সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কখনোই নিরঙ্কুশ ছিল না। সাংবাদিকতার সূচনালগ্ন থেকেই এটি নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। কখনো প্রযুক্তিগত, কখনো বা আর্থিকভাবে যেমন সাংবাদিকতার যাত্রায় স্থবিরতার উদ্ভব হয়েছিল, আবার তেমনি সময়ে সময়ে শাসকের রোষানলে পড়ে ক্ষুণ্ণ হয়েছে সাংবাদিকতার মুক্তচর্চা। কত আইন, কত বিধিনিষেধের বেড়াজাল পেরিয়ে সাংবাদিকতাকে টিকে থাকতে হয়। সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রকে নিয়ন্ত্রণের এই রীতি অধুনা কোনো প্রচেষ্টা নয়, অনেক আগে থেকেই সরকার বা রাষ্ট্র সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর শ্যেনদৃষ্টি নিক্ষেপের নজির রয়েছে।
ভারতবর্ষে সংবাদপত্রের সূচনা হয়েছে ১৮ শতকের শেষভাগে। এসব সংবাদপত্র সৃজন করা হয়েছিল ইউরোপের সংবাদপত্রগুলোর অনুকরণে। প্রথমে ইংরেজি ভাষার সংবাদপত্র ও পরে বাংলা ভাষা এবং তারও পরে অন্যান্য নেটিভ ভাষায় সাংবাদিকতার প্রচলন শুরু হয়। ব্রিটিশরাজের অধীনে এই সংবাদপত্রসমূহকে যেতে হয়েছিল বিভিন্ন আইনকানুন ও নীতিমালার মধ্য দিয়ে। এসবের চাপে পড়ে অনেক সংবাদপত্র হারিয়ে গেছে, কিছু সংবাদপত্র এখন পর্যন্ত টিকে আছে। তবে সাংবাদিকতার ভাগ্য কখনো পরিবর্তিত হয়নি। আজকের দিনেও গণমাধ্যমগুলোকে জবুথবু হয়ে পার করতে হচ্ছে তাদের নিত্যদিন, কারণ রাষ্ট্রীয় আইন এখনো আগের মতোই বহাল তবিয়তে সাংবাদিকতার ‘দেখভাল’ করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। কখনো আনকোরা নতুন আইন, আবার কখনো সেই ব্রিটিশপ্রণীত পুরানো আইনের প্রেতাত্মা; এসবের মাঝেই টিকে থাকার অবিরাম চেষ্টায় রত গণমাধ্যমগুলো।
ব্রিটিশ ভারতে সংবাদপত্রের সূচনা
ব্রিটিশ ভারতে সংবাদপত্রের প্রথম সফল সূচনা ঘটে ১৭৮০ সালে। তবে প্রথম ছাপাখানা বসানোর পরিকল্পনা ভেস্তে যায় তারও এক যুগ আগে। ১৭৬৮ সালে জনৈক ওলন্দাজ উইলিয়াম বোল্টস ভারতবর্ষে প্রথমবারের মতো ছাপাখানা স্থাপনের পরিকল্পনা করেন। বোল্টস ছিলেন কোম্পানির কর্মচারী, তবে ব্যবসায়িক কাজের ফাঁকে টু-পাইস কামানোতে তার খ্যাতি ছিল। সে সময় অবশ্য কোম্পানির অনেক কর্মচারীই এদিকসেদিক করে টাকা কামাচ্ছিলেন। এদের অনেককে কর্তৃপক্ষ বরখাস্ত করে ইংল্যান্ডে ফেরত পাঠিয়ে দিতো।
উইলিয়াম বোল্টসও সেরকম প্রাতিষ্ঠানিক আয়ের বাইরে গিয়ে উপরি আয়ের আয়াস করছিলেন। কিন্তু কোম্পানি তাকে বরখাস্ত করে। বোল্টস তখন ঠিক করলেন তিনি একটা ছাপাখানা বসাবেন এবং সেখান থেকে একটি পত্রিকা বের করবেন। এ প্রসঙ্গে তিনি কলকাতা কাউন্সিল হলে একটা হাতে লেখা বিজ্ঞাপনও সেঁটে দিলেন।
ব্যাপারটা কোম্পানির পছন্দ হলো না। কারণ, বোল্টস কোম্পানির হাঁড়ির খবর অনেক কিছুই জানতেন। তাই, কোনোপ্রকার ঝুঁকি না নিয়ে কোম্পানি তাকে মাদ্রাজ ডেকে নিয়ে সোজা বিলেতের জাহাজে তুলে দেয়। ভারতবর্ষে প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশের প্রচেষ্টা এভাবে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়।
উপমহাদেশে প্রথম মুদ্রিত ও প্রকাশিত সংবাদপত্রের যাত্রা শুরু হয় হিকির বেঙ্গল গেজেট-কে দিয়ে। এটি ছিল একটি ইংরেজি সংবাদপত্র। ১৭৮০ সালে পত্রিকাটি প্রকাশের পর পরই সে সময়ের গভর্নর জেনারেল হেস্টিংস এবং হেস্টিংসের একজন বিচারপতি এলিজা ইম্পের সঙ্গে পত্রিকার বিবাদ শুরু হয়ে যায়। পত্রিকাটি এই দুজন ছাড়াও একপর্যায়ে মিসেস হেস্টিংসকে নিয়েও ‘মিথ্যা ও বানোয়াট’ খবর প্রচার করা শুরু করে। সরকারের আরেক কর্মকর্তা ফিলিপ ফ্রান্সিসের ইন্ধনে হিকি তার পত্রিকায় হেস্টিংসদের বিরুদ্ধে এত কিছু লিখতে পারতেন বলে কথিত আছে। ফ্রান্সিস ভারত ছাড়ার পরেই হিকির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত হেস্টিংস-এর আদেশে হিকির ছাপাখানা বাজেয়াপ্ত করা হলে হিকির গেজেটের সমাপ্তি ঘটে। জেমস অগাস্টাস হিকিকে ‘ভারতবর্ষের সংবাদপত্রের জনক’ (Papa of Indian Press) বলা হয়।
১৮১৮ সালে এপ্রিলে শ্রীরামপুরের ব্যাপ্টিস্ট মিশন থেকে বাংলা ভাষার প্রথম পত্রিকা দিগদর্শন বের হয়। তবে এটি ছিল একটি মাসিক পত্রিকা। তাই বাংলা ভাষার প্রথম সংবাদপত্রের তকমা পেয়েছে একই বছরের ২৩ মে প্রকাশিত সমাচার দর্পণ।
সেন্সরশিপ অভ প্রেস অ্যাক্ট, ১৭৯৯
লর্ড ওয়েলেসলি এ আইন প্রণয়ন করেন। এ আইনের উদ্দেশ্য ছিল ফরাসিরা যেন কোনোপ্রকার প্রকাশনার সাথে যুক্ত না হতে পারে তা নিশ্চিত করা। সেসময় ফরাসিরা এ অঞ্চলে বাণিজ্য করলেও ইংরেজদের মতো প্রতিপত্তি কোনো দিক থেকেই তাদের ছিল না। ইংরেজরা তাদের ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার জন্য সবরকম ব্যবস্থাই নিয়েছিল। সেন্সরশিপ অভ প্রেস অ্যাক্টের মূল লক্ষ্য ছিল ফরাসিরা যাতে এমন কোনো সংবাদপত্র প্রকাশ না করে যেটি ইংরেজ শাসনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। এই আইনের নির্দেশের মধ্যে ছিল সংবাদপত্রের ওপর আগে থেকে সেন্সরশিপ (প্রিসেন্সরশিপ) প্রয়োগ করা, এবং সংবাদপত্রের মুদ্রাকর, প্রকাশক, মালিক, সম্পাদক ইত্যাদি ব্যক্তির নাম প্রতিটি সংখ্যায় ছাপানো। প্রিসেন্সরশিপের অর্থ হচ্ছে পত্রিকা ছাপানোর আগে তা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমোদিত হতে হতো।
লর্ড হেস্টিংস ১৮১৮ সালে আইনটি থেকে প্রিসেন্সরশিপের ধারাটি তুলে দেন।
লাইসেন্সিং রেগুলেশন অ্যাক্ট, ১৮২৩
জন অ্যাডামস এ আইন আরোপ করেন। সম্ভবত ব্রিটিশ ভারতের কুখ্যাত গণমাধ্যম আইন হচ্ছে লাইসেন্সিং রেগুলেশন অ্যাক্ট। এ আইন প্রণয়নের পর অনেক সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে যায়। এ আইনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিটি সংবাদপত্রের লাইসেন্স গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা বাধ্যতামূলক করা হয়। পাশাপাশি ছাপাখানাগুলোকেও লাইসেন্সিং-এর আওতায় আনা হয়। লাইসেন্স না থাকার শাস্তি ছিল ৪০০ টাকা জরিমানা। দ্য ক্যালকাটা জার্নাল সেসময় সরকারের সমালোচনা করে লাইসেন্স খোয়ায় এবং পরবর্তীকালে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়।
দ্য প্রেস অ্যাক্ট, ১৮৩৫ বা মেটকাফ অ্যাক্ট
লর্ড উইলিয়াম বেন্টিক ১৮২৮ থেকে ১৮৪৫ সাল পর্যন্ত ভারতবর্ষে কর্মরত ছিলেন। গণমাধ্যম নিয়ে তিনি প্রগতিশীল মনোভাব পোষণ করলেও ১৮২৩ সালের লাইসেন্সিং রেগুলেশন অ্যাক্ট বাতিলকরণে কোনো আগ্রহ দেখাননি। তৎকালীন গভর্নর-জেনারেল স্যার চার্লস মেটকাফ (১৮৩৫-৩৬) লাইসেন্সিং রেগুলেশন আইনটি রদ করেন। ১৮৩৫ সালে মেটকাফ দ্য প্রেস অ্যাক্ট চালু করেন। এ আইনের কল্যাণে ভারতবর্ষে সংবাদপত্র প্রকাশের হিড়িক পড়ে যায়। মেটকাফকে এজন্য ‘ভারতীয় গণমাধ্যমের ত্রাতা’ (Liberator of the Indian Press) বলা হয়।
দ্য লাইসেন্সিং অ্যাক্ট, ১৮৫৭
১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ শুরু হয়। সংবাদপত্রগুলোতে স্বভাবতই এ নিয়ে খবর প্রকাশিত হয়। কিন্তু সরকারের চোখে সংবাদপত্রের কাজকারবারকে উসকানিমূলক বলে মনে হয়। লর্ড ক্যানিং খেয়াল করলেন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান খবরের কাগজগুলো যেমন বিদ্রোহের একটি অংশকে সমর্থন করছে, তেমনিভাবে দেশীয় সংবাদপত্রগুলোও তাদের পছন্দমতো বিদ্রোহীদের সমর্থন জানাচ্ছে। এসব রুখতে দ্য লাইসেন্সিং অ্যাক্ট, ১৮৫৭ বলবৎ করা হয়।
ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট, ১৮৭৮
১৮৭৫ সালে লর্ড লিটন ভারতের ভাইসরয় হিসেবে নিযুক্ত হন এবং তিনি ১৮৭৬-৮০ সাল পর্যন্ত শাসনকাজ পরিচালনা করেন। ১৮৭৬-৭৭-এর মন্বন্তর সামলাতে তিনি যারপরনাই ব্যর্থ হন। এদিকে সিপাহি বিদ্রোহের পর থেকে ভারতবর্ষে জাতিগত বিদ্বেষ বেড়েই চলছে। সেই সময় আবার ভারতে ভারতীয় ভাষার সংবাদপত্রের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছিল। তখন প্রায় সারা ভারতজুড়ে ১৬৯টির মতো স্থানীয়দের দ্বারা পরিচালিত সংবাদপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। আর এই পত্রিকাগুলোর পাঠকসংখ্যাও লাখের ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল। এসব সংবাদপত্র সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করছিল। ব্রিটিশরাজকে এই সমালোচনার বন্যা সামাল দেওয়ার জন্য নতুন আইনের প্রয়োজন হলো। আর তার জন্য তৈরি করা হলো নতুন আইন, দ্য ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট।
ভার্নাকুলার শব্দের অর্থ স্থানীয় ভাষা। এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত হওয়া সংবাদপত্রগুলোর স্বাধীনতা হরণ করা। লর্ড ক্যানিং-এর তৈরি করা আইনে ইংরেজি ও স্থানীয় ভাষার পত্রিকাগুলো আওতাধীন থাকলেও ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্টটি কেবল স্থানীয় পত্রিকাগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্যই জারি করা হয়েছিল। এ আইনের উদ্দেশ্য ছিল ‘প্রাচ্য ভাষার প্রকাশনাগুলোতে (publications in oriental languages) রাষ্ট্রদোহমূলক লেখালেখি (seditious writing)’ দমন করা। অমৃতবাজার পত্রিকা তখন মূলত ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই প্রকাশিত হতো। এই আইনকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য পত্রিকাটি পুরোদস্তুর ইংরেজি সাপ্তাহিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এর আগে নীলচাষীদের ওপর ব্রিটিশদের অত্যাচারের সংবাদ প্রকাশ করে রাজরোষে পড়ে পত্রিকাটি।
নিউজপেপার অ্যাক্ট (ইনসাইটমেন্ট টু অফেন্স), ১৯০৮
ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, বিশেষত স্বদেশী আন্দোলন, বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন ইত্যাদি যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, তখন এগুলোর পক্ষে সংবাদপত্রে লেখালেখি করা রুখতে এ আইন প্রবর্তন করা হয়। এ আইন অনুযায়ী কোনো সংবাদপত্র সরকারের বিরুদ্ধে কিছু ছাপালে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সে সংবাদপত্র বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা রাখতেন। তবে বাজেয়াপ্তের ১৫ দিনের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত প্রকাশক চাইলে উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারতেন।
ইন্ডিয়ান প্রেস অ্যাক্ট, ১৯১০
এ আইন অনুযায়ী সংবাদপত্রের রক্ষককে পত্রিকা প্রকাশের আগে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করতে হতো, একইসাথে প্রকাশনার জন্য নিবন্ধন নেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। এর পাশাপাশি জামানত (security) হিসেবে ন্যূনতম ৫০০ ও অনূর্ধ্ব ২,০০০ রূপি সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হতো। এছাড়া ছাপানো সংবাদপত্রের প্রতিটি ইস্যুর দুটি করে কপি স্থানীয় সরকারের কাছে জমা দিতে হতো। স্বভাবতই সরকার চাইলে ‘রাষ্ট্রদোহমূলক লেখালেখি’র অভিযোগে যেকোনো সংবাদপত্র জামানতসহ বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা রাখত। উচ্চ আদালতের বিশেষ ট্রাইবুনালে আপিলের সুযোগ ছিল যদিও।
এ আইনের অধীনে প্রায় ১,০০০-এর মতো সংবাদপত্র অভিযুক্ত হয়, ৫০০-এর মতো পত্রিকা নিষিদ্ধ করা হয় । প্রথম পাঁচ বছরে জামানত ও বাজেয়াপ্ত জামানত মিলিয়ে রাজকোষাগারে তখনকার সময়ের প্রায় পাঁচ লাখ রুপির মতো জমা পড়ে। উদাহরণ হিসেবে অমৃতবাজার পত্রিকার কথা উল্লেখ করা যায়। পত্রিকাটিকে ৫,০০০ রুপি জামানত হিসেবে জমা দিতে হয়েছিল। অনেক সম্পাদক সরকারবিরোধী সম্পাদকীয় লেখার দায়ে চাকুরি হারান।
ইন্ডিয়ান প্রেস (ইমারজেন্সি পাওয়ার্স) অ্যাক্ট, ১৯৩১
এ সময় সত্যাগ্রহ আন্দোলন চলছিল। মহাত্মা গান্ধী তার রাজনৈতিক বার্তা গণমাধ্যমে প্রকাশ করতেন। তার অধীনে এসব আন্দোলন ঠেকানোর জন্য এ আইন জারি করে ব্রিটিশ সরকার। আইন অনুযায়ী প্রাদেশিক সরকার সংবাদপত্রে ব্রিটিশবিরোধী ‘প্রপাগান্ডা’ থামানোর ক্ষমতা দেওয়া হয়।