এককালের সমৃদ্ধ ও প্রতাপশালী চীন অষ্টাদশ শতকের শেষে ও উনিশ শতকের শুরুতে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছিলো। এত প্রাচীন সভ্যতার এই দেশটি যেন কোনো অজানা রোগে ধুঁকে ধুঁকে নিজের অসহায়ত্ব দেখছিলো।
ঐতিহ্য যেমন কোনো সভ্যতাকে সামনে এগিয়ে চলার পথ দেখাতে পারে, তেমনি অনেক সময় বাঁধাও হয়ে দাঁড়াতে পারে। ঐতিহ্যের বৈচিত্র অনেক সময় মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে সংকীর্ণ করে তোলে। ফলে নতুন উদ্ভাবন ও অনুসন্ধানে উন্নাসিকতা এসে পড়ে। আর তার সুযোগ নেয় বহিরাগত শক্তি। রাজকীয় শক্তি অবিশ্বাসের চোখে নিজের পতন দেখে।
অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে ইউরোপের বিভিন্ন শক্তির লোলুপদৃষ্টি এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে পড়েছিলো। ১৭৫৭ সালে ভারতে ইংল্যান্ডের আধিপত্য শুরু হলে চীনের উপরও তার নজর পড়ে। চীনে তখন চিং রাজবংশ রাজত্ব করছিলো। বাইরে রাজত্বের জৌলুস থাকলেও ভেতরে চলতে থাকা ক্ষয় বিশাল সাম্রাজ্যকে বেশ দুর্বল করে তুলেছিলো। যার প্রত্যক্ষ ফল দেখা গেলো ১৮৪২ সালে প্রথম আফিম যুদ্ধে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে চীনের শোচনীয় পরাজয়ে।
রাজ্যের দুর্বলতার ফলে ইউরোপীয় শক্তিগুলোর আধিপত্য আরো বেড়ে গেলো। ১৮৬১ সালে দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ আর ১৮৯৫ সালে জাপানের সাথে যুদ্ধ অপমানজনক চুক্তি সাম্রাজ্যের শেষ নিঃশ্বাসের চিহ্ন বয়ে এনেছিলো। রাজ্যে যুগোপযোগী সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হলেও চিং সম্রাজ্ঞী দাওজের চিচি তার সব সম্ভাবনা তছনছ করে দিলেন।
দেশজুড়ে ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছিলো। বিশেষ করে তরুণ ও শিক্ষিত সমাজের মধ্যে অসার রাজ্যের বিপরীতে কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা নেবার গুঞ্জন তৈরি হলো। এসব নতুন ভাবধারার মানুষজনের মধ্যে সেসান তাই ও সান ইয়াৎ সেন অগ্রগণ্য ছিলেন। পরবর্তীতে সান ইয়াৎ সেনই আধুনিক চীনের একচ্ছত্র নেতা হয়ে উঠেছিলেন।
চীনের অবসংবাদিত এই নেতা ১৮৬৬ সালে এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি শিক্ষার জন্য বড় ভাইয়ের সাথে হংকং ও হনলুলু গমন করেন। বৈদেশিক শিক্ষা দেশ সম্পর্কে তার অন্তর্দৃষ্টি খুলে দিতে সাহায্য করেছিলো। চীনের চলমান দুরবস্থা দূর করতে অনেক তরুণের মতো তিনিও প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। ১৮৯৪ সালে হনলুলুতে তিনি ‘রিভাইভ চায়না সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯৫ সালের গণজাগরণ ব্যর্থ হলে তিনি দেশ ত্যাগ করে প্রথমে হংকং হয়ে জাপান, পরে যুক্তরাষ্ট্র হয়ে ব্রিটেনে পৌঁছান। বিশ শতকের প্রথমদিকে চীনে ইউরোপীয় হস্তক্ষেপ আরো বেড়ে গিয়েছিলো। ফলে বিদ্রোহীদের বড় সংগঠনে একত্রিত হওয়া দরকারী হয়ে পড়লো। সেই উদ্দেশ্যে তার হাত ধরে ‘ইউনাইটেড লিগ’ এর জন্ম হলো।
চীনের আমূল পরিবর্তনের জন্য তিনি তিনটি নীতি ঘোষণা করেছিলেন। ‘গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও উন্নত জীবনযাত্রা’ ছিলো এই নীতির বহিঃপ্রকাশ। এর উদ্দেশ্য ছিলো জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা, বৈদেশিক হস্তক্ষেপের অবসান আর আর্থিক উন্নয়ন। এই নীতিই পরে চীনের রাজতন্ত্রবিরোধী বিপ্লবের মূলনীতি হয়ে দাঁড়ায়।
১৯০৫ সালে চীনের প্রধান বিদ্রোহী দলগুলো নিয়ে জাপানের টোকিয়োতে ‘তংমেংহুই’ বা ইউনাইটেড লিগ জন্ম নিয়েছিলো। সংগঠনের নেতাকর্মীরা চীনের বিভিন্ন অঞ্চল ছাড়াও এশিয়া ও পশ্চিমের বিভিন্ন দেশে কার্যক্রম চালাতেন। সদস্যবৃন্দের প্রায় সবাই তরুণ ছিলেন, তাদের বয়স ১৭ থেকে ১৬ বছরের কোঠায় ছিলো। জাপানে থাকার সময় সান ইয়াৎ সেন জাপানে আধুনিকতা ও শিল্পভিত্তিক অর্থনীতি ও সমাজের রূপান্তর বেশ ভালোভাবে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। জাপানের কয়েকজন উদ্যোক্তা ও নেতৃবৃন্দের সাথে ইউরোপবিরোধী বৃহত্তর এশিয়াভিত্তিক মৈত্রীর বিষয় নিয়ে তিনি নিরীক্ষার সুযোগ পেয়েছিলেন। ফিলিপাইনে স্পেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চলমান সংগ্রামেও তিনি সাহায্য করেছিলেন। চীনের সংগ্রামের বৈদেশিক ঘাঁটি হিসেবে ফিলিপাইনের সম্ভাব্য ব্যবহার তাকে আগ্রহী করে তুলেছিলো।
১৯০০ সালে তার নেতৃত্বে ‘হুওয়াইঝৌ’ বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়। গুয়াংদং প্রদেশ থেকে এর বিস্তার হতে থাকে। প্রথমে যথেষ্ট চাঞ্চল্য তৈরি করলেও এটি শেষ অবধি ব্যর্থ হয়। সান ইয়াৎ সেন চীন ত্যাগ করলেন। জাপানে গিয়ে তিনি সেখানকার ফিলিপাইন প্রবাসীদের সাহায্য করতে থাকেন। তার আশা ছিলো, ফিলিপাইনের সংগ্রাম সফল হলে দেশটিতে চীনাদের সংগ্রামের বৈদেশিক ঘাঁটি বানানো সম্ভব হবে। কিন্তু মার্কিন বাহিনীর হাতে ফিলিপাইনের পরাজয়ের পর তাকে সে আশা ত্যাগ করতে হয়।
চীনের সমাজে আর রাষ্ট্রব্যবস্থায় পরিবর্তনের কাজ করার কারণে সান ইয়াৎ সেন বহুবার চিং রাজশক্তির রোষানলে পড়েছেন। এই কারণে একাধিকবার তাকে দেশত্যাগ করতে হয়েছে। তবে বিদেশের মাটিতেও তিনি চেষ্টা করেছেন দেশের জন্য কাজ করার। এসময় প্রবাসী চীনা সমাজ ও এশীয়-পশ্চিমা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর সাথে তার পরিচয় হয়। এমন একটি চীনা গোষ্ঠী ছিলো ‘তিয়ান দিহুই’ সংঘ। চিং রাজবংশ এসব দলকে দেশদ্রোহী ও সন্ত্রাসী হিসেবে দেখতো। সান ইয়াৎ সেন এই গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্ক রাখতেন। সংগঠন চালানোর অর্থ ও সমর্থন যোগাতে এটা তার সহায়ক হয়েছিলো।
১৯০৪ সালে তিনি বেশ কিছু কর্মসূচী ঘোষণা করলেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো চীনের মাটি থেকে আগ্রাসী তাতারদের উৎখাত, সামন্ত ব্যবস্থা উৎখাত করে শাসন ও ভূমি সংস্কার করা। এই নীতির প্রয়োজন চীনের জন্য একরকম অত্যাবশ্যকীয় হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। প্রায় অর্ধশতক আগে এর কাছাকাছি পদক্ষেপ নিয়ে জাপান ঔপনিবেশিক আক্রমণের সম্ভাবনা সমূলে উৎখাত করেছিলো।
১৯০৫ সালে সান ইয়াৎ সেন জাপানের টোকিও শহরে প্রবাসী চীনা ছাত্রদের দ্বারা গঠিত বিপ্লবী দলগুলিকে একত্রিত করলেন। এছাড়া পূর্বের বৈদেশিক সম্পর্কের সূত্র ধরে সিঙ্গাপুর, মালয়শিয়া ও থাইল্যান্ডের চীনা ব্যবসায়ী কর্মজীবীদের ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। ১৯০৭ সালে চীন ও ভিয়েতনাম সীমান্তে চিং রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সূত্রপাত করলেন। এই বিদ্রোহ ‘ঝেন নাংগুয়ান’ নামে পরিচিতি পেয়েছিলো। সাত দিনের রাজনৈতিক উত্তেজনা তৈরির পর এই বিদ্রোহ স্তিমিত হয়ে পড়ে। ক্রমাগত ব্যর্থতার কারণে চীনে ও চীনের বাইরের বিদ্রোহীদের মধ্যে সান ইয়াৎ সেনের বিরুদ্ধে ক্ষোভের জন্ম হচ্ছিলো। তবে তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
সান ইয়াৎ সেন নির্বাসনে থেকেও তার বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের পরিধি বাড়িয়ে তুলছিলেন। ১৯১০ সালে ব্রিটিশ শাসিত মালয় অঞ্চলে বসবাসরত চীনা বিদ্রোহীদের পক্ষ থেকে ১ লক্ষ ৮৭ হাজার হংকং ডলার তোলা হয়েছিলো।
১৯১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চিং রাজবংশ কিছু দমনমূলক পদক্ষেপ নেয়। বিশেষ করে রেলওয়ে সেক্টরে প্রশাসনের পদক্ষেপ শ্রমিক সংগঠন ও দরিদ্র জনমনে ব্যাপক আকারে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। সান ইয়াৎ সেন ও তার বিপ্লবী দল এই সুযোগ কাজে লাগাতে চাইলেন।
১৯১১ সালের ২৭ এপ্রিল জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী হুয়াং জিং স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের ডাক দিলেন। রাজপরিবার মরিয়া হয়ে বিদ্রোহ দমন করতে চাইলো। এসময় প্রচুর নিরীহ মানুষ রাজরোষে নিহত হয়েছিলো। ৭২ জন বিপ্লবীর রক্তাক্ত মৃতদেহ রাজপরিবারের পতন ডেকে আনছিলো।
বিদেশে থাকা সত্ত্বেও সান ইয়াৎ সেন কিন্তু বসে ছিলেন না। পশ্চিমা বিশ্বে চীনের রাজতন্ত্রবিরোধী বিপ্লবের পক্ষে সাধারণ, অভিজাত ও কূটনৈতিক মহলে জোরালো সমর্থন তৈরির কাজ করে যাচ্ছিলেন। এছাড়া প্রবাসী চীনা শ্রমিক, ছাত্র ও আধুনিক শিক্ষিত মহলে তিনি তার মতবাদ দ্বারা ব্যাপক সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অন্ধকারের পর্দা সরিয়ে চীনা সভ্যতা যেন নতুন সূর্যের অপেক্ষা করছিলো।
১০ অক্টোবর হুবেই প্রদেশের উওচাং এলাকায় সশস্ত্র অভ্যুত্থান সংঘটিত হলো। ১৮৯৫ সালে নবগঠিত আধুনিক সেনাবাহিনীর এক বড় অংশ বিদ্রোহে যোগ দিলো। রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গও এর প্রতি সংহতি জানালেন। এবারে এপ্রিল মাসের পুনরাবৃত্তি হবার সম্ভাবনা বেশ কম দেখা যাচ্ছিলো। পরিস্থিতি চিং রাজবংশ ও সম্রাট পুয়ির আয়ত্ত্বের বাইরে চলে যাচ্ছিলো।
সিংহাসন আগলে রাখতে সম্রাট বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে বসলেন। চিং রাজবংশের অনুগত সৈন্যবাহিনী শেষ রক্ষা করতে চেষ্টা করলো। ১৮ অক্টোবর থেকে তাদের সাথে বিপ্লবীদের যুদ্ধ শুরু হলো। প্রথমদিকে সেনাবাহিনীর আক্রমণে বিপ্লবীদের কিছুটা কোণঠাসা অবস্থা তৈরি হয়েছিলো। কিন্তু দেশজুড়ে সক্রিয় সমর্থন ও বিপ্লবীদের দৃঢ়তায় তাদের হার মানতে হলো।
সেনাপতি য়ুয়ান শিকাইয়ের সন্ধির প্রস্তাবে বিপ্লবীরা সম্মত হলেন। ফলে হাজার বছর ধরে প্রচলিত চীনা রাজতন্ত্রের অবসান হলো। ২১ ডিসেম্বর সান ইয়াৎ সেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে এলেন। ২৯ ডিসেম্বর সমগ্র চীনের প্রদেশগুলো থেকে আগত প্রতিনিধিরা তাকে প্রভিন্সিয়াল প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত করলো। এশিয়ার অন্যতম বড় দেশ চীন আত্মপ্রকাশ করলো প্রজাতন্ত্র হিসেবে।
চীনের ইতিহাস নিয়ে জানতে পড়ুন এই বইটি