরমাণু প্রকল্পের ওপর আক্রমণ চালাবে এবং সোভিয়েত সৈন্যরা ইসরায়েলে অবতরণ করবে। এর ফলে একদিকে যেমন ইসরায়েলের পারমাণবিক সামর্থ্য ধ্বংস হবে, অন্যদিকে তেমনি ইসরায়েলকে ১৯৪৭ সালের সীমানায় প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য করার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি বড় বিজয় অর্জিত হবে।
কিন্তু ইসরায়েলি আক্রমণ যে এতটা তীব্র এবং আরবদের জন্য এতটা ধ্বংসাত্মক হবে, সেটি মস্কো ধারণা করতে পারেনি। যুদ্ধের প্রথম ৬ ঘণ্টার মধ্যে মিসরীয় বিমানবাহিনী আকাশে উড্ডয়নের আগেই ইসরায়েলি বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর মিসরীয় সেনাবাহিনী ‘এয়ার কাভার’ ছাড়া ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতে গিয়ে পুরোপুরিভাবে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। অন্যান্য আরব রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে।
এর ফলে মস্কোর দৃষ্টিতে পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে। মস্কো ভেবেছিল, আরবরা ইসরায়েলি আক্রমণ প্রতিহত করতে পারবে কিংবা অন্তত ইসরায়েলিদের সঙ্গে সমান তালে যুদ্ধ করতে পারবে, এবং এর ফলে যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নকে বড় ধরনের কোনো হস্তক্ষেপ করতে হবে না। বরং তারা সীমিত মাত্রার একটি অভিযান পরিচালনার মাধ্যমেই তাদের উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারবে। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে আরবদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের পরিপূর্ণ সাফল্যের ফলে পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়ায় যে, ইসরায়েলকে তখন পরাজিত করতে হলে মস্কোকে বড় মাত্রার একটি অভিযান পরিচালনা করতে হতো, এবং সেক্ষেত্রে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেত। এছাড়া, নাসের প্রথমে মিসরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কথা লুকানোর চেষ্টা করেন, যার ফলে যুদ্ধক্ষেত্রের প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে মস্কোর স্পষ্ট ধারণা ছিল না।
ফলে মস্কো তাদের মূল পরিকল্পনা (ইসরায়েলি পরমাণু প্রকল্প ধ্বংস করা) পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়, এবং শেষপর্যন্ত আরব–ইসরায়েলি যুদ্ধে সরাসরি হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকে। যুদ্ধের শেষ দিনে ইসরায়েলি আক্রমণে বিপর্যস্ত সিরিয়াকে রক্ষা করার উদ্দেশ্য মস্কো ইসরায়েলি উপকূলে একটি সীমিত আক্রমণ পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু ইসরায়েলিরা যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়ায় সোভিয়েতদের এই পরিকল্পনাটিও পরিত্যক্ত হয়। এভাবে ইসরায়েল কর্তৃক পরিচালিত ‘অপারেশন ফোকাসে’র সাফল্য ইসরায়েলি পরমাণু প্রকল্পকে সম্ভাব্য সোভিয়েত আক্রমণ থেকে রক্ষা করে।
উল্লেখ্য, ‘ফক্সব্যাটস ওভার ডিমোনা’ বইটির বক্তব্য ১৯৬৭ সালের আরব–ইসরায়েলি যুদ্ধের প্রচলিত ইতিহাসের সঙ্গে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। মস্কোর কর্মকর্তারা এই তত্ত্বকে অস্বীকার করেছেন, কিন্তু তাতে কিছুই প্রমাণ হয় না। কারণ আরব–ইসরায়েলি যুদ্ধ সংক্রান্ত সকল সোভিয়েত নথিপত্র এখনও ‘ক্লাসিফায়েড’ রয়েছে, এবং রুশ কর্মকর্তাদের মতে, আরব–ইসরায়েলি সংঘাতের স্থায়ী সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ‘শান্তি রক্ষা’র স্বার্থে এসব প্রকাশ করা হবে না। অন্যদিকে, ইসরায়েলি কর্মকর্তারাও এই ব্যাপারে রুশদের মতোই গোপনতাপ্রিয়, এবং তারা আদৌ কখনও এই সংক্রান্ত গোপন নথিপত্র প্রকাশ করবেন কিনা সেটিও সন্দেহের বিষয়। সুতরাং, একদিকে উপরে বর্ণিত তথ্যকে সত্য প্রমাণ করার কোনো উপায় নেই, অন্যদিকে সেটিকে অকাট্যভাবে মিথ্যা প্রমাণ করারও কোনো সুযোগ নেই।