ঊনসত্তরের উত্তাল সেই সময়টির কথা বলছি, আইয়ুব শাহীর শাসনামল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ১৭ নম্বর আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হক ‘দেশরক্ষা আইনে’ ছাড়া পেলেও সামরিক আইনের গ্যাঁড়াকলে বন্দি ছিলেন কুর্মিটোলা সেনানিবাসে। সেখানেই ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্মমভাবে নিরাপত্তা প্রহরীর গুলিতে শহীদ হন সহকর্মীদের কাছে ‘মার্শাল’খ্যাত এই অকুতোভয় বীর।
কেউ কেউ জীবন দিয়েই লক্ষ প্রাণের উন্মেষের ক্ষেত্র তৈরি করে যান। জহুরুল হকের মহাপ্রয়াণ ছিলো তেমনই বিশেষ কিছু। তাঁর হত্যাকে কেন্দ্র করে ক্ষোভে ফেটে পড়ে বাঙালি জনতা, লৌহমানব আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনে জেরবার হয় গোটা পূর্ব পাকিস্তান। এই হত্যার প্রতিবাদ ও শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফার সমর্থনে এগারো দফা নিয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পরদিনই সারা দেশব্যাপী ডেকেছিলো সকাল-সন্ধ্যা হরতাল। ১৬ ফেব্রুয়ারির সেই হরতালে নির্লজ্জ সামরিক জান্তার লেলিয়ে দেওয়া পুলিশ চালিয়েছিলো গুলি। ক্ষোভের স্ফুলিঙ্গে দ্বিগুণ উসকানি হিসেবে এই গুলিবর্ষণ কাজ করেছিলো, ১৭ ফেব্রুয়ারিও সারাদেশ ছিলো ক্ষোভে উন্মাতাল! রাজশাহীতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্ররা বেরিয়ে এলে সেখানেও চলে পুলিশের লাঠিচার্জ। আহত, রক্তে সিক্ত নিজের ১০-১২ জন ছাত্রকে দেখতে বোয়ালিয়া থানায় সেদিন ছুটে এসেছিলেন এক দরদী শিক্ষক। ছাত্রদের হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসার প্রাথমিক ব্যবস্থা করে দেন তিনি। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন পরদিন দেখতে আসার। কথা রেখেছিলেন তিনি, পরদিন এসেছিলেন বটে, রক্তাক্ত দেহে, নিথর দেহে। আজ বলবো সেই মহাপ্রাণ শিক্ষকের কথা, তাঁর অবিস্মরণীয় আত্মত্যাগের কথা।
শামসুজ্জোহার ‘জোহা স্যার’ হবার প্রারম্ভ
ড. শামসুজ্জোহা; ডাকনাম জোহা, শিক্ষকজীবনেও শিক্ষার্থীদের কাছে ছিলেন প্রিয় ‘জোহা স্যার’। ১৯৩৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ায় তাঁর জন্ম; বেড়ে ওঠা ও প্রাথমিক শিক্ষা সেখানেই। দেশভাগের বছর তিনেক পর দাঙ্গার শিকার হয়ে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন সপরিবারে। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে। ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী জোহা ভালো ফলাফল নিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষে উচ্চশিক্ষার্থে বিলাতও গিয়েছিলেন। লন্ডনের বিখ্যাত ইম্পেরিয়াল কলেজে রসায়নে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি করেছিলেন তিনি। উচ্চশিক্ষা চলাকালেই তিনি প্রভাষক পদে যোগ দিয়েছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে, সালটা ১৯৬১। সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে ১৯৬৫-৬৭ অবধি রাবির শাহ মখদুম হলের আবাসিক শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ১৯৬৮ সালের পয়লা মে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোক্টর (প্রাধ্যক্ষ) হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ড. জোহা।
ফিরে দেখা ইতিহাস
শুরুটা হয়েছিলো সার্জেন্ট জহুরুল হক হত্যার ন্যাক্কারজনক ঘটনা দিয়ে। আবারও সেখানে ফিরে যেতে হচ্ছে। ঢাকায় যখন ঘাতকের বুলেটে রক্তাক্ত হলেন জহুরুল হক, তখন রাবিতে চলছিলো বাৎসরিক ক্রীড়ানুষ্ঠান। ‘মার্শালের’ হত্যার খবর পেয়ে সাথে সাথে অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেন ড. জোহা। শিক্ষার্থীদের সাথে নিয়ে তাঁর মিছিলে সেদিন প্রকম্পিত হয়েছিলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবিশাল ক্যাম্পাস। তার দু’দিন বাদে ছাত্রদের মিছিলে পুলিশি হামলায় আহত শিক্ষার্থীদের দেখতে বোয়ালিয়া থানায় উপস্থিত হয়েছিলেন তিনি।
নিজের ছাত্রদের রক্ত কয়জন শিক্ষকের অন্তরে এমন রক্তক্ষরণ ঘটাতে পারে, তার দ্বিতীয় উদাহরণটি খুঁজতে গেলে স্বয়ং ইতিহাসকেও বেগ পেতে হবে। কী করলেন জোহা? রাবির কলাভবনে বাংলা বিভাগের এক অনুষ্ঠানে ১৭ ফেব্রুয়ারির সন্ধ্যায় সকলের সামনে ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত নিজের শার্ট দেখিয়ে আবেগতাড়িত দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে তিনি বললেন,
“আহত ছাত্রদের পবিত্র রক্তের স্পর্শে আমি উজ্জীবিত। এরপর আর যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে গুলি হয়, সেই গুলি কোনো ছাত্রের গায়ে লাগার আগে আমার বুকে বিঁধবে।”
রক্তাক্ত সে দিনটি
পরদিন অর্থাৎ ১৮ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন নাটোর-রাজশাহী মহাসড়কে পরিকল্পিতভাবে আন্দোলন দমাতে স্থানীয় প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা আগের রাতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো সেই ধারা ভঙ্গ করে মূল ফটক থেকে মিছিল বের করবার। পরিকল্পনামাফিক সকাল নয়টা নাগাদ বিভিন্ন হল থেকে প্রায় দুই হাজারের মতো শিক্ষার্থী এসে জড়ো হয় মূল ফটকের কাছে। আন্দোলনকারীদের দমন করতে সেদিন পুলিশ, ইপিআরের সাথে ছিলো রাইফেল সজ্জিত সেনাসদস্যরাও।
কিন্তু শিক্ষার্থীরা যেদিন একজোট, সেদিন তারুণ্যের শক্তিকে রুধবার ক্ষমতা কার হয়! নিপীড়ক বাহিনীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীদেরও মিছিল করবার ব্যাপারে ছিলো চোয়ালবদ্ধ সংকল্প। উত্তেজিত শিক্ষার্থীদের সাথে সেনাসদস্যদের বাগবিতণ্ডা ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢেলেছিলো আরো এক দফা। এই উত্তপ্ত পরিস্থিতি জোহা দু’পক্ষের ক্রমাগত মধ্যস্থতার কূটনীতি চালিয়ে যাচ্ছিলেন শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে। ড. জোহা সামরিক কর্মকর্তা ও ম্যাজিস্ট্রেটদের উদ্দেশ্যে করজোড়ে বার বার বলছিলেন,
“প্লিজ ডোন্ট ফায়ার, প্লিজ ডোন্ট ফায়ার।”
শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ফিরে যাবে, জোহার এমন আশ্বাসের পরও সেদিন দায়িত্বরত অবাঙালি সামরিক অফিসার ক্যাপ্টেন হাদি হয়তো ছিলেন তুমুল যুদ্ধাংদেহী মেজাজে। তিনি যতবারই বাহিনীর সদস্যদের রাইফেল তাক করার আদেশ দিচ্ছিলেন, ততই জোহা নমনীয় হয়ে শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে মিনতি করছিলেন। একপর্যায়ে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীকে ক্যাম্পাসের ভেতরের দিকে পাঠিয়ে দিতে সক্ষমও হন তিনি। কিন্তু শত্রুকে বিশ্বাস করা বা নমনীয় হওয়া সবসময়ই ভুল! ড. জোহাও জেনে-বুঝে ‘ভুল’ই করেছিলেন, কেন করেছিলেন? কেবলমাত্র প্রাণপ্রিয় শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে। বিনা উসকানিতে এগারোটার দিকে হুট করেই কাছ থেকে প্রথমে গুলি ও পরে বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে রক্তাক্ত করা হলো শামসুজ্জোহার দেহটাকে। তাঁকে বেলা দেড়টা নাগাদ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সকলের প্রিয় জোহা স্যার।
উজ্জ্বল এক নক্ষত্রের পতন
আত্মভোলা এই মানুষটি ভালোবাসতেন প্রকৃতিকে, ভালোবাসতেন বইয়ের পাতাকে; বলা বাহুল্য, সীমাহীন ভালোবাসতেন নিজ ছাত্রছাত্রীদের। চৌহদ্দির মানুষের বয়ানে, স্ত্রী নীলুফার জোহা ডলির সাথেও রোমান্টিক সম্পর্ক ছিলো তাঁর। স্ত্রী এবং একমাত্র মেয়েটিকে রেখে লোকান্তরিত হয়েছিলেন তিনি। জোহা স্যারের কানাডা যাবারও কথা ছিলো, তার বদলে না ফেরার দেশে চলে গিয়ে তিনি বরং আমাদের জাতির জন্যই তৈরি করে গিয়েছিলেন এক নিকষ কালো শূন্যতা।
স্বাধীনতা যুদ্ধোত্তর বাংলার প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. শামসুজ্জোহার স্মরণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়স্থ তাঁর সমাধিকে ঘিরে তৈরি করা হয়েছে ‘জোহা চত্বর’, তাঁর নামে নামকরণ করা হয় একটি ছাত্র হলেরও। ২০০৮ সাল থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারিকে রাবিতে পালন করা হয় জোহা দিবস হিসেবে, সে বছরই মরণোত্তর স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন এই মহাত্মা। দুঃখজনক বিষয়, রাজশাহীর বাইরে এই সূর্যসন্তানকে নিয়ে স্মারক খুব কমই আছে। কেবল স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশই হয়তো এই কৃতির মূল্যায়ণে যথেষ্ট নয়। জাতীয়ভাবে তাঁর স্মরণে ১৮ ফেব্রুয়ারিকে ‘শিক্ষক দিবস’ ঘোষণা করা হলে হয়তো কিছুটা সম্মান দেখানো হবে তাঁকে।
এই মহান শিক্ষক পুরো শিক্ষক জাতির জন্যই অঢেল গৌরব ও অপরিমেয় অনুপ্রেরণার আধার। কিন্তু শিক্ষা যখন আজকের দিনে ব্যবসার পণ্যে পরিণত হচ্ছে, স্বার্থবাদী রাজনীতির নির্লজ্জ তোষামোদিতে কলুষিত হচ্ছে, তখন সত্যিই জোহার আদর্শ ঘুণে ধরা সমাজের কতক ‘শিক্ষক’ নামধারীদের আড়াল থেকে ভর্ৎসনা দিয়ে যায় বৈকি। ওদিকে শিক্ষার্থীদের পরম পূজনীয় এমন আত্মত্যাগী শিক্ষাগুরুকে যুগে যুগে পেতে চায় শিক্ষার্থীরা, এমন শিক্ষকের গর্বের অংশীদার যে তারাও! তবে জোহা রক্ত দিয়েছিলেন তাঁর শিরদাঁড়াসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য, তিনি কোনো স্বার্থপর দাসের শিক্ষাগুরু ছিলেন না। জোহা তাই ‘সব মেনে নেওয়া’ নামধারী শিক্ষার্থীদের জন্যও যেন এক বিমূর্ত চপেটাঘাত! স্মৃতির পাতায় যুগ-যুগান্তর অম্লান থাকুন শহীদ ড. শামসুজ্জোহা, তাঁর আদর্শে উজ্জীবিত হোক শিক্ষাঙ্গনের প্রতিটি প্রাণ।
ফিচার ইমেজ: the-prominent.com