তিরিশ দিনেতে হয় মাস সেপ্টেম্বর, সেইরূপ এপ্রিল-জুন আর নভেম্বর।
আটাশ দিনেতে সবে ফেব্রুয়ারি ধরে, বাড়ে তার একদিন চতুর্থ বৎসরে।
লিপিয়ার বলে তারে রেখো ভাই মনে, অবশিষ্ট মাস হয় ৩১ দিনে।।
– সোমনাথ সেন
কোন মাস ৩০ দিন আর কোন মাস ৩১ দিনে ছোটবেলা থেকে এভাবেই হিসাব করা শিখেছি আমরা। এসব হিসেবের মাঝে ফেব্রুয়ারি মাসটা একটু ভিন্ন। ২৮ দিনের ফেব্রুয়ারি মাস ৪ বছর পর পর ২৯ দিনে হয়। প্রতি চার বছর পর অতিরিক্ত একদিন বাড়িয়ে যে বর্ষটি হয়, তাকে বলে লিপ-ইয়ার বা অধিবর্ষ।কোনো সনকে চার দিয়ে ভাগ করলে যদি নিঃশেষে ভাগ যায়, তাহলে সেই সনই অধিবর্ষ।
বাস্তবে, এটা ভুল ধারণা। মজার কথা হলো, এই ভুলটা জুলিয়ান ক্যালেন্ডারেরই ভুল। যাক, আমরা তো অনুসরণ করি গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। সেখানকার হিসাব অন্য রকম।
প্রকৃত হিসাব
খুব সহজ করে যদি বলা হয়, আধুনিক বর্ষপঞ্জি সৌরবর্ষের হিসেবে লিখিত। সূর্যকে কেন্দ্রে রেখে পৃথিবী সর্বদা ঘুরছে। এক পাক ঘুরতে যে সময় লাগে তাকেই আমরা একটি সৌরবর্ষ বলি। সূর্যের পাশ দিয়ে পৃথিবীর এক পাক ঘুরতে সময় লাগে ৩৬৫ দিন এবং অতিরিক্ত কিছু সময় যা প্রায় একদিনের চারভাগের এক ভাগ (One fourth)। তো আমরা এজন্যই বলি, এক বছরে কয় দিন? ৩৬৫ দিন।
এখন প্রশ্ন, ঐ অতিরিক্ত অংশ (এক-চতুর্থাংশ) যে বাদ গেল সেটার কী হবে? হ্যাঁ, প্রতি বছর এক-চতুর্থাংশ করে বাদ যাচ্ছে। চার বছরে বাদ যাচ্ছে পুরো একটা দিন। তাই ঐ পুরো একটা দিনকে আমরা চতুর্থ বর্ষে অতিরিক্ত দিন (Leap day) হিসেবে যোগ করি, এমন একটা মাসের সাথে যার দিনের সংখ্যা সবচেয়ে কম (ফেব্রুয়ারি)। ব্যস, হয়ে গেল একটা অধিবর্ষ।
কিন্তু আসলেই কি আমাদের হিসাব ঠিক?
না, আমাদের একটা ভুল হয়েছে। সূর্যের পাশ দিয়ে পৃথিবীর এক পাক ঘুরতে আসলে সময় লাগে ৩৬৫ দিন এবং ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট। ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট আসলেই কি এক দিনের চার ভাগের এক ভাগ? না, এক দিনের চার ভাগে এক ভাগ হলো ৬ ঘণ্টা (২৪ ঘণ্টাকে ৪দিয়ে ভাগ করুন)।
সোজাসাপ্টা বাংলায়, চার বছর পরে আমরা যে অতিরিক্ত একটা দিন বাড়ালাম তা পুরোপুরি ঠিক না। অর্থাৎ আমরা হিসাবের চেয়ে একটু বেশি ধরে ফেলেছি। এই ‘বেশি’টাকে বাদ দিব কী করে? হ্যাঁ, এজন্য আমরা একশ বছর পরে একটা দিন বাদ দিয়ে দেই। ঐ একটু একটু বেশি সময় একশ বছরে প্রায় একটা দিনের সমান হয়ে যায়, এজন্য প্রতি একশ বছরে একটা করে অধিবর্ষ বাদ যাবে। তার মানে কোনো সন চার দিয়ে ভাগ গেলে অধিবর্ষ হতে পারে; তারপর একশ দিয়ে ভাগ গেলে ওটা আর অধিবর্ষ হবে না।
এখন, আরো একটা সমস্যা হলো, একশ বছর পর পর যে একটা করে দিন আমরা বাদ দিচ্ছি সেটাও কি নিখুঁত হচ্ছে? না, এখানে একটু বেশি বাদ দেওয়া হচ্ছে। কারণ, একশ বছরে আসলে পুরো একটা দিন হয় না। একটু কম থাকে। একটু বেশিই বাদ দেওয়া হচ্ছে। তাই আমরা চারশ বছর পরে আর একটা দিন যোগ করে দিই। ব্যস, এখন মোটামুটি হিসাব সঠিক। এখানেও অল্প কয়েক সেকেন্ড বা মিলি সেকেন্ডের হেরফের হলেও বড় কোনো তারতম্য দেখা দেবে না।
সারকথা, প্রতি ৪ বছরে এক দিন যোগ করলাম। কিছুটা বেশি হলো। ১০০ বছরে একটা দিন বিয়োগ করলাম। কিছুটা কমতি হয়ে গেল। তাই ৪০০ বছরে একটা দিন আরো বাড়ালাম। আর কমানো-বাড়ানোর দরকার নাই।
অতএব, কোনো একটা সন ৪ দিয়ে যদি ভাগ যায়, তাহলে সেটা অধিবর্ষ হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। তারপর ১০০ দিয়ে ভাগ দিব, যদি যায় তাহলে সেটা অধিবর্ষ নয়; যদি না যায় তাহলে অধিবর্ষ। আর কোনো সন যদি ৪০০ দিয়ে ভাগ যায়, তাহলে সেটা অবশ্যই অধিবর্ষ হবে (৪ দিয়ে ভাগ না গেলেও কিংবা ১০০ দিয়ে ভাগ গেলেও)।
উপরের আলোচনায় অসংখ্য প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে। যেমন-
চান্দ্রবর্ষের হিসাব করলে দোষ কোথায়?
সৌরবর্ষের তুলনায় চান্দ্রবর্ষ বেশ সহজ। অনেক জাতি আগেও এই হিসেবে চলত বা এখনও এই হিসেব করে। যেমন- রোমানদের আদিমগোষ্ঠীরা চান্দ্রবর্ষের হিসাব মানতো, মুসলমানরা এখনও মানে। বিষয়টা অনেকটা কেজি আর পাউন্ডের হিসাবের মতো। ইউরোপে পাউন্ডের হিসাব জনপ্রিয় আর দক্ষিণ এশিয়ায় গ্রাম-কেজির হিসাব। সুতরাং, সৌরবর্ষ অধিক জনপ্রিয় বলে একে বেশিরভাগ মানুষ অনুসরণ করে।
আর বাস্তবে পৃথিবীর কোনো ক্যালেন্ডারই নিখুঁত নয়। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারেও প্রতি বছর ২৭ সেকেন্ড বাদ যাচ্ছে, যা ৩,২৩৬ বছরে এক দিনের সমান হয়! পরে রিভাইজ্ড গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার নামে আরো নিখুঁত ক্যালেন্ডার প্রবর্তনের তাগিদ নেওয়া হলেও তাতেও ২ সেকেন্ডের ত্রুটি! ২ সেকেন্ডের ত্রুটিও কম ত্রুটি নয়।
অন্যদিকে, চান্দ্রবর্ষের হিসাব সৌরবর্ষ থেকে ১১ দিন পিছিয়ে। আবার এতে অধিবর্ষও ধরার উপায় নেই। কারণ, চাঁদ দেখেই সাধারণত এই ক্যালেন্ডার নিরূপণ করা হয়। তাই তিন বছর পর পর এটি প্রায় এক মাস পিছিয়ে যায়। ৩৩ বছরে এক বছর পিছিয়ে যায়। ধরি, একজন মুসলিম যখন রমযান মাসে রোজা থাকে; সেই রমযান মাস প্রতি তিন বছরে এক মাস পিছিয়ে যায়। এবার গ্রীষ্মকালে তো ছয় বছর পরে বর্ষাকালে; আরো ছয় বছর পর শরৎ, হেমন্ত, শীত- এভাবে ঘুরে ঘুরে সব ঋতুতেই সে রমযান পালন করে এবং রমযানের শেষে মহা উৎসব ঈদ! তারপরে হজ, তারপরে আরেক ঈদ!
পাঠকের জানার কথা, চীনেও লুনার ইয়ার উদযাপনের প্রথা মানা হয় অতি সাম্প্রতিককালেও। যদিও চৈনিক ক্যালেন্ডার পুরোপুরি চান্দ্রবর্ষীয় নয়। বরং অনেকটা মিশ্র ক্যালেন্ডার। তাই এর হিসাব বের করতেও চাঁদ দেখা লাগে।
চীনা ক্যালেন্ডার দুই ভাগে বিভক্ত, প্রথম অংশে আছে ১০টি মাস আর দ্বিতীয় অংশে ১২টি। প্রথম অংশটিকে বলা হয় স্বর্গীয় অংশ আর দ্বিতীয় অংশ পার্থিব। প্রথম অংশে মাসগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে স্বর্গীয় উপাদানসমূহের (আগুন, পানি, মাটি, কাঠ ও ধাতু) নামে। আমাদের ভারতবর্ষে যাকে বলা হয় পঞ্চভূত- আগুন, পানি, মাটি, বাতাস ও আকাশ। চৈনিকগণ ঐ পাঁচ উপাদানকে দুই অবস্থায় ভাগ করে ১০টি মাস নির্ধারণ করেন- Jia (বর্ধনশীল কাঠ), Yi (কর্তিত কাঠ), Bing (প্রাকৃতিক আগুন), Ding (কৃত্রিম আগুন), Wu (মাটি), Ji (মাটির পাত্র), Geng (ধাতু), Xin (আকৃতিপ্রাপ্ত ধাতব বস্তু), Ren (প্রবহমান পানি) ও Gui (স্থির পানি)।
আর দ্বিতীয় অংশ, যাকে ‘চাইনিজ যোডিয়াক ক্যালেন্ডার’ বলে, এতে বারো মাসের নাম বারোটি পার্থিব প্রাণীর নামে- Zi (ইঁদুর), Chou (ষাঁড়), Yin (বাঘ), Mao (খরগোশ), Chen (ড্রাগন), Si (সাপ), Wu (ঘোড়া), Wei (ছাগল), Shen (বানর),You (মোরগ), Xu (কুকুর) এবং Hai (শুকর)। এই প্রাণীগুলোর নাম নিয়ে একটা লোককথাও প্রচলিত আছে। স্বর্গের শাসক (Jade Emperor) Yù Dì, সময় পরিমাপের জন্য এই বারোটি প্রাণীকে নিয়ে একটি নদী পেরোনোর “মহান প্রতিযোগিতা” (The grate race) এর আয়োজন করেন। জয়ের তালিকা অনুসারে ক্যালেন্ডারে তাদের নাম লিপিবদ্ধ করা হয়।
তো এই দুই অংশের ক্যালেন্ডার আসলে একটু ভিন্ন নিয়মে চলে। এটি আসলে এক বছরের হিসাব করে না। বরং পুরো ষাট বছরকে একত্রে একটি চক্র ধরা হয়। চক্রের প্রতিটি বছরের আলাদা আলাদা নাম দেওয়া হয় ১ম ও ২য় অংশ মিলিয়ে। যেমন, ১ম বছরের নাম হবে: Jia-Zi (কাঠ-ইঁদুর), ২য় বছর: Jia-Chou(কাঠ-ষাঁড়)… এভাবে একেবারে ৬০ নম্বর বছর হবে Gui–Hai (পানি-শুকর)। আশা করি বুঝতে পেরেছেন। তো হিসাবটা বেশ সহজ। সব মিলিয়ে ১২০ বছর হয় (১০×১২)। অর্ধেক করলে হয় ৬০ বছর। এই হলো ষাট বছরের দুটি চক্র।
যোডিয়াক ক্যালেন্ডার নিয়ে অনেক কল্পকথা চীনা সমাজে প্রচলিত আছে। যেমন বলে আসলাম, ‘মহান প্রতিযোগিতা’ বা ‘দ্য গ্রেট রেস’ এর কথা কথা। সেখানে ইঁদুর হয়েছিল প্রথম! আর শুকর তার আলসেমি আর খাওয়া-দাওয়ার জন্য সবার পেছনে পড়ল।
এছাড়াও চীনারা ভাবে, যোডিয়াক ড্রাগন হলো সবচেয়ে ভাগ্যবান মানুষ। এজন্য ড্রাগনের সনটি যোডিয়াক সনের সর্বাধিক সন্তান গ্রহণের বছর হয়। তাছাড়া, খরগোশ অনেক ভাগ্যবান, বানর অনেক বুদ্ধিমান, বাঘ আর ছাগলের শত্রু বা প্রতিদ্বন্দ্বী থাকে না ইত্যাদি। তাছাড়া চাইনিজ যোডিয়াক সাইন দিয়ে মানুষের বয়সের অনুমান করা যায়। যেমন, একজন তরুণী যদি ২০২০ সনে বলে সে একজন বানর তাহলে তার বয়স ১৬ বা ২৮ কিংবা সর্বোচ্চ ৪০ হতে পারে। এছাড়া আর কিছু না। কারণ সাম্প্রতিক যোডিয়াক বানরের সনগুলো হলো- ২০১৬, ২০০৪, ১৯৯২, ১৯৮০, ১৯৬৮, ১৯৫৬, ১৯৪৪। এবার হিসাব করেই দেখুন তার বয়স কত হতে পারে!
চাইনিজ যোডিয়াকই এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এসে কিছু পরিবর্তিত হয়েছে সেসব দেশের সংস্কৃতির সাথে মিল রেখে। যেমন, ভিয়েতনামে যোডিয়াকে খরগোশের স্থানে আছে বিড়াল, থাইল্যান্ডে ড্রাগনের স্থলে আছে ‘নাগা’ নামের দানবীয় পৌরাণিক সাপ।
তাছাড়া পশ্চিমা যোডিয়াক (Western Zodiac) যেমন রাশি নির্ধারণে ব্যবহৃত হয়, তেমনি চাইনিজ যোডিয়াক দিয়ে রাশি, ভাগ্য, বিবাহের শুভাশুভ লক্ষণ ইত্যাদি নির্ণয় করা হয়।
বিবিসির তথ্যমতে, ২০১৫ সনে হঠাৎ প্রচুর পরিমাণে গর্ভবতী নারীর সিজারিয়ান অপারেশন করা হয়েছে। কেন? কারণ, ঐ বছরটা ছিল যোডিয়াক ঘোড়ার শেষ সময়। সন্তানকে ঘোড়া বানানোর জন্য এত তোড়জোড়! না, আসলে ওর পরের বছরটিই ছিল যোডিয়াক ছাগলের বছর! তবে আমরা হয়তো জানি, যোডিয়াক সন হিসেবে বিশ্বের অন্যতম ধনী বিল গেটস এবং তার বন্ধু স্টিভ জভস উভয়েই হলেন ছাগল! তো ব্যাপারটার ব্যাখ্যা এভাবে করা হয়, আসলে বাঘ আর ছাগলের প্রতিদ্বন্দ্বী কম, তাই এরা বড়লোক হতে পারে। জেনে খুশি হবেন, মিশন ইম্পসিবলের অভিনেতা টম ক্রুজ আর টাইটানিক খ্যাত অভিনেতা ডিক্যাপ্রিও হলেন যোডিয়াক বাঘ।
তো যা-ই হোক, আপনিও হয়তো আপনার যোডিয়াক প্রাণী খুঁজে নিতে লেগে পড়েছেন। তবে এটা জেনে রাখুন, যোডিয়াক প্রাণী তিন ধরনের- ১. অভ্যন্তরীণ প্রাণী; যা জন্মসাল দিয়ে বের করা হয়, ২. সত্যিকার প্রাণী; যা জন্মের প্রকৃত তারিখ দিয়ে বের করা যায়, ৩. গোপন প্রাণী; যা বের করা যাবে জন্মের সঠিক সময় দিয়ে। কাজেই জন্মতারিখ বের করেই ঘাবড়াবেন না।
এই ছিল চান্দ্রবর্ষের কিছু কথা। আমরা এবারে আবার সৌরবর্ষ এবং অধিবর্ষ সংক্রান্ত আলোচনায় ফিরে যাবো।
কেন ফেব্রুয়ারি মাস ২৮ দিনে? কে বানাল?
ফেব্রুয়ারি মাসকে ২৮ দিন বানিয়েছেন রোমের ২য় রাজা নুমা পম্পিলিয়াস । রোমের প্রথম রাজা রোমিউলাসের আমল পর্যন্ত প্রচলিত ক্যালেন্ডারকে তিনি চান্দ্রবর্ষের সাথে মেলানোর জন্য (ঋতুরও একটু সমস্যা ছিল যা) পরিবর্তন করেন। অনেকটা হ-য-ব-র-ল অবস্থা হয়। রোমের ক্যালেন্ডারে মার্চ থেকে ডিসেম্বর মোট ১০টি মাস ছিল- মার্চিয়াস (মার্চ), এপ্রিলিস (এপ্রিল), মাইয়াস (মে), লুনিয়াস (জুন), কুইন্টিলিস (বর্তমানে জুলাই), সেক্সটিলিস (বর্তমানে অগাস্ট), সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর। এই মাসগুলোর কয়েকটির নাম গ্রীক দেব-দেবীদের নামে আর কয়েকটি ল্যাটিন সংখ্যা পদ্ধতি খেকে (কুইন্টিলিস-৫, সেক্সটিলিস-৬, সেপ্টেম্বর-৭, অক্টোবর-৮, নভেম্বর-৯, ডিসেম্বর-১০)। আর জুলাই, আগস্টের কথা পরের প্রশ্নের আওতায় আসছে।
মার্চ, মে, জুলাই এবং অক্টোবর ছিল ৩১ দিনের। বাকিগুলো ৩০ দিনের। মোট হয় ৩০৪ দিন (৩১×৪ + ৩০×৬)। অথচ চান্দ্রবর্ষ ৩৫৪ দিনের। যাক, তিনি প্রত্যেক ৩০ দিনের মাস থেকে এক দিন করে কাটেন (৩০৪-৬=২৯৮) এবং জানুয়ারি (লানুয়ারিয়াস), ফেব্রুয়ারি (লানুয়ারিয়াস) দুটো মাস নির্ধারণ করেন। জানুয়ারিকে দেন ২৯ দিন আর ফেব্রুয়ারিকে দান করেন মাত্র আটাশ দিন (২৮+২৯=৫৭)। ফলে, বছরে মোট মাস হয় ১২ আর মোট দিন হয় ৩৫৪ দিন (৩০৪+৫৭)। তো, এভাবে ফেব্রুয়ারি মাস ২৮ দিনে হয়ে যায়।
আফসোসের বিষয়, নুমা মহারাজের সেই নিয়ম পরে ভেঙে নতুন করে জুলিয়াস সিজার সৌরবর্ষের হিসাবে ক্যালেন্ডার তৈরি করেন যাকে বলা হয়, জুলিয়ান বর্ষপঞ্জি। পরে একে কিছুটা পরিবর্তন করেন পোপ গ্রেগরি। যাকে বলা হয়, গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার।
সৌরবর্ষের ক্যালেন্ডার কীসের ভিত্তিতে তৈরি? কোনো মাস ৩০ দিনের, কোনোটা ৩১ দিনের!
আসলে সৌরবর্ষের ৩০ দিন আর ৩১ দিনের হিসাবের বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নাই। রোমানরা তাদের সেনামহরা, আমোদ-ফূর্তি, গ্ল্যাডিয়েটরদের খেলাধুলা ইত্যাদির ভিত্তিতে মাসগুলোকে প্রয়োজনে ৩০ আর ৩১ হিসেবে দশটি মাসে পরিণত করে। ব্যস, সেই হিসাব কেউ আর পাল্টায়নি। জুলিয়াস সিজারও না। পোপ গ্রেগরিও না। জুলিয়াস সিজার মূলত জুলাই মাস (নিজের নামে) আর অগাস্ট মাস (সেনাপতি অগাস্টাস সিজারের নামে) রাখেন।
জুলিয়ান ক্যালেন্ডার আর গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের ইতিহাস কী?
সৌরবর্ষের হিসাব প্রথম প্রচলন করে মিশরীয়রা। তাদের বছর চলত ১২ মাসে, ৬ ঋতুতে এবং ৩৬৫ দিনে। আমরা অবাক হই, এত আগে তারা কীভাবে এত নির্ভুল হিসাব করেছিল! যদিও তাদের কাছে অ্যাস্ট্রোল্যাব, সেক্সট্যান্ট বা অনুরূপ কোনো যন্ত্র ছিলই না!
পরে গ্রীক ও রোমান বিজ্ঞানীগণ (টলেমী এবং পরবর্তীগণ) হিসাব করে দেখেন মিশরীয়দের হিসাব অনেকাংশেই যথার্থ। কিন্তু রোমে তখনও চান্দ্রবর্ষের হিসাব চলত।
জুলিয়াস সিজার আদিম রোমান ক্যালেন্ডারকে সৌরবর্ষের সাথে মেলাতে কিছুটা পরিবর্তন করে যে ক্যালেন্ডার প্রচলিত করেন তাকেই জুলিয়ান ক্যালেন্ডার বলে। যিশু খ্রিস্ট (Jesus Christ) তথা ঈসা আ. এর জন্ম সনকে প্রথম বছর ধরে এই ক্যালেন্ডার শুরু হয়। খ্রিস্টের জন্মের আগের বছরগুলো বিসি (Before Christ) এবং পরের বছরগুলোকে বলা হল এডি (Anno domini: ল্যাটিন শব্দ, অর্থ: আমাদের প্রভু যিশুর বছর, রোমের ভাষা ল্যাটিন ছিল)। এই ক্যালেন্ডারে অধিবর্ষের হিসাব রাখা হয় অর্থাৎ ৪ বছরে একদিন বাড়ানো। কিন্তু ১০০ বছরে ১ দিন কমানো বা ৪০০ বছরে একদিন বাড়ানোর চিন্তা জুলিয়াস মহারাজের মাথায় আসেনি।
পঞ্চদশ শতাব্দীতে পোপ গ্রেগরি দেখেন, অধিবর্ষের হিসাবে বেশ গণ্ডগোল আছে। তিনি এজন্যই একে আরও কিছুটা পরিবর্তন করে যে ক্যালেন্ডার প্রণয়ন করেন তাকে বলে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। অর্থাৎ এই ক্যালেন্ডারে ১০০ বছরে ১ দিন কমানো হয় বা ৪০০ বছরে একদিন বাড়ানো হয়। আসলে ইস্টার উৎসবের হিসাব মিলছিল না দেখেই পোপের মাথায় এই চিন্তা আসে।
জুলিয়ান আর গ্রেগরিয়ান উভয় ক্যালেন্ডারকে খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডার বলা হয়; খ্রিস্টের জন্মসন থেকে যেহেতু এদের হিসাব সূচিত হয়।
জুলিয়ান ক্যালেন্ডার আর গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার নিয়ে মজার কিছু গল্প আছে। আমরা হয়তো অনেকেই জানি, গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার থেকে ১০ দিন হাওয়া হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে যে জোর করে ৬৭ দিন যোগ করা হয়েছিল সেটা হয়তো অনেকেই জানি না। আর এটাও হয়তো জানেন না, গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার নিয়ে কী পরিমাণ বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল।
জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে ৬৭ দিন যোগ করা আর গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার থেকে ১০ দিন গায়েব হওয়ার গল্পটা কী?
জুলিয়ান ক্যালেন্ডার চালুর দিনই দেখা গেল, চালুর বছরটিই প্রকৃত সৌরবর্ষ থেকে প্রায় ৬৭ দিন পিছিয়ে আছে। তাই ঐ বছরের নভেম্বর ও ডিসেম্বরের মধ্যে ‘ইন্টার ক্যালিয়ারি’ নামে তিনটি বিশেষ মাস (২২+ ২৩+ ২২) ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। সোজা কথায়, সৌরবর্ষের সাথে জোর করে মেলাতে হয়েছিল।
আর গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার নিয়ে তো বিরাট বিতর্ক বাঁধে। ক্যাথলিক-প্রোটেস্ট্যান্ট (খ্রিস্টানদের দুই দল) লড়াই শুরু হলো। প্রোটেস্ট্যান্টরা (বাইবেলের কট্টরপন্থী দল) মানতেই চাইল না। আর ক্যাথলিকরা (পোপ ভক্তদল) অনেকে মেনে নিল। যাক, অনেক পরে এসে রাশিয়া যখন মেনে নেয় তখন গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার সর্বত্র চালু হয়।
যেদিন গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার চালু হয় সেদিনটা ছিল ৪ অক্টোবর, ১৫৮২। অথচ ঐ একই দিন জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে ১৪ অক্টোবর, ১৫৮২। অর্থাৎ দুই ক্যালেন্ডারে ঐ সাল পর্যন্ত দশ দিনের পার্থক্য বিদ্যমান। এর কারণটা ছিল অধিবর্ষের হিসাব। জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে প্রতি চার বছরে একদিন করে বাড়ানো হয়েছে। কমানো হয়নি। কিন্তু গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে চার বছরে একদিন বাড়িয়ে ১০০ বছরে একদিন কমিয়ে ৪০০ বছরে একদিন বাড়ানোয় এই হিসাবের গরমিল।
শুধু ১০ দিনের পার্থক্য এমন নয়। এই পার্থক্য পরে আরো বেড়েছে। ১০, ১১, ১২, ১৪ এভাবে বাড়তেই থাকে। পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত পার্থক্য ১০ দিনের। ১৭০০-১৮০০ তে ১১ দিন, ১৮০০-১৯০০ তে ১২ দিন, ১৯০০-২১০০ তে ১৩ দিন এবং ২১০০-২২০০ তে ১৪ দিন।
বুঝতেই পারছেন, প্রতি একশ বছরে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার একদিন করে কমছে। কিন্তু ৪০০ দিয়ে ভাগ যায় এমন বছরগুলোতে নয় (যেমন- ১৬০০)।
বর্ষপঞ্জি, দিনপঞ্জি, কালপঞ্জি এগুলোর মধ্যে পার্থক্য কী? এরা কত প্রকার এবং কী কী?
পঞ্জি অর্থ তালিকা। বর্ষপঞ্জি হলো ক্যালেন্ডার। দিনপঞ্জি হলো দিনলিপি, রোজনামচা। কালপঞ্জি মানে ইতিহাস। যেমন, তথ্যপঞ্জি মানে তথ্যের তালিকা, গ্রন্থপঞ্জি মানে গ্রন্থের তালিকা বা বিবরণী। নক্ষত্রপঞ্জি মানে নক্ষত্রের তালিকা।
এখন ক্যালেন্ডার নিয়েই বলি। ক্যালেন্ডার মোটের ওপর কত প্রকার বলা মুশকিল। প্রধানত ৪ প্রকার-
১. চন্দ্রভিত্তিক (lunar): যেমন, মায়ানদের ক্যালেন্ডার Dreamspell, মুসলিমদের হিজরি ক্যালেন্ডার, ব্যাবিলনের ক্যালেন্ডার, অ্যাসিরীয় ক্যালেন্ডার ইত্যাদি।
২. সূর্যভিত্তিক (Solar): যেমন, মিশরীয় ক্যালেন্ডার, চাইনিজদের চার ঋতুর ক্যালেন্ডার, জুলিয়ান ক্যালেন্ডার, গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ইত্যাদি।
৩. চন্দ্র-সূর্যভিত্তিক (Lunisolar): যেমন, ভারতীয় বিক্রম সংবৎ ক্যালেন্ডার, রোমান ক্যালেন্ডার, প্রাচীন পারসিক ক্যালেন্ডার, ইনকা ক্যালেন্ডার, চাইনিজদের জেনেসিস ক্যালেন্ডার, গলদের ক্যালেন্ডার, জাপানীদের ক্যালেন্ডার, বাংলা ক্যালেন্ডার, হিব্রু ক্যালেন্ডার, তিব্বতী ক্যালেন্ডার ইত্যাদি।
৪. ঋতুভিত্তিক (Seasonal): প্রাচীন ভারতের বারো ঋতুতে বিভক্ত ক্যালেন্ডার (তপঃ, তপস্যা, মধু, মাধব, শুক্র, শুচি, নভস্, নভস্য, ইষ, ঊর্জ, সহস্ ও সহস্য। তপঃ থেকে শুচি পর্যন্ত উত্তরায়ণ এবং নভস্ থেকে সহস্য পর্যন্ত দক্ষিণায়ন এবং আমেরিকার বিশেষ কিছু ক্যালেন্ডার।
অপ্রধান প্রকারভেদ হলো- প্রাচীন, মধ্যযুগীয় ও আধুনিক।
এছাড়াও প্রকারভেদ আছে- ধর্মীয় (যেমন, হিজরি ক্যালেন্ডার, খ্রিস্টীয় ক্যালেন্ডার: জুলিয়ান ও গ্রেগরিয়ান, হিন্দু ক্যালেন্ডার, বৌদ্ধ ক্যালেন্ডার, মায়ান ক্যালেন্ডার, মিশরীয় ক্যালেন্ডার, অ্যাজটেক ক্যালেন্ডার) ও অধর্মীয়।
তো উপর্যুক্ত ক্যালেন্ডারগুলোর মধ্যে আমাদের ভারত উপমহাদেশে অত্যন্ত প্রাচীন ও প্রচলিত বর্ষপঞ্জি হলো রাজা বিক্রমাদিত্যের প্রবর্তিত ‘বিক্রম সংবৎ’। সংবৎ একধরনের বিশেষ ক্যালেন্ডার। ভারতের বিভিন্ন এলাকায় আরো অনেক পঞ্জিকা এবং সংবৎ প্রচলিত ছিল। বিক্রমাদিত্য শকদের পরাজিত করে তার বিজয়ের উপলক্ষে ৫৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এটি প্রবর্তন করেন। আগে শকদেরও সংবৎ ছিল যাকে বলা হত ‘শক সংবৎ’। এর পরে বাদশাহ আকবর হিমুকে পরাজিত করে বাংলা অব্দ প্রবর্তন করেন।
উভয় ক্যালেন্ডারের মাসের সংখ্যা ১২, মাসের নামগুলোও এক। যথা- চৈত্র, বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ ও ফাল্গুন। আমরা জানি, বাংলায় বৈশাখ থেকে হিসাব শুরু হয়। এর কারণ পরেই আলোচনা করা হবে। প্রত্যেক মাসের নাম এসেছে সেই মাসের পূর্ণিমার দিনে চলমান নক্ষত্রের নাম থেকে। বিশাখা থেকে বৈশাখ, জ্যেষ্ঠা থেকে জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়া থেকে আষাঢ়, শ্রবণা থেকে শ্রাবণ, ভাদ্রপদ থেকে ভাদ্র, অশ্বিনী থেকে আশ্বিন, কৃত্তিকা থেকে কার্তিক, অগ্রাইহনী থেকে অগ্রহায়ণ, পুষ্যা থেকে পৌষ, মঘা থেকে মাঘ, ফল্গুনী থেকে ফাল্গুন এবং চিত্রা থেকে চৈত্র। ভারতে নক্ষত্রপঞ্জিতে ২৭টি নক্ষত্রের নাম পাওয়া যায়; চীনে ৮০০টি।
মাসগুলো ২৯ বা ৩২ হতে পারে। তবে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর সমাধান করেছেন যা পরে আলোচনা করা হবে। প্রতিটি মাস দুই ভাগে বিভক্ত – শুক্লপক্ষ (১৫ দিন) ও কৃষ্ণপক্ষ (১৫ দিন)। অমাবস্যা থেকে ১৫ দিন পর পূর্ণিমা এই ১৫ দিন শুক্লপক্ষ। আবার পূর্ণিমা থেকে পরের ১৫ দিন পর অমাবস্যা অর্থাৎ কৃষ্ণপক্ষ।
প্রশ্ন হলো, মাসে শুক্লপক্ষ আগে থাকে না কৃষ্ণপক্ষ? আসলে এ নিয়ে মাস গণনার দুটো নীতি আছে। ১. অমাবস্যার পরের দিন থেকেই নতুন মাস হিসাবের পদ্ধতি; অমাবস্যান্ত নীতি বা অমান্ত নীতি, ২. পূর্ণিমার পর দিন থেকে মাস গণনার পদ্ধতি; পূর্ণিমান্ত নীতি। সুতরাং প্রথম নীতিতে কৃষ্ণপক্ষ আগে আর দ্বিতীয় নীতিতে শুক্লপক্ষ। মজার ব্যাপার, যে নীতিতে মাস অমাবস্যা দিয়ে শুরু তার শেষেও অমাবস্যা থাকে। ঠিক পূর্ণিমার ব্যাপারটিও। যাক, দুই নীতিরই প্রচলন আছে।
হিন্দু পঞ্জিকায় “পুরুষোত্তম মাস” নামে অতিরিক্ত একটি মাস আছে, চান্দ্র্য ও সৌর ক্যালেন্ডারের সামঞ্জস্য বিধানের জন্য। মাস যেমন ১২টি তেমনি রাশিও ১২টি। রাশির হিসাব এই প্রবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করছি না। তেমন প্রয়োজনও নেই। খালি এতটুকু জেনে রাখি, রাশি একটি বিশেষ হিসাব। সূর্য কোন রাশিতে গমন করেছে তা দিয়ে ঋতু বের করা হয়। যেহেতু পৃথিবীতে গরম, ঠান্ডা, বৃষ্টি ইত্যাদি সূর্যের প্রভাবেই ঘটে।
যেহেতু ভারতীয় ক্যালেন্ডারগুলো গড়ে উঠেছিল আর্যদের পূজা-পার্বণের প্রয়োজনে, সেজন্য এর হিসাব প্রথমে করা হত বেদের জ্যোতিষশাস্ত্রের নিয়মানুযায়ী। পরে আর্যভট্ট, বরাহমিহির, বহ্মগুপ্ত প্রমুখ পণ্ডিতগণ একে জ্যোতিষশাস্ত্রের সাথে মিলিয়ে ঠিকঠাক করেন। এদের মধ্যে বরাহমিহির ছিল বিক্রমাদিত্যের সভার নবরত্নের একজন। তিনি জ্যোতির্বিদ ও কবি। পঞ্চসিদ্ধান্তিকা নামক বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেছেন। ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যার গ্রন্থকে সিদ্ধান্ত গ্রন্থ বলে। যে সময়ে এই সিদ্ধান্তগুলো রচিত হয় তাকে সিদ্ধান্তযুগ বলে। নিউটনের জন্মের বহু আগেই মাধ্যাকর্ষণ শক্তি সম্পর্কে তিনি বলে গেছেন। বলেছেন, “কদম্বফুলের পাঁপড়ি যেমন কদম্বপৃষ্ঠে সংযুক্ত থাকে, সকল মানুষই সেরূপ ভূ-পৃষ্ঠে সংযুক্ত।” তাছাড়া ভারতীয় ক্যালেন্ডারের নিয়মকানুন সূর্যসিদ্ধান্ত নামক গ্রন্থে খুবই প্রাঞ্জল ভাষায় লিখিত হয়েছে। এর রচনাকার অজ্ঞাত হলে এখনও এটি জ্যোতিষশাস্ত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ।
তো এরপরেও ক্যালেন্ডার রচনা থেমে নেই। একের পর এক সংস্কারকর্ম এবং অঞ্চলভেদে নতুন নতুন ক্যালেন্ডার প্রবর্তনের মাধ্যমে পুরো ভারতবর্ষে হাজারো ক্যালেন্ডারের অস্তিত্ব আসে, আবার লড়াইয়ে টিকতে না পেরে অনেকগুলো হারিয়েও যায়।
বাংলা ক্যালেন্ডার নাকি অবিকল হিজরি ক্যালেন্ডারের নকল? কথা কি সত্য?
কথাটি পুরোপুরি সত্য নয়। তবে কিছুটা মিল আছে। ব্যাপারটা হলো, আগে বাংলায় মোগলদের আমলে হিজরি সাল অনুসরণ করা হতো। কারণ, মোগলরা ছিল মুসলিম। পরে সম্রাট আকবর এই প্রথা পাল্টে সেখানে নতুন আরেকটা ক্যালেন্ডার (তারিখ-এ-এলাহী) প্রণয়ন করেন।
হিজরি ক্যালেন্ডার হলো মুসলমানদের ক্যালেন্ডার। দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর রা. এর যুগে এই ক্যালেন্ডার প্রণয়ন করা হয়। বসরার কর্মকর্তা আবু মূসা আশআরী রা. এর প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে এটি প্রণীত হয়। এই ক্যালেন্ডারের সূচনাকাল ধরা হয় মহানবী সা. এর হিজরত (দেশত্যাগ) এর বছরটিকে। এই বছর তিনি মুসলিমদের নিয়ে মাতৃভূমি মক্কা ছেড়ে মদিনায় চলে যেতে বাধ্য হন। পরে মদীনা সনদের বিপ্লব সাধিত হয়। তো এই হলো হিজরি ক্যালেন্ডার, যা একটি খাঁটি চন্দ্রভিত্তিক ক্যালেন্ডার। এতে মাসের সংখ্যা ১২টি। প্রতিটি মাস সাধারণত চাঁদ দেখে, পৃথিবীর অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অবস্থান, ঋতু প্রভৃতি দেখে নিরূপণ করা হয়। প্রতিটি মাসই ২৯ বা ৩০ দিনের হতে পারে। এজন্য গড়ে দিন ধরা হয় ২৯.৫।
হিজরি ক্যালেন্ডারই মোগল আমলে বাংলাদেশে বেশি ব্যবহৃত হতো, এখনও হয়। বাদশাহ আকবর এসে নতুন ক্যালেন্ডার চালু করেন, যা সৌরবর্ষ অনুযায়ী প্রণীত হয়। তবে মজার ব্যাপার হলো, ক্যালেন্ডারটি সৌরবর্ষ অনুযায়ী চালু হলেও তা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সাথে মিলছে না। আবার হিজরি ক্যালেন্ডারের কাছাকাছি হলেও তার সাথেও মিলছে না। কারণ, নতুন এই ক্যালেন্ডার যে বছর চালু করা হয় ঐ বছর হিজরিতে চলছিল ৯৬৩ বছর। বাংলা ক্যালেন্ডারটিও শুরু করা হয় ৯৬৩ থেকে অর্থাৎ এর শুরু হিজরি ক্যালেন্ডারের সূচনাকাল থেকেই। ৯৬৩ হিজরির মুহররম মাস (প্রথম মাস) বাংলা বৈশাখ মাসের সঙ্গে সামজ্ঞস্যপূর্ণ ছিল বিধায় চৈত্র মাসের পরিবর্তে বৈশাখ মাসকেই বাংলা বর্ষের প্রথম মাস করা হয়। যদিও চৈত্র ছিল শক বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস। কিন্তু হিজরি ক্যালেন্ডার চান্দ্র্যবর্ষীয় আর আকবরের বাংলা ক্যালেন্ডার (তারিখ-এ-এলাহি, বর্তমানে, বঙ্গাব্দ) সৌরবর্ষীয়। তাই এদের হিসাবে গরমিল হবেই।
অপরদিকে, গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সূচনাকাল যেহেতু যিশুখ্রিস্টের জন্মসাল আর বাংলা ক্যালেন্ডারের সূচনাকাল হিজরির সূচনাকাল তাই এদের মাঝেও মিল নেই। তবে ৯৬৩ সনের পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলা ক্যালেন্ডার অবিকল সৌরবর্ষের হিসাব অনুযায়ী চলছে। এমনকি অধিবর্ষের হিসাবে ঝামেলা ছিল। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহের অধীনে একটি কমিটি কাজ করে সেই সমস্যা ঠিক করে। চৈত্র মাসে অধিবর্ষে একটি দিন যোগ করা হয়। অতএব, আমরা যদি ৯৬৩ সনের পর থেকে মেলাই তাহলে দেখবো বাংলা সন অবিকল গ্রেগরিয়ান সনের সাথে মিলে যাবে। তারিখ-ই-এলাহী প্রচলন করার সময়ে গ্রেগোরিয়ান ও হিজরি বর্ষের মধ্যে পার্থক্য ছিল ১৫৫৬-৯৬৩ = ৫৯৩ বছর। তাই বাংলা সনের সঙ্গে ৫৯৩ যোগ করলে খ্রিস্টাব্দ পাওয়া যায়।
সবশেষে বলি, প্রশ্নের তো কোনো শেষ নাই। প্রশ্নের শেষ থাকতে পারে না। এরপরও অনেক অনেক প্রশ্ন পাঠকের মনে উঁকি দিতে থাকবে।
যেমন, চান্দ্রবর্ষের ক্যালেন্ডার ঠিক কীভাবে কাজ করে? চন্দ্রের তিথিগুলোর সূক্ষ্ম হিসাব কী? চন্দ্রের তিথি আসলে কাকে বলে? তিথিগুলোর ভৌত ব্যাখ্যা কী? কীভাবে একটা চিকন ধনুকের মত চাঁদ দুধের বাটির মতো পূর্ণিমায় রূপান্তরিত হয়? মানুষ পৃথিবীতে বসে সৌরবর্ষের হিসাবই বা কীভাবে বের করে? আমরা প্রতিদিনই সূর্যকে উদিত হতে আর ডুবতে দেখি; তো কীভাবে উদয় আর অস্ত থেকে কীভাবেই বা বের করা যায় সৌরবর্ষের হিসাব? আরো আছে বিলুপ্ত মায়ান, অ্যাজটেক ও মেসোপটেমিয়ান ক্যালেন্ডারের কথা। পৃথিবীর অত্যাশ্চর্য এই ক্যালেন্ডারগুলো কীভাবেই ঠিক নিরূপিত হয়েছে? মায়ান ক্যালেন্ডারের রহস্যাবৃত ভবিষ্যদ্বাণীগুলোর কোনো কূল-কিনারা করা কি আমাদের পক্ষে সম্ভব? আরও অবাক বিষয় হলো, আমরা কেবল জেনেছি মাস-বছর গণনার পদ্ধতি, দিন-তারিখ গণনার পদ্ধতির ব্যাপারে আমি কিছুই বলিনি। বলিনি আহ্নিক গতি, রাত-দিন, জোয়ার ভাটার কথা। আমাদের গ্যালাক্টিক বর্ষের পরিমাপের কোনো কিছু। বলিনি বর্ষ আসলে কত রকমের।
এতসব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে একটা প্রবন্ধে আলোচনা করা সম্ভব নয়। আশা করছি আগ্রহী পাঠকগণ নিজেরাই এসবের উত্তর খুঁজে নেবেন। প্রশ্ন তো বলেই দেয়া হলো!