সালটা ১৮৫৭। সময়টা সিপাহী বিদ্রোহের ঠিক আগে। হঠাৎ উত্তর ভারতের কিছু গ্রাম থেকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল, ‘চাপাতি’ নামে পরিচিত একধরনের রুটি। সে রুটি মানুষের হাত ঘুরে ঘুরে ছড়িয়ে যেতে লাগল হাজার মাইল দূরে। কেন বিতরণ হচ্ছে এই রুটি? কে রয়েছে এর পেছনে? এ রুটি কি কোনো গোপন বার্তা পৌঁছাচ্ছে? নাকি পেছনে রয়েছে কোনো বড় ষড়যন্ত্র? ইংরেজ শাসকদের কপালে পড়ল চিন্তার ভাঁজ। ‘চাপাতি’ নামক নিরীহ দর্শন রুটিই হয়ে গেল ব্রিটিশ শাসকদের ঘুম নষ্টের কারণ। ইতিহাসে এ ঘটনাকে ডাকা হয় ‘চাপাতি আন্দোলন’ (Chapati Movement) নামে।
‘চাপাতি’ বৃত্তান্ত
‘চাপাতি’ মূলত গমের আটা দিয়ে তৈরি একধরনের খামিরবিহীন রুটি। এটি সাধারণত তাওয়ায় ভেজে কিংবা খোলা আগুনে পুড়িয়ে তৈরি করা হয়।
হিন্দী ‘চপত’ থেকে এসেছে চাপাতি, যার অর্থ ‘চ্যাপ্টা’। এর আরেকটি অর্থ ‘চড়’ও। হাতের তালুতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে থাপড় দিয়ে বানানো হয় এই রুটি। এর চ্যাপ্টা আকার, কিংবা থাপড় দিয়ে দিয়ে বানানো হয় বলেই হয়তো এর এই নাম। ১৬ শতকে আবুল ফজলের লেখা আইন-ই-আকবরীতে সম্রাট আকবরের পছন্দের খাবারের তালিকায়ও আছে এই চাপাতির উল্লেখ।
চাপাতি আন্দোলন: যেভাবে শুরু
প্রথম ‘চাপাতি’ বিতরণ ঠিক কোথা থেকে শুরু হয়েছিল, ইতিহাসে তা নিয়ে যদিও ধোঁয়াশা রয়েছে। তবে রুটির এই অস্বাভাবিক ভ্রমণের বিষয়টি, ১৮৫৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটিশ প্রসাশনের নজরে আনেন মাথুরার ম্যাজিস্ট্রেট মার্ক থ্রনহিল। থ্রনহিল ফেব্রুয়ারির কোনো এক সকালে অফিসে এসে, তার টেবিলে আবিষ্কার করেন, এক টুকরো ময়লা রুটি! অনুসন্ধানে তিনি জানতে পারেন, রুটিটি এখানে এনেছেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা, সেই পুলিশ কর্মকর্তা সেটা পেয়েছেন একজন গ্রামের চৌকিদারের কাছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো চৌকিদার পেয়েছেন কোথা থেকে? জানা গেল, জঙ্গল থেকে কেউ একজন এসে প্রহরীদের কারো হাতে তুলে দেন এই রুটি, আর সাথে এটাও বলে দেন যে, আরো চারটি রুটি বানিয়ে যেন সকলকে বিতরণ করা হয়, এবং সে চারজনকেও যেন বলে দেওয়া হয়, তারাও যেন প্রত্যেকে আরো চারটি করে রুটি বানিয়ে বিতরণ করে।
এ বিষয়ে ১৮৫৭ সালের মার্চে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন সেনা কর্মকর্তা গিলবার্ট হেডো তার বোনকে লেখা চিঠিতে লেখেন,
“এখানে রুটি বিতরণের একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটে চলছে। মনে হচ্ছে, কেউই এই ঘটনার প্রকৃত কারণ জানে না। কোথা থেকে শুরু, এর পেছনে কারা রয়েছে, কী উদ্দেশ্য রয়েছে কিছুই স্পষ্ট নয়। মনে হচ্ছে, এই ঘটনার সাথে কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান কিংবা গোপন কোনো সংঘের যোগাযোগ আছে। স্থানীয় পত্রিকাগুলোও অনুমান করার চেষ্টা করছে, আসল ঘটনা কী।”
ঘুম নষ্ট হলো ব্রিটিশ শাসকদের
মার্ক থ্রনহিল অনুসন্ধানে জানতে পারেন, রুটি ছড়িয়ে যাচ্ছে দক্ষিনে নর্মদা নদীর তীরবর্তী এলাকা থেকে উত্তরে নেপালের সীমানা পর্যন্ত কয়েকশত মাইল পর্যন্ত। এমনকি এক রাতেই এই রুটি ছড়িয়ে যাচ্ছে দুই থেকে তিনশত কিলোমিটার পর্যন্ত! থ্রনহিল তার অফিসে চাপাতি খুব গভীরভাবে পরীক্ষা করেও, তাতে অস্বাভাবিক কিছু পাননি। না কোনো বার্তা, না কোনো চিহ্ন। চাপাতিগুলোও ছিল স্বাভাবিক আকারের।
ধীরে ধীরে শত শত চাপাতি বিতরণ হতে লাগল ভারতের বিভিন্ন জেলাগুলোতে। রুটি বিতরণ অস্বাভাবিক রকমে বেড়ে গেলে, অচিরেই ব্রিটিশ প্রশাসনের ঘুম কেড়ে নেয় এই নিরীহ দর্শন চাপাতি।
রুটি বিতরণের সাথে জড়িত ছিল অধিকাংশ পুলিশ সদস্য ও গ্রাম চৌকিদার। ব্রিটিশরা যদিও বিষয়টিকে গুরুতরভাবেই সন্দেহ করছিল কিন্তু রুটি বিতরণ প্রতিরোধ করতে তারা কোনো কার্যকর ব্যবস্থাই নিতে পারছিল না, কারণ যেহেতু রুটি বিতরণ অবৈধ কিছু নয়, কিংবা এর মধ্যে কোনো বার্তাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। কাজেই রুটি বহনকারীদের কাউকে গ্রেফতার, কিংবা আইনের মুখোমুখিও করাও সম্ভব হচ্ছিল না।
রুটি নিয়ে যত রটনা
রুটি বিতরণকারীদের কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও কিছু জানা সম্ভব হয়নি, কারণ তারাও ঠিক করে কিছু বলতে পারছিল না, কেন তারা রুটি বহন করছে। ব্রিটিশ প্রশাসন নানাভাবে অনুসন্ধান ও জিজ্ঞাসাবাদ করেও সঠিক কোনো উপসংহারে পৌঁছতে পারছিল না। তবে তারা ঠিকই অনুমান করতে পারছিল, এর আড়ালে কিছু না কিছু ঘটে চলছে।
অনেকে শক্তভাবেই অনুমান করছিল, হয়তো কোনো গোষ্ঠী কোন গোপন বার্তা পৌঁছানোর চেষ্টা করছে রুটির মাধ্যমে। তবে রুটির মধ্য থেকে কোনো বার্তা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি বলে নিশ্চিত হওয়া যায়নি বার্তা পাঠানোর সাথে, রুটি বিতরণের উদ্দেশ্যের আসলেই কোনো সংযোগ ছিল কিনা।
কেউ কেউ অবশ্য মনে করেছিল, রুটি বিতরণের উদ্দেশ্য ছিল কলেরা কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে ফসল রক্ষায় ভারতীয় কুসংস্কারের অংশ। আর কেউ কেউ একে ভেবেছিল নিতান্তই কাকতালীয় ঘটনা! যা-ই হোক, পরবর্তীতে সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাস অনুসন্ধানে, এই চাপাতি বিতরণের একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা সম্পর্কে প্রায় সকলেই নিশ্চিত হন।
অভিনব মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধকৌশল
জে ডব্লিউ শিরার তার ‘Life During the Indian Mutiny’ গ্রন্থে রুটি বিতরণ সম্পর্কে মন্তব্য করেন, “যদি রুটি বিতরণের উদ্দেশ্য সত্যিকার অর্থেই বিদ্রোহকে ছড়িয়ে দেওয়ার মানসে হয়ে থাকে তবে বলা যায় এটি ছিল অত্যন্ত একটি সফল কূটচাল।”
বড় ধরনের একটি বিদ্রোহের প্রাক্কালে চাপাতি বিতরণের মতো একটি অভিনব কৌশল একদিকে যেমন ইংরেজদের বিভ্রান্ত করে, অপরদিকে এর আড়ালে সশস্ত্র প্রস্তুতি নেওয়া সহজ হয় বিদ্রোহের জন্য। সেইসাথে চাপাতি বিতরণ ছিল, আসন্ন বিদ্রোহের একটি বার্তা। সেই সময়টাতে একটি বিশ্বাস প্রচলিত হয়ে উঠেছিল যে, ইংরেজ শাসনের শত বছর পূর্ণ হলে তাদের পতন অনিবার্য!
সেই সময়টাতে চাপাতি বিতরণের মাধ্যমে, রাজনৈতিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছিল বিদ্রোহীরা, এবং সাধারন মানুষও এটিকে সেই অর্থেই নিয়েছিল যে, অচিরেই কিছু ঘটে চলেছে।
মৌলভী আহমাদুল্লাহ শাহ: নেপথ্যের নায়ক
সিপাহী বিদ্রোহের অন্যতম একজন নেতা ছিলেন মৌলভী আহমাদুল্লাহ শাহ। ইংরেজ সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল থমাস সিয়েটনের মতে তিনি ছিলেন, “একজন মহৎ ক্ষমতাসম্পন্ন, প্রচন্ড সাহসী, দৃঢ় সংকল্পের জন্য অনন্য ও সিপাহী বিদ্রোহের সবচেয়ে ভালো যোদ্ধা।” চাপাতি আন্দোলনের নেপথ্যের নায়ক মনে করা হয় তাকেই।
বিদ্রোহের কিছুকাল আগে থেকেই তিনি ভারতের উত্তর পশ্চিমের প্রদেশগুলো ভ্রমণ করেছিলেন, এবং সম্ভাব্য বিদ্রোহের বার্তা দেওয়ার জন্য, রুটি বিতরণের কৌশল গ্রহণ করেছিলেন। সেইসাথে রুটি বিতরণ ছিল ইংরেজদের চোখে ধুলো দেওয়ার ফন্দি। এর আড়ালে সশস্ত্র বিদ্রোহের প্রস্তুতি গ্রহণ করে, ইংরেজদের ঘোল খাওয়ানোয় তার এই পরিকল্পনা ছিল সফল।
তবে ইংরেজরা আহমাদুল্লাহ শাহ’র বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে, তাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পঞ্চাশ হাজার রুপি পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। ইংরেজ সরকার তাকে পাটনা থেকে অাটক করতে সমর্থ হয় ও তার মৃত্যুদণ্ডের ঘোষনা দেয়। কিন্তু এর মধ্যেই বিদ্রোহ শুরু হয় এবং বিদ্রোহীরা তাকে জেল থেকে মুক্ত করে। পরে পবায়নের রাজা জগন্নাথ সিংহের বিশ্বাসঘাতকতায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
সিপাহী বিদ্রোহ শুধুমাত্র সিপাহীদের বিদ্রোহ ছিল না। বরং তা ছিল কৃষক-জনতা-সিপাহীদের সম্মিলিত প্রতিরোধ। এ বিদ্রোহ যদিও পুরোপুরি সফলতার মুখ দেখেনি। কিন্তু উপমহাদেশের ইতিহাসে এই বিদ্রোহের রয়েছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও তাৎপর্য। সেই বিদ্রোহের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে চাপাতি আন্দোলনের মতো ধুরন্ধর যুদ্ধ কৌশলের নামও। চাপাতি বিতরণের মতো অদ্ভুত কৌশল গ্রহণের ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে হয়তো আর একটিও আছে কিনা সন্দেহ!
ফিচার ইমেজ: tribuneindia.com
তথ্যসূত্র: