প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর প্রতিটি ফ্রন্টে পর্যুদস্ত তুর্কিদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় অপমানজনক সেভ্রে চুক্তি। তুরস্কের স্বাধীনতাকে করা হয় সীমাবদ্ধ। রাজধানী কনস্টান্টিনোপলের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় মিত্রশক্তির হাতে, প্রশাসনেও প্রতিষ্ঠিত হয় তাদের কর্তৃত্ব। এরই মধ্যে তুরস্কের স্মার্না, ব্রুসা, আফিয়ুনের মতো বেশকিছু অঞ্চল দখল করে নেয় গ্রিকরা। এরপর অগ্রসর হচ্ছিল আরো ভেতরের দিকে। মোস্তফা কামালের নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়ায় জাতীয়তাবাদী তুর্কিরা, গ্রিকদের হাত থেকে মুক্ত করে আফিয়ুন, ব্রুসা ও স্মার্নার মতো শহরগুলো। সময়ের সাথে শক্তিশালী হয় তুর্কি জাতীয়তাবাদীরা, ১৯২২ সালে তুর্কি সালতানাতের সমাপ্তির পর তুরস্কের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতাসীন হন মোস্তফা কামাল।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে মোস্তফা কামাল তুরস্কের জাতি গঠনের প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেন, তুর্কি জাতিকে ইউরোপীয়করণের জন্য নেন অনেকগুলো সংস্কারপন্থী পদক্ষেপ। তার সংস্কার কার্যক্রমগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত একটি সংস্কার ছিল, খিলাফতের বিলুপ্তি করে তুরস্ককে একটি সেক্যুলার দেশ হিসেবে গড়ে তোলা। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ তুরস্কে সেক্যুলারিজমকে জাতি গঠনের প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করতে অনেকগুলো বাঁধা অতিক্রম করতে হয়েছে তাকে। তার মৃত্যুর আট দশক পরেও থামেনি সেই প্রক্রিয়াসমূহ নিয়ে বিতর্ক।
মোস্তফা কামালের তুরস্কে সেক্যুলারিজম
মধ্যযুগে ইউরোপে রাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান হিসেবে আবির্ভূত হয় চার্চ। অর্থের বিনিময়ে তারা মানুষের পাপ মোচনের ধারণাকে বিস্তৃতভাবে প্রতিষ্ঠিত করে, প্রচলন করে চার্চের যাজকদের উপহার দেওয়ার প্রথা। সময়ের সাথে চার্চের অধীনে সম্পত্তির পরিমাণ বাড়তে থাকে, সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শুরু হয় বিভিন্ন চার্চের মধ্যে যুদ্ধ। ফলে, ইউরোপের যখন রেনেসাঁ বিকশিত হওয়া শুরু করে, তখন এই ধারণা তৈরি হয় যে, একটি সুষ্ঠু রাষ্ট্রকাঠামোর জন্য চার্চের ক্ষমতাকে সীমিত করা প্রয়োজন, প্রয়োজন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রভাব কমানোর।
এরপর রেনেসাঁর ধারণাকে কেন্দ্র করে আটলান্টিক রেভ্যুলুশন হয়েছে, লাতিন আমেরিকার দেশগুলো স্বাধীনতা আন্দোলনে সফলতা পেয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীজুড়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে হয়েছে শাসনতান্ত্রিক বিবর্তন। এই বিবর্তনের সাথে বিকশিত হয়েছে সাম্যের ধারণা, আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক ভিত্তি হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে সেক্যুলারিজম। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক ন্যাশনাল সেক্যুলার সোসাইটির ব্যাখ্যা অনুযায়ী, সেক্যুলারিজমের তিনটি মৌলিক ভিত্তি রয়েছে।
প্রথমত, রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ধর্ম ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রভাবের বাইরে রাখা এবং দুই ধরনের প্রতিষ্ঠানের কাঠামো ও কাজে সুস্পষ্ট পার্থক্য থাকা। অর্থাৎ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের মর্জিমতো রাষ্ট্রের নীতি পরিবর্তনের জন্য চাপ দিতে পারবে না, ধর্মীয় পরিচয়কে ব্যবহার করে প্রভাবিত করতে পারবে না রাষ্ট্রের কার্যক্রমকে।
দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রে বসবাসকারী প্রত্যেক নাগরিক নিজের বিশ্বাসকে স্বাধীনভাবে চর্চার সুযোগ পাবে, চর্চা করতে পারবে নিজের অবিশ্বাসকেও। রাষ্ট্র একজন বিশ্বাসীকে যেমন তার ধর্ম পালনের সুযোগ করে দেবে, তেমনইভাবে একজন ধর্মে অবিশ্বাসীকেও রাজনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগরিষ্ঠ, প্রত্যেক ধর্মের মানুষ স্বাধীনভাবে নিজের ধর্ম চর্চার সুযোগ ভোগ করবে।
তৃতীয়ত, রাষ্ট্র সকল ধর্মের মানুষের মধ্যে সমতা নিশ্চিত করবে, সমান সুবিধা নিশ্চিত করবে বিশ্বাসী আর অবিশ্বাসীদের জন্য। ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে কেউ অতিরিক্ত রাষ্ট্রীয় সুবিধা পাবে না, একই কারণে কেউ রাষ্ট্রীয় সুবিধা ও নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিতও হবে না।
মোস্তফা কামাল প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণের পরই তুরস্ক জনতন্ত্রের শাসনকাঠামোর অন্যতম মৌলিক ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে সেক্যুলারিজমকে। তার সেক্যুলারিজম একদিকে যেমন তুরস্কে হার্ড-সেক্যুলার দেশ হিসেবে পরিচিতি এনে দিয়েছে, আবার তৈরি করেছে সীমাহীন বিতর্ক।
খিলাফতের সমাপ্তি
ইসলামের চারটি খিলাফতের মধ্যে সর্বশেষ খিলাফত ছিল উসমানীয়দের, টিকে ছিল প্রায় ছয়শো বছরের মতো। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকেই তুরস্কে সংস্কারপন্থীরা শক্তিশালী হতে থাকে। উসমানীয়দের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকে খলিফা হিসেবে উসমানিয়া সুলতানদের অবস্থান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগেই সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের পথে হাঁটে তুরস্ক, সীমিত হয়ে আসে সম্রাটের ক্ষমতা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ককে জড়িয়ে সীমাহীন দুর্ভোগ নিয়ে আসেন শাসক পঞ্চম মুহাম্মদ, যুদ্ধের পরে শাসক ষষ্ঠ মুহাম্মদ জাতীয়তাবাদীদের বিরুদ্ধে গিয়ে চেষ্টা করতে থাকেন মিত্রশক্তিকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে।
সুলতানি সরকারের অপমানজনক সেভ্রে চুক্তি আরো দুর্বল করে দেয় সুলতান ষষ্ঠ মুহাম্মদের অবস্থান। মোস্তফা কামালের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদীদের উত্থান তুরস্ককে জনতন্ত্রে পরিণত করে, বিলুপ্ত হয় সালতানাত। ১৯২৩ সালের জনতান্ত্রিক সংবিধানে বিলুপ্ত করা হয় সালতানাত, তৈরি হয় সাংবিধানিক জনতন্ত্র। ফলে, সুলতান আবদুল মাজেদ পরিণত হন শুধু একজন খলিফায়, যেটি অনেকটা আলংকারিক পদ করে রাখা হয়। পরের বছরই আধুনিক তুরস্ক তৈরির নেশায় খলিফা পদটিও বিলুপ্ত করেন মোস্তফা কামাল।
খলিফা পদের মাধ্যমে যেখানে তুরস্ক অঘোষিতভাবে সুন্নি মুসলিম বিশ্বের নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল, নিজেদের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ ছিল মুসলিম বিশ্বের সকল প্রান্তে, সেখানে খলিফা পদটির বিলুপ্তি কতোটুকু বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত ছিল, তা বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট দিয়ে নির্ণয় করা সম্ভব না। খলিফা পদ বহাল রাখার জন্য কুর্দিরা বিদ্রোহ করেছে, ভারতে হয়েছে খেলাফত আন্দোলন, মিসরে খেলাফতের সমর্থকরা করেছিলেন সম্মেলন। তবে, এসব উদ্যোগের ব্যর্থতা ইঙ্গিত করে, তৎকালীন প্রেক্ষাপটে খিলাফতের রাজনৈতিক বাস্তবতা ছিল না।
খিলাফতের বিলুপ্তির মাধ্যমে আধুনিক তুরস্কের দিকে যাত্রা শুরু করে মোস্তফা কামালের তুরস্ক। রাষ্ট্রীয় কাঠামো মুক্ত হওয়া শুরু করে ধর্মীয় প্রভাব থেকে। দীর্ঘ সময় ধর্মীয় রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি ছিল তুরস্কের, মোস্তফা কামাল সেই পরিচয় থেকে বের করে আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের গঠন শুরু করেন তুরস্কে। রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক ভিত্তি হিসেবে গৃহীত হয় সেক্যুলারিজম।
উলামাদের ক্ষমতা সীমিতকরণ
একটি ধর্মীয় রাষ্ট্র হিসেবে তুরস্কের বিচার বিভাগ চলতো ইসলাম ধর্মের আইনে, আইনের ব্যাখ্যা করতেন ইসলামী আইনের উপর বিশেষজ্ঞ উলামারা। আধুনিক জাতিরাষ্ট্র গঠনের স্বপ্নে বিভোর মোস্তফা কামাল বাতিল করেন ইসলামি বিচারব্যবস্থা, প্রচলন করেন সুইজারল্যান্ডের দেওয়ানি আইন, ইতালির ফৌজদারি আইন। বাণিজ্য আইনে অনুসরণ করেন জার্মানিকে। নতুন আইনের ফলে ইসলামি বিচারব্যবস্থা থেকে দূরে সরে যায় তুরস্ক, তালাক, বহু-বিবাহের মতো বিষয়গুলোতে বদলে যায় আইনি অবস্থান।
ইউরোপীয় আইন প্রচলেনর সঙ্গে সঙ্গে উলামাদের ক্ষমতা সীমিত করা শুরু করেন মোস্তফা কামাল, বিলুপ্ত করা হয় ধর্মীয় আইনের ব্যাখ্যা দানকারী শায়খ-উল-ইসলামের পদ। এর পাশাপাশি বিলুপ্ত করা হয় ধর্মীয় আইন মন্ত্রণালয়, বন্ধ করে দেওয়া হয় দীর্ঘদিন ধরে চলা ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। আইনি ভিত্তি না থাকায় আপনা-আপনিই বিলুপ্ত হয়ে যায় ধর্মীয় বিচারালয়গুলো।
ধর্মীয় আইনের কাঠামো থেকে বেরিয়ে ইউরোপীয় আইন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কামাল আতাতুর্ক তুরস্কের নারীদের অনেক বেশি স্বাধীনতার সুযোগ করে দেন। পুরুষতান্ত্রিক তুর্কি সমাজে তৈরি করে দেন নারীদের অবস্থান তৈরির সুযোগ। রাষ্ট্রীয়ভাবে নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্যের অবসান হয়, দুই অংশের জন্যই সৃষ্টি হয় সমান রাষ্ট্রীয় সুবিধা উপভোগের সুযোগ। সেক্যুলারিজমের মৌলিক ভিত্তিগুলোর একটি, ধর্মীয় বা অন্য পরিচয়ের কারণে রাষ্ট্রীয় সেবায় বৈষম্য না করা। আইনি পরিবর্তনের মাধ্যমে মোস্তফা কামাল তুরস্কে সেটি নিশ্চিত করতে পেরেছিলেন।
রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম বাতিল
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ ধর্মীয় পরিচয়কে তাদের প্রধান পরিচয় হিসেবে বিবেচনা করে। এই পরিচয়কে দেখে সামাজিক পরিচয়ের অংশ হিসেবে, কখনো দেখে জাতীয় পরিচয় হিসেবে। জাতিরাষ্ট্রের যুগে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ এই ধর্মীয় পরিচয়ের স্বীকৃতি পেতে চায় সংবিধানের মাধ্যমে। সংবিধান সাধারণত ধর্ম ও রাষ্ট্রীয় জীবনের মধ্যে সম্পর্ক ঠিক করে। কিন্তু, এই ধর্মীয় স্বীকৃতি নির্দিষ্ট ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিকরণ করে, রাষ্ট্রীয় আইনের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট ধর্মের মানুষকে অতিরিক্ত সুবিধা দেয়। নির্দিষ্ট ধর্মের মানুষদের দেওয়া এই সুবিধা সাধারণভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠদের ঘরেই যায়, সংখ্যালঘুদের বঞ্চিত করে তাদের রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক অধিকার থেকে।
তুরস্কে ১৯২৪ সালে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় ইসলামকে। পরবর্তীতে ১৯২৮ সালের এপ্রিল সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব আনেন মোস্তফা কামাল, বাতিল করা হয় রাষ্ট্রধর্ম সংক্রান্ত ধারাগুলো। তবে, এখনো তুরস্কের জাতীয় পরিচয়পত্রে ধর্ম উল্লেখ করতে হয়।
পরিসংখ্যান বলছে, তুরস্কে সুন্নি মুসলমানদেরই রয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠতা। এই সংখ্যাগরিষ্ঠতা ৯০ শতাংশের উপরে, রয়েছে অন্য কিছু তরিকার অনুসারী। এসব কিছুকে একসাথে নিয়ে, সরকারি হিসাব অনুযায়ী সুন্নি মুসলিমের পরিমাণ মোট জনসংখ্যার ৯৯.৮ শতাংশ। ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু গোষ্ঠী থাকলেও রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করার মধ্যে দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘুদের মধ্যে রাষ্ট্রীয় সমান সুবিধা প্রাপ্তির সুযোগ তৈরি করে দেয়।
ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থা
তুরস্ককে ধর্মীয় আবহ থেকে বের করে আরবি ক্যালেন্ডারের পরিবর্তে গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করেন মোস্তফা কামাল, তুর্কি ভাষা আরবি হরফের পরিবর্তে লেখা শুরু করেন ল্যাটিন হরফে। ইউরোপের সাথে মিল রেখে সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার থেকে পরিবর্তন করে রবিবারে নিয়ে আসেন। কিন্তু মোস্তফা কামাল অনুভব করতে পারছিলেন, সেক্যুলারিজমকে রাষ্ট্রীয় নীতির পাশাপাশি রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি পর্যায় ও সামাজিক জীবনে ছড়িয়ে দিতে প্রয়োজন ধর্মীয় প্রভাবহীন শিক্ষাব্যবস্থা। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে মোস্তফা কামাল ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্ধ করে দেন, ১৯২৪ সালের ‘শিক্ষা একত্রীকরণ আইনের’ মাধ্যমে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার অবসান করে শিক্ষা ব্যবস্থাকে নিয়ে আসেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে। ত্রিশের দশকে প্রথমে শহরের স্কুলগুলো থেকে ধর্মীয় শিক্ষাকে বাদ দেওয়া হয়, পরবর্তীতে বাদ দেওয়া হয় গ্রামের স্কুলগুলো থেকেও।
একটা সেক্যুলার সমাজ নির্মাণ করার যুক্তিতে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করার মাধ্যমে মোস্তফা কামাল আসলে গণতন্ত্রের প্রাথমিক মূল্যবোধগুলো লঙ্ঘন করেছেন, মানুষের শিক্ষার পছন্দের উপর আরোপ করেছেন রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদ। গণতান্ত্রিক দেশের একজন নাগরিক হিসেব, প্রত্যেক তুর্কির অধিকার আছে, নিজেদের পছন্দমতো শিক্ষা গ্রহণের, ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের চেষ্টারও রয়েছে রাষ্ট্রীয় ও নৈতিক বৈধতা। নিজের স্বপ্নের তুরস্ক প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে মোস্তফা কামাল নাগরিকদের এই গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করেছেন, নিজেকে বটবৃক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে হরণ করেছেন নাগরিকদের রাজনৈতিক অধিকার। এই অধিকার হরণের কাজটি মোস্তফা কামাল সেক্যুলারিজমের নামে করলেও, ন্যাশনাল সেক্যুলার সোসাইটির ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এর সাথে তাত্ত্বিক সেক্যুলারিজমের যোগাযোগ সামান্যই।
পর্দাপ্রথা নিষিদ্ধকরণ
প্রত্যেক ধর্মেই মৌলিক কিছু বিধান রয়েছে, রয়েছে জীবন-যাপনের আলাদা পদ্ধতি। পর্দাপ্রথা ইসলাম ধর্মের এমনিই এক বিধান। অন্যান্য রক্ষণশীল সমাজের মতো পর্দাপ্রথার চর্চা ছিল তুরস্কের সমাজেও, পর্দাপ্রথা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সামাজিক মূল্যবোধের অংশ হিসেবে।
পর্দাপ্রথাকে নারী সমাজের উপর পুরুষতান্ত্রিক রক্ষণশীল তুরস্কের সমাজের চাপিয়ে দেওয়া প্রথা হিসেবে উপস্থাপন করা শুরু করেন মোস্তফা কামাল। আধুনিক তুরস্ক গড়ার স্বপ্নে বিভোর মোস্তফা কামাল ১৯২৫ সালের কাস্তাননু বক্তৃতায় পর্দাপ্রথাকে উল্লেখ করেন সভ্য জাতির জন্য অপমানকর এক প্রথা হিসেবে। ১৯৩৫ সালে পিপলস পার্টির সম্মেলনে পর্দাপ্রথা আইন করে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করেন মোস্তফা কামাল। সেবার ব্যর্থ হলেও, তুরস্কের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পর্দাপ্রথাকে নিগৃহ করা শুরু হয়। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে পর্দাপ্রথা অনুসরণ করলে কাজ পাওয়া যেত না, পর্দাপ্রথা অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ ছিল সংবাদমাধ্যমে কাজ করা নারীদের জন্যও।
পর্দাপ্রথার বিরুদ্ধে মোস্তফা কামালের সংস্কারবাদের জন্য অনেকে তুরস্ককে হার্ড-সেক্যুলার দেশ হিসেব অবহিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু, প্রথমত, পর্দাপ্রথার নিগ্রহের মাধ্যমে মোস্তফা কামালের তুরস্ক একটি সম্প্রদায়কে তাদের ধর্মপালনে বাঁধা দিয়েছে, ধর্মীয় স্বাধীনতায় আঘাত করেছে। ধর্মীয় স্বাধীনতা সেক্যুলারিজমের অন্যতম ভিত্তি। দ্বিতীয়ত, পর্দাপ্রথাকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নিগ্রহের মাধ্যমে মোস্তফা কামাল নাগরিক অধিকার হরণ করেছেন, হরণ করেছেন পোশাকের স্বাধীনতা। সেক্যুলারিজমের যুক্তি দিয়ে পর্দাপ্রথাকে নিগ্রহ করার চেষ্টার বৈধতা দেওয়ার সুযোগ নেই।
মুসলিমদের প্রার্থনায় আরবির পরিবর্তে তুর্কি ভাষা
একটি সেক্যুলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে, পাশ্চাত্যের সাথে তুরস্কের সাংস্কৃতিক ব্যবধান কমাতে মোস্তফা কামালের সরকার এমন অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল, যেগুলো সরাসরি ইসলামবিরোধী।
প্রথমত, তুরস্কে আরবির পরিবর্তে তুর্কি ভাষায় খুৎবা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। প্রচলিত খুৎবার পরিবর্তে ধর্মীয় প্রশ্নাবলীর আধুনিক ও দর্শনসম্মত ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আধুনিক ভাবধারা সম্পন্ন কর্মচারী নিয়োগের ব্যবস্থা করেন। দ্বিতীয়ত, সমস্ত প্রার্থনা তুর্কি ভাষায় করার নিয়ম জারি করা হয়, আরবি ভাষার ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। তৃতীয়ত, খ্রিস্টান উপাসনালয়গুলোর মতো প্রার্থনাকে আকর্ষণীয় ও উদ্দীপনাপূর্ণ করতে মোস্তফা কামালের সরকার বাদ্যযন্ত্র ব্যবহারের নিয়ম করে, নিয়ম করে গায়কের ব্যবস্থা করার।
সেক্যুলার তুরস্ক
রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পাশাপাশি সমাজ জীবনেও সেক্যুলারিজম প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক আগ্রাসী পদক্ষেপ নিয়েছিল মোস্তফা কামালের সরকার। সেক্যুলারিজমের নামে হরণ করেছিল নাগরিক অধিকার, বাধাগ্রস্ত করেছিল নাগরিকদের রাজনৈতিক অধিকার চর্চার সুযোগ। ধর্মীয় কারণে সংখ্যালঘুদের অধিকার হরণের উদাহরণ তুরস্কে কখনোই মোটা দাগে না থাকার পরেও ইসলামবিরোধী অনেক পদক্ষেপের মাধ্যমে পাশ্চাত্যের সাথে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা ছিল মোস্তফা কামালের, চেষ্টা ছিল ধর্মীয় আবহ থেকে তুরস্ককে বের করে আনার। মোস্তফা কামালের সেই প্রচেষ্টা সফল হয়নি, বরং তার অনেক রাজনৈতিক সফলতার সাথে যুক্ত হয়েছে অসংখ্য বিতর্ক, যুক্ত হয়েছে সমালোচনা।