ভ্যাটিকান
‘ভ্যাটিকান নগর রাষ্ট্র’ (ল্যাটিন: Status Civitatis Vaticanae; ইতালীয়: Stato della Città del Vaticano) ইতালির রাজধানী রোমের অভ্যন্তরে অবস্থিত একটি অতি ক্ষুদ্র নগর রাষ্ট্র (city-state)। মাত্র ০.৪৯ বর্গ কি.মি. আয়তনবিশিষ্ট এই রাষ্ট্রটি আয়তন ও জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের ক্ষুদ্রতম রাষ্ট্র। রাষ্ট্রটির শাসনকর্তা হচ্ছেন পোপ, যিনি একই সঙ্গে রোমান ক্যাথলিক চার্চের প্রধান ধর্মগুরু এবং রোমের বিশপ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। ভ্যাটিকান কার্যত একটি ধর্মতাত্ত্বিক রাষ্ট্র এবং বিশ্বের স্বল্প সংখ্যক নির্বাচিত রাজতন্ত্রের (elective monarchy) মধ্যে এটি একটি। উল্লেখ্য, ভ্যাটিকান আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, কিন্তু রাষ্ট্রটি জাতিসংঘের সদস্য নয়।
বর্তমানে ভ্যাটিকানকে একটি পূর্ণরূপে শান্তিপ্রিয় রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং রাষ্ট্রটির ক্ষুদ্র সশস্ত্রবাহিনী ‘সুইস গার্ড’কে আধুনিক সৈন্যবাহিনী হিসেবে বিবেচনা না করে একটি সুপ্রশিক্ষিত দেহরক্ষী বাহিনী হিসেবে বিবেচনা করাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত। স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুদ্র ভ্যাটিকান কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হতে পারে কিংবা ব্রিটেন কখনো ভ্যাটিকানের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে থাকতে পারে, এই ধারণাগুলো এখন অবাস্তব বলে প্রতীয়মান হয়। কিন্তু অতীতে ভ্যাটিকানের সীমা বর্তমানের চেয়ে অনেক বেশি বিস্তৃত ছিল এবং ‘স্টেট অফ দ্য চার্চ’/’প্যাপাল স্টেটস’ নামে পরিচিত রাষ্ট্রটি বিভিন্ন যুদ্ধবিগ্রহে বিস্তৃত মাত্রায় জড়িত ছিল। শুধু তা-ই নয়, অতীতে ব্রিটিশ নাগরিকরা ভ্যাটিকানের এই যুদ্ধবিগ্রহে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে।
উক্ত ব্রিটিশ নাগরিকদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন স্যার জন হকউড। ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে সংঘটিত শতবর্ষব্যাপী যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ডের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেন। পরবর্তীতে তিনি বর্তমান ইতালির ভূখণ্ডে একজন মার্সেনারি নেতা হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেন। চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে ইউরোপ জুড়ে বিভিন্ন মার্সেনারি সংগঠন গঠিত হতে থাকে। এরকমই একটি সংগঠন ছিল ফ্রান্সের ভূখণ্ডে গঠিত ‘গ্রেট কোম্পানি অফ ইংলিশ অ্যান্ড জার্মানস”, যেটি পরবর্তীতে ‘হোয়াইট কোম্পানি’ বা ‘ইংলিশ কোম্পানি’ নামে পরিচিতি লাভ করে। হকউড এই মার্সেনারি সংগঠনে যোগদান করেন এবং পরবর্তীতে এর অধিনায়কে পরিণত হন।
তার অধীনে গ্রেট কোম্পানি ১৩৬০ সালে দক্ষিণ–পূর্ব ফ্রান্সের একটি দুর্গ দখল করে নেয় এবং প্রায় তিন মাস ধরে সেটি দখল করে রাখে। সেসময় ইংরেজদের হাতে বন্দি ফরাসি রাজা জনের মুক্তিপণ প্রদানের জন্য এই অঞ্চল থেকে কর সংগ্রহ করা হচ্ছিল। হকউড উক্ত দুর্গটি দখল করে নেয়ার ফলে ঐ অঞ্চলে কর সংগ্রহে বিশেষ অসুবিধার সৃষ্টি হয়। এই পর্যায়ে পোপ ৬ষ্ঠ ইনোসেন্ট গ্রেট কোম্পানির কাছে একটি চিঠি প্রেরণ করেন এবং শান্তি স্থাপনের জন্য উক্ত চিঠিতে আহ্বান জানান। কিন্তু হকউড পোপের আহ্বানে সাড়া প্রদান করেননি এবং তার অধীনস্থ মার্সেনারিরা উক্ত দুর্গের কার্যক্রমে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে থাকে। ফলে ভ্যাটিকান ক্ষিপ্ত হয়ে হকউড ও তার দলের সদস্যদের ক্যাথলিক চার্চ থেকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে।
কিন্তু পরবর্তীতে ভ্যাটিকান ও গ্রেট কোম্পানির মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। ১৩৬১ সালের মার্চে তাদের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী গ্রেট কোম্পানির মার্সেনারিরা স্পেন ও ইতালিতে পোপের পক্ষে যুদ্ধ করতে রাজি হয় এবং বিনিময়ে ভ্যাটিকান তাদেরকে স্থায়ীভাবে নিজস্ব সামরিক বাহিনীতে চাকরি প্রদানের অঙ্গীকার প্রদান করে। এই চুক্তির ফলে গ্রেট কোম্পানি কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং তাদের একাংশ ইতালিতে ও অপর অংশ স্পেনে গমন করে। হকউড ইতালিতে গমনকারী দলটিতে যোগদান করেন এবং ইতালির ভূখণ্ডে পোপের পক্ষে যুদ্ধ করেন। শেষ পর্যন্ত হকউডের মর্যাদা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, ১৩৮১ সালে ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় রিচার্ড হকউডকে ভ্যাটিকানে ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্ত করেন।
ভ্যাটিকানের পক্ষে ও বিপক্ষে হকউড ও তার মার্সেনারি সংগঠনের কার্যক্রমকে ঠিক ভ্যাটিকানের ভূখণ্ডে ব্রিটিশ আক্রমণ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না। কারণ মার্সেনারি হিসেবে হকউডের কোনো নির্দিষ্ট রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ছিল না এবং পোপের বিপক্ষে যুদ্ধ করার সময় তিনি ব্রিটেন বা অন্য কোনো রাষ্ট্রের হয়ে কাজ করছিলেন না। পরবর্তীতে তিনি পোপের পক্ষ নিয়ে ইতালিতে লড়াই করেন এবং একে তো কোনোভাবেই ভ্যাটিকানের ভূখণ্ডে ব্রিটিশ আক্রমণ হিসেবে বিবেচনা করা চলে না।
সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের লর্ড প্রোটেক্টর অলিভার ক্রমওয়েলের শাসনামলে ‘জেনারেল অ্যাট সি’ (General at Sea) রবার্ট ব্লেইক তার নৌবহর নিয়ে ইতালির লিভর্নো বন্দরে উপস্থিত হয়েছিলেন। সেসময় ভ্যাটিকানের নেতৃবৃন্দের মধ্যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল যে, ইংরেজরা ভ্যাটিকানের ভূখণ্ডে আক্রমণ পরিচালনা করতে পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের আশঙ্কা বাস্তবায়িত হয়নি এবং জেনারেল অ্যাট সি ব্লেইক ভ্যাটিকানের ভূখণ্ডে আক্রমণ না চালিয়েই তার নৌবহর সমেত ইংল্যান্ডে প্রত্যাবর্তন করেন।
১৮৭১ সালে ইতালির একত্রীকরণের পর রোম একীভূত ইতালীয় রাষ্ট্রের রাজধানীতে পরিণত হয় এবং এর ফলে ভ্যাটিকানের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। অবশেষে ১৯২৯ সালে ইতালি ও ভ্যাটিকানের মধ্যে ‘ল্যাটারান চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয় এবং এর মধ্য দিয়ে ইতালি ভ্যাটিকানকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ভ্যাটিকান উভয় পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করে, কিন্তু তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। যুদ্ধ শুরুর পর ভ্যাটিকান নিজেদের নিরপেক্ষতা ঘোষণা করে।
যুদ্ধ চলাকালে ভ্যাটিকানের অন্যতম প্রধান একটি লক্ষ্য ছিল রোমকে বিমান হামলার হাত থেকে রক্ষা করা, কারণ রোমের ওপর বিমান হামলা পরিচালিত হলে ভ্যাটিকানও আক্রান্ত হতে পারত। বস্তুত ভ্যাটিকান এই ব্যাপারে এতটাই উদ্বিগ্ন ছিল যে, তারা রোমে ব্রিটিশ বিমান থেকে প্রচারপত্র ফেলারও তীব্র বিরোধিতা করে এবং ভ্যাটিকানের সীমানার মধ্যে এরকম যে অল্প কয়েকটি প্রচারপত্র পড়েছিল, সেটিকে তারা ভ্যাটিকানের নিরপেক্ষতার লঙ্ঘন হিসেবে আখ্যায়িত করে। ব্রিটেন ভ্যাটিকানের নিরপেক্ষতাকে সম্মান করতে রাজি ছিল, কিন্তু তারা ঘোষণা করে যে, যুদ্ধের প্রয়োজনে তারা নিজেদের ইচ্ছেমতো রোমের ওপর বিমান হামলা চালাবে।
শুধু তা-ই নয়, যুদ্ধ চলাকালে ভ্যাটিকান অন্তত দুবার (১৯৪৩ সালের ৫ নভেম্বর এবং ১৯৪৪ সালের ১ মার্চ) বিমান হামলার শিকার হয়। প্রথম হামলাটি কোন দেশ চালিয়েছিল, সেটি স্পষ্ট নয়, কিন্তু ঐ আক্রমণে ব্যবহৃত বোমাগুলো ছিল ব্রিটেনের তৈরি। অবশ্য ব্রিটিশরা এই অভিযোগ অস্বীকার করে। দ্বিতীয় আক্রমণটি ছিল আরো মারাত্মক, কারণ এই আক্রমণে ভ্যাটিকানের অভ্যন্তরে একজন ব্যক্তি নিহত ও একজন আহত হয় এবং বেশ কিছু স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই আক্রমণটি যে ব্রিটিশরা পরিচালনা করেছিল, সেটি সম্পর্কে ইতিহাসবেত্তারা নিশ্চিত। কিন্তু এই আক্রমণ দুর্ঘটনাবশত পরিচালিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৪৪ সালে মিত্রবাহিনী (যাদের মধ্যে ব্রিটিশ সৈন্যরাও ছিল) রোম দখল করে নেয়, কিন্তু ভ্যাটিকানের নিরপেক্ষতার প্রতি তারা সম্মান প্রদর্শন করে এবং ভ্যাটিকানের ভূখণ্ডে কোনো ধরনের আক্রমণাত্মক কার্যকলাপ পরিচালনা থেকে বিরত থাকে।
সামগ্রিকভাবে, ভ্যাটিকানের ভূখণ্ডে ব্রিটিশ নাগরিকরা মার্সেনারি হিসেবে সামরিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করেছে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ বিমানবাহিনী ভ্যাটিকানের ভূখণ্ডের ওপর বোমাবর্ষণ করেছে। কিন্তু মার্সেনারিদের কার্যক্রমের সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের কোনো প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা ছিল না এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পরিচালিত বিমান হামলাগুলো ভ্রান্তিবশত ঘটেছিল বলে ধারণা করা হয়। এজন্য বলা যেতে পারে যে, ব্রিটিশরা কখনো ভ্যাটিকানের ভূখণ্ডে আক্রমণ পরিচালনা করেনি।
মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র
‘মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র’ (ফরাসি: République centrafricaine; সাঙ্গো: Ködörösêse tî Bêafrîka) মধ্য আফ্রিকায় অবস্থিত একটি বৃহৎ স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র। ৬,২২,৯৮৪ বর্গ কি.মি. আয়তনবিশিষ্ট এই রাষ্ট্রটির উত্তরে শাদ, উত্তর–পূর্বে সুদান, দক্ষিণ–পূর্বে দক্ষিণ সুদান, দক্ষিণে কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, দক্ষিণ–পশ্চিমে কঙ্গো প্রজাতন্ত্র এবং পশ্চিমে ক্যামেরুন অবস্থিত। রাষ্ট্রটি যে কেবল স্থলবেষ্টিত তা-ই নয়, রাষ্ট্রটির অবস্থান আফ্রিকা মহাদেশের একেবারে কেন্দ্রে, সুতরাং ঔপনিবেশিক যুগে ব্রিটিশ নৌবহরের পক্ষে অঞ্চলটিতে পৌঁছানো ছিল অসম্ভব ব্যাপার। কার্যত আফ্রিকায় মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের অবস্থানকে এশিয়ায় মঙ্গোলিয়ার অবস্থান এবং দক্ষিণ আমেরিকায় বলিভিয়ার অবস্থানের সঙ্গে তুলনা করা হয়ে থাকে। অবশ্য রাষ্ট্রটির পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত বর্তমান সুদান ও দক্ষিণ সুদানের ভূখণ্ড ব্রিটেন ও ব্রিটিশ আশ্রিত রাষ্ট্র মিসর কর্তৃক শাসিত ‘ইঙ্গ–মিসরীয় সুদান’ কন্ডোমিনিয়ামের অন্তর্ভুক্ত ছিল, সুতরাং ব্রিটেন চাইলে স্থলপথে বর্তমান মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের ভূখণ্ডে আক্রমণ চালাতে পারত। কিন্তু ইতিহাসের নানা ঘটনাচক্রে তাদের আর সেটা করা হয়ে ওঠেনি।
১৮৮০–এর দশকে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলো আফ্রিকা মহাদেশকে নিজেদের মধ্যে বণ্টন করে নেয় এবং বর্তমান মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের ভূখণ্ড ফ্রান্সের প্রভাব বলয়ের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ১৮৮০–এর দশকের শেষদিকে ফ্রান্স বর্তমান মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের ভূখণ্ডে নিজেদের উপনিবেশ স্থাপন করে। এই উপনিবেশটি ‘উবাঙ্গি–শারি’ নামে পরিচিত ছিল। উল্লেখ্য, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে ও বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে এই অঞ্চলের ইউরোপীয় উপনিবেশগুলোর সীমানা নির্ধারিত ছিল না, এবং প্রায়ই ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর সুবিধা–অসুবিধা অনুযায়ী এই সীমান্ত পরিবর্তিত হতো। উবাঙ্গি–শারির পূর্বদিকে অবস্থিত বর্তমান দক্ষিণ সুদানের ভূখণ্ড সেসময় ব্রিটিশদের শাসনাধীনে ছিল। সুতরাং, এটি সম্ভব যে, এই সময়ে ব্রিটিশ সৈন্যরা বর্তমান মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের ভূখণ্ডে প্রবেশ করে থাকতে পারে। কিন্তু এই বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই।
অবশ্য বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে উবাঙ্গি–শারিতে একটি স্থানীয় বিদ্রোহ দমনের জন্য উপনিবেশটির ফরাসি প্রশাসন ব্রিটিশ সৈন্যদের সহায়তা প্রার্থনা করেছিল। কিন্তু ব্রিটিশরা শেষ পর্যন্ত উক্ত বিদ্রোহ দমনের জন্য বর্তমান মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছিল কিনা, সেই সম্পর্কে কোনো তথ্য-প্রমাণ নেই। এজন্য এই ঘটনাকে নিশ্চিত রূপে বর্তমান মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের ভূখণ্ডে পরিচালিত ব্রিটিশ ‘আক্রমণ’ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না।
১৯১১ সালে ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং চুক্তি অনুযায়ী জার্মানি মরক্কোকে ফ্রান্সের প্রভাব বলয়ের অংশ হিসেবে স্বীকার করে নেয়। বিনিময়ে ফ্রান্স উবাঙ্গি–শারি উপনিবেশের একটি বড় অংশ জার্মানির নিকট হস্তান্তর করে। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ফ্রান্স জার্মানির কাছে হস্তান্তরকৃত অংশটি পুনর্দখল করে নেয় এবং পুনরায় উবাঙ্গি–শারির অন্তর্ভুক্ত করে। ফ্রান্স যদিও মিত্রশক্তির অংশ ছিল এবং ইউরোপে চলমান যুদ্ধের কারণে সৈন্য সঙ্কটে ভুগছিল, তবুও এই অভিযানে তারা ব্রিটেন বা অন্য কোনো রাষ্ট্রের সহায়তা গ্রহণ করেনি। ফরাসিরা এই অভিযানের জন্য মধ্য আফ্রিকান সৈন্যদের ব্যবহার করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪০ সালের জুনে ফ্রান্স জার্মানির কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং ফ্রান্সের ভূখণ্ডে জার্মান–নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র ‘ভিশি ফ্রান্স’ স্থাপিত হয়। জার্মানবিরোধী ফরাসি সেনা কর্মকর্তারা ‘ভিশি ফ্রান্স’কে প্রত্যাখ্যান করেন এবং ‘মুক্ত ফ্রান্স’ (Free France) নামক একটি বিকল্প সরকারের সৃষ্টি করেন। ১৯৪০ সালের জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত উবাঙ্গি–শারির ফরাসি প্রশাসন ভিশি ফ্রান্সের অনুগত ছিল। এ সময় ব্রিটেন ভিশি ফ্রান্সের অনুগত উপনিবেশগুলোর ওপর আক্রমণ চালাচ্ছিল এবং সেজন্য বর্তমান মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের ভূখণ্ডেও তাদের আক্রমণ পরিচালনার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু ১৯৪০ সালের আগস্টে ‘মুক্ত ফ্রান্সে’র সৈন্যরা উবাঙ্গি–শারির ওপর আক্রমণ চালায় এবং সেপ্টেম্বর নাগাদ উপনিবেশটির ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। এই অভিযানে ব্রিটিশ সৈন্যরা অংশগ্রহণ করেনি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৫৮ সালে উবাঙ্গি–শারি একটি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয় এবং ‘মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র’ নাম ধারণ করে। অবশেষে ১৯৬০ সালে রাষ্ট্রটি ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে। স্বাধীনতা–পরবর্তী সময়ে কেবল ফ্রান্স নয়, রাশিয়া ও রুয়ান্ডাও মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের ভূখণ্ডে সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। কিন্তু রাষ্ট্রটি কখনো ব্রিটিশ প্রভাব বলয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল না, এবং এজন্য রাষ্ট্রটির ভূখণ্ডে ব্রিটিশরা কোনো ধরনের সামরিক অভিযান পরিচালনা করেনি।
সামগ্রিকভাবে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে এবং বিংশ শতাব্দীর একেবারে শুরুর দিকে ব্রিটিশ সৈন্যরা বর্তমান মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের ভূখণ্ডে কিছু সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকতে পারে, এমন সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু আসলেই এরকম কিছু ঘটেছে কিনা, সেটি সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ নেই এবং এরকম কিছু ঘটে থাকলে রাষ্ট্রটির ইতিহাসে একে ব্রিটিশ ‘আক্রমণ’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি। এজন্য মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র জাতিসংঘের সেই ২২টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে অন্যতম, যাদের ভূখণ্ডে ব্রিটিশরা কখনো আক্রমণ চালায়নি বলে ধরে নেয়া হয়।