প্রাচীন সাম্রাজ্যগুলোর ইতিহাস ঘাঁটলে মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপীয়দের নাম প্রথমে উঠে আসে। বলতে গেলে এই দুই অঞ্চলে গড়ে ওঠা সাম্রাজ্যগুলো হাজার বছর ধরে পৃথিবীর রূপ পাল্টে দিয়েছে। আজকের আধুনিক সভ্যতায় আমরা যেসব জিনিসপত্র ব্যবহার করছি তার বেশিরভাগই সভ্যতার ক্রমবিকাশে হাত বদল হয়ে রূপ পরিবর্তন করে আমাদের নিকট পৌঁছেছে। যদিও আমরা সৌভাগ্যবান প্রতিটি জিনিসপত্রের উন্নত সংস্করণ ব্যবহার করতে পেরেছি বলে! কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপীয় প্রাচীন সাম্রাজ্যের বাইরে পূর্ব এশিয়ার একটি অঞ্চল সভ্যতার ক্রমবিকাশে বিশ্বকে অনেক কিছু উপহার দিয়েছে।
বলছিলাম প্রাচীন চীনা সভ্যতার কথা। দেরিতে হলেও প্রত্নতত্ত্ববিদরা চীনাদের আবিষ্কার এবং সভ্যতা আধুনিক বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে পেরেছেন। খ্রিস্টপূর্ব হাজার বছর আগে থেকেই একাধিক রাজবংশ চীনসহ পূর্ব এশিয়া শাসন করেছিলো। খ্যাতি, শাসনামল এবং আবিষ্কারের দিক দিয়ে হান রাজবংশ ছিলো অন্যতম প্রসিদ্ধ। তাদের ৪০০ বছরের শাসনামলে কৃষিব্যবস্থা থেকে শুরু থেকে ধাতববিদ্যা রপ্ত করেছিলো চীনারা। খ্রিস্টপূর্ব ২০৭ সালে লুই বেং নামক একজন সাধারণ ব্যক্তি হান সম্রাজ্যের রাজা নির্বাচিত হন। আর সেই সময় থেকেই হানরা কৃষি, স্বাস্থ্য এবং নানারকম জিনিসপত্র আবিষ্কারে ব্যাপক উন্নতি লাভ করতে থাকে।
কানাডার মন্ট্রিলে অবস্থিত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস এবং শাস্ত্রীয় বিভাগের অধ্যাপক রবিন ডি ইয়েটস বলেন, “হান রাজবংশের শাসনামলে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার সংঘটিত হয়েছিলো। যদিও সেগুলোর কিছু তাদের মাঝে সরাসরি পৌঁছেছিল, আবার কিছু কিছু অনেক পরে। তবে হান রাজবংশের আমলে আবিষ্কৃত গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলো জিনিস আমাদের আধুনিক সভ্যতায় ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করে। অন্তত আমাদের জীবনে সেগুলোর ব্যবহার পর্যালোচনা করলে এর বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যায়। চলুন জেনে নিই হান রাজবংশের শাসনামলে চীনাদের কিছু আবিষ্কার সম্পর্কে।
কাগজ
কাগজের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে চীনাদের নাম সবার আগে আসে। কারণ সর্বপ্রথম লেখার কাগজ তারাই আবিষ্কার করে। ১৯৫৭ সালে চীনের একটি প্রাচীন সমাধিতে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে পুরোনো কাগজ পাওয়া যায়। শণের তন্তুর তৈরি ঐ কাগজে ১৪০ থেকে ৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দের তারিখ উল্লেখ ছিলো। আর সে সময় হান রাজারা চীন শাসন করছিলেন। অতঃপর খ্রিস্টপূর্ব ১০৫ সালে হান আদালতের একজন নপুংসককে কাগজ আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেয়া হয়।
কাই লুন নামক ঐ নপুংসক সত্যিই উচ্চমানের কাগজ তৈরি করেছিলেন। তিনি গাছের বাকল, শণ, লেনন রেগস, মাছ ধরার জালের স্ক্র্যাপের মিশ্রণ তৈরি করে লেখার কাগজ প্রস্তুত করতেন। লি শি’র বই ‘দ্য হিস্ট্রি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইন দ্য কিন অ্যান্ড হান ডেনসিটি‘তে এই সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়। যদিও হান রাজবংশের শাসনামলে কাই লুনের আবিষ্কৃত কাজটি শুধুমাত্র প্রশাসনিক কাজে ব্যবহৃত হত। সাধারণ মানুষের মাঝে তখনও এই সম্পর্কে ধারণা জন্মায়নি। পরবর্তীতে হানদের পতনের পর লেখার কাগজ সবার নিকট উন্মুক্ত হয় এবং জনপ্রিয়তা পায়।
ঝুলন্ত সেতু
বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় সাসপেনশন ব্রিজ বা ঝুলন্ত সেতু লক্ষ্য করা যায়। মূলত পাহাড়ী অঞ্চলে এই ধরনের সেতু তৈরি করা হয়। পাহাড়ের গা বেয়ে চলা রাস্তাগুলো এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যুক্ত করতে অতি প্রাচীনকাল থেকেই এই ধরনের সেতু নির্মাণ করতেন স্থপতিরা। যদিও এই ধরনের সেতু ১৮ শতকে এসে নতুনত্ব লাভ করে এবং আধুনিকায়ন হয়। মূলত সেতুর দুই প্রান্তের কিংবা মাঝের স্তম্ভের সাথে মোটা ধাতব তার উল্লম্বভাবে সেতুর ডেকের সঙ্গে সংযোগ দেয়া থাকে। আর ডেকের অংশ দিয়েই যানবাহন চলাচল করে।
কয়েকশ বছর আগে ঝুলন্ত সেতু আধুনিকায়ন হলেও এটি সর্বপ্রথম নির্মাণ করেন হান রাজবংশের লোকেরা। চীনের পাহাড় ঘেরা গহীন বনাঞ্চলে যাতায়াতের জন্য তারা কাঠ এবং শক্ত লতাপাতা দিয়ে এই ধরনের সেতু তৈরি করতেন। আধুনিক যুগের একাধিক প্রত্নতত্ত্ববিদের গবেষণা এবং তাদের লেখা বইয়ের আলোকে এটি স্পষ্ট যে, কাঠের তক্তা দিয়ে ঝুলন্ত ব্রিজ আবিষ্কারের পাশাপাশি নিজেদের শাসনামলে কাঠ ব্যবহার করে আরো উন্নত সেতুও তৈরি করেন হান স্থপতিরা। গত কয়েক শতাব্দী থেকে এখন পর্যন্ত ৯০ খ্রিস্টাব্দে তৈরি কিছু বড় বড় ঝুলন্ত সেতুর ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পেয়েছেন চীনের প্রত্নতত্ত্ববিদরা। বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ ২০টি সর্বাধুনিক এবং দীর্ঘতম ঝুলন্ত সেতুগুলোর মধ্যে ১০টিই চীনে অবস্থিত।
গভীর খনন
খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে লবণ খনির সন্ধানে নামা লোকেরা মাটির নিচে খনন করার প্রচলন শুরু করেন। সে সময় তারা লবণ খুঁজতে গিয়ে কাঠের টাওয়ার, ক্রেন এবং লোহার ড্রিল যন্ত্র তৈরি করেন। হান রাজবংশের মন্দিরে পাওয়া বই অনুসারে, সেকালে খনি শ্রমিকরা পৃথিবীর অভ্যন্তরে প্রায় ৪,৮০০ ফুট পর্যন্ত খনন করেছিলেন। আর হানদের এই খনন প্রক্রিয়াটি বিকশিত হওয়ায় আজকে মানুষ হাজার হাজার ফুট গভীরে খনন করে তেল, গ্যাস সহ আরো বিভিন্ন খনিজ পদার্থ আহরণ করতে পেরেছে।
সিসমোগ্রাফ যন্ত্র
এখন অবধি পূর্বাভাস পাওয়া অসম্ভব একমাত্র প্রাকৃতিক দুর্যোগের নাম ভূমিকম্প। পৃথিবীর গঠনগত কারণে এটি সংঘটিত হয়। তবে এর ক্ষয়ক্ষতি এবং মাত্রা সম্পর্কে জানার জন্য একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন বিজ্ঞানীরা। সিসমোগ্রাফ নামক ঐ যন্ত্রের সাহায্যে নির্দিষ্ট অঞ্চলের ভূকম্পন সম্পর্কে জানা যায়। বিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্প সংগঠিত হয় পূর্ব এশিয়ার চীন এবং জাপানে। আর এই সিসমোগ্রাফ যন্ত্রের ধারণাও এসেছে সেখান থেকেই।
হান রাজবংশের শাসনামলে বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ, গণিতবিদ এবং ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ঝাং হ্যাং এই যন্ত্র আবিষ্কার করেন। তিনি ১৩২ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম দূরবর্তী স্থানের ভূমিকম্প পরিমাপের যন্ত্রটি তৈরি করে হান আদালতে উপস্থাপন করেন। এই যন্ত্রের নকশা ছিলো খুবই সহজ। একটি ধাতব কলসে দুলতে পারে এমন একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা ছিলো। যখন কম্পন অনুভূত হতো তখন ধাতব কলসের উপরে স্থাপন করা ড্রাগনটি থেকে দুলতে দুলতে নিচের ধাতব ব্যাঙে ফেলতো। এতে করে ঝনঝন আওয়াজ হতো এবং বোঝা যেতো কোথাও ভূমিকম্প হয়েছে। তিনি হান আদালতে প্রথমবার ভূমিকম্প প্রমাণ করতে না পারলেও এটি আবিষ্কারের কিছুকাল পর ৪০০ মাইল দূরের একটি গ্রামে ভূমিকম্প হওয়ার ঘটনা সম্রাটের কানে পৌঁছায়।
বিস্ফোরক চুল্লী
আগুন আবিষ্কারের ইতিহাস হান সাম্রাজ্যের থেকেও পুরোনো। কিন্তু বিস্ফোরক চুল্লীর ইতিহাস হানদের শাসনামলেই খুঁজে পেয়েছেন গবেষকরা। খ্রিস্টপূর্ব ২০০ সালের গোড়ার দিকে হান শাসনামলের প্রথম পর্যায়ে লোহা গলানোর জন্য আগুনের চুল্লী তৈরি করেন শ্রমিকরা। মূলত লোহাকে নানারকম আকার আকৃতি প্রদান করার জন্য এই চুল্লী তৈরি করেছিলেন তারা। চুল্লীতে প্রচুর বাতাস প্রবেশ করিয়ে সেখানে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে লোহাকে গলিয়ে ঢালাই লোহা উৎপাদন করা হতো। চীনা প্রযুক্তি বিষয়ক গবেষক ডোনাল্ট বি ওয়াগনার এই সমস্ত বিষয়গুলো নিশ্চিত করেন।
ছাঁচবোর্ডের লাঙ্গল
রবার্ট গ্রিনবার্গের বিখ্যাত বই ‘দ্য টেকনোলজি অব অ্যানসিয়েন্ট চায়না’ বইয়ের আলোকে জানা যায়, চীনারা খ্রিস্টপূর্ব কয়েকশ বছর লোহার ফলাযুক্ত লাঙ্গল ব্যবহার করেছিলো। যদিও পাহাড়ী ভূমিতে সেটি তেমন বেশি সহায়ক ভূমিকা পালন করত না। উল্টো পাহাড়ের মাটি ক্ষয় হতে শুরু করে। অতঃপর হান শাসনামলের কয়েকজন মেধাবী আবিষ্কারক ছাঁচবোর্ডের লাঙ্গল আবিষ্কার করেন।
এই লাঙ্গলে শুধুমাত্র একটি ফলা ছিলো যা তীক্ষ্ণ বিন্দুতে শেষ হয়। পশুর সাহায্যে এই ধরনের লাঙ্গল দিয়ে লোকেরা যখন জমিতে চাষাবাদ করার তখন এটি ঘর্ষণ কমিয়ে মাটি ক্ষয় রোধ করতো। পাহাড়ের মাটিতে পানি জমিয়ে মাটি নরম করা অসম্ভব কাজ। কিন্তু এই লাঙ্গল আবিষ্কারের পর পাহাড়ে মাটি চাষ একেবারেই সহজ হয়ে যায়। মূলত হান সম্রাজ্যের সময় যতগুলো যুগান্তকারী আবিষ্কার হয়েছে সেসবের মধ্যে ছাঁচবোর্ডের লাঙ্গল অন্যতম।
রেকাব
প্রাচীনকাল থেকে ঘোড়া মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি সাহায্য করছে। বিভিন্ন সভ্যতার ইতিহাসের গতিপথও পাল্টে দিয়েছিলো এটি। প্রথম প্রথম শুধুমাত্র মানুষের যাতায়াতে ব্যবহৃত হলেও একটা সময় এটি পণ্য আনা নেয়াতেও ব্যবহৃত হতো। আধুনিক যুগে এসেও ঘোড়ায় চড়ে যাতায়াত একেবারেই বিলুপ্ত হয়নি। বরং মানুষ শখ করে ঘোড়ায় চড়ে দূর-দূরান্তে ঘুরে বেড়ায়। চীনের হান রাজবংশের শাসনামলেও দেশটির নাগরিকরা দুর্গম পাহাড়ে ঘোড়ায় চড়ে যাতায়াত করতেন। কারণ এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে পায়ে হেঁটে চলাফেরা করা ছিলো সময়সাপেক্ষ আর কষ্টকর।
হান মন্দিরের তথ্যমতে, ঘোড়ায় মানুষ বসার পর দুই পা রাখার জন্য যে রেকাব ব্যবহার করা হয় সেটি চীনাদের সৃষ্টি। তারা এটি লোহা এবং ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরি করেন। এটি আবিষ্কারের পূর্বে ঘোড়ায় চড়লে মানুষের পা বেঁধে রাখতে হতো। পরবর্তীতে রোমানরা স্যাডেলে দাঁড়ানোর ব্যবস্থা করে ঘোড়ায় চড়তেন। তবে হান শাসনামলের উদ্ভাবকদের রেকাব ঘোড়ায় যাতায়াতকে আরো সহজ করেছিলো। সে হিসেবে একে একটি বিপ্লবী আবিষ্কার হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ইতিহাসবিদরা।