আইভান চতুর্থ ভাসিল্য়েভিচ ১৫৪৭ থেকে ১৫৮৪ সালে মৃত্যুর আগপর্যন্ত রাশিয়ার জার তথা সম্রাট হিসেবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। তার শাসনামলেই কাজান, আস্ত্রাখান ও সিবির খানাত জয়ে সক্ষম হয় রাশিয়া। ফলে সেটি প্রায় ৪০,৫০,০০০ বর্গ কিলোমিটারের বিশাল এক সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। মধ্যযুগীয় কেবল একটি প্রদেশ থেকে রাশিয়াকে বিশাল সাম্রাজ্যে রুপান্তরের কারিগর ছিলেন আইভান।
এমন এক বিজেতার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে যখন আলোচনা শুরু হয়, তখনই অবশ্য অর্জনের সাথে তাকে মেলানো বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। অনেকেই তাকে বর্ণনা করেছেন বুদ্ধিমান ও ধর্মপরায়ণ একজন শাসক হিসেবে। অন্যদিকে আইভানের মাঝে থাকা ‘রাগ’ নামক পশুটা মাঝে মাঝে এতটাই লাগামছাড়া হয়ে যেত যে, তখন সেটাকে সামাল দেয়াই হয়ে উঠতো কষ্টকর। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার সেই উন্মত্ততা যেন পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে।
তার সেই উন্মত্ততাই একসময় তাকে জনতার কাছে পরিচিত করিয়ে দেয় ‘আইভান গ্রজনি’ নামে। ‘গ্রজনি’ একটি রাশিয়ান শব্দ যার অর্থ শক্তি ও বীরত্ব প্রদর্শনের মাধ্যমে ত্রাসের সঞ্চার করা। কিন্তু আইভান যতটা না বীরত্বের জন্য, তার চেয়ে বেশি প্রতিপক্ষের উপর অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞ চালানোর জন্য ‘গ্রজনি’ শব্দটিকে নিজের নামের সাথে সুপার গ্লু দিয়ে লাগিয়ে নিয়েছিলেন। ইংরেজিতে তিনি সবার কাছে পরিচিত ‘Ivan the Terrible’ নামে, বাংলায় তাকে বলা যায় ‘ভয়ঙ্কর আইভান’ নামেই।
তার উন্মত্ততার কিছু নমুনা দেয়া যাক। একদিন পুত্রবধুর পরনের পোষাক পছন্দ হয় নি সম্রাটের। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি তাকে নির্দয়ভাবে পেটাতে থাকেন। স্ত্রী ইয়েলেনার উপর বাবার এমন অত্যাচার মেনে নিতে পারে নি ছেলে আইভান আইভানোভিচ। স্বীয় স্ত্রীকে বাঁচাতে চেষ্টা করে আঘাত ফেরাতে থাকে সে, আর চিৎকার করে বলতে থাকে, “তুমি আমার প্রথম স্ত্রীকে কোনো কারণ ছাড়াই মঠে পাঠিয়ে দিয়েছ, আমার দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথেও একই কাজ করেছ। আর এখন তুমি আমার তৃতীয় স্ত্রীর গায়ে হাত তুলছ, যার ফলে ওর গর্ভে থাকা সন্তানের মৃত্যু ঘটতে পারে!”
পরবর্তীতে ইয়েলেনার গর্ভপাত ঘটে যায়। এ ঘটনার জের ধরে বাপ-ছেলের তীব্র বাদানুবাদ হয়। ছেলের এমন উচ্চস্বরে কথা বলাকে সম্রাট বিদ্রোহের নামান্তর হিসেবে দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। হাতে থাকা রাজদন্ড দিয়ে ক্রোধের বশে সজোরে ছেলের মাথায় আঘাত করে বসেন তিনি। এত জোরে আঘাত সইতে পারে নি ছেলেটি। সাথে সাথেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে জ্ঞান হারায় সে, গলগল করে রক্ত বেরোতে থাকে আঘাতপ্রাপ্ত জায়গা থেকে। সাথে সাথেই যেন হুঁশ ফিরে আসে সম্রাটের। হাতের দন্ডটি ছুড়ে ফেলে দিয়ে ছেলেকে কোলে তুলে নেন তিনি। কপালে চুমু খেতে খেতে বিলাপ করে বলতে থাকেন, “আমার ধ্বংস হোক। আমার ছেলেকে আমি খুন করেছি! আমার ছেলেকে আমি খুন করেছি!” তখন ছেলের মৃত্যু না ঘটলেও এর অল্প কিছুদিন পরে এই আঘাতের দরুণই মৃত্যু হয় তার।
এছাড়াও সম্রাটের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে হাজার হাজার অভিজাত রাশিয়ান ব্যক্তিবর্গকে অকালে প্রাণ হারাতে হয়েছে। তিনি ‘অপ্রিচনিকি’ নামে একটি গোপন পুলিশ দলও চালু করেছিলেন, যাদের কাজ ছিলো সম্রাটের বিরোধীদের খুঁজে বের করে চিরতরে শেষ করে দেয়া।
আমাদের আজকের আলোচনা অবশ্য আইভানের নিষ্ঠুরতা কিংবা জীবনী নিয়ে না, বরঞ্চ তার সংসার জীবন নিয়ে। আরো ভালো করে বলতে গেলে আইভানের আট স্ত্রীকে নিয়ে। তার আট স্ত্রীর মাঝে মাত্র একজনই স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণের ‘সৌভাগ্য’ লাভ করেছিলেন। আর বাকিদের কী হয়েছিলো? সেটা জানতে চলুন ঘুরে আসা যাক পুরো লেখা থেকেই।
১. আনাস্তাশিয়া রোমানোভ্না
১৫৪৭ সালে মাত্র ষোল বছর বয়সে সিংহাসনে বসেন আইভান। অল্প কয়েকদিনের মাঝেই কিশোর জার (সম্রাট) একাকীত্ব অনুভব করতে শুরু করলেন। রাজ্য আছে, চাকর-বাকর আছে, আছে বিশাল এক সেনাবাহিনী; তবু মনের কথা একান্তে বলবার জন্য মনের মানুষই যে নেই! এজন্য সিংহাসন প্রাপ্তির দু’সপ্তাহের মাঝেই বিয়ের পিঁড়িতে বসেন রাজা।
রাজার বিয়ে বলে কথা। সারা রাশিয়া থেকে প্রায় ১,৫০০ অভিজাত পরিবারের বাবারা সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন তাদের মেয়েদের, উদ্দেশ্য আদরের মেয়েটিকে সম্রাজ্ঞী বানাবেন। ক্রেমলিনে জড়ো হওয়া এতসব পাত্রীর মাঝে সেদিন আনাস্তাশিয়া রোমানোভ্না নামের এক তরুণীও ছিলো। শত শত তরুণীকে বাদ দিয়ে আইভানের ভালো লেগে যায় তাকেই। ব্যাস, এবার তাহলে বিয়ে হয়ে যাক!
১৫৪৭ সালে শুরু হয় আইভান-রোমানোভ্নার সুখের সংসার। তাদের ভালোবাসার ফসল হিসেবে সংসারে এসেছিলো ছয়টি সন্তান। কিন্তু সুখের এ সংসার খুব বেশিদিন টিকে রইলো না। ১৫৬০ সালের দিকে হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন সম্রাজ্ঞী। রাজ্যের সেরা চিকিৎসকদের চিকিৎসাতেও কোনো লাভই হচ্ছিলো না, দিন দিন স্বাস্থ্যের কেবল অবনতিই ঘটছিলো। অবশেষে সবাইকে কাঁদিয়ে সেই বছরই পরপারে পাড়ি জমান তিনি।
এ ঘটনার পর ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে পড়েন সম্রাট আইভান। তিনি ভাবতে শুরু করেন তাকে হত্যা করতে গিয়েই হয়তো তার স্ত্রীকে বিষ মেশানো কিছু খাইয়ে হত্যা করা হয়েছে। রাশিয়ান বয়ারদের উপর আগে থেকেই ক্ষোভ ছিলো আইভানের। এ দুর্ঘটনা যেন সেই আগুনে ঘি ঢেলে দিলো। এরপর বিনা বিচারে অগণিত মানুষকে নির্মম নির্যাতন সইতে হয়েছে, মারাও গিয়েছে অনেকে।
ঐতিহাসিকগণ বলে থাকেন, রোমানোভ্নার মাঝে এক বিশেষ কোমলতা ছিলো যা আইভানের উন্মত্ততাকে বশীভূত করতে পারতো সহজেই। তার মৃত্যুই যেন শেকলে বাঁধা হিংস্র হায়েনাকে আরো উন্মত্ত করে ছেড়ে দেয়। সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণা থেকে ধারণা করা হয় যে, সম্রাজ্ঞীকে খুন করতে সম্ভবত পারদই ব্যবহার করা হয়েছিলো বিষ হিসেবে। তবে সেটাও পুরোপুরি নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কারণ তৎকালে ওষুধ হিসেবেও এর প্রচলন ছিলো।
লোকমুখে শোনা যায়, মৃত্যুর আগে রোমানোভ্না নাকি আইভানকে সতর্ক করে গিয়েছিলেন স্ত্রী হিসেবে পৌত্তলিক কাউকে বেছে না নিতে।
২. মারিয়া তেম্রিয়ুকোভ্না
রোমানোভ্নার মৃত্যুর এক বছর পরেই মারিয়া তেম্রিয়ুকোভ্নাকে সম্রাজ্ঞী করে ঘরে তোলেন আইভান। মারিয়া ছিলেন উত্তর-পশ্চিম ককেশীয় নৃগোষ্ঠী সার্কাশিয়ানদের নেত্রী। তবে সার্কাশিয়ানদের মাঝে তখনও খ্রিস্টান ধর্মের বাণী পৌঁছায় নি। ফলে প্রথম স্ত্রীর নিষেধ সত্ত্বেও একজন পৌত্তলিককেই বিয়ে করা হয়ে গেলো সম্রাটের। ধারণা করা হয়, মারিয়ার রুপই তাকে প্রথম স্ত্রীর সতর্কবাণী ভুলিয়ে দিয়েছিলো।
কিন্তু নতুন সম্রাজ্ঞীকে মন থেকে কেউই মেনে নিতে পারছিলো না, সবাই তাকে ভয় পেতো। এমনকি অনেকে বলতো তাকে নাকি দেখতে ডাইনীদের মতো লাগে! অনেকেই ভাবতো নতুন সম্রাজ্ঞী হয়তো তাদের সম্রাটকে দিয়ে নিজের কার্যসিদ্ধি করিয়ে নিচ্ছেন।
আইভানের প্রথম সংসারে ছয় সন্তানের জন্ম হলেও এদের চারজনই শৈশবে মারা যায়, বেঁচে থাকে শুধু দুজন- আইভান ও ফিওদর। এ দুজনকে সহ্যই করতে পারতেন না মারিয়া। মারিয়ার গর্ভে আইভানের এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়, নাম ছিলো তার ভাসিলি। কিন্তু দুর্ভাগা ভাসিলি জন্মের মাসখানেক পরই মারা যায়।
এভাবে আট বছর মারিয়ার সাথে সংসার টিকে ছিলো আইভানের। অবশেষে ১৫৬৯ সালে মাত্র ২৫ বছর বয়সে মারা যান আইভানের এ জীবনসঙ্গিনীও। গুজব আছে যে, দ্বিতীয় স্ত্রীকে নাকি সম্রাট নিজেই বিষ প্রয়োগে হত্যা করেছিলেন। তবে রাজা কখনো এর সত্যতা নিশ্চিত করেন নি। বরঞ্চ মারিয়াকে খুনের অভিযোগ এনে আবারো অনেক লোককে নির্যাতন আর হত্যার মাধ্যমে মনের জ্বালা মেটান তিনি।
৩. মার্ফা সোবাকিনা
তৃতীয় এ বিয়ের সময় আবারো প্রথম বিয়ের মতো পাত্রীর সন্ধান করেন তিনি, তবে এবার আগের চেয়েও বড় পরিসরে। আইভানকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাবার আশায় রাজ্যের সেরা দুই হাজার সুন্দরী তরুণী এসে জড়ো হয় আলেকজান্দ্রোভস্কায়া স্লোবোদাতে। এবারের পাত্রী নির্বাচন প্রক্রিয়া ছিলো আগের চেয়েও অনেক বেশী কঠিন। ২,০০০ থেকে দ্বিতীয় রাউন্ডে উত্তীর্ণ হয় মাত্র ২৪ জন তরুণী। তৃতীয় রাউন্ডে এ সংখ্যাটা নেমে আসে অর্ধেক অর্থাৎ এক ডজনে। এই ১২ জন তরুণী থেকে সবচেয়ে সুন্দরীকে বাছাইয়ের আগে একজন চিকিৎসকের সাহায্যও নেয়া হয় যাতে নতুন সম্রাজ্ঞীর শারীরিক সুস্থতার বিষয়টি নিশ্চিত হয়।
অবশেষে সকল পরীক্ষায় সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়ে রাশিয়ার নতুন সম্রাজ্ঞী হবার যোগ্যতা অর্জন করেন মার্ফা সোবাকিনা। ১৫৭১ সালের ২৬ জুন আইভানের সাথে সোবাকিনার বাগদান সম্পন্ন হয়। এতকিছু করেও শেষ রক্ষা হলো না। বিয়ের অল্প কয়েকদিনের মাথায় মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন নতুন সম্রাজ্ঞী। অবশেষে বিয়ের সাজসজ্জা রাজপ্রাসাদ থেকে ঠিকমতো মুছে যাবার আগেই মাত্র দু’সপ্তাহের মাথায় মারা যান সোবাকিনা। তখন তার বয়স হয়েছিলো মাত্র ১৯ বছর। সোবাকিনার মৃত্যুর কারণ হিসেবেও বিষপ্রয়োগকেই মূল কারণ হিসেবে দেখেন অধিকাংশ ইতিহাসবেত্তা।
৪. অ্যানা কল্তোভ্স্কায়া
আগের তিন স্ত্রীর মৃত্যুর পেছনের কারণ হিসেবে সন্দেহ করা হচ্ছিলো বিষ প্রয়োগকে। তাই এবার রানী নির্বাচনের ব্যাপারে বেশ সতর্কতা অবলম্বন করলেন আইভান। অনেক ভেবে-চিন্তে তিনি ঘরে তুললেন অ্যানা কল্তোভ্স্কায়াকে।
ওদিকে সম্রাটের সাথে এ বিয়ে নিয়ে ঝামেলা বেধে যায় রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চের। কারণ চতুর্থ বিয়ে তারা কখনোই স্বীকৃতি দেয় না। তাদের দৃষ্টিতে এটি ধর্মবিরোধী এক কাজ। চার্চের এ নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল এড়াতে আইভান জানান, সোবাকিনার সাথে তার বৈবাহিক সম্পর্ক দৈহিক মিলন পর্যন্ত গড়ায় নি। অতএব আগের বিয়ে অসম্পূর্ণ, চতুর্থ বিয়ে করাই তার জন্য সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত অপশন! এমন যুক্তিতেও অবশ্য মন গলে নি চার্চ কর্তৃপক্ষের। তাই চার্চের আশীর্বাদ ছাড়াই বিয়ে করে এক ছাদের নিচে বসবাস শুরু করেন আইভান-অ্যানা দম্পতি।
বিয়ের দু’বছর পরও অ্যানার গর্ভে কোনো সন্তান না আসায় ধৈর্যের বাধ ভেঙে যায় আইভানের। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নেন অ্যানাকে একটি আশ্রমে পাঠিয়ে দেবার। সেখানে মাটির নিচের এক অন্ধকার কুঠুরিতেই বন্দী করে রাখা হয় তাকে। আইভানের মৃত্যুর পরও জীবিত ছিলেন অ্যানা। আশ্রমের কর্তৃপক্ষ তখন তাকে মুক্তি দিতে চাইলেও তিনি আর সেই কুঠুরি ছেড়ে যেতে চান নি। অবশেষে ১৬২৬ সালে আশ্রমের সেই অন্ধকার ঘরেই মারা যান তিনি।
৫. মারিয়া দোল্গরুকায়া
অর্থোডক্স চার্চের নিয়মানুযায়ী আর কোনো বিয়ে করারই অধিকার ছিলো না আইভানের। ওদিকে ১৫৭৩ সালের নভেম্বর মাসে মারিয়ার প্রেমে পড়ে যান আইভান। তার শয়নে-স্বপনে-জাগরণে তখন কেবলই মারিয়ার ছবি ভাসতো। তাই প্রেমের ডাকে সাড়া দিতে গোপনে মারিয়ার সাথে বিয়ের কাজটা সেরে ফেলেন তিনি।
গোলমাল বেধে যায় বাসর ঘরে। সেই রাতে স্ত্রীর সতীত্ব নিয়ে আইভানের মনে সন্দেহ দেখা দেয়। ব্যাস, আর যায় কোথায়! সম্রাটের সন্দেহ বলে কথা। রাগে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে যান তিনি, আদেশ দেন সম্রাজ্ঞীকে ঘোড়ার লেজের সাথে বাঁধার জন্য। এরপর ঘোড়াগুলোকে আঘাত করলে সেগুলো ছুটতে শুরু করে। মারিয়ার শেষ পরিণতি যে কী হয়েছিলো তা বোধহয় না বললেও চলে।
৬. অ্যানা ভাসিল্চিকোভা
একবার আইভান গিয়েছিলেন প্রিন্স পিটার ভাসিলচিকভের সাথে দেখা করতে। সেখানে গিয়েই তার নজর পড়ে পিটারের সপ্তদশী কন্যা অ্যানার দিকে। অ্যানার রুপ-লাবণ্যে আইভানের পাগল হবার দশা হয়। আবারো বিয়ের রঙ উঁকি দিয়ে যায় তার মনে। পরদিন তাই ঘটকের মাধ্যমে সম্বন্ধ চলে যায় অ্যানার বাবার কাছে। মেয়েকে আইভানের হাতে তুলে দিতে তার মন সায় দিচ্ছিলো না। ওদিকে সম্রাটের পক্ষ থেকে পাঠানো ঘটকদের “না” বলার সাহসটুকুও তার ছিলো না। তাই অ্যানা ভাসিল্চিকোভা হন আইভানের নতুন সম্রাজ্ঞী।
কিন্তু সম্রাট আইভানের মন বোঝা বড় দায়। কখন যে কোন মেয়েকে তার ভালো লাগে, আবার কখন যে সেই মেয়েই তার চোখের বিষ হয়ে ওঠে তা বোঝা ছিলো বড় মুশকিল। দু’বছর পর অ্যানাকেও পাঠিয়ে দেয়া হয় এক আশ্রমে। সেখানে বন্দী অবস্থাতেই তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ধারণা করা হয়, এর পেছনে আইভানের নির্দেশ ছিলো।
৭. ভাসিলিসা মেলেন্তিয়েভা
ভাসিলিসা ছিলেন আইভানেরই পরিচিত এক শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তির স্ত্রী। লোকটির অসুস্থতার খবর শুনতে পেরে তিনি তাকে দেখতে আসেন। তখনই ভাসিলিসার দিকে নজর পড়ে যায় আইভানের, আবারো জেগে ওঠে তার প্রেমিক সত্ত্বা। স্বামীর মৃত্যুর অল্প কিছুদিন পরই তাই ভাসিলিসাকে দেখা যায় আইভানের প্রাসাদে চলে আসতে।
আশ্চর্যজনকভাবে ভাসিলিসাকে সন্তুষ্ট করতে আইভান যেন তার হৃদয়ের সর্বোচ্চ ভালোবাসাটুকু নিংড়ে দেয়া শুরু করেছিলেন। ভাসিলিসার শত্রু হয়ে উঠতে পারে এমন সবাইকেই প্রাসাদ থেকে বের করে দেন তিনি। ভাসিলিসাও বেহায়াপনা, উৎসব ও মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ করতে সম্রাটকে প্ররোচিত করেন। তার স্বপ্ন ছিলো একজন সম্রাজ্ঞী হবার। আইভান সেই স্বপ্ন পূরণের ব্যবস্থাও করেন।
দুই বছর ধরে সুখেই সংসার করেন তারা। কিন্তু একটি বড় সত্যের কথা জানতেন না আইভান। ভাসিলিসা বিয়ের পর লুকিয়ে লুকিয়ে চুটিয়ে আরেকটি প্রেমও করছিলেন। একদিন শোবার ঘরে এসে স্ত্রীকে তার প্রেমিকার সাথে আবিষ্কার করেন আইভান!
যাহ্ বাবা! সব তো শেষ এখানেই। কীসের প্রেম, কীসের স্ত্রী! আবারো পাগলা কুকুরের মতোই ক্ষেপে উঠলেন সম্রাট আইভান। তার সাথে প্রতারণা! তার ভালোবাসা নিয়ে ছিনিমিনি খেলা! এমনটা কিছুতেই বরদাশত করতে পারলেন না তিনি। সম্রাটের নির্দেশে দুজনকেই বন্দী করা হয়। এরপর একটি গর্ত করে দুজনকেই সেখানে পুঁতে ফেলা হয়। কথিত আছে, ভাসিলিসাকে জীবন্তই মাটি চাপা দেয়া হয়েছিলো।
৮. মারিয়া ফিওদোরভ্না নাগায়া
আইভানের সর্বশেষ সহধর্মিনী ছিলেন মারিয়া। এই বুড়ো সম্রাট যখন তার বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান, তখন তিনি তার বাবার কাছে অনেক কাকুতি-মিনতি করেছিলেন যেন এই অর্ধোন্মাদ সম্রাটের সাথে তাকে বিয়ে দেয়া না হয়। বলাবাহুল্য, তার সেই আপত্তি ধোপে টেকে নি।
শুরুর দিকে সুন্দরী মারিয়াকে নিয়ে সুখেই দিন কাটছিলো বুড়ো আইভানের। কিন্তু সবসময় স্ত্রীকে মনমরা থাকতে দেখে একসময় তার মনও বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে নতুন স্ত্রীর প্রতি। তাই এই স্ত্রীকে শেষ করে কীভাবে আরেকজন সম্রাজ্ঞী ঘরে আনা যায়, সেই ছকও কষতে শুরু করে দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু আফসোস, নতুন স্ত্রী ঘরে আনার আগেই আইভানের পরপারের ডাক এসে গিয়েছিলো। ১৫৮৪ সালের ২৮ মার্চ দাবা খেলতে থাকা অবস্থায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি।