বার্লিনে ১৮৪৮ সালের মার্চের বিপ্লব (German revolution of 1848) ইউরোপসহ পুরো জার্মানিতে চলমান শাসনতন্ত্র সংস্কারের আন্দোলনেরই অংশ ছিল। প্রতিবেশী অস্ট্রিয়াতে তো সহিংস বিক্ষোভে একপর্যায়ে এককালের মহা ক্ষমতাধর অস্ট্রিয়ান চ্যান্সেলর মেটেরনিখ পদত্যাগ করে ইংল্যান্ডে পালিয়ে যেতে বাধ্য হলেন (March Revolution in Vienna)। তবে প্রুশিয়াতে সহিংসতার মাত্রা ছিল তুলনামুলকভাবে বেশি। অস্ট্রিয়াতে যেখানে ৫০ জন হতাহত হয়েছিল, সেখানে প্রুশিয়াতে নিহতের সংখ্যাই ছিল শতাধিক। তবে ফ্রেডেরিক উইলিয়ামের বিচক্ষণতায় ঘটনা আর বেশি দূর বাড়তে পারেনি।
বার্লিনের সাথে পাল্লা দিয়ে প্রুশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলেও উত্তেজনার খবর আসতে থাকে। অনেক জায়গাতে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে, ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় কলকারখানা আর দালানকোঠার উপর। সংবিধান আর প্রতিনিধিত্ব ছাড়িয়ে ক্ষোভ রূপ নিয়েছিল দরিদ্র মানুষের কাজের দাবিতে। ওয়ারেনডর্ফ নামে এক শহরে কাপড়ের কারখানাতে যন্ত্রের ব্যবহারে অনেকে কাজ হারায়। সেখানে শ্রমিকেরা এসব কারখানার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। রাইন নদীতে স্টিমার চলাচলে ছোট ছোট নৌকার মাঝিরা বেকার, ফলে তারাও ক্ষতিপূরণের দাবিতে আওয়াজ তুলল। বার্লিনের সংঘর্ষের আগে, তেসরা মার্চ কোলন শহরে নগরকর্তাদের এক সভায় বিক্ষুদ্ধ জনতা ঢুকে পড়ে, তারা দাবি করল সকলের জন্য ভোটাধিকার এবং সেনাবাহিনী বিলোপের। কর্মকর্তারা দৌড়ে পালিয়ে যান, একজন তো জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়ে পা-ই ভেঙে ফেলেন। সরকারি হিসেবে এ সময় বার্লিনে ১২৫, কোলনে ৪৬, ব্রেস্লাউতে ৪৫ আর কনিগসবার্গে ২১বিক্ষোভের ঘটনা লিপিবদ্ধ হয়।
ক্ষোভের প্রশমন
সেনাবাহিনীকে তুলে নেয়ার পর রাজা তার পরিবারের নিরাপত্তা আক্ষরিক অর্থে জনতার হাতে সঁপে দিয়েছেন। তার পুরাতন মন্ত্রীসভা পদত্যাগ করে, সেখানে লিবারেল মতাদর্শের রাজনীতিবিদদের নিয়োগ দিতে শুরু করলেন ফ্রেডেরিক। ১৯ মার্চ বিকালে নিহত বিপ্লবীদের মরদেহ নিয়ে জনতা প্রাসাদের সামনে দিয়ে মিছিল করে। ফ্রেডেরিক এবং রানী এলিজাবেথ দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রাসাদের ব্যালকনিতে। রাজার মাথায় টুপি দেখে জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হলে তিনি তৎক্ষণাৎ টুপি খুলে মাথা নোয়ালেন। রানী পাশে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপছেন। একপর্যায়ে তিনি ফিসফিস করে বলেই বসলেন, কেবল একটা গিলোটিন হলেই ষোলকলা পূর্ণ হয়।
তবে প্রুশিয়ান সাধারণ মানুষের কাছে হনজোলার্ন পরিচয়ের সুবাদে ফ্রেডেরিকের আসন ছিল বেশ উঁচুতে। রাজাকে সিংহাসনচ্যুত করার ইচ্ছা তাদের ছিল না, তারা চাইছিল গণতন্ত্রভিত্তিক অভিন্ন জার্মান রাষ্ট্র গঠনে ফ্রেডেরিক তাদের নেতৃত্ব দেবেন। ২১ মার্চ বার্লিনে বহু প্ল্যাকার্ডে তাকে এজন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ জানান হয়।
ফ্রেডেরিক উইলিয়াম এই সুযোগ ছাড়লেন না। ২০ তারিখ তিনি সাধারণ ক্ষমার আওতায় বার্লিনের সংঘাতে জড়িত সকলকে জেল থেকে মুক্ত করে দেন। এরপর তিনি ঘোষণা করে দিলেন জার্মান রাষ্ট্রগুলোর একটি সম্মিলিত সংসদের ব্যাপারে তিনি প্রুশিয়ার সমর্থন জ্ঞাপন করছেন। ২১ মার্চ ঘোড়ায় চেপে অল্প কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে তিনি শহরের মধ্য দিয়ে রওনা দেন। যাত্রাপথে অনেক জায়গাতে থেমে তিনি সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলেন।২৫ তারিখ তিনি হাজির হলেন পটসড্যামে, যেখানে সেনা অফিসারেরা বার্লিন থেকে তাদের সরিয়ে দেয়ায় ফুঁসছিল। সবাইকে একসাথে করে রাজা ঘোষণা করেন প্রুশিয়ান নাগরিকদের মধ্যেই তিনি সবথেকে বেশি নিরাপদ বোধ করেন। এর ফলে সেনাবাহিনীতে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলেও ফ্রেডেরিক তা সামলে নিন।
ফ্রেডেরিকের সবকিছুই ছিল খুব সতর্কভাবে পরিকল্পনা করা। তিনি পটসড্যামে তার ঘোষণার কপি সাধারণ মানুষের কাছে বিলি করার নির্দেশ দেন। ফলে মানুষ জানল সেনাবাহিনীর বাড়াবাড়িতে রাজার কোনো হাত ছিল না, এবং তিনি সত্যসত্যই চান জনতার দাবি পূরণ হোক।
মন্ত্রীসভার রদবদল
পুরনো মন্ত্রীদের সরিয়ে ফ্রেডেরিক উইলিয়াম নতুন মুখ হাজির করলেন। ২৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন প্রথিতযশা ব্যবসায়ী ক্যাম্পহাউজেন (Ludolf Camphausen)। তিনি ছিলেন একজন সক্রিয় লিবারেল। অন্যান্য পদেও নামকরা লিবারেলদের নিয়োগ করা হয়।
নতুন সংবিধান আর সংসদ
এপ্রিলের ২ তারিখ ইউনাইটেড ডায়েটের অধিবেশনে ফ্রেডেরিক উইলিয়ামের তরফ থেকে সংবিধানের জন্য কয়েকটি প্রস্তাব উত্থাপিত হলো:
- চব্বিশ বছর এবং তদুর্ধ্ব সকল প্রুশিয়ান পুরুষ নাগরিক ভোটাধিকার প্রাপ্ত হবে। তাদের ভোট প্রযোজ্য হবে নিম্নকক্ষের সদস্য নির্বাচনে।
- প্রতি ৫০০ ভোটার একজন ইলেক্টর নির্বাচিত করতে পারবে, যিনি উচ্চকক্ষের জন্য ভোট দেবেন।
- প্রতি ৬০,০০০ জনগণের জন্য দুইজন ডেপুটি থাকবেন, যারা সংসদে তাদের পক্ষে কথা বলবেন।
- ডেপুটি হবার ন্যূনতম বয়স হবে ত্রিশ।
- এই প্রস্তাবনা প্রুশিয়ার জন্য হলেও প্রয়োজনে একীভূত জার্মানির উপর প্রয়োগ করা যাবে।
রাজা ডায়েটকে জানালেন সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার, বিচার বিভাগ ইত্যাদি নিয়েও শীঘ্রই তিনি খসড়া আইন উপস্থাপন করবেন। ডায়েট রাজার বক্তব্য নীতিগতভাবে গ্রহণ করে নেয়। উচ্চকক্ষ প্রুশিয়ান ডায়েট, আর নিম্নকক্ষের নাম চেম্বার অফ ডেপুটিজ বলে স্বীকৃত হলো। সিদ্ধান্ত হলো প্রুশিয়ান পুরুষ যারা অন্তত ছয় মাস টানা একটি ঠিকানাতে থেকেছে এবং রাষ্ট্রের তরফ থেকে দরিদ্র ভাতা গ্রহণ করছে না তারাই হবে ভোটার। আইনসভার দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট হবে বলে সবাই সম্মত হয়। উচ্চকক্ষ সিনেট, যেখানে থাকবে রাজপুত্ররা, আর রাজার বাছাই করা ৬০ জন যাদের আসন হবে বংশানুক্রমিক। আরো ১৮০ জন নির্বাচিত হবেন আট বছরের জন্য, তবে তাদের বার্ষিক আয় অন্তত ২,৫০০ ডলার হতে হবে। নিম্নকক্ষের সদস্যদের মেয়াদ হবে চার বছর।
নির্বাচন
১৮৪৮ সালের মে মাসে প্রুশিয়াতে অনুষ্ঠিত হলো সাধারণ নির্বাচন। এর ফলে যে ডায়েট তৈরি হলো সেখানে ছিল লিবারেলদের সুস্পষ্ট প্রাধান্য। ডেপুটিদের ছয় ভাগের এক ভাগই ছিল খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে থেকে উঠে আসা যা ফ্রাঙ্কফুর্ট বা ভিয়েনার থেকেও বেশি। মাত্র ৭ শতাংশ সদস্যের ভূসম্পত্তি ছিল। ২২ মে থেকে শুরু হওয়া ডায়েটের আলোচনাতে রাজার ক্ষমতা হ্রাস, অভিজাতন্ত্র বিলোপ, এবং সেনাবাহিনীকে রাজার অধীন থেকে সরিয়ে বেসামরিক সরকারের অধীন করবার প্রস্তাব তোলা হলো। সামনে থেকে এতে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন লিবারেলরা।
একই সময় সমগ্র জার্মানিতে একটি প্রতিনিধিত্বশীল পার্লামেন্টের জন্য ভোট গ্রহণ হয় (জার্মান ফেডারেল নির্বাচন)। এর ফলে ৫৮৫ জন নির্বাচিত সদস্য নিয়ে প্রথমবারের মতো সৃষ্টি হয় ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি। এখানে জার্মান রাষ্ট্রগুলো ছাড়াও জার্মানিতে অস্ট্রিয়ান নিয়ন্ত্রণাধীন জার্মান অধ্যুষিত এলাকা থেকেও প্রতিনিধি ছিল।ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি ছিল লিবারেল এবং জাতীয়তাবাদীদের বিজয়। এর মধ্য দিয়ে তারা ফ্রাঙ্কফুর্টের রক্ষণশীল সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং অনির্বাচিত কনফেডারেট ডায়েটের প্রয়োজনীয়তা প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলে।
১৮ মে থেকে ফ্রাঙ্কফুর্টে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির প্রথম অধিবেশন বসল। এখানকার বেশিরভাগ সদস্যের চাওয়াই ছিল একীভূত জার্মানি। ২৮ জুন অ্যাসেম্বলি সমগ্র জার্মানির জন্য একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার তৈরি করবার প্রস্তাব রাখে যার রিজেন্ট হিসেবে অস্ট্রিয়ান আর্চডিউক জনের নাম পেশ করা হয়। ১৮৪৮ সালের ১২ জুলাই নেপোলিয়নিক ওয়ার্স শেষে ভিয়েনা কংগ্রেস অনুযায়ী গঠিত জার্মান কনফেডারেট ডায়েট নিজেই নিজেকে ভেঙে দেয়, ফলে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি’ই সর্বেসর্বা হয়ে ওঠে। এই সময় অস্ট্রিয়া নিজেও বিশাল ঝামেলার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল। যে বিপ্লবী শক্তি চ্যান্সেলর মেটেরনিখের পদচ্যুতির পেছনে ছিল তারা ভিয়েনাতে জাঁকিয়ে বসেছিল, তাদের সাথে রক্ষণশীল গোষ্ঠী আর সরকারী বাহিনীর সংঘাত ছিল নিয়মিত ঘটনা।
প্রুশিয়ার রাজা ও সংসদের বিরোধ
এদিকে প্রুশিয়ার অধীনস্থ এলাকাতে পোলিশ জাতীয়তাবাদের উত্থানে রাজা বিচলিত ছিলেন। ডায়েটে ক্যাম্পহাউজেন এর একটি সমাধান খুঁজে বের করতে চাইলেন। তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্নিম পোলিশদের সাথে সমঝোতার পক্ষপাতী হলেও রাজা ও তার উপদেষ্টাদের মত ছিল এতে রাশিয়ার মতো শক্তিশালী রাষ্ট্রকে খেপিয়ে তোলা হবে। তাদের কথাই রইল এবং পোসেনে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে সেনাদের পাঠানো হলো।
সেনাবাহিনীকে রাজার কাছ থেকে বেসামরিক একটি কাঠামোর অধীনে নিয়ে আসার প্রস্তাবও রাজা অপমান হিসেবে নিয়ে পদত্যাগের হুমকি দেন। ফলে মন্ত্রীপরিষদ পিছিয়ে যায়। ফলে শেষ পর্যন্ত যে সংবিধান দাঁড়ায় তাতে বলা ছিল রাজা সিংহাসনে বসবেন ঈশ্বরের ইচ্ছায়। যেখানে লিবারেলদের দাবি ছিল ঈশ্বরের ইচ্ছা বাদ দিতে হবে যাতে প্রতীয়মান হয় রাজা অভিষিক্ত হচ্ছেন জনগণের ইচ্ছাতে। সেনাবাহিনীর উপর রাজার একচ্ছত্র ক্ষমতা স্বীকৃত হয়, এবং সংবিধান রাজা ও তার জনগণের মধ্যে একটি চুক্তি হিসেবে উল্লেখিত থাকে, কিন্তু আদতে তা হওয়া উচিত ছিল জনপ্রতিনিধিদের কর্তৃক প্রণীত রাজার জন্য অবশ্যপালনীয় আইনবিধি।
জুন মাসে যখন এই সংবিধানের খসড়া প্রকাশ পেল তখন অনুমিতভাবেই বহু লিবারেল ক্ষোভে ফেটে পড়ে। তাদের মধ্যে বিভাজন সূচীত হয়। মধ্যপন্থী ও বামপন্থী লিবারেলরা অনেকটা মুখোমুখি অবস্থানে চলে যায়। মার্চের বিপ্লব নিয়ে তীব্র তর্কবিতর্ক চলে সংসদে। একদল চাচ্ছিল একে মহান করে দেখাতে, আরেকদলের দাবি ছিল একে অপরাধ বলে চিহ্নিত করা হোক। ডায়েটের অধিকাংশ ডেপুটি বিপ্লবকে কোনো আইনগত ভিত্তি দিতে রাজি ছিলেন না। রক্ষণশীল আর লিবারেল সংবাদপত্রও নিজেদের মধ্যে কলমের লড়াইয়ে মেতে উঠল।
এই অবস্থায় এটা পরিস্কার ছিল যে খসড়া সংবিধান ক্যাম্পহাউজেনের পক্ষে পাশ করিয়ে আনা সম্ভব না। তিনি জুনের ২০ তারিখ পদত্যাগ করেন। নতুন প্রধানমন্ত্রী হলেন আওয়ারসেড। পরবর্তী মাসে ওয়াল্ডেক নামে এক নামকরা গণতন্ত্রীর নেতৃত্বে সংবিধান প্রনয়ন কমিটি নতুন আরেকটি খসড়া প্রদান করে, যেখানে আরো অনেক বিতর্কিত বিধির সাথে রাজার আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সীমিত করে দেশজুড়ে মিলিশিয়া বাহিনী গঠনের সুপারিশ করা হয়। তুমুল হট্টগোলে সংসদে এই সংবিধানও ঝুলে যায়।
এদিকে ৩১ জুলাই সিলিসিয়াতে ছোট একটি সেনাদলের সাথে স্থানীয় জনতার বিক্ষোভ চলাকালীন সংঘর্ষে ১৪ জন মারা গেলে ব্রেস্লাউয়ের ডেপুটি ইউলিয়াস স্টেইন এক প্রস্তাব উত্থাপন করলেন। উদ্দেশ্য ছিল সেনাবাহিনী যাতে সংবিধানের চেতনা অনুযায়ী পরিচালিত হয় সে ব্যাপারে সরকারকে পদক্ষেপ প্রার্থনা। তার প্রস্তাব বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাশ হলো। প্রধানমন্ত্রী ঠিকই বুঝেছিলেন সেনাবাহিনীর ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করলে ফ্রেডেরিক বিগড়ে যাবেন। তিনি গড়িমসি করতে থাকলে ৭ সেপ্টেম্বর ডায়েট একটি ঘোষণা পাশ করে তাকে অবিলম্বে স্টেইনের প্রস্তাব কাজে পরিণত করতে বলে।
ফ্রেডেরিক তো আগুনের মতো গরম হয়ে গেলেন। রাজা আর সংসদ দুই পক্ষের মধ্যে পড়ে মন্ত্রীসভা পদত্যাগ করে। নতুন প্রধানমন্ত্রী হলেন জেনারেল ফুয়ে। ৩১ অক্টোবর ডায়েট প্রস্তাব পাশ করে বসে যে সকল প্রুশিয়ান এখন থেকে সমান, জন্মপরিচয় দিয়ে কেউ আলাদা সুবিধা পাবে না এবং অভিজাততন্ত্র বিলুপ্ত করা হবে। ফুয়ে চেষ্টা করলেও এবার রাজা আর ডায়েটের মধ্যে সমঝোতা করতে না পেরে নভেম্বরের ১ তারিখ পদত্যাগপত্র জমা দেন।
কঠোর হলেন ফ্রেডেরিক
রাজকীয় নিরীক্ষার কথা বলে পটসড্যামে ৫০,০০০ সেনা জড়ো করা হয়েছিল, তাদের নেতৃত্ব নিয়েছিলেন রাজার অনুগত জেনারেল ভন র্যাঙ্গেল। ২২ সেপ্টেম্বর নিরীক্ষার সমাপ্তির পরেও তারা সেখানে অবস্থান করছিল। ৩১ অক্টোবরের বিতর্কিত প্রস্তাবের পরদিন প্রধানমন্ত্রী ফুয়ে দায়িত্ব ছেড়ে দিলে রাজার চাচা কাউন্ট ব্র্যান্ডেনবার্গকে নতুন প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন ফ্রেডেরিক। তিনি ছিলেন চরমভাবে রক্ষণশীল ঘরানার, লিবারেলদের দু’চোখের বিষ। সংসদ ফ্রেডেরিকের কাছে তার নিয়োগের ব্যাপারে আপত্তি জানালে তিনি তা উড়িয়ে দিলেন। নভেম্বরের ৯ তারিখ উপস্থিত হয়ে ব্র্যান্ডেনবার্গ সংসদ মুলতবী করেন ২৭ তারিখ পর্যন্ত। তিনি জানালেন, রাজা আদেশ করেছেন শহরে উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী অধিবেশন বসবে ব্র্যান্ডেনবার্গে। তুমুল চেঁচামেচি শুরু হলো।
র্যাঙ্গেল তের হাজার সৈন্য নিয়ে বার্লিনে ঢুকে পড়লেন। তিনি রাতের মধ্যেই পুরো সংসদ এলাকা ঘিরে ফেলেন। পরের দিন সদস্যরা হাজির হলে তাদের চলে যেতে বলা হলো। বার্লিনের স্থানীয় মিলিশিয়া বাহিনী, বুরঘের (Burgher Guard) লিবারেলদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। তাদের উৎসাহে সদস্যরা নিকটবর্তী একটি হলঘরে জমায়েত হয়। ১১ নভেম্বর মার্শাল ল’ জারি করা হল। বার্লিনে মোট ৩০,০০০ সেনা সমাবেশ করা হয়। ফ্রেডেরিক বুরঘের বাহিনী ভেঙে দেন। তাদের নিরস্ত্র করা হয়।
সংসদ সদস্যরা হলঘরে অবস্থান ধর্মঘট করলে সৈন্যরা তাদের প্রধানকে চেয়ারসহ কাঁধে তুলে রাস্তায় নামিয়ে দেয়। এরপর কয়েকদিন লিবারেলরা মিলিত হতে চেষ্টা করে, কিন্তু প্রতিবারই সেনারা কোনো রক্তপাত ছাড়াই তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিচ্ছিল। ২৭ তারিখ ব্র্যান্ডেনবার্গে তারা সমবেত হতে চাইলে সেখানেও সৈনিকেরা তাড়া দেয়। ডিসেম্বরের ৫ তারিখ আনুষ্ঠানিকভাবে সংসদ ভেঙে দেয়া হয়, একই দিনে সরকারের তরফ থেকে নতুন সংবিধানের ঘোষণা আসে।
বার্লিন নিয়ন্ত্রিত হলেও রাইনল্যান্ডের প্রুশিয়ান অংশে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। সেনারা সংসদ করতে বাধা দিলে লিবারেলরা কর না দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল, এখানে তা অক্ষরে অক্ষরে পালিত হয়। আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি হলে সেনারা এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
১৮৪৯ সালের জুলাই পর্যন্ত প্রুশিয়াসহ জার্মান রাষ্ট্রগুলোতে কিছু উগ্রপন্থি নতুন করে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করে। ব্যাডেনে তাদের প্রভাব এত বৃদ্ধি পায় যে তারা সেনাবাহিনীকে অকার্যকর করে দেয়। প্রুশিয়া, ভুর্তেমবার্গ, নাসাউ আর হেসের যৌথ বাহিনী তাদের দমন করে। ড্রেসডেনের বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণেও যৌথ বাহিনী যুক্ত হয়। এই সময় বিদ্রোহীদের বাহিনী ছিল সংখ্যায় প্রায় ৪৫,০০০। সুতরাং প্রচুর রক্ত ঝরল।
২৩ জুলাই, ১৮৪৯ সালে রাস্টাট দুর্গের লড়াইতে জার্মান যৌথ বাহিনী ব্যাডেনের বিদ্রোহীদের নেতৃত্বাধীন দলকে পরাজিত করে। প্রুশিয়ার নেতৃত্বে বিদ্রোহীদের প্রধানদের বিচার শুরু হলো। ৫৪ জন বেসামরিক নাগরিক এবং ৫১ জন সেনা অফিসার আদালতে দাঁড়ান। ৩১ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো, যার সাতাশটি কার্যকর করা হয়। প্রুশিয়ান সৈন্যরাই এই দণ্ড কার্যকর করে।