নিউ ইয়র্ক শহর। বিশ্বের শিল্প, বাণিজ্য, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও বিনোদনের অন্যতম প্রধান পীঠস্থান। কোটি কোটি মানুষের স্বপ্নের শহর।
পৃথিবীর প্রতি প্রান্তে এমন কোনো জনপদ নেই, যেখানে অন্তত একজন মানুষ নিউ ইয়র্ককে নিয়ে স্বপ্ন দেখে না। এই শহর যেন আধুনিক যুগে রূপকথার আমেজ তৈরি করা ইন্দ্রজাল ছড়ানো এক লোকালয়।
ইউরোপের পশ্চিম প্রান্তে আটলান্টিক মহাসাগরের ওপারে ‘নতুন পৃথিবী’ আবিষ্কারের পর থেকেই শ্বেতাঙ্গদের বসতি ও প্রভুত্ব বিস্তারের পথ উন্মুক্ত হয়। সেই পথেই এই শহর তিলে তিলে যাত্রা শুরু করে। ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারের ‘ইয়র্ক’ নাম অনুসারে শহরটিকে ‘নিউ ইয়র্ক’ নাম দেওয়া হয়েছিলো। মজার ঘটনা হচ্ছে, ইংরেজদের আগে এখানে ওলন্দাজদের আধিপত্য ছিলো, শহরটি পরিচিত ছিলো ‘নিউ আমস্টারডাম’ নামে। দখলের বদল হওয়ার পর শহরের নামও পরিবর্তিত হয়েছিলো। সে এক রোমাঞ্চকর কাহিনী।
তখন ষোল শতকের শেষ দিক চলছে। ইউরোপের ছোট দেশ নেদারল্যান্ডস তখন আর্থিকভাবে বেশ রমরমা অবস্থায় পৌঁছেছিলো। বাণিজ্যিক শক্তির সাহায্যে ওলন্দাজরা ইউরোপে স্প্যানিশ শক্তিকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। আমস্টারডাম বিশ্ববাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। আর এই শ্রেষ্ঠত্বের পেছনে ছিলো ওলন্দাজ নৌশক্তি। বড় বড় ওলন্দাজ জাহাজের পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যাতায়াত বেড়েই চলছিলো। আর এসব যাত্রার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিলো মশলা অধ্যুষিত পূর্ব ইন্দোনেশিয়ায় আধিপত্য তৈরি করা।
সেসময় শুধু পুরোটা ইউরোপই নয়, গোটা পৃথিবীতে বাণিজ্যিক গোষ্ঠী হিসেবে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একরকম অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিলো। নেদারল্যান্ডস হয়ে উঠেছিলো বণিকদের আশ্রয়দাতা সবচেয়ে বড় দেশ। বণিকদের কল্যাণে আমস্টারডাম শহরের বেশ শ্রীবৃদ্ধিও হয়েছিলো। ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এশিয়া তথা প্রাচ্যে অনুসন্ধান চালানোর জন্য একজন নতুন ইংরেজ ক্যাপ্টেন নিযুক্ত করলো। তিনি ছিলেন হেনরি হাডসন। ‘হাফ মুন’ নামের একটি জাহাজে তিনি ওলন্দাজ সহকারীদের নিয়ে ১৬০৯ সালের ৪ এপ্রিল সমুদ্রে পাড়ি দিলেন।
তার লক্ষ্য ছিলো পূর্বদিকে যাত্রা করা। সমুদ্রে বিশাল বরফখন্ডের বাঁধার কারণে জাহাজের মুখ পশ্চিমদিকে ঘোরাতে বাধ্য হন। ২ জুলাই তারা নিউফাউন্ডল্যান্ডে পৌঁছান। দশদিন পর আবার নতুন যাত্রা শুরু হলো। ৩ সেপ্টেম্বর তারা হাডসন নদীর তীরে পৌঁছান। হেনরি হাডসনের নামেই এই নদীর নাম হয়েছিলো।
নতুন স্থানে অভিযাত্রীরা অভিভূত হয়ে গেলো। বিস্তৃত সমতলভূমি, বন, উর্বর জমি আর সমুদ্রবন্দর নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছিলো।
১৬২১ সালে ডাচ ওয়েস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামে এক নতুন বাণিজ্যিক সংস্থা তৈরি হলো। পূর্বের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির থেকে তারা আলাদা নীতি গ্রহণ করলো। উত্তর আমেরিকায় বাণিজ্যের দ্রুত প্রসারে তারা আগ্রহী হয়ে উঠেছিলো। নতুন ভূখণ্ডে স্প্যানিশদের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তারা পশমের ব্যবসা আরম্ভ করলো। হাডসন, মোহক, ডেলাওয়ার ও কানেক্টিকাট নদীর তীরের বিশেষ বিশেষ স্থানে কেন্দ্র গড়ে আদিবাসীদের সাথে ব্যবসা চলতে লাগলো। সবচেয়ে সফল ব্যবসা কেন্দ্র হিসেবে সেদিনকার ফোর্ট অরেঞ্জ বা আজকের আলব্যানি নাম করেছিলো।
এভাবেই হাডসন নদীর তীরে নিউ আমস্টারডাম অঞ্চলের পত্তন হলো। কোম্পানির ডিরেক্টর পিটার মিনুইট মাত্র ২৪ ডলারে সমস্ত ম্যানহাটন কিনে নিয়েছিলেন!
১৬৩৩ সালে নেদারল্যান্ড থেকে উটার ভ্যান টুয়েলার ওলন্দাজ এই উপনিবেশের গভর্নর হয়ে এলেন। এলোমেলো ছড়ানো এলাকা ও ব্যবসাকেন্দ্রগুলো প্রশাসনিকভাবে একত্রিত করে তিনি নেদারল্যান্ডসের নতুন প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করলেন। নতুন দুর্গ, চার্চ ও সেনানিবাস গড়ে তোলা হলো। উপনিবেশের পূর্বদিকে ইংরেজদের বেড়ে চলা এলাকার সীমান্ত অঞ্চল ছিলো। ব্যবসায়ীরা নেদারল্যান্ডসের মূল ভূখন্ড থেকে যে স্বাধীনতা পেয়ে আসছিলো, নতুন গভর্নরের কারণে তা হারাতে চাচ্ছিলো না। ওদিকে আদিবাসীদের কিছু গোষ্ঠীর সাথে সংঘর্ষ লেগেই ছিলো। ফলে দেখা গেলো, নতুন এই ভূ-ভাগে ওলন্দাজরা শুধু ব্যবসায় সফলতা পেলো, প্রশাসনে নয়।
১৬৩৪ সালে উইলিয়াম কিয়েফট নতুন গভর্নর হয়ে এলেন। অব্যবস্থা কাটিয়ে উঠতে তিনি কিছু সংস্কারের উদ্যোগ নিলেন। প্রশাসনে অচলতা ও ব্যবসায়ের হঠাৎ বিশৃঙ্খলা দমনে তিনি কিছু আদেশ জারি করেন। তবে তার সাফল্য তেমন একটা কার্যকর হয়নি। এসময় নিউ আমস্টারডামের সাবেক ডিরেক্টর পিটার মিনুয়েট সুইডিশ এক কোম্পানির হয়ে আদিবাসীদের কাছ থেকে জমি কিনে দুর্গ তৈরির উদ্যোগ নেন। যা উইলিয়াম কিয়েফটকে কিছুটা রাগিয়ে তুলেছিলো। তিনি শক্তি প্রয়োগ করে তাদের সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, পরে সে আশা ত্যাগ করেন।
ওলন্দাজ কোম্পানির ব্যবসা প্রসারিত হয়েই চলছিলো। নতুন মহাদেশে নেদারল্যান্ডসের মূল ভূখণ্ড থেকে অভিবাসী আগমন অনেক বাড়লো। কখনও কখনও অভিবাসী আনার জন্য বিনামূল্যে জাহাজ ভ্রমণের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হতো। নেদারল্যান্ড থেকে অন্তত ৬ জন মানুষ নিয়ে আসতে পারলে ২০০ একর জমি পুরষ্কার দেওয়া হতো! ফলে ধনী ওলন্দাজ বাদেও ইউরোপের অন্য অঞ্চল থেকে ভালো-মন্দ বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ ভাগ্য বদলের আশায় আসতে লাগলো।
নিউ আমস্টারডাম অঞ্চলের বৈদেশিক সম্পর্ক ধীরে ধীরে জটিল আকার ধারণ করছিলো। নিউ ইংল্যান্ড অঞ্চলের প্রসারমান ইংরেজ শক্তি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দক্ষিণাঞ্চলের সুইডিশ শক্তিও ওলন্দাজ শক্তিকে যেন চ্যালেঞ্জ করছিলো। ওদিকে অ্যালবানি অঞ্চলে বেড়ে চলা বাণিজ্যে কার্যত স্বাধীনতার চিহ্ন দেখা যাচ্ছিলো। আবার ইন্ডিয়ান আদিবাসীদের থেকেও বিপদের আশঙ্কা কম ছিলো না। বিশেষ করে রারিতান গোত্র ওলন্দাজদের বেড়ে চলা আধিপত্য খর্ব করতে প্রস্তুত ছিলো। তাদের হাতে নিউ আমস্টারডামের বেশ কয়েকজন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়।
এসব হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে আদিবাসী ও গভর্নরের সরকারের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছিলো। কিয়েফট শক্ত পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছিলেন। ১৬৪৩ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি আদিবাসীদের উপর নৃশংস হামলা করা হলো। বৃদ্ধ, নারী ও শিশু মিইয়ে প্রায় ১২০ জন আদিবাসী মারা পড়লো। এই হত্যাকাণ্ড আদিবাসীদের বিভিন্ন গোত্রকে একত্রিত করতে সাহায্য করলো। এগারোটি ছোট ছোট ইন্ডিয়ান গোষ্ঠী একত্রিত হয়ে হামলার পরিকল্পনা করলো।
১৬৪৩ সালের শরৎকালে আদিবাসীরা ওলন্দাজদের বিরুদ্ধে এক সম্মিলিত হামলা পরিচালনা করলো। নিউ আমস্টারডামের অধিবাসীরা এই আকস্মিক ও ব্যাপক হামলার জন্য প্রস্তুত ছিলো না। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে সব গৃহপালিত পশু মেরে ফেলা হলো। বয়স্ক পুরুষরা হত্যাকাণ্ডের শিকার হলো, নারীদের বন্দী করা হলো। ওলন্দাজদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো। অনেকে নেদারল্যান্ডসের উদ্দেশ্যে নতুন ভূখণ্ড থেকে পালিয়ে গেলো।
১৬৪৪ সালে ক্যাপ্টেন জন আন্ডারহিলের নেতৃত্বে ইন্ডিয়ানদের উপরে পাল্টা হামলা হলো। ওলন্দাজরা যেন সমুচিত প্রতিশোধের অপেক্ষাতেই ছিলো। আদিবাসীদের গ্রাম ও শস্য জ্বালিয়ে দিয়ে তাদের প্রায় ১০০ জনকে হত্যা করা হয়। বন্দী করা হয় আরো অনেককে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে আরো সৈন্য আনা হলেও দুই পক্ষের শান্তি চুক্তিতে পরিস্থিতি শান্ত হলো।
পিটার স্টুইভেসান্ট নতুন গভর্নর হয়ে নিউ আমস্টারডামে এলেন। তিনি নতুন কিছু সংস্কারের মাধ্যমে বাণিজ্য প্রসারের চেষ্টা করলেন। প্রতিযোগিতামূলক বাজারের প্রসার হলেও নিউ আমস্টারডাম শুধু বন্দর হিসেবেই থেকে গেলো, প্রশাসনিক কার্যকলাপের পরিধি ক্ষুদ্র হয়ে আসছিলো।
১৬৫২ সালে এই অঞ্চলে বেশ কিছু শাসনতান্ত্রিক সংস্কার করা হলো। এতে কিছু উপযোগিতা দেখা গেলেও পূর্বদিকে নিউ ইংল্যান্ডে ব্রিটিশদের আর দক্ষিণে সুইডিশদের ভয় রয়েই গিয়েছিলো। এছাড়া ইন্ডিয়ান গোষ্ঠীগুলোর চোরা হামলা তো ছিলোই। ধর্মীয় কারণে নির্যাতিত ইহুদী আসতে থাকায় জনসংখ্যা বাড়ছিলো। বাড়ছিলো প্রোটেস্ট্যান্ট ক্যাথলিক দ্বন্দ্বও। ওলন্দাজরা প্রোটেস্ট্যান্ট মতবাদের কেলভিনিস্ট শাখা অনুসরণ করতো। অন্যদিকে ইংরেজরা অ্যাংলিকান ও লুথারিয়ান হওয়ায় এই বিরোধ উপনিবেশের রাজনীতিতেও প্রভাব রাখছিলো।
ব্রিটেন ক্রমাগত নতুন মহাদেশে শক্তি বাড়িয়েই তুলেছিলো। ইংল্যান্ডে রাজা দ্বিতীয় চার্লসের অভিষেকের পর তার ভাই ডিউক অব ইয়র্ক নিউ আমস্টারডাম দখল করতে নৌযান পাঠালেন। ওলন্দাজ গভর্নর যোগাযোগের অভাবে যথাসময়ে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হলেন। জনতা একরকম নির্বিকার ছিলো, শাসক ওলন্দাজ না ইংরেজ এ নিয়ে তারা মাথা ঘামালো না।১৬৬৪ সালের ৮ সেপ্টেম্বর পুরো নিউ আমস্টারডাম ইংরেজদের কাছে আত্মসমর্পন করলো।
প্রভু বদলানোর সাথে সাথে নামও বদলে গেলো। ডিউকের উপাধি অনুযায়ী এর নাম হলো নিউ ইয়র্ক। নেদারল্যান্ডস তার বিশ্বব্যাপী ব্যবসায়িক প্রসারের অংশ হিসেবে যে উপনিবেশ গড়ে তুলেছিলো, সমস্যায় জর্জরিত হয়ে তাকে তুলে দিতে হলো চির প্রতিদ্বন্দ্বী এক শক্তির কাছে, যা সময়ের পরিক্রমায় বহু উত্থান-পতন দেখে হয়ে উঠেছে ইতিহাসবিখ্যাত স্বপ্নের শহর নিউ ইয়র্ক।
নিউ ইয়র্কের ইতিহাস নিয়ে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইটি-
১) A History of New York in 101 Objects