বিভিন্ন মুখরোচক খাবার দ্বারা ভোজনপর্ব শেষে দাঁত পরিষ্কার করার জন্য আমাদের অন্যতম দরকারি উপকরণ হয়ে দাঁড়ানো ছোট বস্তুটির নাম ‘টুথপিক’ কিংবা খড়কে। আমাদের নিত্যদিনের ব্যবহার্য বস্তুর মধ্যে টুথপিকের অবস্থান তেমন তাৎপর্যপূর্ণ না হলেও এর গুরুত্ব অস্বীকার করার মতো নয়। বলতে গেলে, সভ্য সমাজের ভোজনপর্বের অত্যন্ত কাজের জিনিস এই টুথপিক। কিন্তু সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, নরম কাঠের তৈরি এই ছোট বস্তুটি আবিষ্কারের শুরুর দিকে ঠিক এরকম ছিল না। দাঁতের ফাঁকে লুকিয়ে থাকা খাদ্যকণা বের করার বাইরেও এর বহুমুখী ব্যবহার ছিল। এমনকি সামাজিক মর্যাদার প্রতীক হিসেবে গণ্যমান্যদের হাতে শোভা পেত কারুকার্যখচিত টুথপিক। প্রাচীনকালে সামাজিক পরিমণ্ডলের বাইরে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে টুথপিক হয়ে উঠেছিলো ভয়ংকর অস্ত্র। দেখতে সামান্য মনে হলেও এই টুথপিকের পেছনে লুকিয়ে আছে এক রোমাঞ্চকর ইতিহাস। চলুন জেনে নেয়া যাক সেই ইতিহাস সম্পর্কে।
প্রাচীনতম টুথপিকের সন্ধানে
যদি প্রশ্ন করা হয়, মানুষ সর্বপ্রথম কত সালে টুথপিক ব্যবহার করা শুরু করে? তাহলে অনেকেই উত্তরের কাঁটা সপ্তদশ শতাব্দীর ঘরে এনে রাখবেন। কারণ, আধুনিক সভ্যতার শুরু থেকেই সর্বপ্রথম বাণিজ্যিকভাবে টুথপিকের বাজারজাতকরণ করা হয়। কিন্তু আপনারা জেনে অবাক হবেন, উত্তরটি সম্পূর্ণ ভুল! এবার হয়তো অনেকেই ক্যালেন্ডারের পাতায় আরো কয়েক শতাব্দী পিছিয়ে গিয়ে উত্তর দেবেন। কিন্তু তারপরেও উত্তরটি সম্পূর্ণ ভুল হবে। পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন টুথপিকের সন্ধানে আমাদেরকে শুধু ক্যালেণ্ডারের পাতায় পেছনে গেলেই চলবে না, বরং চোখ বুলাতে হবে আমাদের পূর্বপুরুষদের ইতিহাসে। বর্তমান Homo sapiens কিংবা মানুষের পূর্বপুরুষ Homo neanderthalensis (সংক্ষেপে Neanderthal)-দের প্রাপ্ত করোটির দাঁত পরীক্ষা করে টুথপিকের ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। এই তথ্য উদঘাটনের পর নড়েচড়ে বসেছেন বিজ্ঞানীরা। প্রাচীনযুগের বন্য পৃথিবীর বুকে যখন আমরা ছিলাম না, তখনও নাকি ব্যবহৃত হতো টুথপিক!
আজ থেকে প্রায় চল্লিশ হাজার বছর পূর্বে নিয়ান্ডারথালরা বিলুপ্ত হয়ে যায়। আর পৃথিবীর প্রাচীনতম টুথপিকের ব্যবহার হয়েছিলো আজ থেকে প্রায় ১.৮ মিলিয়ন বছর পূর্বে। জর্জিয়ার মানিসি নামক স্থানে প্রাপ্ত নিয়ান্ডারথাল করোটির দাঁত পরীক্ষা করে এই তথ্য লাভ করা হয়। গবেষকদের মতে, নিয়ান্ডারথালের উপরের পাটির দাঁতের মূলের দিকে টুথপিকের আকারের বেশ ঘন আঁচড় লক্ষ্য করা যায়। পরবর্তীতে আরো কয়েকটি নমুনা পরীক্ষার মাধ্যমে টুথপিক ব্যবহার সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। পুরাতত্ত্ববিদগণের মতে, টুথব্রাশ বা মাজন ব্যবহারের বহু আগে থেকেই টুথপিকের ব্যবহার শুরু হয়। তখন মানুষ দাঁত পরিষ্কার রাখার উদ্দেশ্যে শক্ত কাঠের তৈরি টুথপিক ব্যবহার করতো।
মধ্যযুগীয় বিলাসিতা
সময়ের আবর্তে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেলো নিয়ান্ডারথালরা। এরপর শুরু হলো স্যাপিয়েন্সদের যুগ। প্রাচীন অন্ধকার যুগ পাড়ি দিয়ে শুরু হলো সভ্যতার উৎসব। সভ্য পৃথিবীতে টুথপিক পেলো এক নতুন পরিচয়। ইউরোপের সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্যবৃন্দ আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে বিভিন্ন দামি ধাতুর কারুকার্যখচিত টুথপিক ব্যবহার শুরু করে। এমনকি উনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভেও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে দামি টুথপিক ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়।
টুথপিকের বিলাসিতা নিয়ে একটি মজার ঘটনা বলা যাক। উনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপে বিয়ের যৌতুক হিসেবে পাত্রীপক্ষকে বিভিন্ন মূল্যবান বিলাসবহুল বস্তুসামগ্রী উপহার দিতে হতো। ইতালির পার্মা শহরের সম্ভ্রান্ত নারী লুই মারি থেরেসি দার্তোয়া তার বিয়েতে বিলাসিতায় সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেলেন। তিনি পাত্রপক্ষকে যৌতুক হিসেবে এক ডজন সোনালী টুথপিক উপহার দিয়েছিলেন! তৎকালীন ইউরোপে এই ঘটনা বেশ সাড়া জাগিয়েছিলো। আসলেই তো! এক ডজন টুথপিক উপহার দেয়া কি সহজ ব্যাপার?
টুথপিক যখন অস্ত্র
ইতিহাসবিদ দিদোরাস সিকুলাসের পাণ্ডুলিপি থেকে টুথপিক সম্পর্কে বেশ কিছু রোমাঞ্চকর তথ্য উদঘাটন করা সম্ভব হয়েছে। প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার এই বিখ্যাত ইতিহাসবিদের মতে, গ্রিসের সিরাকিউস রাজ্যে এক অত্যাচারী শাসক ছিলেন। তার নাম ছিল আগাথক্লিস। তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে একদল বিদ্রোহী তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিলো। কিন্তু রক্ষীদের চোখ এড়িয়ে তাকে হত্যা করা খুব কঠিন হবে। আর মুখোমুখি লড়াইয়ে আগাথক্লিসকে পরাজিত করা অসম্ভব। তাই তারা ভিন্ন পথ অবলম্বন করলো। আগাথক্লিসের ব্যক্তিগত সামগ্রীর মধ্যে কিছু মূল্যবান টুথপিকের সংগ্রহ ছিল। বিদ্রোহিরা গোপনে টুথপিকে বিষ মাখিয়ে দিলো। আগাথক্লিস টুথপিক ব্যবহারের পর বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
এভাবে টুথপিক আততায়ীদের প্রিয় অস্ত্রে রূপান্তরিত হয়। ইতিহাসে এরূপ বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের সাথে টুথপিকের সম্পর্ক পাওয়া যায়। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে গবেষকদের নিকট মানুষের হাড়ের মতো টুথপিকও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
চতুর চার্লস ফর্স্টার
আধুনিক সভ্যতায় হঠাৎ করে টুথপিকের ব্যবহার হ্রাস পেতে থাকে। তবে সীমিত আকারে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে টুথপিক উৎপাদন করা হতো। এদের মধ্যে পর্তুগাল এই ক্ষেত্রে সফলতার মুখ দেখে। পর্তুগালের বিভিন্ন কুটিরশিল্পীর উদ্যোগে উন্নতমানের টুথপিক উৎপাদন করা হতো। একটা সময়ে সেই টুথপিক ইউরোপের অন্যান্য দেশে রপ্তানি করা শুরু হয়। ধীরে ধীরে ইউরোপের গণ্ডি পেরিয়ে টুথপিক আমেরিকা মহাদেশে রপ্তানি হওয়া শুরু হয়। ঠিক তখন টুথপিকের সাথে সাক্ষাৎ হয় এক কিংবদন্তী ব্যবসায়ীর।
১৮২৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের চার্লসটাউনে জন্মগ্রহণ করা চার্লস ফর্স্টার নামক এক ব্যবসায়ী তখন ব্রাজিলে মাছ রপ্তানির উদ্দেশ্যে অবস্থান করছিলেন। ফর্স্টার মানুষ হিসেবে অত্যন্ত চালাক ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে তার সম্পর্কে বিভিন্ন প্রবাদ প্রচলিত ছিল। অনেকে কৌতুক করে বলতেন, ফর্স্টার বুদ্ধির জোরে একজন নিরামিষাশীর নিকট কয়েক কেজি মাংস বিক্রি করে দিতে পারতেন অনায়াসে। ফর্স্টার ব্রাজিলের মানুষদের সাথে বন্ধুত্ব করার পর লক্ষ্য করলেন যে, তাদের দাঁত খুব সুন্দর। কৌতূহলী ফর্স্টার এই রহস্য উদ্ঘাটনের সময় টুথপিকের সন্ধান লাভ করেন। তিনি টুথপিক নিয়ে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গিয়েই তিনি কাজে লেগে পড়েন।
তবে মার্কিন মুলুকে নতুন ব্যবসার মাধ্যমে সফল হওয়া খুব সহজ ব্যাপার নয়। তাই ফর্স্টার এক অভিনব পন্থা অবলম্বন করেন। তিনি বেশ কিছু লোক ভাড়া করে দোকানে দোকানে টুথপিক কেনার জন্য প্রেরণ করেন। হঠাৎ করে টুথপিকের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দোকানিরা ক্রেতার মন জয় করতে টুথপিক সংগ্রহ করা শুরু করে। কিন্তু তারপরেও বিক্রি বেশিদিন চললো না। তাই ফর্স্টার এবার রেস্তোরাঁয় টুথপিক প্রচলনের উদ্যোগ নেন।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্র তাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসে। তারা শহরের বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় খাওয়াদাওয়ার পর টুথপিক দেয়ার জন্য ম্যানেজারদের নিকট আবেদন করে। ছাত্রদের মন রক্ষার্থে ম্যানেজাররা বাধ্য হয়ে টুথপিক সরবরাহ শুরু করে। ছাত্র ছাড়া অন্যান্য ক্রেতারাও নরম, সরু কাঠের তৈরি টুথপিকের ভক্ত হয়ে গেলো। ফলে ফর্স্টারের নিকট প্রচুর পরিমাণে টুথপিক উৎপাদনের অর্ডার আসতে থাকলো। ১৮৭০ সালে চার্লস ফর্স্টার বেশ বড় পরিসরে আমেরিকার বুকে প্রথম বাণিজ্যিক টুথপিক উৎপাদন কারখানা স্থাপন করেন। এর মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে প্রচুর পরিমাণে টুথপিক উৎপাদন শুরু হয়। চার্লস ফর্স্টারের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত টুথপিকের চাহিদা দিন দিন বাড়তে থাকে। প্রতি বছর প্রায় শত কোটি টুথপিক উৎপাদিত হচ্ছে। চীনের বাণিজ্যিক জরিপ অনুযায়ী, প্রতি বছর শুধু চীনেই প্রায় ২০০ বিলিয়ন টুথপিক উৎপাদিত হয়ে থাকে!
একটা সময়ে বিজ্ঞাপনের খাতিরে টুথপিক ব্যবহার শুরু হয়। হোটেলের সামনে তরুণ যুবকের টুথপিক মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ছবি যেন তৃপ্তিদায়ক ভোজনের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে। ইউরোপের বিভিন্ন সমাজে তরুণরা ফ্যাশন হিসেবে মুখে টুথপিক ব্যবহার করতে থাকে। দাঁতের ফাঁকে টুথপিক কামড়ে রাখাকে আধুনিকতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ধরা হতো। হলিউডের সিনেমায় তারকারা টুথপিকের এই আধুনিকতাকে লুফে নেন। ছোট-বড় সবরকম রেস্তোরাঁতে ভোজন শেষে ভদ্রতাসূচকভাবে ক্রেতাদের টুথপিক প্রদান করা হয়। বিংশ শতাব্দী পেরিয়ে একবিংশ শতাব্দীতে টুথপিক এক অপরিহার্য সামগ্রীতে পরিণত হয়েছে। আকারে ছোট হলেও কাজের দিক থেকে বেশ পটু এই টুথপিক আজ সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের নিকট গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে।
ফিচার ইমেজ: Newstage