ধরা যাক, বাংলাদেশ দক্ষিণ কোরিয়ার কাছ থেকে কিছু ইলেক্ট্রনিক সরঞ্জাম আমদানি করল। বাংলাদেশি সরকার যদি বাংলাদেশি টাকায় এর মূল্য পরিশোধ করতে চায়, তাহলে কিন্তু হবে না। বাংলাদেশকে তার আমদানিকৃত দ্রব্যের মূল্য মার্কিন ডলারে (United States dollar) পরিশোধ করতে হবে। অনুরূপভাবে, দক্ষিণ কোরিয়া যদি বাংলাদেশের কাছ থেকে কিছু আমদানি করতে চায়, তাহলে দক্ষিণ কোরিয়াকেও আমদানিকৃত দ্রব্যের মূল্য মার্কিন ডলারে পরিশোধ করতে হবে। আবার, সোমালি জলদস্যুরা যখন কোনো জাহাজের নাবিকদের জিম্মি করে, তখন তারাও মার্কিন ডলারেই ‘মুক্তিপণ’ দাবি করে। প্রশ্ন হলো, মার্কিন ডলারের মধ্যে কী এমন আছে, যেজন্য বাংলাদেশের সরকার থেকে সোমালি জলদস্যু পর্যন্ত সকলেই এর প্রতি আকৃষ্ট?
এর উত্তর হচ্ছে, মার্কিন ডলার বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর মুদ্রা। এটি বর্তমান বিশ্বের প্রধান ‘রিজার্ভ মুদ্রা’। বিশ্বের মোট অর্থনৈতিক লেনদেনের প্রায় ৯০% মার্কিন ডলারের মাধ্যমে হয়ে থাকে। এক হিসেব অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে বর্তমানে প্রায় ১.৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের কাগুজে ও ধাতব মুদ্রা ছড়িয়ে আছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য মার্কিন ডলার প্রায় অপরিহার্য। কিন্তু মার্কিন ডলার কীভাবে ‘অপরিহার্য’ হয়ে উঠলো? এই প্রশ্নের উত্তরটি স্পষ্টভাবে জানতে হলে একটু পুরনো ইতিহাসে ফিরে যেতে হবে।
Money বা ‘অর্থ’কে সাধারণত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। ‘কমোডিটি মানি’ (Commodity Money), ‘রিপ্রেজেন্টেটিভ মানি’ (Representative Money) এবং ফিয়াট মানি (Fiat Money)। ‘কমোডিটি’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে পণ্য। ‘কমোডিটি মানি’ হচ্ছে সেই ধরনের অর্থ যার কোনো অন্তর্নিহিত মূল্য আছে। যেমন: প্রাচীনকাল থেকে স্বর্ণ ও রৌপ্যকে সরাসরি বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হতো। স্বর্ণ বা রৌপ্যের নিজস্ব মূল্য আছে। স্বর্ণমুদ্রা বা রৌপ্যমুদ্রাকে গলিয়ে ফেলা হলেও এর মূল্য হ্রাস পায় না। এজন্য স্বর্ণমুদ্রা বা রৌপ্যমুদ্রা এগুলো হলো কমোডিটি মানি। মানব ইতিহাসের বড় একটি সময় জুড়ে অর্থনৈতিক লেনদেনের জন্য কমোডিটি মানি ব্যবহৃত হতো।
কিন্তু পরবর্তীতে ইউরোপে কাগুজে মুদ্রার প্রচলন ঘটে এবং ক্রমশ তা বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। কাগুজে মুদ্রার কোনো অন্তর্নিহিত মূল্য নেই, কার্যত এগুলো কাগজের টুকরো ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু এই কাগুজে মুদ্রাগুলো কোনো ধাতুর সঙ্গে (প্রধানত স্বর্ণ) সম্পর্কিত ছিল। অর্থাৎ, এই কাগুজে মুদ্রাগুলোর মান কোনো রাষ্ট্রের স্বর্ণের (ক্ষেত্রবিশেষে রৌপ্যের) মজুদের ওপর নির্ভর করত। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যে বিশ্বের অধিকাংশ উন্নত রাষ্ট্র ‘স্বর্ণমান’ (gold standard) গ্রহণ করে। এই ব্যবস্থায় স্বর্ণের মূল্য নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়, এবং এই নির্দিষ্ট মূল্যে যেকোনো সময় যেকোনো পরিমাণ কাগুজে মুদ্রাকে স্বর্ণে রূপান্তরিত করা যেত (অর্থাৎ, যেকোনো সময়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ কাগুজে মুদ্রার পরিবর্তে নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণ পাওয়া যেত)। এই ‘অর্থ’কে বলা হয় ‘রিপ্রেজেন্টেটিভ মানি’ বা ‘কমোডিটি–বেজড মানি’, যেহেতু এই কাগুজে মুদ্রাগুলোর সঙ্গে স্বর্ণের সরাসরি সংযোগ ছিল।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটেন ছিল বিশ্বের প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি এবং সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্য। তাদের স্বর্ণের মজুদ ছিল সবচেয়ে বেশি, এবং লন্ডন ছিল বিশ্ব ব্যাংকিংয়ের কেন্দ্র। এজন্য ব্রিটিশ মুদ্রা ‘পাউন্ড স্টার্লিং’ ছিল সেসময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী মুদ্রা এবং বিশ্ব বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এটিকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হতো। কিন্তু ১৮৭০–এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়। এরপর বিংশ শতাব্দীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো পরস্পরের বিরুদ্ধে এক ধ্বংসাত্মক সংগ্রামে লিপ্ত হয়। যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহের জন্য রাষ্ট্রগুলো তাদের স্বর্ণ মজুদের ভিত্তিতে যে পরিমাণ মুদ্রা ছাপানো যেত, তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে কাগুজে মুদ্রা ছাপাতে শুরু করে। অন্যদিকে, যুদ্ধের প্রথম তিন বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে এবং ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর নিকট সামরিক সরঞ্জাম ও রসদপত্র রপ্তানি করে নিজেদের অর্থনীতিকে আরো সমৃদ্ধ করে তোলে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ব্রিটেনসহ অধিকাংশ রাষ্ট্র ‘স্বর্ণমান’ পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। অর্থাৎ, তখন থেকে আর এসব রাষ্ট্রের মুদ্রা স্বর্ণমানের ওপর নির্ভরশীল ছিল না। মুদ্রার মানকে বাজারের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়, যেটাকে অর্থনীতির ভাষায় বলা হয় ‘free floating exchanges’। এ ধরনের মুদ্রা, যেগুলো কোনো পণ্যের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট নয়, সেগুলোকে বলা হয় ‘ফিয়াট মানি’। অর্থাৎ, এখন আর স্বর্ণের মূল্য নির্দিষ্ট রইল না, বরং সেটি চাহিদা ও যোগানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ল।
কিন্তু মার্কিন ডলার তখনো ফিয়াট মানিতে পরিণত হয়নি। এটি তখনো ছিল স্বর্ণমানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তদুপরি, মার্কিন অর্থনীতি ছিল বিশ্বের বৃহত্তম এবং মার্কিন ব্যাংকিং ব্যবস্থা ছিল সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য। অন্যদিকে, যেসব রাষ্ট্র ‘ফিয়াট মানি’র প্রচলন ঘটিয়েছিল, তারা তাদের স্বর্ণের মজুদ বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেনি। মার্কিন ডলার যেহেতু তখনো স্বর্ণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল, তাই ডলারকে তারা বেশি নির্ভরযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করে এবং এটিকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অধিক হারে ব্যবহার করতে শুরু করে। ফলে পাউন্ড স্টার্লিং–এর পরিবর্তে মার্কিন ডলার বিশ্ব বাণিজ্যের মাধ্যম তথা ‘রিজার্ভ মুদ্রা’য় পরিণত হয়।
‘রিজার্ভ মুদ্রা’ (reserve currency) বা ‘বৈশ্বিক মুদ্রা’ (global currency) হচ্ছে এমন একটি মুদ্রা যেটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বহুল ব্যবহৃত এবং যে মুদ্রাকে রাষ্ট্রগুলো সঞ্চয় করে রাখে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে অধিকাংশ রাষ্ট্রের মুদ্রাই ছিল ‘ফিয়াট মানি’, যেগুলোর কোনো অন্তর্নিহিত মূল্য ছিল না। এজন্য তারা পরস্পরের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মার্কিন ডলার ব্যবহার করতে আরম্ভ করে, কারণ ডলার তখনো স্বর্ণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল। এর ফলে মার্কিন ডলার পরিণত হয় বৈশ্বিক রিজার্ভ মুদ্রায়।
এসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার স্বর্ণ মজুদ বৃদ্ধি করতে শুরু করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার রপ্তানিকৃত দ্রব্যাদির বিনিময়ে স্বর্ণ ছাড়া অন্য কিছু গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়, এবং এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বর্ণের মজুদ বাড়তে থাকে, আর অন্য রাষ্ট্রগুলোর স্বর্ণের মজুদ কমতে থাকে। এভাবে স্বর্ণ মজুদ বৃদ্ধি প্রসঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রপতি হার্বার্ট হুভার বলেছিলেন, “আমাদের স্বর্ণ আছে, কারণ আমরা [অন্য] সরকারগুলোকে বিশ্বাস করতে পারি না।”
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হলে অনেকটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। যুদ্ধের প্রথম প্রায় আড়াই বছর যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে, এবং যুদ্ধরত রাষ্ট্রগুলোর কাছে প্রচুর পরিমাণে সামরিক সরঞ্জাম ও রসদপত্র বিক্রি করতে থাকে। যথারীতি এসময়ও যুক্তরাষ্ট্র তার রপ্তানিকৃত দ্রব্যাদির বিনিময়ে স্বর্ণ ছাড়া অন্য কিছু গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়, এবং এই নীতির ফলে তাদের স্বর্ণমজুদ ফুলেফেঁপে ওঠে। ১৯৪৭ সালে বিশ্বের মোট মজুদকৃত স্বর্ণের ৭০% মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তগত ছিল।
এমতাবস্থায় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালেই অন্যান্য রাষ্ট্র অনুধাবন করতে পারে যে, যুদ্ধপরবর্তী সময়ে বিশ্ব অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকবে। যুদ্ধপরবর্তী অর্থনীতি যাতে স্থিতিশীল থাকে সেটি নিশ্চিত করার জন্য ১৯৪৪ সালে মিত্রপক্ষের ৪৪টি সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ার অঙ্গরাজ্যের ব্রেটন উডস নামক স্থানে আলোচনার জন্য সমবেত হয়। এসময় অন্যান্য সিদ্ধান্তের পাশাপাশি এই সিদ্ধান্তও গৃহীত হয় যে, মার্কিন ডলারের সঙ্গে স্বর্ণের যে সংযোগ ছিল, সেটি বজায় থাকবে, এবং আগের মতোই বিনা বাধায় মার্কিন ডলারকে ইচ্ছেমতো স্বর্ণে রূপান্তরিত করা যাবে। এই ব্যবস্থাটি ‘ব্রেটন উডস ব্যবস্থা’ হিসেবে পরিচিতি অর্জন করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কার্যত বিশ্বব্যাপী মার্কিন অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। মার্কিন ডলার পরিণত হয় বিশ্ব বাণিজ্যের মাধ্যমে, এবং মার্কিন ব্যাংকিং ব্যবস্থার তুলনামূলক নির্ভরযোগ্যতার কারণে অনেক রাষ্ট্র তাদের নিজস্ব ‘বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ’ও মার্কিন ব্যাঙ্কগুলোতে জমা রাখতে থাকে। এই ব্যবস্থা কার্যত যুক্তরাষ্ট্রকেই লাভবান করে, কারণ এর ফলে এই রাষ্ট্রগুলোর অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ে।
অবশ্য বিভিন্ন রাষ্ট্র ডলারের একাধিপত্যকে নেতিবাচকভাবে দেখতে থাকে। তাদের মতে, ডলারের একাধিপত্যকে স্বীকার করে নিয়ে কার্যত তারা নিজেদের অর্থে মার্কিনিদের জীবনমানের উন্নয়ন করছে। ১৯৬০–এর দশকে এক ফরাসি অর্থমন্ত্রী মার্কিন ডলারের এই একাধিপত্যকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘মাত্রাতিরিক্ত সুবিধা’ (exorbitant privilege) হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন।
অবশ্য ১৯৫০ ও ১৯৬০–এর দশকে পশ্চিম ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো ও জাপান বিশ্বযুদ্ধের ফলে সৃষ্ট দুর্দশা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়, এবং তারা তাদের মজুদকৃত মার্কিন ডলারের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বর্ণ কিনতে শুরু করে। এর ফলে মার্কিন স্বর্ণ মজুদ ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। অন্যদিকে, এসময় ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং মার্কিন রাষ্ট্রপতি লিন্ডন জনসনের ‘গ্রেট সোসাইটি’ প্রকল্পের ব্যয় নির্বাহের জন্য মার্কিন সরকার বিপুল পরিমাণে কাগুজে মুদ্রা ছাপতে শুরু করে। এর ফলে মার্কিন ডলারের সঙ্গে স্বর্ণের সংযোগ বজায় রাখা ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠতে থাকে।
১৯৭১ সালে মার্কিন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন বিশ্ব অর্থনীতিকে বড় একটি ধাক্কা দেন, যেটি ‘নিক্সন শক’ (Nixon Shock) নামে পরিচিতি অর্জন করে। তিনি ঘোষণা করেন যে, এখন থেকে আর মার্কিন ডলারের সঙ্গে স্বর্ণের কোনো সংযোগ নেই। অর্থাৎ, এখন আর রাষ্ট্রগুলো চাইলেই নির্দিষ্ট মূল্যে মার্কিন ডলারের বিনিময়ে স্বর্ণ কিনতে পারবে না। মার্কিন ডলারও বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের মুদ্রাগুলোর মতো ‘ফিয়াট মানি’তে পরিণত হয়। এর মধ্য দিয়ে কার্যত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক আধিপত্যকে ধরে রাখার প্রচেষ্টা চালায়।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, মার্কিন ডলারকে যখন ‘ফিয়াট মানি’তে পরিণত করা হলো, তখন অন্য রাষ্ট্রগুলো কেন মার্কিন ডলারকে ‘রিজার্ভ মুদ্রা’ হিসেবে ব্যবহার করা বন্ধ করল না? কেন তারা এখনো এই কাগুজে মুদ্রাকে আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করছে? সেসময়ের মার্কিন অর্থমন্ত্রী জন কনোলি পশ্চিম ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর অর্থমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকের সময় এই প্রসঙ্গে বলেছিলেন,“ডলার আমাদের মুদ্রা, কিন্তু তোমাদের সমস্যা।”
এর উত্তর হচ্ছে, যখন এই ‘নিক্সন শক’ কার্যকর হয়, তখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল বিশ্বের প্রধান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি। এমন কোনো রাষ্ট্র ছিল না, যেটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারে। তাছাড়া, বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ সমস্যা সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন ছিল রাজনৈতিক ও অভ্যন্তরীণভাবে স্থিতিশীল। মার্কিন ব্যাংকগুলোর ওপর তখনো ব্যবসায়ীদের আস্থা তুলনামূলকভাবে বেশি ছিল। সর্বোপরি, মার্কিন ডলারকে পরিত্যাগ করে বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য নতুন একটি রিজার্ভ মুদ্রার প্রয়োজন হতো। কিন্তু মার্কিন ডলারের পরিবর্তে কোন মুদ্রাকে রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে গ্রহণ করা হবে এই ব্যাপারেও বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কোনো ঐকমত্য ছিল না। ফলে মার্কিন ডলারের একাধিপত্যকে কোনো বাধারই সম্মুখীন হতে হয়নি।
স্বভাবতই বিশ্ব অর্থনীতিতে মার্কিন ডলারের এই একাধিপত্যকে মার্কিন সরকার নিজেদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ব্যবহার করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলো অভিযোগ করে যে, যুক্তরাষ্ট্র ডলারকে তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। যেমন: ইরানের ওপর আরোপিত মার্কিন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার একটি দিক হচ্ছে, ইরান আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মার্কিন ডলার ব্যবহার করতে পারে না। যেখানে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সিংহভাগ ডলারের মাধ্যমে ঘটে থাকে, সেখানে মার্কিন ডলার ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা ইরানের জন্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে লিপ্ত হওয়াকে অত্যন্ত কঠিন করে দিয়েছে। একইভাবে, রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার মতো রাষ্ট্রগুলোর ওপরও মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে, এবং এর ফলে এই রাষ্ট্রগুলো মার্কিন ডলারের একাধিপত্যের তীব্র বিরোধী। রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের মতে, “আমরা ডলারকে ছেড়ে যাচ্ছি না, ডলারই আমাদেরকে ছেড়ে যাচ্ছে।”
এই পরিস্থিতিতে অনেকেই এমন একটি সম্ভাবনার কথা বলছেন, যেখানে অন্য কোনো মুদ্রা মার্কিন ডলারকে বৈশ্বিক মুদ্রা হিসেবে প্রতিস্থাপিত করবে। সম্ভাব্য বিকল্প হিসেবে ইউরো, চীনা রেনমিনবি ও জাপানি ইয়েনের কথা বলা হচ্ছে। কেউ কেউ কাগুজে মুদ্রার পরিবর্তে ক্রিপ্টোকারেন্সিকে বৈশ্বিক মুদ্রা হিসেবে গ্রহণের প্রস্তাব করছেন। কার্যত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব অর্থনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে একাধিপত্য ছিল, এখন আর সেটি নেই। চীন ও জার্মানি এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি পণ্য রপ্তানি করে। যুক্তরাষ্ট্রের দুই ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও রাশিয়া ধীরে ধীরে মার্কিন ডলারকে প্রতিস্থাপনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। বর্তমানে রাশিয়া মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষেত্রে ইউরোর পরিমাণ ৩০%, যেখানে মার্কিন ডলারের পরিমাণ ২৩%। চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে রাশিয়া ডলারের চেয়ে ইউরো অধিক হারে ব্যবহার করছে, এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও তারা অনুরূপ ব্যবস্থা কার্যকরী করতে ইচ্ছুক। ইতোমধ্যে কিছু কিছু রাষ্ট্র চীনা রেনমিনবিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে জমা করতে শুরু করেছে।
কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, মার্কিন ডলারের একাধিপত্যকে অপসারণ করা এত সহজে সম্ভব হবে না। কারণ একে তো মার্কিন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব এখনো অত্যন্ত ব্যাপক, তদুপরি মার্কিন ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোর যে আস্থা আছে, অন্য কোনো রাষ্ট্রের ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর তাদের এতটা আস্থা নেই। বিশেষত চীনের অর্থব্যবস্থার সচ্ছতা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান এবং চীনা রেনমিনবিকে রিজার্ভ মুদ্রায় পরিণত করে বিশ্বব্যাপী চীনা অর্থনৈতিক আধিপত্য স্বীকার করে নেয়ার ইচ্ছেও অনেক রাষ্ট্রের নেই। ইউরো বা জাপানি ইয়েনকে দিয়ে মার্কিন ডলারকে প্রতিস্থাপন করার ক্ষেত্রেও নানাবিধ সমস্যা বিদ্যমান। তাছাড়া, আকস্মিকভাবে মার্কিন ডলারকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে বড় ধরনের অর্থনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে, সুতরাং সেটিও এই প্রস্তাবনার একটি বড় প্রতিবন্ধক। সুতরাং, নিকট ভবিষ্যতে মার্কিন ডলারের একাধিপত্য অপসারণ সম্ভব কিনা, সেটি অনিশ্চিত এবং প্রশ্নসাপেক্ষ।