থার্মোমিটারের ভেতরের ওই তাপ সুপরিবাহী তরল ধাতুটির নাম পারদ। পারমাণবিক সংখ্যা ৮০, তাই ভারী ধাতুসমুহের একটি হিসাবেই এটি পরিচিত। থার্মোমিটার, ম্যানোমিটার ছাড়াও শিল্পে বহুল ব্যবহৃত ধাতুগুলোর একটি এই পারদ। তাই প্রতিনিয়ত আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে ভূগর্ভ থেকে উঠে আসা কয়লাখনির কিংবা শিল্পবর্জ্যের সাথে এই পারদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এসে পড়ছে সমুদ্রে। ফলে সামুদ্রিক প্রাণির খাদ্যশৃংখলে ঢুকে পড়ছে এই ভারী ধাতু এবং এর বিভিন্ন যৌগ। সামুদ্রিক প্রায় সব মাছ যেমন টুনা, স্যালমন, সার্ডিন, ম্যাকরেল ইত্যাদিতে এই ধাতু কিংবা এর যৌগসমুহ পাওয়া যাচ্ছে উল্লেখযোগ্য হারে।
ষাটের দশকে জাপানে এই ঘটনা সৃষ্টি করে এক মানবিক দুর্যোগ। সেই ভয়াবহ দুর্যোগের বিশ্ববাসীর নজর আকর্ষিত হয় ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডের বিশ্বস্ত সুত্র হিসাবে পরিচিত এই সামুদ্রিক মাছের উপর। জাপানে ঘটে যাওয়া দুর্যোগের আদ্যোপান্ত জানবো আর বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ যেহেতু সামুদ্রিক মাছ এবং সামুদ্রিক মাছ থেকে তৈরি শুটকি খেয়ে থাকেন তাই আমাদের জন্য এই ঝুঁকি কতটুকু এই নিয়েই আলোচনা।
পারদ কি ক্ষতিকর?
পারদ স্নায়ুতন্ত্রের জন্যে একটি স্বীকৃত বিষ। খাদ্য বা অন্য কোনো উপায়ে পারদ বা এর কোনো যৌগ গৃহীত হলে এটি মানব মস্তিষ্কের উপর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এটি মানুষের বুদ্ধিমত্তার বিকাশ এবং মস্তিষ্কের কার্যাবলির উপর দীর্ঘমেয়াদে এত নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে সক্ষম যে এটি স্মৃতিভ্রম (Dementia), হ্যালুসিনেশন (Hallucination), আত্মহত্যা প্রবণতা (Suicidal tendency) র জন্যে দায়ী। দীর্ঘমেয়াদে গ্রহিতাদের যকৃতে সঞ্চিত হয়ে যকৃতকে অচল করে দেয় এটি। গর্ভবতী মায়ের দেহে বিকাশমান ভ্রূণের বৃদ্ধি রহিত করে দেয়ার গবেষণালব্ধ প্রমাণ বিজ্ঞানীরা খুব সম্প্রতিই পেয়েছেন। এই পারদজনিত দূষণ জাপানের মিনামাতা সহ বেশ কয়েকটি শহরে মানবিক দুর্যোগের সৃষ্টি করে।
জাপানে এই সমস্যার উদ্ভব
সামুদ্রিক মাছে পারদের উপস্থিতি ১৯৫০ এর আগে মোটেও স্বাস্থ্যসমস্যা রুপে গণ্য করা হতো না। এই সমস্যার দিকে জাপানবাসী পর্যন্ত সচেতন ছিলো না যতক্ষণ না জাপানের উপকুলীয় শহর মিনামাতায় (Minamata) এই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে এবং এর ফলে সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষিত হয় এর দিকে।
২১ এপ্রিল ১৯৫৬, জাপানের শহর মিনামাতায় পাঁচ বছরের কন্যাশিশুকে খিচুনি এবং পায়ের হাড়ের সমস্যার কারণে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এবং পরবর্তী সপ্তাহগুলোতে পুরো শহরের প্রায় শতাধিক রোগী এই সমস্যায় হাসপাতালে ভর্তি হন। যা জাপান সরকার সহ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে উদ্বেগের কারণে পরিণত হয়। কারণ তখন নাগাদ গবেষকরা নিশ্চিত হতে পারছিলেন না যে সামুদ্রিক মাছে পারদের উপস্থিতি এমন ভয়ংকর প্রভাব ফেলতে পারে জনজীবনে। পরবর্তীতে চালানো গবেষণায় প্রমাণিত হয় যে শিল্পাঞ্চলের পারদ সমুদ্রের পানিকে দুষিত করছে আর তা মাছের খাদ্যশৃংখলে ঢুকে পড়ছে। উপকুলীয় শহরগুলোতে সামুদ্রিক্ মাছ প্রধান খাদ্য হওয়ায় এই পারদ মানুষের খাদ্যশৃংখলেও ঢুকে পড়েছে। ফলে উপরোক্ত স্বাস্থ্যসমস্যাগুলো প্রকট আকার ধারণ করে।
সেই অঞ্চলের প্রতি কেজি মাছে পারদের সর্বোচ্চ মাত্রা ছিলো ৭০৫ মিলিগ্রাম যা ঐ অঞ্চলের বাইরে অন্যান্য উপকুলীয় অঞ্চলে গড়ে প্রতি কেজি মাছে ৪ মিলিগ্রাম।
এই মাছ খাদ্য হিসাবে গ্রহণের ফলে জাপান বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাস্থ্যসমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রোগীরা তাদের পেশীর উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন ফলে দেখা দেয় খিচুনি, এবং অনেক রোগী সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় করতে না পারায় পক্ষাঘাতগ্রস্ত (paralysed) হন। পুরো জাপান জুড়ে এই ঘটনায় প্রায় ১৭৮০ জনের মারা যাবার রেকর্ড আছে।
মাছে কী রুপে থাকে এই পারদ?
প্রায় ৯৫ শতাংশ পারদ মাছে মিথাইলমার্কারি (methylmercury) রুপে থাকে। এই মিথাইলমার্কারি মাছের দেহে সঞ্চিত হয় খাদ্যের মাধ্যমে। মাছের দেহের প্রোটিনের সাথে এটি যুক্ত থাকে বলে এই মিথাইল মার্কারি তাপ দিয়ে বা রান্নার মাধ্যমে দূর করা যায় না।
ছোট মাছ শিল্পবর্জ্যে বেড়ে উঠা জুপ্লাংকটন-ফাইটোপ্ল্যাংকটন খায় এতে থাকে মার্কারি। বড় মাছ যখন আবার ছোট মাছ খায় তা ক্রমান্বয়ে বড় মাছের দেহে সঞ্চিত হয়। এর ফলে খাদ্যশৃংখলের উপরের দিকের অর্থাৎ বড় মাছের দেহে আশংকাজনক হারে এই মিথাইলমার্কারি পাওয়া যায়। নিচের ছবিটিতে তা আরো ভালোভাবে বুঝা যাবে।
মারাত্মক স্বাস্থ্যযুকিতে গর্ভবতী মায়েরা
বিভিন্ন জরিপ এবং গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে এই মিথাইল-মার্কারি গর্ভবতী মায়েরা খাদ্যের সাথে গ্রহণ করলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয় গর্ভে থাকা বাচ্চাটির স্নায়ুতন্ত্র। শিশুটি পরবর্তীতে জটিল স্নায়ুতন্ত্রজনিত সমস্যা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। কিছু ক্ষেত্রে গর্ভপাতের মত ঘটনারও শিকার হয়েছেন বলে জরীপের তথ্য থেকে উঠে এসেছে।
এমনকি বৃদ্ধ কিংবা বয়স্কদের উপরও পারদ দূষণের কালোছায়া পড়েছে। মিনামাতা দুর্যোগের পরে সারাবিশ্ববাসীর কাছেই সামুদ্রিক মাছে পারদ দুষণ প্রধান সাস্থ্যসমস্যার একটি।
বাংলাদেশের মানুষের জন্য এই ঝুঁকি কতটুকু?
বাংলাদেশের উপকুলীয় অঞ্চলের মানুষ সামুদ্রিক মাছের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। এখনই আমাদের সমুদ্র উপকুলের মাছে পারদের মাত্রা নির্ণয় করে তা স্বাভাবিক মাত্রায় আছে কিনা জেনে নেয়া অত্যাবশ্যক। যেহেতু বাংলাদেশে এই নিয়ে গবেষণা করা হয়নি সেহেতু এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পারদ দূষণের শিকার হবার সম্ভাবনা আছে। পাশাপাশি এই অঞ্চলের মানুষের তৈরি শুটকি বা ড্রাইড ফিশের সমাদর সারা দেশ জুড়ে।
এখনই সময় পদক্ষেপ নেবার
যেহেতু পারদ বা মার্কারি মাছের দেহের প্রোটিনের সাথে মিথাইল মার্কারি নামক যৌগ হিসাবে সংযুক্ত থাকে তা শুটকি হবার পরও এর কার্যকারিতা অব্যাহত থাকে। এবং রান্নায়ও যেহেতু এই যৌগ নষ্ট হয় না, তাই যদি আমাদের উপকুলীয় অঞ্চলের সামুদ্রিক মাছে পারদ দূষণ ঘটে থাকে তাহলে পরোক্ষভাবে সারা বাংলাদেশের মানুষ আরেকটি “মিনামাতা দুর্যোগ” এর সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
তাই এখনই সময় পারদ দূষণ বন্ধ করতে সবার সমন্বিত পদক্ষেপ নেবার। সমুদ্রের পানিতে কলকারখানা কিংবা খনির পারদজনিত বর্জ্যের পরিমাণ এখনই কমিয়ে না আনার চিন্তা করলে সারাবিশ্বের জন্যে অপেক্ষা করছে অনেকগুলো “মিনামাতা দুর্যোগ”। সেই দূর্যোগে প্রাণ হারানো সবাই আজ আমাদের জন্যে চিন্তার এক দুয়ার খুলে দিয়ে গিয়েছেন। এখন বিশ্বনেতাদের চিন্তার বিষয় তারা এখনই পারদ দূষণ কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিবেন কিনা, না আরো শত প্রাণের ঝরে যাওয়া প্রত্যক্ষ করবেন!