ঔপনিবেশিক ভারতের সামরিক বাহিনী: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (পর্ব-৭)

ষষ্ঠ পর্ব: ঔপনিবেশিক ভারতের সামরিক বাহিনী: ভারতীয়করণ (পর্ব-৬)

১৯৪৫, ২ মার্চ। বার্মার ঠিক মাঝখানে থাকা ছোট শহর মেইকটিলার পাশেই বাঙ্কার গেঁড়ে অবস্থান নিয়েছে একদল জাপানি সৈন্য। ১০ নং বালুচ রেজিমেন্টের নায়েক ফজল দ্বীনের দায়িত্ব তার কোম্পানি নিয়ে এখান থেকে জাপানিদেরকে হটিয়ে দেওয়া। ফজল দ্বীন নিজেই এক বাঙ্কারে গ্রেনেড ছুঁড়ে বাঙ্কারে থাকা জাপানি সৈন্যদেরকে খতম করলেন। এদিকে শব্দ পেয়ে পাশের এক বাড়ি থেকে বের হয়ে আসলো ৬ জন জাপানি সৈন্য, সবার সামনে ২ জাপানি অফিসার তাদের তরবারি বাগিয়ে ছুটে আসছে। রেজিমেন্টের ব্রেন গানার তার গান চালিয়ে এক অফিসার ও আরেক সৈন্যকে খতম করার সাথে সাথেই গুলি শেষ হয়ে গেল। তাকে আর দ্বিতীয় সুযোগ না দিয়ে বাকি জাপানি অফিসার সরাসরি তরবারি চালিয়ে মেরে ফেললেন।

নায়েক ফজল দ্বীন ব্রেন গানারকে সাহায্য করতে এগিয়ে যেতেই অফিসার তার বুকেও তরবারি ঢুকিয়ে দিলেন, তরবারির অংশ ফজল দ্বীনের পিঠ ফুটো করে বেরিয়ে এল। অফিসার তরবারি বুক থেকে বের করে আনতেই আহত ফজল দ্বীন তৎক্ষণাৎ অফিসারের হাত চেপে ধরে তরবারিটি কেড়ে নিলেন, তারপর নিজেই তরবারি চালিয়ে দিলেন। অফিসারকে খতম করার পর আরও দুজন জাপানি সৈন্যের পরিণতি হলো তার ঊর্ধ্বতনের মতোই। তারপর তরবারি উঁচিয়ে তার কোম্পানির লোকজনকে আক্রমণ চালিয়ে যাওয়ার কথা বলতে বলতে কয়েক পা এগিয়ে যেতেই মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন। রেজিমেন্টাল এইড পোস্টে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই মারা গেলেন ফজল দ্বীন। ততক্ষণে তার কোম্পানি ৫৫ জন জাপানি সৈন্যের গ্যারিসন উড়িয়ে দিয়েছে।

২৩ বছর বয়সী ফজল দ্বীন সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন রাইফেলম্যান হিসেবে, তারপর একে একে সেকশন গানার এবং শেষমেশ নায়েক হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছিলেন। তার এই বীরত্বের জন্য মরণোত্তর ভিক্টোরিয়া ক্রস পদক প্রদান করে ইংরেজ সরকার। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও ইংরেজদের পক্ষে প্রাণ বাজি রেখে যুদ্ধক্ষেত্রে পাড়ি জমিয়েছিল হাজার হাজার ভারতীয় সেনা। এ কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ভারতীয় ফৌজের কমান্ডার-ইন-চিফ ফিল্ড মার্শাল স্যার ক্লড অকিনলেক বলেছিলেন, ‘ভারতীয় বাহিনী না থাকলে ব্রিটিশরা কখনোই দুটো যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারতো না।’

নায়েক ফজল দ্বীন; Image Source: Wikimedia Commons

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ

১৯৩৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর জার্মানির বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করল গ্রেট ব্রিটেন। একইসাথে ভারতের ভাইসরয়ও ভারতের হয়ে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন, ভারত ডোমিনিয়ন হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়ায় সংসদের অনুমতি ছাড়াই এই ক্ষমতা তার ছিল। এদিকে ভারতে ক্রমাগত স্বাধীনতার দাবি বাড়তে থাকলেও ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিটিশ রাজের প্রতি আনুগত্য ঠিকঠাকভাবেই বজায় ছিল। একমাত্র জাপানিদের হাতে বন্দী হওয়ার পর ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীন হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মিতে যোগ দেওয়া সৈন্যরা ছাড়া বাকিরা সবাই বাধ্য ছিল ইংরেজদের পক্ষে যুদ্ধ চালানোর জন্য।

ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি এবং তাদের কমান্ডার-ইন-চিফ নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু; Image Source: Cultural India

বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগে, ভারতীয় বাহিনীর হাতে ছিল সাড়ে ৩ লক্ষ সৈন্য, যাদের মধ্যে ৬১ হাজার জন ব্রিটিশ। এদের মধ্যে ২ লক্ষ ৫ হাজার সৈন্য নিয়মিত ভারতীয় বাহিনীর অধীনে, বাকি ৮৪ হাজারের মধ্যে ছিল স্টেট ফোর্সেস অর্থাৎ, স্থানীয় রাজাদের বাহিনী, ইউরোপীয় ভলান্টিয়ারদের অক্সিলিয়ারি বাহিনী এবং ইন্ডিয়ান টেরিটোরিয়াল ফোর্স।

ভারতীয় বাহিনীর আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র কম থাকলেও লোকবলের অভাব ছিল না। যুদ্ধের কথা মাথায় রেখে প্রচুর নন-কমিশনড অফিসার নিয়োগ দেওয়া হতে থাকে, একইসাথে সাধারণ সৈন্যও। তাই যুদ্ধের ৬ বছরের মধ্যে ভারতীয় বাহিনীর মোট লোকবল দাঁড়ায় ২৫ লক্ষে।

পুরো পৃথিবীব্যাপী এই যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনী সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে মূলত মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। একদিকে মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ তেলখনিগুলোর দখল ধরে রাখা এবং বিশ্বযুদ্ধে নাৎসিদের পক্ষ নেওয়া শাসকদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা, অন্যদিকে আগ্রাসী জাপানিদের হাত থেকে ভারতসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশকে মুক্ত করা, এই ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর মূল কাজ। এর বাইরেও ইউরোপ ও আফ্রিকায় যুদ্ধ করতে হয়েছে তাদেরকে। ১৯৩৯-এর আগস্টে ৪নং ডিভিশনকে মিশরে এবং একটি ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডকে মালয়ে পাঠানোর মধ্য দিয়ে ভারতীয় বাহিনীর বিশ্বযুদ্ধ অভিযান শুরু হয়।

মিশরের ওয়েস্টার্ন ডেজার্টে এক ভারতীয় অ্যান্টি-এয়ারক্র্যাফট ব্রেন গানার; Image Source: Wikimedia Commons

আফ্রিকা (১৯৩৯-৪৩)  

ভারতীয় বাহিনীর দুটো পদাতিক ডিভিশন, ৪র্থ ও ৫ম ডিভিশনকে পাঠানো হয় উত্তর আফ্রিকায়। শুরুর দিকে এই দুটো ডিভিশনের কাজ ছিল রক্ষণাত্মক। ১৯৪০-এর আগস্টে ইতালীয়রা ব্রিটিশ সোমালিল্যান্ড (বর্তমান সোমালিয়ার অংশবিশেষ)-এ আক্রমণ চালিয়ে দখল করে নেয় এবং ইতালিয়ান ইস্ট আফ্রিকার অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। ১ মাস পরেই, ইতালির আরেকটি দল লিবিয়া থেকে ব্রিটিশদের অধিকৃত মিশরে আক্রমণ চালায়। ব্রিটিশ সেনাপতি ওয়াভেলের দক্ষতায় ৪র্থ ইন্ডিয়ান এবং ৭ম আর্মারড ডিভিশনের সাহায্যে ইতালির ৮টি ডিভিশনকে গুড়িয়ে দেয় ব্রিটিশরা।

ইরিত্রিয়ার গ্রামে; Image Source: Wikimedia Commons

১৯৪১-এর জানুয়ারিতে ইরিত্রিয়া ও আবিসিনিয়ায় (বর্তমান ইথিওপিয়া) থাকা ইতালীয় বাহিনীকে আক্রমণ করে ব্রিটিশরা, সাথে ছিল ৪র্থ ও ৫ম ইন্ডিয়ান ডিভিশন এবং কেনিয়া থেকে আসা আরও ৩টি ডিভিশন। ব্রিটিশদের সাথে না পেরে একপর্যায়ে হাল ছেড়ে দেয় ইতালীয়রা এবং আদ্দিস আবাবার পতন হওয়ার ১ মাস পর ইতালীয়রা আত্মসমর্পণ করে। এদিকে ইতালীয়দের সাথে যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থাতেই জেনারেল রোমেলের নেতৃত্বে উত্তর আফ্রিকায় হাজির হয় নাৎসি বাহিনীর আফ্রিকাকর্পস। তাদেরকে সামাল দিতে তড়িঘড়ি করে ৪র্থ ডিভিশনকে পাঠানো হয় উত্তর আফ্রিকার মরুভূমিতে। ইতালির আত্মসমর্পণের পর ৫ম ডিভিশনও তাদের সাথে যোগ দেয়।

উত্তর আফ্রিকার সিদি ওমরে জার্মান পতাকা হাতে ভারতীয় সৈন্যরা; Image Source: Wikimedia Commons

জুন মাসে রোমেলের বিরুদ্ধে অপারেশন ব্যাটলঅ্যাক্স পরিচালনা করতে গিয়ে মারাত্মকভাবে ধরাশায়ী হয় জেনারেল ওয়াভেল, যার ফলে তাকে বদলী করে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কমান্ডার-ইন-চিফ হিসেবে, বিপরীতে কমান্ডার-ইন-চিফ হিসেবে থাকা অকিনলেকের হাতে উত্তর আফ্রিকার দায়িত্ব দেওয়া হয়। নভেম্বর মাসে অকিনলেক অপারেশন ক্রুসেডার পরিচালনা করেন, যার ফলে রোমেল তার শুরুর জায়গা এল আঘেলিয়ায় প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হয়। তবে ১ মাসের মধ্যেই রোমেলের অতর্কিত প্রতি-আক্রমণে ব্রিটিশরা আবার পিছু হটতে বাধ্য হয়। ৪র্থ ইন্ডিয়ান ডিভিশনকে এসময় মিশরে ফেরত পাঠানো হয় যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য। ১৯৪২-এর মে মাসে রোমেল তোবরুক শহর দখল করে নেয় এবং এল-আলামিনের দিকে আগাতে থাকে। এখানে রোমেলকে থামানো গেলেও অকিনলেককে সরিয়ে জেনারেল মন্টেগোমারিকে নিয়ে আসা হয়। অকিনলেককে পুনরায় ভারতের কমান্ডার-ইন-চিফ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়, অন্যদিকে ওয়াভেল পান ভাইসরয়ের দায়িত্ব।

মন্টেগোমারি (বাম), ওয়াভেল (মধ্য) এবং অকিনলেক; Image Source: Wikimedia Commons

মন্টেগোমারি ৩টি আর্মারড এবং ৭টি পদাতিক ডিভিশন (৪র্থ ভারতীয় ডিভিশন সহ, ৫ম ডিভিশনকে এশিয়ায় পাঠানো হয়) নিয়ে বাহিনীকে ঢেলে সাজান। এল-আলামিনের ১২ দিনের প্রাণান্তকর যুদ্ধের পর অবশেষে জয়ের স্বাদ পায় ব্রিটিশরা, রোমেল লিবিয়া থেকে তিউনিসিয়ায় পিছু হটেন। তিউনিশিয়ার পাহাড়ি অঞ্চলে ৪নং ভারতীয় ডিভিশন বেশ কৃতিত্ব দেখায়। ১৯৪৩-এর এপ্রিলে আলজেরিয়া থেকে আসা ফার্স্ট আর্মির সাথে যুক্ত হয়ে তিউনিশিয়ার ওপর শেষ অভিযান পরিচালনা করা হয় এবং উত্তর আফ্রিকায় অক্ষশক্তি আত্মসমর্পণ করে।

তিউনিশিয়ায় ভারতীয় আর্মির ৪র্থ ডিভিশন, যাদের কাছে জার্মান জেনারেল ফন আরনিম আত্মসমর্পণ করেন;
Image Source: Wikimedia Commons

মধ্যপ্রাচ্য (১৯৪১-৪২)  

১৯৪১-এর শুরুতে জার্মানরা রাশিয়ায় আক্রমণের পরিকল্পনা হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের ৩ দেশ ইরান, ইরাক ও সিরিয়ার ওপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেলের সরবরাহে যেন ব্যাঘাত না ঘটে এবং একইসাথে জার্মানির সাথে হাত মেলানো ইরাকের নেতা রশিদ আলীকে থামানোর জন্য ভারতীয় বাহিনীর ৮ম ডিভিশনকে মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানো হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নে জার্মানি অপারেশন বারবারোসা পরিচালনা করে অনেকখানি এগিয়ে গেলে ইরানের তেলক্ষেত্রগুলো ঝুঁকির মুখে পড়ে যায়। এরপর ইরানে ব্রিটিশ ও সোভিয়েতরা যৌথ আক্রমণ চালিয়ে ইরান দখল করে নেয় এবং তেলসহ অন্যান্য রসদ সাপ্লাইয়ের রুট হিসেবে ব্যবহার হতে থাকে।

ইরানের আবাদান শহরের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান অয়েল কোম্পানির তেল শোধনাগার পাহারারত অবস্থায়; Image Source: Wikimedia Commons

যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও ‘অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা’ হিসেবে ২য়, ৬ষ্ঠ ও ১২শ ভারতীয় পদাতিক বাহিনী মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থান করে আরও কয়েক বছর।

ইরানে শীতকালীন কাপড়ে (১৯৪৪); Image Source: Wikimedia Commons

ইতালি (১৯৪৩-৪৫)  

বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ইউরোপের মূল ভূখণ্ডে জার্মানদের বিরুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীকে পাঠানো হবে না। তবে উত্তর আফ্রিকা ভারতীয় বাহিনী নিজেদের সক্ষমতার প্রমাণ দেয়, বিশেষ করে তিউনিশিয়ার পাহাড়ি অঞ্চলে। এই অঞ্চলের ভূমিপ্রকৃতির সাথে ইতালির ভূমিপ্রকৃতির মিল থাকায় সিদ্ধান্ত বদলানো হয়। উত্তর আফ্রিকায় অক্ষবাহিনীর পতনের পর ইউরোপে তাদের শক্তি কমাতে ইতালিতে পাঠানো হয় ভারতীয় বাহিনীর ৪র্থ, ৮ম ও ১০ম পদাতিক ডিভিশন, সাথে ৪৩ তম গুর্খা ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড।

ইতালির পথে ১০ম ডিভিশন; Image Source: Wikimedia Commons

শুরুতেই মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা ৮ম ডিভিশন সাঙ্গ্রো নদী পার হয়ে ইতালির বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল নাৎসিদের কাছ থেকে দখল করে নেয়। ১৯৪৪-এর প্রথমদিকে রোমের ১০০ মাইল দক্ষিণে থাকা গুস্তাভ লাইন অতিক্রম করার চেষ্টা করে এবং বেশ কয়েক মাস চেষ্টা করার পর মে মাসে লাইন ভাঙতে সক্ষম হয় এবং জার্মানরা আরও পিছু হটে। একপর্যায়ে রোমও তাদের হাতছাড়া হয়ে যায় এবং আরও উত্তর দিকে পেছাতে থাকে। এই সবগুলো অভিযানেই ১০ম ডিভিশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। জার্মানরা এরপর পিসা-ফ্লোরেন্স জুড়ে গথিক লাইন তৈরি করে। এ সময় মিত্রবাহিনী দক্ষিণ ফ্রান্সে অভিযান চালানোর জন্য ইতালি অভিযান সাময়িক মুলতবি রাখে। জার্মানদের এগোনো বন্ধ করতে থেকে যাওয়া সৈন্যরা পুরো শীতকাল পরিখার মধ্যেই কাটিয়ে দেয়। অবশেষে ১৯৪৫-এর এপ্রিলে ব্রিটিশদের এইটথ আর্মি আক্রমণ চালায় এবং মে মাসের ২ তারিখ ইতালিতে থাকা জার্মান বাহিনী আত্মসমর্পণ করে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া (১৯৪১-৪৫)

১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর পার্ল হারবারের মার্কিন ঘাঁটিতে আক্রমণ চালালো জাপানি নৌবাহিনী। তার পরদিনই থাইল্যান্ড আর মালয়ে দলে দলে ভিড়তে শুরু করলো জাপানি সৈন্যরা, আক্রমণ করে ২ সপ্তাহের মাথায় দখল করে নিল হংকং, যেখানে ভারতীয় বাহিনীর দুটো ব্যাটালিয়ন ছিল।

হংকংয়ে জাপানিদের আক্রমণ; Image Source: Wikimedia Commons

মালয়ে থাকা ভারতীয় বাহিনীর ৯ম ও ১১শ ডিভিশন অপর্যাপ্ত অস্ত্র আর বনেজঙ্গলে যুদ্ধের অভিজ্ঞতার অভাবে খুব সহজেই ধরাশায়ী হলো জাপানি সৈন্যদের কাছে। তাদেরকে সাহায্য করতে পাঠানো ১৮শ ডিভিশনও চরমভাবে ব্যর্থ হলো। ১৫ ফেব্রুয়ারি মালয়ে প্রায় ৬০ হাজার সৈন্য আত্মসমর্পণ করলো, যার মধ্যে ৩২ হাজারই ছিল ভারতীয়। ততদিনে থাইল্যান্ডেরও পতন ঘটেছে, জাপানিদের পরবর্তী লক্ষ্য বার্মা।

মালয়ে ভারতীয় বাহিনী (১৯৪১); Image Source: Wikimedia Commons
সিঙ্গাপুরে সদ্য পা রাখা ভারতীয় দল; Image Source: Wikimedia Commons 

এদিকে বার্মায় সৈন্য সংকট ছিল আগে থেকেই। ভারত থেকে ১৭শ ডিভিশনকে এনে ১ম বার্মা আর্মিকে কিছুটা শক্তিশালী করার চেষ্টা করা হয়। এছাড়া ব্রিটিশদের হাতে ছিল ৭ম আর্মার্ড ব্রিগেড আর একটি চীনা ডিভিশন, কিন্তু জাপানিদের প্রবল আক্রমণে পিছু হটতে থাকে তারা। ৭ মার্চ রেঙ্গুনের পতন হলে ১০০০ মাইল পেছনে আসামের সীমানায় পিছু হটে ইংরেজরা। জাপানিরা পিছু পিছু চিন্দুইন নদী পর্যন্ত (ভারতের মণিপুর রাজ্য ও মিয়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি) চলে এসে অবশেষে থামে, ক্লান্ত সৈন্যদের বিশ্রাম এবং নিজেদের সাপ্লাই-লাইন ঠিক করার জন্য সময় নেয়।

স্কর্চড আর্থ নীতি অনুসারে বার্মায় থাকা তেল শোধনাগারসহ অন্যান্য স্থাপনা ও রসদ জ্বালিয়ে দেয় ব্রিটিশরা;
Image Source: Wikimedia Commons 

১৯৪২-এর সেপ্টেম্বরে ১৪শ ডিভিশন চট্টগ্রাম থেকে আরাকানের উপকূলীয় অঞ্চলের মধ্য দিয়ে আক্রমণ চালানোর চেষ্টা করে, কিন্তু বাজে আবহাওয়া, রসদ পরিবহনে ঝামেলা এবং বনে যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতার অভাবে এই অভিযান ব্যর্থ হয়। ১৯৪৩-এর শুরুতে জাপানিরা এর প্রতি-আক্রমণে ডিভিশনকে আবার শুরুর অবস্থানে ফিরে যেতে বাধ্য করে।

১৯৪৩ সালেই প্রথম চিন্ডিট অপারেশন পরিচালনা করে ভারতীয় বাহিনী, এই চিন্ডিটদের কাজ হচ্ছে শত্রু এলাকার গভীরে ঢুকে অতর্কিত হামলা চালানো, স্যাবোটেজ করে বা অন্যান্য প্রক্রিয়ায় শত্রুদের সাপ্লাই লাইনকে ক্ষতিগ্রস্ত করা। এই কাজের জন্য ৭৭নং ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডকে বিশেষভাবে ট্রেনিং দিয়ে পাঠানো হয়। বনে-জঙ্গলে লুকিয়ে থাকার ফলে সৈন্যদের মধ্যে ব্যাপক হারে ডায়রিয়া-ম্যালেরিয়াসহ রোগ বিস্তার হয়ে মৃত্যুর জন্য সমালোচিত হলেও একে একেবারে ব্যর্থও বলা যাবে না। কারণ এর ফলে প্রমাণিত হয়, সঠিক ট্রেনিং ও রসদ পেলে ভারতীয় বা ইংরেজরাও বনে জঙ্গলে জাপানিদের সাথে সমানভাবে টক্কর দিতে পারবে।

বার্মার জঙ্গলে গাড়োয়াল রাইফেলসের প্যাট্রল; Image Source: Wikimedia Commons

১৯৪৩-এর ডিসেম্বরে আরাকান দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো আক্রমণ চালায় ৫ম ও ৭ম ডিভিশন, কিন্তু জাপানিদের প্রতি-আক্রমণে তাদের সাপ্লাই লাইন ভেঙে যায়, বিমান থেকে ফেলা সাপ্লাই দিয়েই তাদের টিকে থাকতে হচ্ছিল। অন্যদিক থেকে ২৮শ ডিভিশন জাপানিদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাদেরকে পিছু হটতে বাধ্য করে। তাদের মণিপুরের রাজধানী ইমফাল দখল করার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।

আরাকান অভিযানে যাওয়ার আগে ৭ম রাজপুত; Image Source: Wikimedia Commons

১৯৪৪ সালের মার্চ মাসে ইমফালে থাকা বাহিনীকে হটানোর জন্য আক্রমণ চালায় বাহিনীরা। ইমফাল ও কোহিমাকে কেন্দ্র করে আক্রমণ-প্রতিআক্রমণ চলতে থাকে এবং সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এভাবে চলতে চলতে একপর্যায়ে জাপানিদের ৫টি ডিভিশনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলে তারা চিন্দুইন উপত্যকায় ফিরে যায়। এরই ফাঁকে ফাঁকে চিন্ডিট অপারেশন চালাতে থাকে আরও ৫টি ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড। এছাড়াও চীনা সৈন্যদের সহায়তায় বার্মার উত্তরদিকে থাকা কাচিন প্রদেশের অধিকাংশ অঞ্চল জাপানিদের কাছ থেকে মুক্ত হয়।

ডিসেম্বরে তৃতীয় ও শেষবারের মতো আরাকান থেকে আক্রমণ পরিচালনা করে মিত্রবাহিনী। ২৫শ ভারতীয় ডিভিশন এবং ৮২তম ওয়েস্ট আফ্রিকান ডিভিশনের আক্রমণে আরাকানের উপকূলীয় এয়ারফিল্ডগুলো দখল করে নেয় মিত্রবাহিনী। অন্যদিকে ১৪নং আর্মি চিন্দুইন থেকে জাপানিদেরকে হটিয়ে ইরাবতী নদী পর্যন্ত এগিয়ে যায়। এদিকে সেনাপতি উইলিয়াম স্লিম ভান করেন যে তিনি তার বাহিনী নিয়ে ইরাবতী নদী পার হয়ে মান্দালয়ে আক্রমণ করবেন, জাপানিরাও সেই অনুযায়ী তাদের বেশিরভাগ সৈন্য সেখানে জড়ো করে। কিন্তু স্লিম তার মূল বাহিনী নিয়ে আক্রমণ করেন আরও ১০০ মাইল দক্ষিণে, মেইকটিলাতে। ১৯৪৫ সালের মার্চ মাসের মধ্যেই মেইকটিলা ও মান্দালয় দুটোই ব্রিটিশদের দখলে চলে আসে এবং ফোর্টিনথ আর্মি রেঙ্গুনের দিকে অভিযান অব্যাহত রাখে। রেঙ্গুনে গুর্খা প্যারাশ্যুট ব্যাটালিয়ন এবং সাগর থেকে ২৬শ ইন্ডিয়ান ডিভিশনের যৌথ আক্রমণে রেঙ্গুন থেকে পালিয়ে থাইল্যান্ডে আশ্রয় নেয়। এদিকে ১২শ ডিভিশনও তাদের পিছু পিছু থাইল্যান্ডে আক্রমণ পরিচালনা করে এবং সিঙ্গাপুরে আক্রমণের পরিকল্পনা চলতে থাকে। এরই মাঝে মার্কিন বাহিনী হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা ফেলার ৫ দিনের মাথায় জাপানিরা আত্মসমর্পণ করে।

মান্দালয়ে ভারতীয় দল; Image Source: Wikimedia Commons
কুয়ালা লাম পুরে জাপানিদের আত্মসমর্পণ; Image Source: Wikimedia Commons

 

জাপান ও জার্মানির আত্মসমর্পণের পরও অনেক জায়গায় ভারতীয় বাহিনী দখলদার বাহিনী কিংবা ‘নিরাপত্তা বাহিনী’ হিসেবে অবস্থান করতে থাকে। ১৯৪৪-এর ডিসেম্বরে ৪র্থ ভারতীয় ডিভিশনকে পাঠানো হয় গ্রিসে, যেখানে তারা ২ বছর অবস্থান করে। এছাড়াও মালয়, থাইল্যান্ড, ইন্দোচীন (বর্তমান ভিয়েতনাম-কম্বোডিয়া), ইন্দোনেশিয়া এবং জাপানে অবস্থান করতে হয় তাদেরকে।

ভারতীয় সৈনিকদের হিরোশিমার ধ্বংসস্তূপ পর্যবেক্ষণ; Image Source: Wikimedia Commons 

অষ্টম পর্ব: ঔপনিবেশিক ভারতের সামরিক বাহিনী: স্বাধীনতা ও ইংরেজদের বিদায় (পর্ব-৮)

This article is in the Bengali language. It is about the Indian Army during the colonial period.

References:
1. ভারতীয় ফৌজের ইতিহাস - সুবোধ ঘোষ - দিব্যপ্রকাশ (২০২০)
2. The Indian Army (1914-1947) - Ian Sumner - Osprey Publishing (2001)
3. The Indian Army - Boris Mollo - New Orchard Editions (1986) 

Related Articles

Exit mobile version