১
১৫৩৯ সালে চৌসার যুদ্ধে আর ১৫৪০ সালে কনৌজের যুদ্ধে শের শাহ পরাজিত করেন দ্বিতীয় মুঘল সম্রাট নাসিরউদ্দিন মুহাম্মদ হুমায়ুনকে। এত বড় দুটি ধাক্কা মুঘল সম্রাট হুমায়ুন সামলাতে পারলেন না। এই দুটি পরাজয়ের ফলে তাকে আগ্রা আর দিল্লি দুটি শহরই হারাতে হয়। বাধ্য হয়ে লাহোরের দিকে পিছু হটলেন তিনি।
সম্রাট হুমায়ুন পিছু হটলে শের শাহ খুব সহজেই বিনা বাঁধায় মুঘল সাম্রাজ্যের মসনদ দখল করে নিতে সক্ষম হলেন। আর নিজেকে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন হিন্দুস্তানের সম্রাট হিসেবে।
মুঘল সাম্রাজ্যের হঠাৎ এই সাময়িক ছন্দপতন বিস্ময়কর ঠেকলেও, শের শাহের নেতৃত্বে আফগানদের এই উত্থান যেন একরকম হওয়ারই কথা ছিলো। মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার পূর্বে আফগানরাই হিন্দুস্তানের দন্ডমুন্ডের কর্তা ছিলো। ১৫২৬ সালে পানিপথের প্রান্তরে ইব্রাহীম লোদির পতনের সাথে সাথে হিন্দুস্তানে প্রবল স্বাধীনচেতা জাতির এই মানুষগুলো ভয়াবহ রকমের হোঁচট খায়। পরাজয়ের পর যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে তারা সংগঠিত হতেও পারছিলো না।
আফগানদের ভাগ্যকাশে ঠিক এমনই একটা সময় উদয় হয় শের শাহ নামের এই বাঘের, যিনি ছিন্নভিন্ন আফগানদের সংগঠিত করে একটি একক শক্তি হিসেবে পুনরায় দাঁড় করান। সেই সাথে হুমকি হয়ে ওঠেন স্বয়ং মুঘল সাম্রাজ্যের জন্যই। তার বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত, দুর্দান্ত সাহসীকতা আর যোগ্যতার ফলস্বরূপ চৌসা আর কনৌজের যুদ্ধে আফগানরা তাদের কাঙ্ক্ষিত বিজয় অর্জন করে। আফগানরা পুনরায় অধিষ্ঠিত হয় হিন্দুস্তানের মসনদে।
২
হিন্দুস্তানের শাসনক্ষমতা লাভের পর নিজের ক্ষমতা সুসংহত করার কাজে মনোযোগ দিলেন শের শাহ। তার শাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিলো নিজেকে কেন্দ্র করে, অর্থাৎ, সম্রাটই ছিলেন শাসন ব্যবস্থার মূলে। শাসনব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য তিনি বেশ কয়েকজন মন্ত্রীকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তবে মন্ত্রীরা অনেকটা কর্মচারীর মতোই ছিলেন। সম্রাটের পরিকল্পনা আর ইচ্ছা বাস্তবায়ন করাই তাদের প্রধান কাজ ছিলো। আর প্রশাসনিক বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে পরামর্শের জন্য অভিজাত আর বিজ্ঞদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন একটি পরামর্শক কাউন্সিল। তবে সব ব্যাপারে শের শাহের সিদ্ধান্তই ছিলো শেষ কথা।
দিউয়ান-ই-ওয়াজির, দিউয়ান-ই-আরীজ, দিউয়ান-ই-রসলত আর দিউয়ান-ই-ইনশাহ, এই চারটি পদ নিয়ে গঠিত হয়েছিলো শের শাহের মন্ত্রীসভা। দিউয়ান-ই-ওয়াজির বা উজির সাম্রাজ্যের সকল বিষয়ই দেখাশোনা করতেন। মন্ত্রীসভার কাজ তদারক করাও তার দায়িত্বের মাঝে অন্তর্ভূক্ত ছিলো।
দিউয়ান-ই-আরীজ বা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাজ ছিলো সেনাবাহিনীকে নিয়ে। সেনাবাহিনীকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান, অস্ত্র-শস্ত্র জোগান দেয়া, যুদ্ধপরিকল্পনা করা, নতুন সৈন্য ভর্তি, সেনাবাহিনীর রসদ জোগান ইত্যাদি বিষয় তদারক করতো এই মন্ত্রণালয়। শের শাহ প্রায়ই এই মন্ত্রণালয়ের কাজ নিজে ব্যক্তিগতভাবে তদারক করতেন।
দিউয়ান-ই-রসলত পররাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখতো আর রাষ্ট্রীয় বার্তা, ঘোষণা ইত্যাদি প্রচারের দায়িত্ব ছিলো দিউয়ান-ই-ইনশাহ এর।
শের শাহ তার পুরো সাম্রাজ্যকে ৬৬টি সরকারে ভাগ করে দিয়েছিলেন। সরকার আবার কতগুলো পরগণায় এবং পরগণা কতগুলো গ্রামে বিভক্ত থাকতো। প্রতিটি পর্যায়েই প্রশাসনিক কাজকর্ম দেখাশোনার জন্য একজন করে প্রধান নিয়োগপ্রাপ্ত হতেন। সরকার বা পরগণা বা গ্রামের সমস্ত দায়িত্ব সেই প্রধানের উপরই বর্তাতো।
৩
হিন্দুস্তানের সম্রাট হওয়ার পর সেনাবাহিনীর প্রতি শের শাহ বিশেষ জোর দিয়েছিলেন। তিনি মূলত মহান খিলজি সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির সেনাবাহিনীর অনুকরণে নিজের সেনাবাহিনী গঠন করেন। সেনাবাহিনীর জন্য উন্নত অস্ত্রশস্ত্র আর প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করেন তিনি।
শের শাহ সবসময় তার সাথে প্রায় পনের হাজার অশ্বারোহী আর পঁচিশ হাজার পদাতিক সৈন্য রাখতেন। তার আমিররাও পদমর্যাদা অনুযায়ী বিভিন্ন সংখ্যক সৈন্য নিজেদের সাথে রাখতে পারতেন। এছাড়া সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে দুর্গ স্থাপন করে সেগুলোতে সেনা মোতায়েন করে রাখতেন, যাতে বাইরের আক্রমণে দ্রুত সাড়া দিয়ে আক্রমণ প্রতিহত করা সম্ভব হয়।
শের শাহ তার নিজস্ব হাতিশালায় প্রায় ৫,০০০ হাতি পুষতেন। যুদ্ধের জন্য ব্যবহৃত ঘোড়ার সংখ্যা নির্দিষ্ট করে জানা যায়নি, তবে সেটাও যে বিরাট সংখ্যক হবে তা সহজেই অনুমেয়। তবে শুধুমাত্র খবর আনা-নেয়ার জন্য সরাইখানাগুলোতে তার প্রায় সাড়ে তিন হাজার ঘোড়া সবসময় প্রস্তুত থাকতো।
সামরিক শৃঙ্খলা আরো সুসংহত করতে শের শাহ ব্যাপক সামরিক সংস্কার করেন। এক্ষেত্রে প্রথমেই চলে আসে আমিরদের দুর্নীতি প্রতিরোধে ব্যাপকভাবে ঘোড়া দাগানোর ব্যাপারটি। বিষয়টি হলো, সেই সুলতানি আমল থেকেই সেনাবাহিনী সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনার জন্য প্রত্যেক আমিরের অধীনেই নির্দিষ্ট সংখ্যক ঘোড়া আর সৈন্য বরাদ্দ দেয়া হতো। আমির আর জায়গীরদারদের কাজ ছিলো এসব ঘোড়া আর সৈন্যদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধের জন্য সবসময় প্রস্তুত করে রাখা। সৈন্য প্রশিক্ষণ আর ঘোড়া প্রতিপালনের খরচ কেন্দ্র থেকে দেয়া হতো।
দুর্নীতিপরায়ণ আমির আর জায়গীরদাররা এই ব্যবস্থায় একটি ফাঁক তৈরি করে অর্থ আত্মসাৎ করা শুরু করলো। তাদের যতজন সৈন্য আর ঘোড়া পালনের কথা থাকতো, তারা তারচেয়ে অনেক কম সংখ্যক সৈন্য আর ঘোড়া রাখতেন। কিন্তু অর্থ আদায়ের সময় কেন্দ্র থেকে পুরোটাই আদায় করে নিতেন।
কেন্দ্র থেকে পরিদর্শনের সময় কিংবা অর্থ আদায়ের সময় তাড়াহুড়ো করে ভাড়াটে সৈন্য আর ঘোড়া ভাড়া করে হিসাব বুঝিয়ে দেয়া হতো। অর্থ আদায় হয়ে গেলে বেশিরভাগ যোদ্ধা আর ঘোড়া ছাটাই করে দিয়ে কেন্দ্র থেকে পাওয়া বেশিরভাগ অর্থই আত্মসাৎ করে ফেলতো। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমনও দেখা যেতো যে, ছাটাই করার সময় সৈন্যদের পাওনা টাকাও দেয়া হতো না।
আমির আর জায়গীরদারদের এ ধরনের দুর্নীতির ফলে সেনাবাহিনীতে যেমন বিশৃঙ্খলতার সৃষ্টি হতো, তেমনই যুদ্ধের সময় সুলতান পড়ে যেতেন বিপদে। কারণ দীর্ঘদিন যত সংখ্যক সৈন্য আর ঘোড়া প্রশিক্ষণের জন্য তিনি ব্যয় করেছিলেন, প্রয়োজনের সময় তার অর্ধেকও পাওয়া যেতো না। এ কারণেই ঘোড়া দাগানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিলো।
অবশ্য ঘোড়া দাগানোর এ ব্যবস্থাটি শের শাহ নিজে আবিষ্কার করেননি। দুর্ধর্ষ খিলজি সুলতান আলাউদ্দিন খিলজিই সর্বপ্রথম এই ‘ঘোড়া দাগানো’-র প্রচলন করেন। এই ব্যবস্থায় ঘোড়ার গায়ে ঘোড়ার মালিক, নাম্বার ইত্যাদি তথ্য লিখে দেয়া হতো। একই সাথে সরকারি নথিতে ঘোড়ার বর্ণনা, ঘোড়ার মালিকের চেহারার বর্ণণা ইত্যাদি লিখে রাখা হতো।
শের শাহ তার শাসনামলে খুবই গুরুত্বের সাথে ঘোড়া দাগানোর ব্যাপারটি পুনঃপ্রচলন করেছিলেন। যতক্ষণ না শের সাহের আমিররা তাদের অধীনস্থ ঘোড়া না দাগাতেন, ততক্ষণ পর্যন্ত কোষাগার থেকে তারা কোনো অর্থ পেতেন না। এমনকি রাজপ্রাসাদের কর্মচারীরাও যদি তাদের ঘোড়া না দাগাতেন, তাদের বেতনও বন্ধ হয়ে যেতো। কঠোরতার সাথে এই বিষয়টি বাস্তবায়ন করার কারণে শের শাহের শাসনামলে প্রশাসন কেন্দ্রীক এই দুর্নীতিগুলো পুরোপুরি বন্ধই হয়ে গিয়েছিলো।
৪
সামরিক শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে শের শাহ খুবই সতর্কতা অবলম্বন করতেন। সেনানিবাসে অবস্থানকালে সৈন্যদের সামরিক আইন কানুন তো মেনে চলতেই হতো। এমনকি যুদ্ধযাত্রার সময়ও তাদের মেনে চলতে হতো ইসলামি রীতিনীতি।
যুদ্ধযাত্রার সময় শের শাহের সৈন্যদের প্রজাদের সম্পদ নষ্ট করা রীতিমতো আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো। বাহিনীর কোনো সদস্য যাতে যাত্রাপথে প্রজাদের কোনো সম্পদ বা কৃষিজমির ক্ষতি করতে না পারে, সেজন্য শের শাহ বাহিনীর যাত্রাপথে বিপুল সংখ্যক লোক ছড়িয়ে রাখতেন। প্রজাদের সম্পদ রক্ষায় দায়িত্বপ্রাপ্ত এসব লোক বিশেষ নজরদারি করতো।
ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো সৈন্য যদি প্রজাদের সম্পদ নষ্ট করতো, তাহলে তার কান কেটে দেয়া হতো। তবে যাত্রাপথে জায়গার স্বল্পতার জন্য যদি কোনো কৃষিজমি বা প্রজাদের সম্পদ নষ্ট করে এগোতে হতো, তাহলে শের শাহ তখনই জরিপকারীদের দিয়ে ক্ষয়ক্ষতি পরিমাপ করে ক্ষতিপূরণ আদায় করে তারপরেই ঐ স্থান ত্যাগ করতেন।
এমনকি শের শাহ পারতপক্ষে প্রজাদের কৃষিজমির কাছে তাঁবু গাড়তেন না। পাছে সৈন্যরা যদি ফসলের ক্ষতি করে ফেলে! আর এসব ক্ষেত্রে সৈন্যরাও বেশ সতর্ক থাকতো। নিজেরা তো ক্ষতি করতোই না, অন্য কেউ ক্ষতি করলে তৎক্ষণাত তাকে গ্রেফতার করা হতো। কে চায় অযথা নিজের সাধের কানটি হারাতে!
কৃষকদের ব্যাপারে শের শাহ একটু বেশিই উদার ছিলেন। যুদ্ধজয়ের পরে শত্রু রাজ্যের কৃষকদের তিনি কোনোরুপ ক্ষতি করতেন না বা তাদের দাস বানাতেন না। এক্ষেত্রে শের শাহের বক্তব্য ছিলো, সাধারণত কৃষকরা রাজনীতির আগেও থাকে না পেছনেও থাকে না। তারা শুধু তাদের চাষবাস নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বিজয়ী হয়ে আমি যদি তাদের উপর অত্যাচার করি, তাহলে তারা আমার এলাকা ছেড়ে চলে যাবে। এতে সাম্রাজ্যের উৎপাদন ব্যহত হবে। মোটের উপর ক্ষতি আমার সাম্রাজ্যেরই হবে।
যুদ্ধযাত্রায় প্রজাদের প্রতি শের শাহের এমন মনোভাব দেখে প্রজারা স্বেচ্ছায় বিভিন্ন সময় সেনাবাহিনীকে সাহায্য সহযোগীতা করতো।
এছাড়া শের শাহ যখন যেখানে থাকতেন, তার ও তার বাহিনীর সদস্যদের জন্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত আরো কিছু বেশি রান্না করা হতো। কোনো দরিদ্র অভাবি কিংবা কৃষক চাইলেই শের শাহের জন্য রান্না করা খাবারে ভাগ বসাতে পারতো। তাদের জন্য সেনা ছাউনির পাশেই খাবার বিতরণ করা হতো।
৫
ক্ষমতা পাকাপোক্ত করা, প্রশাসন ও সেনাবাহিনী ঢেলে সাজানোর পর শের শাহ মনোযোগ দিলেন সাম্রাজ্য আর সাম্রাজ্যের প্রজাদের জন্য জনহিতকর কাজের প্রতি।
প্রথমেই প্রশাসনের অত্যাচার-নির্যাতন থেকে জনগণকে রক্ষা করতে কিছু নতুন নিয়মনীতি প্রবর্তন করলেন। কর সংগ্রহকারীদের থেকে জনগণকে রক্ষা করার জন্য পুরো রাজস্ব ব্যবস্থাই ঢেলে সাজালেন তিনি।
আদায়কৃত রাজস্বকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছিলো। কেন্দ্রীয় রাজস্ব আর স্থানীয় রাজস্ব। ভূমি রাজস্ব, যাকাত, জিজিয়া, টাকশাল, বাণিজ্যশুল্ক, উপহার কিংবা উপঢৌকন, উত্তরাধীকারবিহীন সম্পত্তি কেন্দ্রীয় রাজস্বের অন্তর্ভূক্ত ছিলো। স্থানীয় রাজস্বের মাঝে বাণিজ্য শুল্কই প্রধান ছিলো।
রাজস্ব ব্যবস্থার জন্য তিনি প্রত্যেক পরগণার জন্য একজন করে আমির, একজন শিকদার, একজন খাজাঞ্চি আর দুজন করে হিসাবরক্ষক প্রেরণ করেন। হিসাবপত্র ফারসি আর হিন্দি দুই ভাষাতেই লেখা হতো।
সাম্রাজ্যের মূল চালিকাশক্তি কৃষকদের উপর যাতে কোনো প্রকার নির্যাতন না হয়, সেজন্য প্রশাসন বিশেষ দৃষ্টি রাখতো। ইচ্ছামতো রাজস্ব আদায় যাতে করা না হয়, সেজন্য শের শাহ ভূমি জরিপের ব্যবস্থা করেন। সাম্রাজ্যের চাষযোগ্য সমস্ত জমিকে উত্তম, মধ্যম আর নিকৃষ্ট এই তিন ভাগে ভাগ করে জরিপ করা হতো। অবশ্য পরবর্তীতে এই বিভাজনের কিছুটা কুফলও দেখা গিয়েছিলো। এই ব্যবস্থায় জমির শ্রেণী তিন প্রকার হলেও গড়ে রাজস্ব হিসাব করা হতো। ফলে মধ্যম আর নিকৃষ্ট জমির চাষীরা কিছুটা বিপাকে পড়েছিলো।
ফসলের মোট উৎপাদনের তিন ভাগের এক ভাগ আদায় করা হতো রাজস্ব হিসেবে। কৃষকদের সুবিধার জন্য রাজস্ব ফসল কিংবা নগদ দুই ভাগের আদায়ের সুযোগ ছিলো। তাছাড়া বিভিন্ন বিপদ আপদে তাদের সরকারি ঋণ ও অনুদান দেয়া হতো।
ভূমি জরিপ ব্যবস্থা আর রাজস্বব্যবস্থায় শের শাহের এসব সংস্কারের ফলে অতীত থেকে চলে আসা রাজস্ব ব্যবস্থাপনার শৃঙ্খলা আসে।
পণ্যের শুল্ক ব্যবস্থাতেও শের শাহ কড়া নজরদারি করতেন, যাতে পণ্যের দাম বেড়ে না যায়। পুরো সাম্রাজ্য জুড়ে মাত্র দুটি ক্ষেত্রে বাণিজ্য শুল্ক আদায় করা হতো। বাংলা থেকে পণ্য প্রবেশ করলে সড়কিগলি ঘাটে শুল্ক আদায় করা হতো। আর মধ্য এশিয়া থেকে পণ্য আসলে শুল্ক আদায় করা হতো সিন্ধুতে। আর দ্বিতীয় প্রকারের শুল্ক আদায় করা হতো বিক্রয়স্থলে। এই দুই প্রকার শুল্ক ব্যতীত শের শাহের সাম্রাজ্যে আর কোথাও পণ্যের উপর শুল্ক আদায় করা হতো না। এতে বাজারদর স্থিতিশীল থাকতো।
প্রশাসনের কর্মকর্তারা প্রভাব খাটিয়ে যাতে বাজার থেকে কম মূল্যে পণ্য কিনতে না পারে, সে ব্যাপারেও শের শাহ নজরদারি করতেন।
তাছাড়া ব্যবসায়ীক কাজে সুবিধার জন্য শের শাহ পূর্ববর্তী সুলতানদের বিভিন্ন মানের এবং প্রায় নষ্ট হয়ে যাওয়া মুদ্রাগুলো বাতিল করে নতুন করে মুদ্রা তৈরি করালেন। ‘দাম’ নামে এক ধরনের তামার মুদ্রা তৈরি করে প্রচলিত স্বর্ণমুদ্রা, রৌপ্যমুদ্রা ও তাম্রমুদ্রার সাথে বিনিময় হার নির্ধারণ করে দিলেন। এতে সাম্রাজ্যজুড়ে ব্যবসায়ীক লেনদেন সহজ হয়ে গেলো।
৬
ন্যায়বিচার ছাড়া কোনো সাম্রাজ্য, রাজ্য বা দেশ টিকে থাকতে পারে না। শের শাহ তাই তার সাম্রাজ্যে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করেছিলেন। প্রশাসন পরিচালনা কিংবা বিচারকার্যে শের শাহ ছিলেন সম্পূর্ণরুপে নিরপেক্ষ। দুর্নীতি করলে বা অন্য কোনো অপরাধ করলে তিনি কাউকে ছাড় দিতেন না। এক্ষেত্রে তিনি কে আমির আর কে প্রজা, কে আমিরের ছেলে আর কে মুচির ছেলে এসব কিছুই দেখতেন না। সবার জন্যই একই আইন ছিলো। বিচারের শাস্তি দেয়া হলে তা বাস্তবায়নেও তিনি কখনো পিছপা হননি।
ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সাম্রাজ্যজুড়ে তিনি নিয়োগ দিয়েছিলেন অসংখ্য বিচারক। ‘কাজী’ আর ‘মুনসিফ’রা দিউয়ানী মামলার বিচার করতেন। ফৌজদারি মামলার বিচার করতেন ‘শিকদার’রা। গ্রামাঞ্চলে বিচারের জন্য গ্রাম পঞ্চায়েত গঠিত হয়েছিলো। গ্রাম পঞ্চায়েত দিউয়ানি আর ফৌজদারি দুই ধরনের মামলারই বিচার করতে পারতো। তাছাড়া সাম্রাজ্যের রাজস্ব সম্পর্কিত বিচারের জন্য আলাদা বিচার ব্যবস্থা ছিলো।
বিচার ব্যবস্থায় শের শাহ তেমন নতুন কিছু যোগ করেননি। পূর্বের বিচার কাঠামোর মাঝেই তিনি মূলত জোর দিয়েছিলেন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রতি।
৭
প্রজা, ব্যবসায়ী এবং সেনাবাহিনীর চলাচলের সুবিধার কথা বিবেচনা করে তৈরি করলেন একের পর এক রাস্তা। প্রশাসনিক কাজ গতিশীল করতে এবং সাম্রাজ্যের পূর্ব অংশকে পশ্চিম অংশের সাথে যুক্ত করতে শের শাহ মৌর্য শাসনামলের বিলুপ্তপ্রায় একটি রাস্তাকে ব্যাপক সংস্কার করে আধুনিকায়ন করেন। রাস্তাটি বর্তমান বাংলাদেশের চট্টগ্রাম থেকে বর্তমান ভারতের হাওড়া, হাওড়া থেকে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে দিল্লি, দিল্লি থেকে অমৃতসর, অমৃতসর থেকে লাহোর এবং পেশওয়ার হয়ে কাবুল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো। প্রায় ২,৫০০ কিলমিটার দীর্ঘ এ সড়কটি পরিচিত ছিলো সড়ক-ই-আজম নামে। সড়কটি বর্তমানে গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড নাম নিয়ে ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে রয়েছে। শের শাহের সড়ক-ই-আজম আজও আধুনিক আফগানিস্তান, পাকিস্তান আর ভারত এশিয়ান হাইওয়ে হিসেবে ব্যবহার করছে।
যা-ই হোক, সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশকে সংযুক্ত করতে তিনি আরো কিছু রাস্তা তৈরি করেন। এসব রাস্তার একটি আগ্রাকে সংযুক্ত করেছিলো দক্ষিণের বুরহানপুরকে। আরেকটি রাস্তা দিয়ে সংযুক্ত করা হয় আগ্রা হয়ে যোধপুর ও চিতোরকে। লাহোর আর মুলতানকে সংযুক্ত করতেও একটি রাস্তা তৈরি করা হয়।
শুধু রাস্তা তৈরি করেই শের শাহ শান্ত হলেন না। একই সাথে সাম্রাজ্যের রাজপথগুলোকে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেয়া হলো, যাতে প্রজা আর ব্যবসায়ীরা অবাধে চলাচল করতে পারে। উপরন্তু, প্রজা আর ব্যবসায়ীদের সুবিধার জন্য প্রতি ৮ কিলোমিটার পর পর সরাইখানা বা বিশ্রামাগার স্থাপন করলেন। সরাইখানাগুলোতে হিন্দু এবং মুসলিম উভয়ের জন্যই সুব্যবস্থা ছিলো। হিন্দুদের দেখভালের জন্য একজন করে ব্রাক্ষণও নিযুক্ত করা হতো।
সরাইখানাগুলোতে পানি সরবরাহের জন্য থাকতো একটি করে কুয়া। আশ্রয় নেয়া পথিকদের জন্য স্বাস্থকর খাবার, বিশ্রামের ব্যবস্থাসহ তাদের ঘোড়ার জন্যও খাবার পাওয়া যেতো এসব সরাইখানায়।
মুসলিমদের প্রার্থনার জন্য সরাইখানারগুলোর সাথে একটি করে মসজিদ থাকতো। মসজিদে ইমাম আর মুয়াজ্জিনও থাকতেন। সরাইখানার ব্যয় নির্বাহের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ জমি বরাদ্দ দেয়া হতো। এসব জমির আয় থেকেই সরাইখানাগুলো চলতো।
শের শাহ তার সাম্রাজ্যজুড়ে মোট ১,৭০০টি সরাইখানা নির্মাণ করেছিলেন। এসব সরাইখানাকে ঘিরে পরবর্তীতে শহর ও গ্রাম গড়ে উঠেছিলো। বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও এই সরাইখানাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো।
শের শাহ একজন বিচক্ষণ ও দূরদর্শী শাসক ছিলেন। সরাইখানার এই সুশৃঙ্খল নেটওয়ার্ককে তিনি রাষ্ট্রীয় কাজেও ব্যবহারের ব্যবস্থা করলেন। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রতিটি সরাইখানায় দুটি করে ঘোড়া বরাদ্দ রাখা হতো, যাতে রাষ্ট্রীয় সংবাদ বাহকরা এসব সরাইখানায় বিশ্রাম নিয়ে ঘোড়া পরিবর্তন করে দ্রুত নির্দিষ্ট জায়গায় যেতে পারতেন।
এছাড়া ব্যবসায়ী ও প্রজাদের সুবিধার জন্য রাস্তার দুই পাশে সাড়ি সাড়ি করে বিপুল সংখ্যক গাছ লাগানো হয়েছিলো।
৮
শের শাহের শাসনামলে কোনো নির্দিষ্ট গ্রামের সীমানার নিরাপত্তার দায়িত্বটি সংশ্লিষ্ট গ্রাম প্রধানের উপর ন্যাস্ত ছিলো। আর এ বিষয়টি নিয়ে গ্রাম প্রধানরা বেশ বিপদে পড়েছিলেন। যে সময়ের আলোচনা করছি, সে সময়ে রাস্তাঘাটগুলো তেমন নিরাপদ ছিলো না। প্রায়ই চুরি, ডাকাতি আর খুন হতো রাস্তাঘাটে। বিশেষত রাতের বেলায় নিরাপদ ভ্রমণ তো এক রকম দুঃস্বাধ্য ঘটনা ছিলো। এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব ঘটনার পেছনে হাত থাকতো গ্রাম প্রধানদেরই। সড়কে অপরাধ করার জন্য চোর-ডাকাতদের তারাই পৃষ্ঠপোষকতা করতো।
তাই শের শাহ খুব কঠোর একটি উদ্যোগ নিলেন। নিরাপত্তারক্ষীদের চোখ এড়িয়ে যদিও বা কোনো অপরাধ সংগঠিত হয়, তাহলে প্রথমেই গ্রাম প্রধানদের ধরে আনা হতো। অপরাধের বিবরণ শুনিয়ে তাদের নির্ধারিত একটি সময় দিয়ে দেয়া হতো অপরাধীকে ধরে আনার জন্য। চুরি-ডাকাতির ক্ষেত্রে যদি অপরাধীকে ধরে আনা না যেতো, তাহলে গ্রাম প্রধানকেই তার ক্ষতিপূরণ দিতে হতো। খুনের ক্ষেত্রে অপরাধীকে ধরা সম্ভব না সেক্ষেত্রেও গ্রাম প্রধানকেই শাস্তি ভোগ করতে হতো। আর যদি গ্রাম প্রধান অপরাধীকে ধরিয়ে দিতে সক্ষম হতেন, তাহলে তিনি সমস্ত দায় দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়ে যেতেন।
নিয়মটি কঠিন মনে হলেও আশ্চর্যভাবে দেখা গেলো যে, এর ফলে সড়ক বা গ্রামগুলোতে অপরাধ প্রায় নেই বললেই চলে।
অভ্যন্তরীণ আইন শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে শের শাহের কঠোরতার ফলে দেখা গেলো, আইন শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে সাম্রাজ্যের সবাই অত্যন্ত তৎপর থাকতেন। আর গ্রাম প্রধানদের তৎপরতা তো আরও বেশি থাকতো। কারণ কিছু হলেই ঝরের প্রথম ধাক্কা যেতো তাদের উপর দিয়ে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিলো যে, কোনো গ্রাম প্রধানের সীমানার মাঝে বাইরে থেকে আসা কোনো ব্যবসায়ী মারা গেলে গ্রাম প্রধান নিজেই গিয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের তার রেখে যাওয়া সম্পত্তির দায়িত্ব নিতে চাপাচাপি করতেন। পাছে কেউ যদি এসব সম্পদ রেখে দেয়! কারণ শের শাহের সাম্রাজ্যে আগন্তুকের সম্পদ আত্মসাৎ করা বিশ্বাসঘাকতার সমতুল্য ছিলো। আর শের শাহের সাম্রাজ্যে বিশ্বাসঘাতকের কোনো স্থান নেই!
৯
শের শাহ একবার খবর পেলেন, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে সাম্রাজ্যের অনেক ইমাম আর ধর্মীয় ব্যক্তিত্বরা প্রাপ্য রাষ্ট্রীয় সুবিধার অতিরিক্ত সুবিধা আদায় করছেন, এমনকি অতিরিক্ত জমিও নিজেদের নামে নিয়ে নিয়েছেন। অভিযোগ পাওয়া মাত্র শের শাহ তাৎক্ষণিকভাবে সমস্ত বরাদ্দকৃত জমি ফিরিয়ে নিয়ে পুনরায় যাচাই বাচাই করে জমি বরাদ্দ দিলেন। আর পরবর্তীতে নিয়ম করলেন, রাষ্ট্রীয় কোনো ফরমান সরাসরি ইমাম বা ধর্মীয় ব্যক্তিদের কাছে যাবে না। বরং স্থানীয় প্রশাসন কর্মকর্তা হয়ে তারা রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করবেন।
শের শাহের এ সিদ্ধান্ত দেখে মনে হতে পারে, তিনি ধর্মীয় ব্যক্তিদের উপর বীতশ্রদ্ধ ছিলেন বা তাদের সম্মান করতেন না। আসলে ঘটনা তেমনটা না। বরং সাম্রাজ্যের উন্নতির জন্য শের শাহ ধর্মীয় ব্যক্তিদের অবশ্যম্ভাবী মনে করতেন। তবে তিনি মনে করতেন বৈষয়িক সম্পত্তির মোহে ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের মোহাবিষ্ট হওয়া উচিত নয়।
ধর্মীয় ক্ষেত্রে হিন্দুদের প্রতি শের শাহ উদার ছিলেন। শাসন ক্ষমতা সুসংহত ও সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটানোর জন্য তাকে হিন্দু রাজ্য রাইসিন, যোধপুর আর কালিঞ্জরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হয়েছিলো বটে, তবে যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়া অন্য কোন সময় তিনি হিন্দুদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ব্যবহার করেননি। মুসলিমদের জন্য যেমন তিনি রাষ্ট্রীয় খরচে মসজিদ-মাদরাসা গড়ে দিয়েছিলেন, ঠিক তেমনই হিন্দুদের জন্যও বিভিন্ন স্থানে পাঠশালা ও ধর্মীয় স্থাপনা তৈরি করে দিয়েছিলেন। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খরচ চালানোর জন্য জমিও বরাদ্দ দেয়া হতো।
শের শাহের সাম্রাজ্যে মুসলিমদের পাশাপাশি হিন্দুরা যেমন নিশ্চিন্তে নিজেদের ধর্ম পালন করতে পারতো, ঠিক তেমনই যোগ্যতার ভিত্তিতে যেকোনো হিন্দু ধর্মাবলম্বীও প্রশাসনের উচ্চপদে বসে যেতে পারতো। সেনাবাহিনীও হিন্দুদের জন্য উন্মুক্ত ছিলো। শের শাহের পদাতিক বাহিনীর বেশিরভাগ যোদ্ধাই ছিলো হিন্দু।
১০
শের শাহ শুধু যে বিভিন্ন আইন কানুন প্রবর্তন করেই নিজের দায় সেরেছিলেন, ব্যাপারটা কিন্তু সেরকম না। বরং, সমগ্র সাম্রাজ্যের খুঁটিনাটি তথ্য সংগ্রহ করার জন্য শের শাহ সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির গুপ্তচর বিভাগের অনুরূপ একটি গুপ্তচর বিভাগ তৈরি করেছিলেন। শের শাহের জানা প্রয়োজন এমন যেকোনো তথ্য মুহূর্তেই এই গুপ্তচর বিভাগের মাধ্যমে শের শাহের কাছে পৌঁছে যেতো।
তাছাড়া, আমিরসহ প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের পেছনে তিনি তার গুপ্তচরদের লাগিয়ে দিয়েছিলেন। এসব গুপ্তচররা আমির, প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ সেনাবাহিনীর সাথে মিশে যেয়ে তথ্য সংগ্রহ করে শের শাহকে জানাতেন। এর ফলে নিজের সেনাবাহিনী, আমির আর প্রশাসনের ব্যাপারে শের শাহ দ্রুত সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন।
এদিকে শের শাহের আমিরসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানতেন যে, তারা যা-ই করেন না কেন, তা শের শাহ মুহূর্তেই জেনে যান। এ কারণে তারাও নিজেরা দুর্নীতিমুক্ত থেকে প্রশাসনিক কাজ করতে বাধ্য হতেন।
শের শাহের এরূপ কঠোর নজরদারির ফলাফল হলো, তার সাম্রাজ্যে জনগণ শান্তিতে নিরুপদ্রব জীবন যাপন করতে পারতো। তাদের কাউকে প্রশাসনিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়নি, কাউকে দিতে হয়নি অতিরক্ত কোনো কর। শের শাহের সাম্রাজ্যে কখনো দুর্ভিক্ষ হয়নি, চুরি ডাকাতির ঘটনাও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছিলো।
মোট কথা, শের শাহের সাম্রাজ্যে জনগণ বেশ শান্তিতেই ছিলো।
১১
মানুষ হিসেবে শের শাহ বেশ সাধারণ জীবন যাপন করতেন। তিনি ঘুম থেকে উঠতেন খুব সকালে। উঠে গোসল করে ফজরের সালাত আদায় করতেন। ফজরের সালাত আদায় করেই রাজকীয় কার্যক্রম পর্যালোচনা করতে বসে যেতেন। এসময় প্রশাসনিক বিভিন্ন রিপোর্ট তার কাছে পাঠানো হতো। তিনি গভীর মনোযোগের সাথে এগুলো দেখতেন। কোথাও সংশোধনের প্রয়োজন হলে কর্মচারীদের তা বলে দিতেন। এ সময় রাজসভার মন্ত্রীরাও নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের সংক্ষিপ্ত বিবরণী পেশ করতেন।
কাগজ-পত্রের কাজ শেষ হলে শের শাহ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাসহ অন্যান্য অভিজাত ব্যক্তিবর্গের সাথে দেখা করার জন্য সময় দিতেন। এ সময় তিনি তাদের ও তাদের পরিবারের খোঁজ নিতেন। প্রয়োজন হলে তাদের মাঝে জায়গীর বন্টন করতেন। এসব কাজ শেষ হলে মনোযোগ দিতেন বিচারকাজের প্রতি।
বিচারকার্যের জন্য বিচারপতি তো ছিলোই, কিন্তু তারপরেও কেউ যদি সেই বিচারে সন্তুষ্ট না হতো, তাহলে নির্দ্বিধায় শের শাহের দরবারে উপস্থিত হয়ে যেতে পারতো। শের শাহও তার প্রজাদের অভাব, অভিযোগ মন দিয়ে শুনতেন ও ন্যায়বিচারের চেষ্টা করতেন। কেবলমাত্র ন্যায়বিচারই পারে একটি সাম্রাজ্যকে টিকিয়ে রাখতে, এই বিষয়টি শের শাহ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। প্রায়ই তিনি বলতেন, ন্যায়বিচারই হলো ধর্মীয় কার্যক্রমের মধ্যে সবচেয়ে সেরা।
বিচারকার্যের পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে শের শাহ সেনাবাহিনীর প্রতি নজর দিতেন। সেনাবাহিনীর বিভিন্ন নথিপত্র নিজে প্রায়ই যাচাই করে দেখতেন। সেনাবাহিনীতে নতুন কেউ চাকরি নিতে এলে তিনি নিজেই তার সাথে কথাবার্তা বলতেন। এরপর তাদের দক্ষতা যাচাই করতেন। সন্তুষ্ট হলে আরো যাচাই বাছাইয়ের পর তাদের সেনাবাহিনীতে নিয়ে নেয়া হতো।
এগুলো শের শাহের দৈনন্দিন কার্যক্রমের অংশ ছিলো। এসব কার্যক্রমের মাঝে যদি সাম্রাজ্যের কোনো প্রান্ত থেকে রাজস্ব চলে আসতো, তাহলে তিনি নিজে তা পরীক্ষা করে হিসাব মিলিয়ে দেখতেন। বিভিন্ন রাজ্য থেকে দূতেরা তার দরবারে এলে তাদের সাথে দেখা করতেন।
এতসব কাজের মাঝখানে কোনো এক ফাঁকে সকালের নাস্তা সেরে ফেলতেন শের শাহ। এসময় প্রায়ই তার সাথে আলেমরা থাকতেন। নাস্তার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে দুপুর পর্যন্ত চলতো রাজকীয় কার্যক্রম।
দুপুরে যোহরের সালাত আদায়ের করে খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতেন। এরপর আবারও রাজকার্য চলতো। বিকালের দিকে বিভিন্ন জনসমাবেশে যোগ দিয়ে আসরের সালাত আদায় করে কিছুক্ষণ পবিত্র কুরআন পাঠ করতেন। এরপর আবারও রাজকার্যে মনোযোগ দিতেন।
এভাবেই সারাদিন প্রচন্ড ব্যস্ততার সাথে কেটে যেত হিন্দুস্তানের সম্রাট শের শাহের দিনগুলো। তার এই দৈনন্দিন কার্যক্রমে তিনি কখনোই অলসতা প্রদর্শন করেননি। কারণ তিনি জানতেন, তিনি অলসতা দেখালে তার সাথে সাথে গোটা প্রশাসনেই অলসতা চলে আসবে।
১২
শের শাহ কোনো রাজপরিবারের উত্তরসূরি হিসেবে দিল্লির মসনদ লাভ করেননি। তার পিতা ছিলেন একজন ঘোড়া ব্যবসায়ী এবং তিনি নিজেও একেবারে সাধারণ পর্যায় থেকে উঠে এসেছিলেন। এ কারণে তিনি রাজকীয় কৃত্রিম গাম্ভীর্য ত্যাগ করে খুবই সাদাসিধে জীবনযাপন করেছিলেন। ফলে শের শাহের সেনারা তাকে যেমন ভালোবাসতো, তেমনই প্রজারাও তাকে ভালোবাসতো।
তিনি ছিলেন একজন দক্ষ যোদ্ধা, দুর্ধর্ষ জেনারেল আর বিচক্ষণ শাসক। হতবুদ্ধ আফগান জাতির হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করে নিজের দূরদর্শিতার বলে তিনি নিজেকে হিন্দুস্তানের মসনদে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
শের শাহ সুরি সাম্রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন মাত্র ৫ বছর, ১৫৪০ সাল থেকে শুরু করে ১৫৪৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত। আর এই ৫ বছরেই রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি যুগান্তকারী যেসব সংস্কার করেছিলেন, তা পরবর্তীতে মুঘল সাম্রাজ্য সরাসরি গ্রহণ করেছিলো। কাজেই বলা যায়, শের শাহ মুঘলদের শত্রু হলেও তিনি পরবর্তীতে মুঘল প্রশাসনের ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিলেন। একজন মানুষকে মনে রাখা হয় তার কাজের মধ্য দিয়েই। শের শাহ অল্প কয়েক বছর রাজত্ব করেছিলেন। কিন্তু এই অল্প কয়েক বছরেই তিনি যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছেন, তাতে হিন্দুস্তানের ইতিহাসে তার নামটি আজীবন অক্ষয় হয়ে থাকবে।
[এই সিরিজের পূর্বের প্রকাশিত পর্বটি পড়ুন এখানে। সিরিজের সবগুলো লেখা পড়তে চাইলে ক্লিক করুন এখানে।]